উত্তরণ পর্ব-১২

0
832

#উত্তরণ
পর্ব_১২

হিয়া উজানের আবাসন থেকে বেড়িয়ে এসে ক্যাব বুক করে. ওর পরবর্তী গন্তব্য ডক্টর নীলিমা কাশ্যপ.

হিয়ার বলে যাওয়া প্রত্যেকটা কথার পুংখানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে থাকে উজান. হিয়ার কথা শুনে মনে হয় ও সত্যি কথা বলছে, ও জানেনা ক্যাপ্টেন কাশ্যপের মৃত্যুর আসল কারণটা কি. তাছাড়া উজানও যেটুকু জেনেছে তাতে ও এখনো পর্যন্ত হিয়ার ব্যাপারে নেতিবাচক কোনো তথ্য পায়নি. কিন্তু উজান ওর অভিজ্ঞতা থেকে জানে সত্যির অস্তিত্ত্ব অনেক গভীরে থাকে যাকে সহজে ছুঁতে পারা যায়না. হিয়া যদি সত্যি কিছু না জানে তাহলে চিফ হিয়াকে নির্দেশ করবে কেন? এখনো পর্যন্ত চিফ ওকে কোনোদিন ভুল পথে চালনা করেনি. তাহলে কি হিয়া অজান্তেই জড়িয়ে এই ব্যপারটাই শুধুমাত্র ক্যাপ্টেন কাশ্যপের সাথে ভালো সম্পর্ক থাকায়? যাইহোক পুরো ব্যপারটা ভালো করে বুঝতে হবে ওকে. তবে একটা ব্যাপার কিছুটা হলেও উজানকে স্বস্তি দেয়, সেটা হলো ক্যাপ্টেন কাশ্যপ আর হিয়ার সম্পর্কের সত্যতা. উজান দ্রুত ভেবে নেয় তারপর ঝড়ের বেগে তৈরী হয়ে বেড়িয়ে পরে, লক্ষ্য হিয়া.

ঝাঁ চকচকে অত্যাধুনিক আবাসনের সামনে এসে নামে হিয়া. ফর্মালিটি শেষ করে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে পৌঁছে হিয়া ডোরবেল বাজায়. দরজার ওপারে ডক্টর নীলিমা কাশ্যপ হেসে হিয়াকে অভর্থনা জানায়. দুজনে ড্রয়িং এ এসে বসলে নীলিমাই কথা শুরু করে.

নীলিমা: কি হয়েছে বলোতো? তোমাকে এতো চিন্তিত কেন লাগছে?

হিয়া ভনিতা না করেই বলে: আমার আপনাকে কিছু বলার আছে.

নীলিমা: হার্দিকের ব্যাপারে?
হিয়া: হুম
নীলিমা: জানি. লালবাজার থেকে কল করেছিল. বলেছে ওটা দুর্ঘটনা ছিলোনা. ইট ওয়াজ আ প্রি-প্লানড মার্ডার.

হিয়া অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে নীলিমার দিকে. নীলিমা কত সহজ ভাবে কথা গুলো বললো. হিয়া এখনো বুঝতে পারছেনা নীলিমা এতো স্বাভাবিক কি করে? নীলিমা হিয়ার চোখের ভাষা পড়তে পারে.

নীলিমা: ভাবছো হার্দিকের মৃত্যুর সত্যিটা জেনেও আমি এতো স্বাভাবিক কিভাবে?
হিয়া:۔۔۔۔۔
নীলিমা: কারণ আমি আরো একটা সত্যি জানি যেটা তুমি জানোনা.

হিয়া এবার যে সত্যির মুখোমুখি হলো সেটার জন্য ও একেবারেই প্রস্তুত ছিলোনা.

নীলিমা: হার্দিক শুধু পাইলট ছিলোনা হিয়া, ও আসলে একজন আন্ডারকপ ছিল. দেশের সুরক্ষায় ও নিবেদিত ছিল. ওর এই পরিণতির জন্য আমরা দুজনেই তৈরী ছিলাম. খুব ভালোবাসতাম একে অপরকে. এটা অবশ্য হার্দিক আমাকে আগে জানায়নি. অনেক পরে জেনেছিলাম যখন একবার ও এইরকমই এক পরিস্থিতিতে পড়েছিল আর ভেবেছিলো হয়তো আর বেঁচে ফিরবেনা. আমাকে নিয়ে খুব ভয় পেতো, যাতে ওর কিছু হলে আমি নিরাপদ থাকি তার জন্য ও আমাকে জানিয়েছিল (নীলিমার মুখ যন্ত্রনা ক্লিষ্ট হয়ে ওঠে).

হিয়া নির্বাক. ওর চোখের সামনে থেকে একটা পর্দা ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে. হিয়ার কাছে স্পষ্ট হচ্ছে ওর উপর আক্রমণের কারনগুলো.

হিয়া: তাহলে তো আপনার সামনে ভীষণ বিপদ নীলিমা দি.

নীলিমা: হুম۔۔۔ জানি. কিন্তু হিয়া বিপদ তো তোমারও হিয়া.

হিয়া: আপনি কি ভাবে জানলেন? (হিয়ার আজ অবাক হবার দিন)

নীলিমা: (হেসে) তুমি বিপদে না পড়লে আমার কাছে এভাবে ছুটে আসতে না. তাছাড়া আমি ডক্টর, তোমার চেহারা দেখে বলে দিতে পারি গত কয়েক মাস তুমি ঘুমোয়নি. নিজেকে শেষ কবে আয়নায় দেখেছো বলতো? কি ছিলে আর কি হয়েছো.

হিয়া নীলিমাকে ওর উপর হওয়া আক্রমণ গুলোর কথা বলে. নীলিমা রীতিমতো আঁতকে ওঠে.

নীলিমা: হিয়া হার্দিক কি তোমাকে কিছু বলেছিলো বা কিছু রাখতে দিয়েছিলো?
হিয়া: না তো
নীলিমা: খুব ভালো করে ভেবে দেখো, নাহলে তোমার উপর আক্রমণ কেন হবে? কিছু একটা আছে, যেটার হদিস তুমি পাও বা তোমার থেকে অন্য কেউ পাক সেটা ওরা চায়না. তোমাকে খুব সাবধানে থাকতে হবে.

হিয়া: আমি সত্যি সেরকম কিছু জানিনা. আমার কাছে কিচ্ছু নেই. আপনার কাছে কিছু নেই তো?

নীলিমা: না গো۔۔۔আমাকে কিছুই দিয়ে যায়নি۔۔ এক হতে পারে হার্দিক স্বার্থপরের মতো আমাকে বাঁচিয়ে তোমাকে বিপদে ফেলে গেছে অথবা তোমাকে বেশি যোগ্য মনে হয়েছে. দুটোর যে কোনো একটা হতে পারে (ম্লান হাসে নীলিমা).

হিয়া: আমি ক্যাপ্টেন কাশ্যপ কে নিজের দাদা হিসেবে মেনেছি এবং সেটা লোক দেখানো নয়. উনিও আমায় বড্ডো স্নেহ করতেন. ক্যাপ্টেন কে পেয়ে মনে হয়েছিল বাবা কে হারানোর দুঃখ কিছুটা কমেছিলো. তাই আপনার প্রথম কারণটা কিছুতেই মানতে পারলামনা. আর দ্বিতীয়টা জানিনা কারণ আমি সত্যি কোনো কিছুই জানিনা. যাইহোক আপনি তো এবার ডিউটি তে বেরোবেন, আপনার আর সময় নষ্ট করবোনা. আমি আসি.

নীলিমা: হিয়া নিজের খেয়াল রেখো আর আমাদের মধ্যে যা কথা হলো সেটা নিজের কাছেই সীমাবদ্ধ রেখো, এমনকি পুলিশকেও কিছু জানিও না. কারন তুমি জানোনা আমাদের বিপরীতে যারা আছে তাদের ক্ষমতা কতটা.

হিয়া হেসে সম্মতি জানায় তারপর যেতে গিয়েও ফিরে আসে নীলিমার কাছে.

হিয়া: আচ্ছা নীলিমা দি আপনি কি ক্যাপ্টেন এর কোনো ভাই কে চেনেন?

নীলিমা অবাক দৃষ্টিতে তাকায়: ভাই? হার্দিকের কোনো ভাই বোন নেই হিয়া.

হিয়া: নিজের ভাই নেই সেটা জানি, কিন্তু কাউকে কি উনি ভাই বলে ডাকতেন? সম্ভবত ওনার ট্রেনিং এর সময় থেকে. সঠিক ভাবে জানিনা.

নীলিমা: (একটু ভেবে) আমি একবার একটা কথা শুনেছিলাম. একবার হার্দিক গল্প করতে করতে বলেছিলো ও যেদিন রিটায়ার করবে ও আর ওর ভাই মিলে একটা ট্রাভেল এজেন্সি খুলবে আর দিন রাত বেরিয়ে বেড়াবে. আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম “ভাই” টা কে? হার্দিক বলেছিলো সময় এলে আলাপ করাবে. এর পর আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করিনি,ভুলেও গিয়েছিলাম. তোমার কথায় মনে পড়লো. কিন্তু তুমি কিভাবে জানলে?

হিয়া: যেদিন ক্যাপ্টেনের এক্সিডেন্ট হয় সেদিন সকালে আমরা একসাথে ফ্লাই করেছিলাম. ফ্লাইটে কথা হচ্ছিলো 26th জানুয়ারী লালকেল্লায় এয়ারফোর্সের দুর্দান্ত পারফর্মেন্স নিয়ে. কথা প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন বললেন ওনার ভাই ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট. আমি স্বভাবতই খুব অবাক হই কারণ ওনার কোনো ভাই নেই বলেই জানি. উনি বললেন ওনারা এক মায়ের সন্তান, তারপর হেসে বলেন মা কি শুধু জন্মদাত্রীই হয়? গোটা পৃথিবী একদিকে আর আমার ভাই একদিকে, আমরা একে অপরের জন্য সব করতে পারি. যেমন জীবন দিতে পারি, তেমনই জীবন নিতেও পারি.
যদিও আমার খুবই অদ্ভুত লেগেছিলো এই কথা শুনে. আমি জিজ্ঞাসা করি তিনি কোথায়? উনি বললেন চিন্তা করোনা, আমার কিছু হলে ও নিজেই তোমায় খুঁজে নেবে. কিন্তু তখন আর কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়ে ওঠেনি কারণ একজন ক্রু মেম্বার ককপিটে চলে আসে. পরে আর সুযোগ হলোনা.

নীলিমা: হঠাৎ তুমি হার্দিকের এই ভাই কে কেন খুঁজছো?

হিয়া: জানিনা নীলিমা দি, তবে মনে হচ্ছে এই ভাই কে ক্যাপ্টেনের কথাটা জানানো উচিৎ. যদিও সে হয়তো ইতিমধ্যে জেনে গেছে.

নীলিমা: কিন্তু তাকে তো আমরা কেউ চিনিনা.

হিয়া: এটাই তো সমস্যা. তাই তো আপনাকে জিজ্ঞাসা করলাম যদি আপনি জেনে থাকেন, কিন্তু আপনারও তো একই অবস্থা. যাইহোক এখন আসি. আপনি সাবধানে থাকবেন.

হিয়া নীলিমার আবাসন থেকে বেড়িয়ে আসে. এবার ও মি: সংকল্প সেনের সাথে দেখা করবে. এমন সময় ওর ফোন টা বেজে ওঠে, দেখে মি:সেন ফোন করেছেন. উনি হিয়ার কাছে ক্ষমা চান আজকের এপয়েন্টমেন্ট ক্যানসেল করার জন্য. একটা জরুরি মিটিং এ যেতে হচ্ছে.

উনি আরো জানান যে হিয়ার গাড়ি পরীক্ষা করার জন্য টীম পাঠিয়েছিলেন এয়ারপোর্ট পার্কিং এ যেখানে কাল হিয়া গাড়িটা রেখে আসে. জানা যায় হিয়ার গাড়ির ফুয়েল ট্যাঙ্কেও একই কেমিকাল পাওয়া গেছে যেটা ক্যাপ্টেন হার্দিকের গাড়ির ফরেনসিক টেস্ট এ পাওয়া গিয়েছিলো. উনি হিয়াকে একা চলা ফেরা করতে বারন করেন, হিয়ার চারপাশে বিপদ ওঁৎ পেতে আছে.

ফোন রাখার পর হিয়ার মনে হয় ওর পা দুটো অবশ হয়ে গেছে, আর চলতে পারছেনা. এই ভাবে ভয় পেয়ে তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবে ও? শরীরের সমস্ত শক্তি একজোট করে সামনের মোর পর্যন্ত পৌঁছনোর চেষ্টা করে হিয়া, কিন্তু পারেনা. শারীরিক ও মানসিক ক্লান্তি ওকে ধরাশায়ী করে ফেলে. জ্ঞান হারায় হিয়া. পড়ে যাবার আগেই ও স্থান পায় কোনো এক নিরাপদ আশ্রয়ে.

দেখা যাক হিয়া এমন কি জানে যে মৃত্যু ওকে তাড়া করে করছে–আর উজানই বা কেন এত কৌতুহলী হিয়ার ব্যাপারে–!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here