#ইচ্ছের_উল্টোপিঠ
#পর্ব_১১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
সময়ের কাটা ছয়টা ছুঁই ছুঁই। সন্ধ্যার প্রহর আঁকড়ে ধরেছে ওই বিশাল আকাশটাকে। আবছা নীল আকাশটা নিংড়ে বেরিয়ে আসছে ঝুড়ি ঝুড়ি বৃষ্টির ফোঁটা। মাটিতে সেই ফোঁটা গুলো ঝরে পড়তেই অদ্ভুত সুরে বেজে উঠছে , ” টিপটপ” “টিপটপ “। ঐশীর সূক্ষ্ম মস্তিষ্ক এই দৃশ্য দেখে ভাবছে ” প্রকৃতি এত সুন্দর কেনো ? এই যে এসব দেখে ঐশীর মনের কালো মেঘ গুলো সরে সেখানে জায়গা করে নিল রঙিন প্রজাপতি। একটা , দুটো অতঃপর অসংখ্য। আফসোস ! ঐশী কেনো ওই নীলাভ প্রকৃতি হলো না। তাহলে সেও হতো তার মতো আমরণ অমায়িক।
দীর্ঘক্ষণ জ্যামে আটকা আছে ওরা। ঐশীর ধ্যান ভাঙলো জানালার পাশ থেকে ভেসে আসা এক ভিক্ষুকের কণ্ঠ শুনে। একজন অর্ধ অন্ধ বৃদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে আছেন জানালার পাশে। তার হাতে একটা দড়ি। সেই দড়ি বেঁধে রেখেছে একটা ভাঙ্গা চেয়ারের টুকরো। সেই ভাঙ্গা চেয়ারে বসে আছেন একজন বৃদ্ধ পাগল মহিলা। ঐশী উনাদের দেখে ভারি অবাক হলো। ভিজে জানালা খুলে দিয়ে ওদের দিকে এক দফা বিস্ময় নিয়ে তাকালো। বৃদ্ধ লোক বললেন,
” মা , একটা পয়সা দিবেন। হেতির ঔষধ কিনতে অইবো। দেন না , মা। আল্লাহ আপনারে রাজরানী করে রাখবো। দেন একটা পয়সা। ”
ঐশীর চোখ ভরে উঠলো বৃদ্ধ লোকের মুখে মা ডাক শুনে। মনে পড়লো বাবা – মায়ের সাথে কাটানো শত – সহস্র স্মৃতির কথা। ও বৃদ্ধ মহিলার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
” ইনি আপনার কে হয় , দাদু ? ”
বৃদ্ধ লোক ফোকলা দাঁতে হাসলো। সেই হাসিতে ঝিলিক দিল একজন তরুণ প্রেমিক পুরুষ। ঐশী তাকালো। খুব অবাক চোখে চেয়ে রইলো সেই হাসির দিকে। লোকটা বললো,
” হেতি আমার বউ হয়রে মা। আমার ফাছ(পাঁচ) টা চাবাল(সন্তান) হইসিলো। হেতে সব মইরা গেছে। হের লাইগা হেতিরে ফাগলা(পাগল) রোগে ধরছে। ”
ঐশী মুগ্ধতা নিয়ে তাকালো মহিলার দিকে। জুভান এরমধ্যে এসে উকি দিল ঐশীর দিকের জানালায়। বললো,
” তাহলে আপনি উনাকে ছেড়ে দেন। উনাকে ক্যারি আই মিন বহন করে আপনার লাভ কি ? কষ্ট হয়না ? ”
ঐশী খানিক চকিতে তাকালো জুভানের দিকে। পাগল হয়েছে ? বলে কী এই ছেলে ? বৃদ্ধ লোকটা আবারও ফোকলা দাঁতে হাসেন। খানিক দুঃখ গলায় বললো,
” কি যে কন ? আমি ওরে কেন ছাইড়া দিমু। আইজ যদি আমি বেমার (অসুস্থ) হইতাম। তাহলে ঐ কি আমারে ছাইড়া দিবার পারতো ? বড্ড ভালাপাই(ভালোবাসি) ওরে আমি। ছারমু কেন ? ”
জুভান বিরক্ত হলো এই আবেগ পূর্ণ কথায়। কোনো প্রত্যুত্তর না করে আবারও সিটে গা এলিয়ে দিল। প্রহর গুনলো ঢাকার এই বিরক্তিকর জ্যাম ছাড়ার।
ঐশী মুগ্ধ হয়ে সাইড ব্যাগ থেকে একটা একশো টাকার নোট বের করে বৃদ্ধ লোকটার হাতে দিল। লোকটা নোটটার দিকে চেয়ে রইল খানিক। দু চোখ ভরা কৃতজ্ঞতা তার। অতঃপর বিড়বিড় করে কি যেন পরে ঐশীর মুখে ফু দিয়ে বললো,
” আল্লাহ তোমার মঙ্গল করুক ,মা। স্বামী সোহাগী হও , মা। রাজরানী হইয়া থাহো সারা জীবন। ”
ঐশী মাথা নুইয়ে হাসলো। সেই হাসি প্রতিধ্বনিত হলো বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটায় ফোঁটায়। এক সমুদ্র খুশি ছড়ালো ওই কালো মেঘের আকাশে।
গাড়ি চলছে আপন পথে। ব্যস্ত শহর ছুটে যাচ্ছে নিজ নিজ গতিতে। ঐশী জানালার দিকে তাকিয়ে ছাড়ছে রাশি রাশি অপ্রাপ্তির নিঃশ্বাস। জুভান গাড়ি চালাতে চালাতে আরো একবার তাকালো ঐশীর দিকে। আচমকা জুভান বললো,
” দাদুটা কি বোকা, না ? এখনো এসব লাভ নিয়ে পড়ে আছে। কি ক্রিঞ্জ ব্যাপার স্যাপার। ! ”
ঐশী ফিরলো জুভানের দিকে। চোখে মুখে উদ্বেগ নিয়ে বললো,
” লাভ ক্রিঞ্জ ! ”
” হ্যাঁ। তাইতো। শুনো , এসব লাভ সাভ হলো জাস্ট লেম। এসব আবার ভাবার কিছু ? এসব জাস্ট রিডিকিউলাস। ”
ঐশী থমকালো। জুভানের আত্মবিশ্বাসী নয়ন দুটোয় তাকিয়ে অবাক হলো। আবার তাকালো রাস্তার দিকে। দূর দৃষ্টি দিল ঐ পিচ ঢালা রাস্তায়। আবেগ গলায় বললো,
” না। লাভ ক্রিঞ্জ না। লাভ যদি ক্রিঞ্জ হয় তাহলে সত্য নামক জিনিসটাও তাহলে সেই কাতারেই পড়ে। লাভ ইজ লাইক এ ম্যাজিক। যাকে একবার ছুঁয়ে দেয় তার সম্পূর্ণ জীবনটাই ম্যাজিক হয়ে যায়। স্তব্ধ জীবন হঠাৎ করেই প্রাণবন্ত হয়ে যায়। চারপাশটা রঙিন ফানুসের মত হয় তখন। সবকিছু , এভরি সিঙ্গেল থিং তখন জীবন্ত মনে হয়। লাভ ইজ লাইক এ ম্যাজিক। ”
জুভান হাসলো। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
” এত সুন্দর লাভের ডেফিনেশন দিলে যে ? কাউকে ভালোবাসো ? ”
ঐশীর মুখ ভার হলো। দুঃখ পেলো। সেদিনের কথা মনে পড়তেই কষ্টের ফোঁটা ছড়িয়ে পড়লো মনের আনাচে কানাচে। ঐশী নিঃশব্দে এক হাফ ছেড়ে দিয়ে বললো,
” হবে হয়তো। কিন্তু আমি একটাই দোয়া করব এরকম প্রেম যেনো কারো জীবনে না আসে। কারো জীবনে না। ”
জুভান ঐশীর দিকে তাকালো। মেয়েটার এত কিসের দুঃখ ? ছোট জীবনে যে এত দুঃখ পেতে নেই। জীবনটা প্রাণোচ্ছল ভাবে পার করা আবশ্যক। জুভান এসব ভেবে আবারও গাড়ি চালানোয় মন দিল।
” সো ।মোদ্দা কথায় আসা যাক। আমি যা শাস্তি দিবো মেনে নিবে তো ? ”
জুভানের রহস্যভরা কণ্ঠ শুনে ঐশী তাকালো। বিচলিত নয়নে চেয়ে রইল জুভানের চোখ জোড়ায়। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
” শুনার পর ভেবে দেখবো। ”
জুভান একটা গাড়ি ওভারটেক করে বললো
” নিজের টাকায় আমাকে খাওয়াবে আজ। তোমার যা মন চায় তাই খাওয়াতে পারো। এভরিথিং, এনিথিং । দাম নিয়ে কোনো ঝামেলা নেই। তো বলো। রাজি ? ”
ঐশী মৃদু হাসলো। অতঃপর মাথা ডানে বামে নাড়িয়ে সম্মতি দিল।
______________________
গাড়ি থামলো একটা টঙের দোকানের সামনে। জুভান ভ্রু কুঁচকে তাকালো ঐশীর দিকে। ঐশী সেই চাহনির বদলে একটা আলতো হাসি দিল। জুভান গাড়ির ইঞ্জিন থামিয়ে বললো,
“আর ইউ সিরিয়াস ? টঙের দোকান ! ”
ঐশী গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। বাইরে দাঁড়িয়ে গাড়ির জানালার হাত দিয়ে জুভানের দিকে তাকালো। বললো,
” এতজীবন তো নামিদামি রেস্টুরেন্টে খেয়ে এলেন। এবার এই ম্যাজিক দোকানের ম্যাজিক চা খেয়ে দেখেন। ট্রাস্ট মি , মুখে লেগে থাকবে। খাবেন ? ”
জুভান একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দিয়ে মাস্ক পরে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। ঐশী দোকানের সামনে দাড়িয়ে দু কাপ চা দিতে বলে সামনে এসে দাড়ালো। দু হাত দুদিকে ছড়িয়ে দিয়ে শীতল বাতাসের সাথে মিশে যেতে চাইলো। ভিজে মাটির গন্ধ ছড়িয়েছে বাতাসে। ঐশী মুখ ভরে শ্বাস নিল সেই মাটির। জুভান এক পাশে দাঁড়িয়ে আনচান করছে। এই পাবলিক প্লেসে একবার যদি ওর চেহারা লিক হয়ে যায় তাহলে ওর আর রক্ষে নেই। ঐশী জুভানের দিকে একনজর তাকিয়ে দৌঁড়ে এলো জুভানের কাছে। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
” আরে। আপনি এখানে ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন কেনো ? সামনে আসুন। এই বাতাস দেখুন। জাস্ট ফিদা হয়ে যাবেন আপনি। আসুন না। ”
প্রকৃতির নেশায় মশগুল ঐশী আনমনে জুভানের হাত ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো। জুভান অবাক চোখে তাকিয়ে আছে ঐশীর হাতের মুঠোয় থাকা নিজের হাতের দিকে। “প্রথম স্পর্শ ! ” যেতে যেতে ঐশী থমকে গেলো। অবাক চোখে নিজের হাতের দিকে তাকালো। আসল ব্যাপারটা মাথায় প্রবেশ করতেই ঝটপট নিজের হাত ছাড়িয়ে নিল জুভানের থেকে। ছি ! কি করেছে ও ? রাগ উঠলো। হঠাৎ করেই মনে হলো , সে চরম অসম্মানের কাজ করেছে। এভাবে একটা ছেলের হাত ধরা তার উচিৎ হয়নি। একদম না। ঐশী নিজের হাত কচলাতে লাগলো। হাসফাস করতে লাগলো এক অজানা শঙ্কায়। জুভান ঐশীকে কাচুমাচু করতে দেখে মৃদু হাসলো। নিজের প্রশস্ত বুকে দু হাত গুটিয়ে বললো,
” বি নরমাল। আমি কিছু মনে করি নি। ”
#চলবে
দয়া করে ছোট বলবেন না। আমি ব্যস্ততার মধ্যে রেগুলার দেওয়ার চেষ্টা করছি। স্বাভাবিক পর্ব এটা। আর আজকের পর্ব কেমন হয়েছে জানাতে ভুলবেন না। হ্যাপি রিডিং