#উপন্যাস_প্রপর্ণ(২)
#কুরআতুল_আয়েন
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।চারপাশ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে।পুরনো জীর্ণ দেয়াল টায় ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে আছে বেলী।আজানের ধ্বনি কানে আসতেই ঘুমের রেশ উধাও হয়ে গিয়েছে।প্রতিদিনকার অভ্যাস তার ফজরের আজানের ধ্বনিতে ঘুম ভাঙে।বাড়ির সামনেই মসজিদ।অবশ্য,তার আগে মাঠ আর একটা পুকুর পেরিয়ে যেতে হয়।বেলী চুপচাপ দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে সম্পূর্ণ আজান টা মন দিয়ে শুনছে আর সেই সাথে আজানের অর্থ গুলোও দিচ্ছে।আজান শেষ হতেই বেলী বসা থেকে উঠতে গেলেই পা দুটো ভেঙে আসলো,সেই সাথে কোমড়ের ব্যথাও টনটন করে উঠলো।একইভাবে বসে থাকতে থাকতে সম্পূর্ণ শরীরটায় কেমন ব্যথার জানান দিচ্ছে।কালকে কান্না করে মাঝরাতের দিকে দুচোখ লেগে এসেছিলো।ফোলা ফোলা চোখ দুটো দিয়ে বিছানার দিকে তাকালো বেলী।বুরাগ নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।বেলী কেমন একটা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে থাকিয়ে আছে।একরাশ ভয় নিয়েই বুরাগের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো।আস্তে করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।ব্লাউজ টা শরীরের থেকে ঢিলে হয়ে আছে।পরমুহূর্তেই বেলীর মনে পড়ে যায় কালকে বুরাগ রাগে তার ব্লাউজের হুক গুলো টান মেরে খুলে দিয়েছিলো।মনটা নিমিষেই কালো হয়ে যায়।এলোমেলো পায়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেলো বেলী।গ্রামের বাড়ি হলেও নিজের রুমের সাথে বাথরুম করে দিয়েছেন জাবেদা।রাত-বিরেতে মেয়েকে নিয়ে বাহিরে বের হতে চান না।গ্রামের মানুষজনের মুখের কোনো ঠিক নেই।বাথরুম থেকে নিজেকে পরিপাটি করে ওজু করে বেরিয়ে আসলো বেলী।টেবিলের পাশে রাখা মাঝারি সাইজের আলমারি টা খুলে জায়নামাজ বের করে ফজরের নামাজ টাও আদায় করে নিলো।প্রত্যেক দিন নামাজের পর হাঁটতে বের হয়ে বেলী।এইটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছে।শিউলিকে নিয়ে গ্রামের চারপাশ টা ঘুরে দেখে।পুকুর পাড়ে ইট,পাথর দিয়ে তৈরি সিমেন্টের সিড়িগুলোতে দুইবোন মিলে বসে সকালের মনোমুগ্ধকর পরিবেশটাকে খুব উপভোগ করে।সকালের মৃদু বাতাস টা যেনো মনটাকে আরো তৃপ্তি করে তোলে।মাঝেমধ্যে জাবেদাও দুই মেয়ের সাথে সকালের প্রকৃতির সৌন্দর্যের শামিল হন।কিন্তু,অন্যদিনের সকালের মতো আজকের সকাল টা একদম অন্যরকম বেলীর কাছে।মনের গভীর থেকে একটা বিষাক্ত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো।জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো।জানালার ছিটকিনি গুলো লাগানো ছিলো না।আধো আধো হয়ে লেগে আছে।বেলী পুরোপুরি ভাবে জানালা টা খুলে দিয়ে লম্বা লম্বা সবুজ রঙের রড়ের গ্রিল গুলো ধরে দাঁড়িয়ে আছে।পরিবেশ টা খুব স্নিগ্ধ লাগছে তার কাছে।পরিবেশ থেকে বুঝাই যাচ্ছে শেষরাতের দিকে বৃষ্টি হয়েছিলো।দূরের আমবাগান আর লিচুবাগানের গাছগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিলো।ঠান্ডা বাতাস টায় কেঁপে উঠছে বেলী।বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ টা এমনেই শীতল আর সেই সাথে সকালের বাতাস টায় কেমন শীত শীত লাগছে বেলীর।শাড়ির আঁচল টা টেনে নিয়ে কাঁধ সহ হাত দুটো ঢেকে নিলো।জানালা থেকে সরে দাঁড়ালো।দরজার কাছে এগিয়ে গেলো উদ্দেশ্য বাহিরে যাবে।যাওয়ার আগে একবার বুরাগের দিকে তাকালো বেলী।শীতল বাতাসটায় বুরাগ শরীর টাকে যতটুকু সম্ভব কুঁচকিয়ে রেখেছে।বেলী বুঝতে পারে জানালা ভেদ করে আসা ঠান্ডা বাতাস টা সোজা গিয়ে বুরাগের উপর আক্রমণ চালাচ্ছে।উল্টো ঘুরে বেলী তড়িঘড়ি করে আলমারির কাছে আবারও এগিয়ে গেলো।কমলা রঙের একটা নকশি কাঁথা বের করে বুরাগের শরীর টায় যত্ন করে টেনে দিলো।পুনরায় দরজার কাছে গিয়ে দরজা ভেদ করে বেরিয়ে আসলো।
জাবেদা খুব দ্রুতগতিতে হাত চালাচ্ছেন।রান্নাঘরের অদূরে বসেই তিনি চালের গুড়ির আটা তৈরি করছেন।একটু পরেই প্রায় পঞ্চাশ,ষাট টার উপরে রুটি বেলতে হবে তাঁকে।বিনার বিয়ের জন্য একটা বড়সড় গরু জবাই করা হয়েছিলো।তাই বাড়ির বুড়োরা বেশ জোর দিয়ে বাড়ির বউদের বলেছেন চালের গুড়ি দিয়ে রুটি বানাতে।মাংস দিয়ে পেট পুড়ে খাবেন তাঁরা।বলতে গেলে একপ্রকার অর্ডার এই দিয়েছেন।তাই তো সকাল হতে না হতেই তোরজোর শুরু করে দিয়েছে।চুলার পাশে বসে মাংস গরম করছেন সুমনা।বাড়িটা কেমন তেজ মরা হয়ে গিয়েছে।বাড়ির মেয়েগুলোর এক রাতের মধ্যেই বিয়ে হয়ে গিয়েছে।উনারও মেয়ের খুব শখ ছিলো।কিন্তু,সবুজ পেটে থাকতে উঠোনে পা পিছলে পড়ে গিয়েছিলেন।তারপর থেকে অনেক রক্তক্ষরণ হওয়ায় ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মাতৃত্ব হারিয়ে ফেলেন।বিনা আর বেলীকে নিজের দুটো মেয়ে মনে করতেন।কিন্তু,বিনার বিয়ের সাথে সাথে বেলীটারও যে এইভাবে বিয়ে হয়ে যাবে তা নিতান্তই ভাবেন নি।
রেশমি তাড়াহুড়ো করে এসে বসেছে জাবেদার পাশে।মাথায় আঁচল টা একটু টেনে নিয়ে জাবেদা কে বললো,
–“ছোট মা!আমাকে দিন আমি করে দিচ্ছি।কাল থেকে আপনার অনেক দখল গেলো।একটু বিশ্রাম করুন।”
জাবেদা চালের গুড়ির মিশ্রণ গুলো এক করতে করতে উত্তর দিলেন,
–“এইসবে আমি অভ্যস্ত রেশমি।আমার আগের শ্বশুড়বাড়িতে আরো সকালবেলা উঠে বাড়ির সব কাজ শেষ করে সবার জন্য রান্নাও করতে হতো।”
জাবেদার এহান কথায় রেশমির মনটা খারাপ হয়ে গেলো।শ্বাশুড়িদের মধ্যে যদি রেশমি কাউকে পছন্দ করে থাকে তাহলে সেটা হলো জাবেদা।কোনো সমস্যার সমাধান খুব সুন্দর করেই করে দেন।কিন্তু,উঠতে বসতে এই বাড়ির প্রতিটি মানুষ জাবেদা কে অনেক তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে।রেশমি কিছু বলে না চুপ করে জাবেদার পাশে বসে সাহায্য করতে থাকে।জাবেদা রেশমির দিকে তাকিয়ে বললেন,
–“একটু বেলীর কাছে যাবে রেশমি।বুঝই তো আমি মা কীভাবে যাই।”
রেশমি হাসি মুখে জাবেদা কে উদ্দেশ্য করে বললো,
–“ঠিকাছে ছোট মা।”
কাঠের পিড়ি ভেদ করে উঠে দাঁড়ালো রেশমি।কিছুটা দূর আগাতেই বেলীকে এদিকে আসতে দেখে দ্রুত পায়ে তার কাছেই এগিয়ে গেলো।বেলী অনেকটা অন্যমনস্ক হয়েই হাটছিলো।সামনে রেশমি ভাবিকে দেখে শাড়ির আঁচল ভালো করে টেনে নিলো।ব্লাউজ টা কোনোমতে বেঁধে আটকে রেখেছে।বুরাগ জোরে টান দেয়ায় ব্লাউজের হুকের আশপাশ টা বাজেভাবেই ছিড়ে গিয়েছে।বেলী চায় না তার ব্লাউজের এমন করুণ অবস্থা যেনো কারোর সামনে পড়ুক।রেশমি বেলীকে দেখে কিছুটা রস মিশিয়ে বললো,
–“কি গো ননদিনী সব ঠিকঠাক।”
বেলী মাথাটা নিচু করে নেয়।কোনো কথার উত্তর না দিয়ে রেশমি ভাবির কথায় শুধু মাথা দোলায়।যার অর্থ সব ঠিকঠাক।জাবেদা পিছনে ফিরে রেশমি আর বেলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নরম গলায় রেশমিকে বলে উঠলেন,
–“রেশমি ওকে গোসল করিয়ে তৈরি করে দাও।একটু পরেই ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দিতে হবে।কালকেই কোহিনূর আমাকে বলে দিয়েছিলো খুব তাড়াতাড়িই রওনা দিবে তাঁরা।”
রেশমির ছাঁয়া ভেদ করে বেলী জাবেদার দিকে খুব করুণ চোখে তাকায়।জাবেদা বেলীকে চোখের ইশারায় আস্বস্ত করলেন।বেলীর চোখের কার্ণিশ বেয়ে পানি পড়ছে।কীভাবে থাকবে সে অচেনা অজানা একটা জায়গায়।রেশমি বেলীর চোখের পানি দেখে বললো,
–“বেলী সব মেয়েদেরই শ্বশুড় বাড়িতে যেতে হবে।সেটা আজ হোক বা কাল।এটাই মেয়েদের জন্য বাস্তবতা।তাই নিজের মন কে মানিয়ে নাও ভেঙে পড়ো না।”
ঘুমের রেশ অনেক আগে কেটে গেলেও আড়মোড়া হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে বুরাগ।কেন জানি তার উঠতে ভালো লাগছে না।শুয়ে থাকতেই ইচ্ছা করছে।পরিবেশ টা খুব ঠান্ডা।যার কারণে কাঁথা ভেদ করে উঠতে তার খুব কষ্ট হচ্ছে।কিন্তু,কটকটে কমলা রঙের কাঁথা টা তার খুব চোখে লাগছে।একবারও মাথায় আসে নি তার, কাঁথাটা কোথা থেকে এসেছে বা কে দিয়েছে।আশেপাশে চোখ বুলিয়ে একবার বেলীকেও খুঁজে নিলো।কিন্তু,দরজার ছিটকিনি খোলা দেখে বুঝতে পারে বেলী এই ঘরে নেই।তাই,আড়মোড়া কাটিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো।টেবিলের উপর থেকে সিগারেট আর লাইটার টা নিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো।স্নিগ্ধা ধোঁকা দেয়ার পর সিগারেট টা যেনো তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছে।হাতে শাড়ি নিয়ে ঘরে ঢুকলো বেলী।দরজা একটু চাপিয়ে রেখেছে।ঘরে ঢুকতেই সিগারেট গন্ধ টা নাকে মুখে এসে বাড়ি খাচ্ছে।সিগারেটের গন্ধ তার সহ্য হয়।কারণ,বড় চাচা লিমিট ছাড়িয়ে সিগারেট খেতেন।তা থেকেই অভ্যস্ত হয়ে যায়।প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও পড়ে ঠিক হয়ে যায়।এমনকি মাঝে মধ্যে তো সিগারেটের গন্ধটাকে খুব পছন্দ করতো।যখন কলেজ যেতো তখন আশেপাশের দোকানপাট গুলোয় সিগারেটের গন্ধে কোনো পারফিউম আছে কিনা তারও খোঁজ লাগিয়ে দিতো।নিজের এমন স্বভাব টা মনে পড়তেই আনমনেই হেসে উঠলো বেলী।বেলীর হাসি পেয়ে বুরাগ ভ্রুকুটি কুঁচকে পিছনে তাকালো।বুরাগের এমন চাহনি দেখে থতমত খেয়ে যায় বেলী।নিজের হাসিটাকে পরমুহূর্তেই থামিয়ে দিয়ে আয়নার সামনে এগিয়ে গেলো।হাতে থাকা শাড়িটা এককোনায় রেখে আয়নায় সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চেইন আর কানের দুল খুলতে শুরু করলো।এইসব নিয়ে কখনোই সে গোসল করতে পারবে না।বুরাগ এই নিয়ে দুই নাম্বার সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরলো।সিগারেট টানছে আর আঁড়চোখে বেলীকে পর্যবেক্ষণ করছে।হুট করে বুরাগের চোখ গিয়ে আটকালো বেলীর ব্লাউজের পিছনের দিকটায়।ব্লাউজের বাঁধন টা আগের থেকে এখন অনেকটাই ঢিলে হয়ে গিয়েছে।যেকোনো মুহুর্তেই খুলে যেতে পারে।বুরাগের রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে পড়লো।বিরবির করে বলতে শুরু করলো,মেয়েটা কি এইভাবেই এতোক্ষণ বাহিরে ছিলো।
বুরাগ শক্ত গলায় বললো,
–“এই মেয়ে এইদিকে আসো।”
সবেমাত্র বেলী চেইন খুলে বাম পাশের কানের দুলটায় হাত দিয়েছিলো।বুরাগের গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে একবার আয়নার ভিতর বুরাগের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকালো।কেমন শক্তমক্ত মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।বেলী ভেবে পায় না এইভাবে ডাক দেয়ার মানে।তাই কানের দুল খোলা বাদ দিয়েই বুরাগের কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
–“কমনসেন্সের অর্থ বুঝ তুমি?”
বুরাগের এমন কথায় বেলী মাথা উঁচু করে তাকালো।এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য কি তাকে ডেকেছে।কয়েকবার চোখের পলক ফেলে বেলী নিম্ন গলায় বললো,
–“আমি তো বুঝি।আপনি কি বুঝেন না?”
বেলীর এমন কথায় বুরাগের চোয়াল আপনাআপনি আরো শক্ত হয়ে যায়।দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
–“আমি যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর গুলো শুধু দিবে।এর চেয়ে বেশি কিছু বললে চড়াইয়া চাপা ব্যথা করে দিবো।”
বুরাগের নেহাৎ এমন কথায় বেলী ঝটপট উত্তর দিলো,
–“জ্বি বুঝি।মানে আক্কেল বা কান্ড জ্ঞান।”
–“যেহেতু বুঝ তাহলে বোকার মতো কাজ করেছ কেন?”
বেলী অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে বুরাগের কথা শুনে।কি করেছে যার জন্য এমন কথা শুনাচ্ছে তাকে।বেলী খুব অবুঝ ভাবে বললো,
–“মানে”
বুরাগের রাগ যেনো মাত্রাতিরিক্ত ভাবে বেড়ে উঠছে।বেলীর এমন মিনমিনে আচরণ গুলো তাকে রাগের শেষ সীমানায় নিয়ে যাচ্ছে।মুখটাকে যতটুকু সম্ভব কুঁচকে রেখে বেলীকে বললো,
–“এই মেয়ে পেছনে ঘুরো।”
বেলী কিছুটা পিছিয়ে গেলো।কাঁধে হাত দিয়ে দেখে শাড়ির আঁচল টা নেই।পিছনে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।তাড়াহুড়ো করে টেনে নিয়ে মাথাটা লজ্জায় নিচু করে ফেললো।খেয়ালেই ছিলো না শাড়ির আঁচল টা কখন পড়ে গিয়েছে।
বুরাগ সরু চোখে তাকালো বেলীর দিকে।থমথমে গলায় প্রশ্ন ছুড়ে মারলো,
–“এইভাবে কেউ তোমাকে দেখে নেয় নি তো।”
বেলী চোখ নামিয়ে রেখেছে।বুরাগের চোখের দিকে তাকানোর সাহস নেই তার।কি একটা বিচ্ছিরি কান্ড হয়ে গেলো তার একটা ভুলের জন্য।
বেলীর উত্তর না পেয়ে বুরাগ শান্ত চোখে তাকালো বেলীর দিকে।শান্ত চোখে তাকালেও যে কেউ বুরাগকে দেখলে পর্যবেক্ষণ করে বুঝে নিবে এইটা ঝড় আসার পূর্বলক্ষণ।হয় না ঝড় আসার আগে সব কিছু শান্ত থাকে।
–“আমি একটা প্রশ্ন করেছি তোমাকে।সঙের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে বলে নি।”
বেলী তাও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।মিনিট পাঁচেক পর মুখ দিয়ে কথা না বলে শুধু ‘না’সূচক মাথা দোলায়।
বেলীর এমন খাপছাড়া আচরণে বুরাগ রেগে গিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়লো।বেলীর কিছুটা কাছে এগিয়ে গেলো।সেই সাথে বেলীও ভয়ে পিছিয়ে গেলো।ভয়ার্ত চোখে বুরাগের দিকে তাকালো।বুরাগ রগচটা হয়ে বললো,
–“তুই কি কথা বলতে পারিস না?বোবা তুই?কি শুধু মাথা দোলাস যত্তসব।আমার চোখের সামনে থেকে সর।শালা আমার মতো ঊনপাঁজুরে মনে হয় আর কেউ নেই।”
বুরাগের এমন কথাবার্তায় বেলী অনেকটায় ভড়কে যায়।বুরাগের মুখ থেকে তুই সম্বোধন টা বেলীর মনের মধ্যে তীব্র একটা ক্ষত সৃষ্টি করে তোলেছে।কান্না গুলো গলার মধ্যে থুথুর মতো দলা হয়ে আটকে আছে।গলা ছেড়ে খুব কান্না করতে ইচ্ছা করছে।কিন্তু,বিপত্তি বাজছে কিছুতেই বুরাগের সামনে কান্না করতে পারছে না।ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্নাটাকে কিছুটা দমানোর চেষ্টা করছে।তাও ব্যর্থ হয়ে বেলীর চোখ থেকে দু এক ফোঁটা পানি উপচে পড়ে যায়।বুরাগের সামনে থেকে শাড়ি টা নিয়ে চটজলদি করে বাহিরে বেরিয়ে আসে।কিছুতেই আর থাকতে পারছে না বেলী।হাঁটছে আর চোখ দিয়ে অজোরে পানি পড়ছে।
বেলী চলে যেতেই বুরাগ নিজের ফোনটা বের করে স্নিগ্ধার একটা ছবিতে মনোনিবেশ করলো।সব কিছু বাদ দিয়ে হলেও স্নিগ্ধার ছবিগুলো দেখতে ভুলে না।যতোই প্রতারণা করুক না কেন প্রথম ভালোবাসা কখনো ভুলা যায় না।বুরাগ স্নিগ্ধার ছবিতে মনোনিবেশ করে থাকলেও তার মনের মধ্যে শুধু বেলীর চলে যাওয়া টা মনে পড়ছে।তার কাছে স্নিগ্ধার ছবিটা এখন খুবই অসহ্য লাগছে।রাগে বিছানার উপর ছুড়ে মারলো ফোনটা।
————————–
গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে শহরের পিচঢালা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বুরাগদের গাড়িটা।অনেকক্ষণ আগেই বেলীদের বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে বের হয়ে হয়েছে।জানালায় মাথাটা হেলান দিয়ে বাহিরের ধূলিকণা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছে বেলী।বাড়ির কথা মনে পড়তেই মনটা নিমিষেই খারাপ লাগতে শুরু করলো।কেমন একটা অসহায় লাগছে নিজেকে।আব্বা,আম্মার মুখটা তার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে।পাশে বসা হাসি আর খুশি চুপ করে ঘুমিয়ে আছে।তাদের পাশেই কোহিনূর বসা।হাসি আর খুশি বেলীর ফুফাতো বোন।দুইজনেই জমজ।চিনতে খুব অসুবিধা হয়।তবে একজন লম্বা আর একজন একটু খাটো।এইটা দেখে কোহিনূর বুঝতে পারেন কোনটা হাসি আর কোনটা খুশি।সামনে বসা বুরাগ আপনমনে ড্রাইভ করে যাচ্ছে।চোখে তার সানগ্লাস।বুরাগের পাশে বসা আফিয়া খুব চিন্তিত হয়ে আছেন।উনি উনার স্বামী আজাদ রহমানকে নিয়ে খুবই ভয় পাচ্ছেন।বুরাগের বিয়েটা ফোনে বলেছিলেন কিন্তু,উনি আফিয়ার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করেছেন সাথে উনার অশ্লীল কথাবার্তা তো আছেই।একবার মায়ামাখা দৃষ্টি দিয়ে পিছনে ফিরে বেলীর দিকে তাকালেন আফিয়া।না জানি কি অপেক্ষা করছে বেলীর জন্য।জাবেদাকে তো কথা দিয়ে এসেছেন বেলীর কোনো অসস্মান হতে দিবেন না।তাও,মনের ভিতর একটা বড়সড় ঝড়ের পূর্বাভাস পাচ্ছেন।শুধু মনে মনে এটাই আশা করছেন,বেলী যেনো সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে পারে,বুরাগের অতীত ভুলিয়ে যেনো তাকে একটা স্বাভাবিক সুন্দর জীবনে ফিরিয়ে আনতে পারে।তবে উনি যেকোনো মুহুর্তে বেলীর পাশে থাকবেন।
চলবে..