#উত্তরণ
পর্ব_১৯
হিয়া কে ওর আবাসনের গেটে নামিয়ে দেয় উজান. হিয়া যতক্ষণ না ভেতরে অদৃশ্য হচ্ছে ততক্ষন অপেক্ষা করে তারপর গাড়ী ঘুরিয়ে নেয়.
ফ্ল্যাটে পৌঁছে উজান দেখে টেবিলে খাবার গুলো রাখা. এখনো রাগ কমেনি উজানের.
উজান: কোনো জিনিসের গুরুত্ব নেই ওনার কাছে, অদ্ভুত. (দুহাত কোমরে দিয়ে) আচ্ছা এই উদ্দীপ্ত টা কে? একে তো দেখিনি. আর কি যেন বলছিলো ঠাম্মি? মিস মিত্রকে চোখে হারায় নাকি? (সোফাতে বসে পড়ে) আমার রাগ হচ্ছে কেন? চোখে হারায় না কি করে তাতে আমার কি? (সোফা থেকে উঠে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে থাকে) আর মিস মিত্রর অত হাসিই বা পাচ্ছিলো কেন উদ্দীপ্তর নাম শুনে? উদ্দীপ্ত কি তবে ওনার কোনো বিশেষ বন্ধু? হলে হবে, আমার তাতে কি? আমি আমার কাজ করতে এসেছি, কে কার বন্ধু সেটা জেনে আমার কি দরকার? (রকিং চেয়ারে বসে বোতল থেকে ঠান্ডা জল গলায় ঢালে) কিন্তু মিস মিত্রর কোনো বন্ধুর কথা তো কেও বলেনি, সোনাল জানলে তো বলতো. তাছাড়া ওনার হাবভাবেও মনে হয়না উনি কোনো সম্পর্কে জড়িত. নাহ আমি একটু বেশিই ভাবছি. ওনাকে কেউ চোখে হারালেই যে উনিও তাকে চোখে হারাবেনই۔۔۔۔۔۔সেটার তো কোনো মানে নেই.
ভাবতে ভাবতে ধীরে ধীরে উজানের মাথা ঠান্ডা হয়ে আসে. খাবার গুলো গুছিয়ে ফ্রিজে রেখে দেয়.
তারপর ফ্রেশ হয়ে এসে একটা ম্যাগাজিন খুঁজতে অন্য রুমে যায়. এই রুমে আজ হিয়া ছিল. রুমে অন্যরকম একটা গন্ধ ছড়িয়ে আছে. কোনো আরাবিয়ান পারফিউমের গন্ধ, যেটা আগেও উজান পেয়েছে হিয়ার থেকে. হিয়া এই নির্দিষ্ট সুগন্ধিটাই ব্যবহার করে. খুব মিষ্টি লাগে গন্ধটা উজানের. মনের সমস্ত ক্লান্তি যেন দূর হয়ে যায় মুহূর্তে. উজান বুক ভোরে শ্বাস নেয়. উজান ঘরের বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বালিশ টা টেনে নেয় কাছে. বালিশ বিছানা সর্বত্র হিয়ার গন্ধ۔۔
উজান গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়ে. ওর হচ্ছে টা কি? এই রেগে যাচ্ছে তো এই আবেগপ্রবন হয়ে উঠছে. নিজেকেই কেমন অচেনা লাগতে থাকে. এই পরিস্থিতি থেকে ওকে বেরিয়ে আসতেই হবে নাহলে ও ওর কাজে মনোসংযোগ করতে পারবেনা. নিজের ঘরে ফিরে মেডিটেশনে বসে উজান, এমন সময় চিফের মেসেজ۔۔۔
হিয়া বাড়ি ফিরে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুছিয়ে নেয়. তারপর সোনাল কে ফোন করতে গিয়ে দেখে এক বিপত্তি, ফোন কাজ করছেনা.
ওর মন টা খারাপ হয়ে যায়. ফোন টা ওর আগের বছর জন্মদিনে ক্যাপ্টেন কাশ্যপ গিফ্ট দিয়েছিলেন. এই তো ছ’মাস আগে দেওয়া জিনিস, খারাপ হয়ে গেলো? সেবারও ওর ফোন টা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো. সেটা দেখেই ক্যাপ্টেন কাশ্যপ হিয়া কে এই ফোন টা উপহার দেন সেই দিন, যদিও জন্মদিন টা দুদিন পরে ছিল.
চোখটা ভিজে যায় হিয়ার, খুব মিস করছে ও ক্যাপ্টেন কাশ্যপ কে. উনি আন্ডারকপ জানার পর হিয়ার ওনার প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আরো বহুগুনে বেড়ে গেছে. হিয়াকে জানতেই হবে ওরা কারা, কিন্তু ও পারবে কি?
মন খারাপের সাথে সাথে বিরক্তও হয় হিয়া. কাল ভোরে ওর ফ্লাইট আর এখনই একটা ফোন কিনতে হবে ওকে. কিছুটা ভয়ও পায় হিয়া বাইরে বেড়োতে. তারপর সুষমা দি কে বলে ফোন কিনতে বেরিয়ে যায়.
একটু দূরেই একটা বড় শপিং মলে ঢোকে হিয়া. আর যাই হোক এখানে ওকে গাড়ি চাপা পড়তে হবেনা. নিজের পছন্দ মত ফোন কিনে হিয়া শপিং মলের গ্রাউন্ড ফ্লোরে আসে. এখানটায় বেশ ভিড়. হিয়া ভিড় ঠেলে এক্সিটের দিকে এগিয়ে যায়. হঠাৎই হিয়ার হাতে হেঁচকা টান পড়ে. হিয়া টাল মাটাল অবস্থাই আছড়ে পড়ে. আকস্মিক ঘটনায় হিয়া হতবম্ব. নিজেকে সামলে কোনোক্রমে সামনে তাকিয়ে দেখে ওর সামনে সেই এক এবং অদ্বিতীয়, বদরাগী, বদমেজাজী ক্যাপ্টেন উজান চ্যাটার্জী۔۔۔
উজান হিয়াকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে এসে সোজা গাড়িতে বসে. বেশ কিছুটা দূরে এসে গাড়ি থামায় উজান. গাড়ি থেকে নিজে নেমে এসে হিয়াকেও টেনে নামায় গাড়ি থেকে. রাগ, ভয়, দুশ্চিন্তা মিলিয়ে উজানের চেহারাটা ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করেছে.
এখনো হিয়া ওর পরিস্থিতিটা সঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনি. মাথার মধ্যে অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরছে. উজান এখানে কি করছে? ওকে এভাবে হাত ধরে টানলই বা কেন? উজানকে এতো অস্থির দেখাচ্ছে কেন? এই কয়েকদিনে হিয়া উজানকে যেটুকু চিনেছে তাতে ও নিশ্চিত এর পেছনে কোনো কারন আছে. কিন্তু সেটা কি?
উজান হিয়াকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে, তারপর হিয়াকে এভাবে চুপ করে থাকতে দেখে কিছুটা শান্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করে۔۔
উজান: আপনি ঠিক আছেন?
হিয়ার ঘোর কাটে. নিচু গলায় বলে: আগে তো ছিলাম, কিন্তু আপনি যেভাবে হাত ধরে টানলেন তাতে হাতে ফ্র্যাকচার হয়েছে কিনা বলতে পারবোনা. বেশ ব্যথা.
উজান রেগে বলে: হাত ফ্র্যাকচার হলে কাল ফ্লাই করতে পারবেন না. এর বেশি কিছু ক্ষতি হবেনা. কিন্তু প্রাণটা গেলে সব যেতো মিস মিত্র.
হিয়া সন্দেহের চোখে তাকায় উজানের দিকে۔۔۔ কি বলতে চাইছে উজান? শপিং মলের মধ্যেও হিয়াকে প্রাণে মারার চেষ্টা করেছে? উনি কিভাবে বুঝলেন?
হিয়া: কি বলতে চাইছেন স্যার?
উজান এবার হিয়ার জামার নিচের দিকে ইশারা করে. উজান কে অনুসরণ করে হিয়া দেখে ওর পেটের কাছে কুর্তিটা বেশ কিছুটা কাটা. কোনো ধারালো কিছু যেন কুর্তি বরাবর চালানো হয়েছে আর সেটা কি বুঝতে বাকি থাকেনা ওর. যদিও হিয়ার এতোটুকু আঘাত লাগেনি.
হিয়া আতঙ্কে নীল হয়ে যায়, ও কাঁপতে থাকে. হিয়ার অবস্থা দেখে উজানের খারাপ লাগে, সাথে ভয়ও. ওর অশান্ত মনে খালি একটা কথাই ঘুরপাক খেতে থাকে, হিয়াকে ও কিছুতেই হারাতে পারবেনা, কোনো মূল্যেই না.
উজানের দুশ্চিন্তা রাগ হয়ে ঝরে পড়ে: আজ সারাদিন টো টো করে ঘুরে বেড়ানোর পরও আবার বেরোতে হলো? কি হতো আমি না থাকলে?
হিয়া আর পারেনা. উজানের কথা ওর কান পর্যন্ত পৌঁছায় না. ওর সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসে. পড়ে যেতে গিয়েও উজানকেই অবলম্বন হিসেবে আঁকড়ে ধরে. উজানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে সশব্দে কেঁদে ওঠে হিয়া. আজ উজানকেই ওর সব থেকে কাছের, সবচেয়ে নিরাপদ বলে মনে হয়–
উজান এর জন্য তৈরী ছিলোনা, মুহূর্তের জন্য হতবম্ব হয়ে যায়. কি করবে, কি বলবে বুঝতে পারেনা. এর আগেও উজান হিয়াকে স্পর্শ করেছে কিন্তু সেখানে অন্য কোনো অনুভূতি কাজ করেনি. কিন্তু এবার হিয়ার ওকে এইভাবে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ওঠা টা যেন আলাদা কিছু. উজানের অজান্তেই ওর মধ্যে অন্য যে স্বত্বাটা ইতিপূর্বে জন্ম নিয়েছে সেটা পূর্ণতা লাভের দিকে ধীরে ধীরে এগোতে থাকে. উজান আস্তে আস্তে ওর একটা হাত হিয়ার মাথায় রাখে আর অন্য হাত দিয়ে হিয়া কে আলগোছে আগলে নেয়۔۔۔
দেখা যাক কোন পথের বাঁকে মোড় নেয়—উজান-হিয়ার এই না বলা সম্পর্ক—!!!