উপন্যাস প্রপর্ণ পর্ব-৩৯

0
3072

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৩৯-সমাপ্ত)
#কুরআতুল_আয়েন

স্নিগ্ধা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লিটনের নিথর দেহটির সামনে।সারা শরীর রক্তে মাখামাখি হয়ে আছে।বুকের ভিতরে কয়েকটা রড ঢুকে রয়েছে।লিটনের নিথর দেহটা দেখেই স্নিগ্ধা চোখ দুটি বন্ধ করে নিলো।তবে,চোখ পড়লো পাশের লাশটির দিকে।লাশটি একটি মেয়ের।মেয়েটির হাতটা লিটনের হাতের ভাঁজে আঁটকে আছে।স্নিগ্ধা যা বুঝার বুঝে গিয়েছে।ঘৃণায় চোখ ফিরিয়ে নিলো লিটনের প্রাণহীন দেহটার থেকে।সকালের দিকেই স্নিগ্ধার ফোনে ফোন আসে!ট্রাকের সাথে ধাক্কা লেগে একটা অটো খুব মারাত্মক ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে।সেখানে দু’জন ব্যক্তি ছিলেন।তারা দু’জনেই সেখানে মারা গিয়েছেন।এমনকি এই ফোনটিও সেই ব্যক্তিটির ফোন।কথাটা শোনার সাথে সাথেই স্নিগ্ধার হাত থেকে ফোনটা ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে যায়।ইফাতকে পাশের বাসায় রেখে স্নিগ্ধা সেই জায়গার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।কিন্তু,লিটনের পাশে অন্যমেয়েকে হাত ধরা অবস্থায় দেখবে এইটা কখনোই ভাবতে পারে নি স্নিগ্ধা।প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও এখন তার মনে হচ্ছে মরে গিয়েছে বেশ ভালো হয়েছে।কিন্তু,মনকে বোঝ দিতে খুব কষ্ট হচ্ছে স্নিগ্ধার।যতোই হোক লিটনকে তো সে একটা সময় খুব ভালোবাসতো।এমনকি ইফাত তাদেরই সন্তান।ইফাতের কথা মনে পড়তেই স্নিগ্ধা ডুকরে কেঁদে উঠলো।এই ছোট একটা ছেলেকে নিয়ে স্নিগ্ধা এই অচেনা শহরে কীভাবে থাকবে।এতোদিন তো লিটন ছিলো।সম্পর্ক ভালো না থাকলেও ভরসা তো পেতো।এইসব ভাবছে আর ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।আকাশের অবস্থা ভালো না।বৃষ্টি হতে পারে।
————-
নিজেকে এখন রুম বন্দী করে রাখে রায়ান।বাহিরের পরিবেশের উপর তার বিরক্তি ধরে গিয়েছে।রায়ান বারান্দার রেলিঙ ধরে দূরের রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে আছে।সেখানে গাড়িঘোড়ার অনেক জ্যাম জমেছে।যা ছুটতে গেলে অনেকটা সময় অপেক্ষা করতে হবে।রায়ানের মনে হচ্ছে তারও মনে কষ্টের জ্যাম লেগে আছে।কিন্তু,রাস্তার জ্যাম ছুটলেও তার মনের জ্যাম কিছুতেই ছুটবে না।ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো রায়ান।খুশিকে ভুলতে গিয়েও ভুলতে পারছে না।বরং,ভুলতে গেলেই খুশি তার মনে আরো জেঁকে বসে।কিন্তু,রায়ান তার মা ইমা খানমের উপর যথেষ্ট ক্ষিপ্ত।তার এক কথা সে কখনোই বিয়ে করবে না তার উপর অনামিকাকে তো মোটেও না।কিন্তু,ইমা খানম শুনতে নারাজ।উনার একটাই ইচ্ছা অনামিকাকে রায়ানের পুত্রবধূ করে আনা।

ইমা খানম দরজা টা হালকা খোলে রায়ানের রুমে গিয়ে ঢুকে পড়লেন।কাটকাট গলায় বললেন,

–“তোমার সমস্যা টা কোথায় রায়ান অনামিকাকে বিয়ে করতে?”

রায়ান এবার অনেকটা রেগে যায়।সকাল সকাল তার কাছে এইসব একদম অসহ্য লাগছে।এমনকি অনামিকার নামটা শুনলেই তার শরীর বিষের প্রকোপে জ্বলে উঠে।মাঝেমধ্যে নিজেই নিজেকে ধমকে উঠে,কেনো আনামিকাকে সাহায্য করেছিলো!যার প্রতিদান আজকে এইভাবে দিচ্ছে।কিন্তু এবার রায়ানের আর সহ্য হলো না।ইমা খানমের কথার পিঠে কিছুটা জোর গলায় বললো,

–“তোমার সমস্যা কোথায় মা!আমাকে একটু বলবে?কেনো বারবার আমাকে জোর করছো।আমি অনাকে বিয়ে করতে রাজি নই।অনা শুধু আমার বন্ধু।এর বেশি কিছু না।”

–“এটাই তো আমি চাই রায়ান।একজন বন্ধুই পারে অন্য এক বন্ধুকে আগলে রাখতে।ঠিক তেমনি অনামিকাও পারবে তোমাকে আগলে রাখতে।”

–“আমি নিজেই নিজেকে আগলে রাখতে পারবো মা।তার জন্য কাউকে প্রয়োজন হবে না।আমি একাই যথেষ্ট।”

–“রায়ান অনামিকা তোমাকে ভালোবাসে।খুব ভালোবাসে।তোমার জন্য অনামিকাই ব্যাটার।শুধু তাই নয় তোমার সাথে অনামিকাকে খুব মানাবে।”

রায়ানের চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে।সেই সাথে হাত দুটোও মুঠোয় করে নিয়েছে।নিজের রাগ সংবরণের জন্য কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থেকে বললো,

–“অনা ভালোবাসলেও আমি ওকে বিন্দুমাত্রও ভালোবাসি না।আমি ওকে শুধু বন্ধু ভাবি।”

ইমা খানম কিছু বলতে যাবেন তার আগেই অনামিকা রায়ানের রুমে ঢুকে বললো,

–“তাহলে তুমি কি ওই খুশিকে ভালোবাসো রায়ান?তুমি কি পাগল রায়ান।এতো ছোট একটা মেয়ে তোমার সাথে যায় নাকি?”

রায়ানের মাথা রাগে আগুনের মতো দপদপ করছে।চোখ গরম করে তাকালো অনামিকার দিকে।ইচ্ছে করছে অনামিকার গালে দুটো চড় বসিয়ে দিতে।কিন্তু,অনেক কষ্টে ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রেখেছে।

ইমা খানম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন অনামিকার দিকে।অনামিকার মুখের কথায় উনি কিছু বোধগম্য করতে পারছেন না।তাই অবাক হয়ে বললেন,

–“এইসব তুমি কি বলছো অনামিকা!খুশির মতো ছোট একটা মেয়েকে রায়ান মোটেও পছন্দ করতে পারে না।তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।

–“আমার কোথাও ভুল হচ্ছে না আন্টি।তুমি রায়ানকে নিজেই জিজ্ঞেস করে নাও।”

রায়ান রুমকাঁপিয়ে চিল্লিয়ে উঠলো।রায়ানের চিল্লানোতে ইমা খানম আর অনামিকা দু’জননেই ভয় পেয়ে যায়।ভায়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রায়ানের দিকে।রায়ান তেড়ে গেলো অনামিকার দিকে।আঙুল তুলে শাসিয়ে বললো,

–“তুমি একটা কালসাপ অনা।তোমাকে আমি বন্ধু ভেবে খুব ভুল করেছি।আজকে তোমার জন্য আমার এই অবস্থা।নিজের ভালোবাসা হাতে পেয়েও পাচ্ছি না।বুঝতে পারছো কতটুকু যন্ত্রণা আমি সহ্য করছি।তুমি ঠিকই বলেছো অনা!আমি খুশিকে ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।কিন্তু,আমি তার কাছে আর কখনোই যেতে পারবো না।সেই রাস্তা বন্ধ হয়ে গিয়েছে শুধুমাত্র তোমার জন্য।এবার প্লিজ আমার বাসা থেকে বেরিয়ে যাও।তোমাকে দেখতে আমার ভালো লাগছে না।মনে হচ্ছে,এখনেই তোমাকে মেরে শেষ করে দেই।”

ইমা খানম চমকে তাকালেন রায়ানের দিকে।ছেলের মনে যে এতোটা পাথর জমে আছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পান নি তিনি।অনামিকা যা বলেছে তাই বিশ্বাস করে গিয়েছে।অনামিকা যখন কেঁদেকেটে বলতো সে রায়ানকে ছাড়া একদন্ডও থাকতে পারবে না তখনই ইমা খানমের মনে অনামিকার জন্য আলাদা একটা মায়া তৈরি হয়ে যায়।কিন্তু,একটিবারও তিনি ছেলের কাছ থেকে জানার প্রয়োজন মনে করেন নি ছেলের মন কি চায়!

রায়ানের কথা শুনে অনামিকা কেমন একটা পাগলের মতো আচরণ শুরু করে দেয়।দৌড়ে গিয়ে রায়ানের হাত দুটো আঁকড়ে ধরে বললো,

–“রায়ান প্লিজ তুমি এমন করো না।আমি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সেই শুরু থেকে।খুশি তো একটা বাচ্চা মেয়ে।ও তোমাকে কীভাবে সুখী করবে বলো।না শারীরিকভাবে আর না মানসিকভাবে।আমাকে দেখো আমি সব পারবো তোমার জন্য।তোমাকে শারীরিক সুখও দিতে পারবো।”

রায়ান আর না পেরে অনামিকার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।ঘৃণা আর রাগে তার শরীর কাঁপছে।দাঁতে দাঁত পিষে অনামিকাকে বললো,

–“ভালোবাসা শারীরিক সম্পর্ক দিয়ে হয় না।মন আর অনুভূতি দিয়ে হয়।আমার মন আর অনুভূতি জুড়ে শুধু খুশিই বিরাজ করছে।সেখানে তোমার কোনোকিছুতেই কাজ হবে না।আর,এতো নিচু মনের কেউ আমার বন্ধু হতে পারে না।বেরিয়ে যাও এখান থেকে।অত্যন্ত আমাকে একটু শান্তি দাও তুমি।”

অনামিকা ক্রন্দনরত অবস্থায় ইমা খানমের দিকে এগিয়ে যেতেই উনিও মাঝরাস্তায় আটকিয়ে বললেন,

–“আমার সামনে আসবে না তুমি।প্রতিনিয়ত তুমি আমাকে ভুলভাল বলেছো।তোমার জন্য আমার ছেলের আজকে এই অবস্থা।তুমি চলে যাও অনামিকা।আর কোনোদিনও এই বাসায় আসবে না তুমি।”

অনামিকা আর কিছু বলার সাহস পায় নি।রায়ানের দিকে একবার তাকিয়ে দৌড়ে চলে যায়।সে ভেবেছিলো কি আর হয়েছে কি!তার সব প্ল্যান একদম ফুটুসফাটুস হয়ে গিয়েছে।
————-
খুশি মনমরা হয়ে বিছানার মাঝখানে বসে আছে।দু’দিন পর থেকে তার এসএসসি পরীক্ষা শুরু।কিন্তু,তার কিছুতেই পড়ায় মন বসছে না।মন রায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে।খুশি আচমকাই ডুকরে কেঁদে উঠলো।নিজেই নিজেকে ক্রন্দনরত গলায় বলছে,

–“কেনো বলতে গেলি ওইসব কথা।এখন তো নিজেই কষ্ট পাচ্ছিস।ওইভাবে না বলে শান্তশিষ্ট হয়ে বলতি।কিন্তু,এখন কি করবি খুশি তুই।তুই তো রায়ানকে ভালোবেসে ফেলেছিস।থাকতে পারবি তুই উনাকে ছাড়া!!”

সেসময় বেলী খুশির রুমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো।খুশির সব গুলো কথা বেলীর কানে এসে ঠেকেছে।খুশির কথা শুনে বেলী চমকে উঠে।এইটা সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না।দৌড়ে খুশির রুমে ঢুকে দরজা টা আঁটকে দিলো।খুশির দিকে এগিয়ে গেলো নিঃশব্দে।

খুশি সামনে বেলীকে দেখে কিছুটা চমকে উঠে।তাড়াতাড়ি চোখ দুটো মুছে হাসির চেষ্টা করে কিন্তু পারে না সেই কান্নাই চলে আসে।বেলী খুশির সামনে হাঁটুগেঁড়ে বসে খুশির হাত দুটো আঁকড়ে ধরলো।কোমল কন্ঠে বললো,

–“বাহির থেকে যতটুকু শুনেছি ততটুকুতেই বুঝতে পেরেছি তুই রায়ান ভাইয়াকে ভালোবাসিস।কিন্তু,খুশি তুই রায়ান ভাইয়াকে ভালোবাসলি কীভাবে।”

খুশি জাপটে ধরে বেলী।এবার শব্দ করেই কেঁদে দেয়।কাঁদতে কাঁদতে বেলীকে সব বলে।বেলী খুশির মুখে সব শুনে একদম হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছে।কিন্তু,তার ভয় হচ্ছে বুরাগ এসব শুনলে কি করবে।মেনে নিবে কি!রায়ান আর খুশির সম্পর্ক।তাদের বয়সের পার্থক্য যে অনেক!!
————-
দেখতে দেখতে আরো কয়েকটা দিন কেটে যায়।হাসি,খুশির পরীক্ষাও শেষ হয়ে গিয়েছে।দিনদিন খুশি যেনো মনমরা হয়ে যাচ্ছে।আগে রায়ানের দেখা পেলেও এখন আর রায়ানের ছাঁয়া টুকুও পায় না।খুশি উপলব্ধি করতে পারছে সে ভালো নেই।রায়ানকে ছাড়া সে একটুও ভালো নেই!
—-
আজাদ রহমান এখন আর অফিসে যান না।সবকিছু বুরাগের হাতে তুলে দিয়েছেন।এখন উনি বাসায় বসে সময় কাটায়।লিভিং রুমে গিয়ে দেখে শিউলি সোফায় বসে টিভি দেখছে।ঘাড় অবধি চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে।একটু পর পর চুলকাচ্ছে আর কপাল থেকে সরানোর চেষ্টা করছে।আজাদ রহমান শিউলির এমন কর্মকাণ্ড দেখে হেসে ফেললেন।আস্তে আস্তে শিউলির প্রতি উনি দূর্বল হয়ে যাচ্ছেন।ছোটবেলায় তেমন একটা নাও দেখতে পারলে এখন ঠিকই শিউলির জন্য মন কেঁদে উঠে।এইতো সেদিন!শিউলি বাগানে খেলতে গিয়ে ইটের সাথে লেগে পড়ে গিয়েছিলো,হাতের দিকে একটু ব্যথা পেয়েছিলো কিন্তু,আজাদ রহমানের কাছে সেই একটুখানি ব্যথা টা অনেকটা মনে হয়েছে।আবার,শিউলি যখন দাদা বলে ডাকে তখন আজাদ রহমানের যেনো মন জুড়িয়ে যায়।উনি ধীর গতিতে শিউলির দিকে এগিয়ে গেলেন।শিউলির পাশে বসে শিউলির চুল গুলো গুছিয়ে দিতে লাগলেন।রান্নাঘর থেকে আফিয়া আর বেলী উঁকি মেরে দেখছে।আফিয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।আফিয়া বুঝতে পারছেন আজাদ রহমান বেলী আর বেলীর সন্তানকে মেনে নিতে শুরু করে দিয়েছেন।

বুরাগ খুব দ্রুত গতিতে ড্রাইভ করছে।দশটার মধ্যে তাকে একটা মিটিং এ জয়েন করতে হবে।না হলে,অনেক টাকার ডিলটা হাতছাড়া হয়ে যাবে।যা বুরাগ কিছুতেই চায় না।আচমকাই গাড়ির সামনে একটা মেয়ে আসায় বুরাগ তাড়াতাড়ি ব্রেক চেপে ধরলো।কিন্তু লাভের লাভ কিছুই হলো না।মেয়েটা বুরাগের গাড়ির সাথে ধাক্কা লেগে কপালে অনেকটা আঘাত পেয়েছে।সেখানেই সেন্স লেস হয়ে পড়ে যায়।বুরাগ তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত মেয়েটির দিকে এগিয়ে যায়।মেয়েটিকে দেখেই বুরাগের পায়ের তোলা থেকে যেনো মাটি সরে যাচ্ছে।শুধু তাই নয় বুকে একটা চিনচিনে ব্যথাও অনুভব করছে।তাড়াতাড়ি করে মেয়েটিকে কোলে তোলে নিলো।গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো।
—-
রাতে মনমরা হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে বুরাগ।সবকিছুই বিষাদ লাগছে তার কাছে।ঠিকঠাক ভাবে অফিস টাও করতে পারে নি।তাড়াহুড়ো করে চলে এসেছে বাসায়।

বেলী ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো।শিউলিকে ঘুম পাড়িয়ে এখন শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।মাথার বিনুনি টা করে বুরাগের দিকে এগিয়ে গেলো।বুরাগের কাঁধে হাত রাখতেই বুরাগ চমকে বেলীর দিকে।বেলীর মুখ টা দেখে বুরাগ স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস নিলো।বেলীকে নিজের কাছে নিয়ে এসে জড়িয়ে ধরলো।মিনমিনে গলায় বললো,

–“বেলী আজকে তোমাকে আমি কিছু কথা বলতে চাই।”

বেলী ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।কয়েকবার চোখ পিটপিট করে বললো,

–“কি কথা!”

–“বলছি শোনো!আমি তখন সবেমাত্র ভার্সিটির প্রথম বর্ষে পড়ি।মা’র সাথে নানু বাড়িতে গিয়ে দেখা হলো ছোট খালামনিদের সাথে।খালামনির পাশে বসে থাকা জিন্স,টপস পড়া অতি মর্ডান মেয়েটিকে দেখে আমি চমকে উঠি।এক দেখাতেই আমার খুব ভালো লেগে যায় মেয়েটিকে।পরে জানতে পারলাম মেয়েটি আমার ছোটখালামনির মেয়ে স্নিগ্ধা।সেই ছোটবেলায় দেখা হয়েছিলো আমাদের।আর,তেমন একটা দেখা হয় নি।কিন্তু,আমার মনে যে স্নিগ্ধা তখনেই জায়গা করে নিয়েছিলো।এমনকি আমাদের কয়েকবার চোখাচোখিও হয়েছিলো।এইভাবে একসপ্তাহর মতো আমরা নানুবাড়িতে থাকি।আসার আগের দিন ভেবে নিয়েছিলাম স্নিগ্ধাকে আমার মনে কথা জানাবো।প্ল্যানও করে ফেলেছিলাম।প্ল্যান মাফিক সব কিছু হলেও আমি আমার মনের কথা বলার আগেই স্নিগ্ধাই আমাকে আমার প্রতি তার ভালোবাসার কথা বলেছিলো।সেইদিন মনে হয় আমি ছিলাম পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ।প্রতিদিন রাত জেগে আমরা ভালোবাসার কথা বলে কাটাতাম।কথা বলতে বলতে কখন যে সকাল হয়ে যেতো তা একটুও বুঝতে পারতাম না।এইভাবে প্রায় দুই বছরের মতো কেটে যায়।তারপরও সবকিছু ভালোই চলছিলো।কিন্তু,ওইদিন রাতে স্নিগ্ধার আসল চেহারা আমার সামনে চলে আসলো।অভিমান হলো স্নিগ্ধার প্রতি।কিন্তু,ভালোবাসার উপলব্ধি থেকে তাকে সরাতে পারি নি।”

বেলী নিঃশব্দে কাঁদছে।বুরাগের মুখে তার আর তার প্রাক্তন প্রেমিকার কথা শুনে খুব কষ্ট হচ্ছে।কোনো মেয়েই চাইবে না নিজের স্বামীর মুখে অন্য মেয়ের কথা শুনতে।তবুও বেলী আজকে শুনবে।এই কথাটা শোনার অপেক্ষায় সে অনেকদিন থেকেই ছিলো।কোনোমতে কান্নাটাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,

–“কি হয়েছিলো সেই রাতে!”

বুরাগ বেলীর মুখপানে তাকালো না।এমতাবস্থায় বললো,

–“একটা সময় স্নিগ্ধার আমাদের বাসায় খুব আনাগোনা ছিলো।আমি ভাবতাম হয়তো আমার জন্য আসে।কিন্তু না স্নিগ্ধা আসতো আমার ফুফা লিটনের জন্য।লিটনের সাথে তার অবৈধ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো।ওইদিন রাতে আমি স্নিগ্ধা আর আমার ফুফাকে ফিজিক্যালি দেখেছি।বাসায় কেউ ছিলো না বিধায় তারা একে অপরের সাথে সেসবে মেতে ছিলো।যখন আমি সেসবের উত্তর জানতে চেয়েছিলাম স্নিগ্ধার কাছে তখনই স্নিগ্ধা আমাকে বলেছিলো সে আমাকে কোনোদিন ভালোইবাসে নি।লিটন তাকে যা দিতে পারে আমি তাকে তা দিতে পারবো না।ওইদিনের পর থেকে স্নিগ্ধাকে আমি ভুলে যাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করি।কিন্তু,কিছুই হতো না!না পারতাম ভুলতে আর না পারতাম ভালোবাসতে।তবুও আমার মনে শুধু স্নিগ্ধাই ছিলো।এমনকি তারপরেও আমার সামনেই তারা দুজন আরো ইন্টিমেট হয়েছে।আমি পারতাম না সেসব সহ্য করতে।একটা সময় পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলাম।মা স্নিগ্ধার ব্যাপারে জানলেও কেনো স্নিগ্ধার সাথে আমার সবকিছু শেষ হয়ে গিয়েছে তা জানতো না।তার কিছুদিন পরেই বুনির বিয়েতে যাওয়া।সেখানে ভাগ্যক্রমে তোমার সাথে বিয়ে হয়ে যায়।বিশ্বাস করো বেলী!আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই নি।মা’র অনুরোধে বিয়ে করেছিলাম।তখনও আমার মনে স্নিগ্ধাই ছিলো।কিন্তু,তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে আসার পর আমি পড়ি বিশাল বড় বিপাকে।লিটন তোমার দিকে চোখ দিয়েছিলো।আমি বেশ বুঝতে পেরেছি লিটনের তোমাকেও চায়।এমনকি সে আমাকে নিজের মুখেও বলেছিলো ওর তোমাকে একদিনের জন্য হলেও চায়।সেদিন কেনো জানি আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম।তার উপর ওই রাতে তুমি আমাকে আর স্নিগ্ধাকে খুব ক্লোজ অবস্থায় দেখে নিয়েছিলে।বিশ্বাস করো!সেদিন স্নিগ্ধাই নিজে থেকে আমার নিকটে এসেছিলো।কিন্তু,তোমার পাগলামি গুলোতে আমি বুঝে গিয়েছিলাম তুমি আমাকে ভালোবাসো।আমিও মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তোমাকে মেনে নিবো।তোমার উপর আমার একটা অন্যরকম অনুভূতি কাজ করতো।তবে,সেদিন রাতে তুমি যে বলেছিলে তুমি যদি পতিতালয়েও যাও তাহলে আমার কিছুই যায় আসবে না ওই কথাটায় আমি আরো ভয় পেয়ে যাই।ভয়ের কারণ,ছিলো একমাত্র লিটন।মনে হতো ও যদি তোমাকেও আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়।তাই বাধ্য হয়ে সেদিন আমি তোমার খুব নিকটে যাই।তোমাকে আমার স্ত্রীর অধিকার দেই।কিন্তু,তাও কোনোকিছু শান্ত হয় নি।একটা সময় ফুপিও সবকিছু জেনে যায়।আর দেখো!ফুপিও এতো কষ্ট সহ্য করতে পারে নি।চলে গিয়েছে আমাদের সবাইকে ছেড়ে।তবে,বিশ্বাস করো বেলী!আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি।তোমাকে ছাড়া আমি নিঃস্ব।তুমি যেদিন রাগ করে চলে গিয়েছিলে সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম তোমার প্রতি আমার ভালোবাসার অনুভূতি।তাই তো সেদিন রাতে ছুটে গিয়েছিলাম তোমার কাছে।”

সবকথা শুনে বেলী কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।লিটন যে এইরকম একটা খারাপ পুরুষ তা বেলী ঘুণাক্ষরেও টের পায় নি।আর স্নিগ্ধার কথা তো বাদেই দিলো।কিন্তু,ফুফির জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে বেলীর।বেলী দীর্ঘ একটা শ্বাস ছেড়ে বুরাগের বুকে মাথা ঠেকিয়ে জড়িয়ে ধরলো।বুরাগও বেলীকে পরমযত্নে নিজের সাথে আলিঙ্গন করে নিলো।
————-
সব কিছু ঠিক থাকলেও এই কয়েকদিন ধরে বেলীর কাছে বুরাগের আচরণ খুব অন্যরকম লাগছে।ঠিকমতো বাসায় ফেরে না।ফিরলেও অনেকটা রাত হয়ে যায়।আবার মাঝরাতে ফোন নিয়ে অনেকটা ব্যস্ত হয়ে পড়ে।বেলী কিছু বলতে গেলেই এড়িয়ে যায়।কয়েকদিন ধরেই বেলীর শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না।বমি আর মাথা ঘুরানোর লক্ষ্মণ দেখে বেলী প্রেগ্ন্যাসির কীট এনে টেস্ট করিয়েছিলো।পজিটিভ আসায় বেলী নিশ্চিত হয় সে আবার মা হতে চলেছে।বেলী খুব খুশি হয়।বুরাগ তো তার কাছে আরেকটি সন্তানের আবদার করেছিলো।এই খবরটা শুনে বুরাগ নিশ্চয় অনেক খুশি হবে।কথাটা ভেবেই বেলীর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠলো।

পরেরদিন সকালে!বুরাগ তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে যাওয়ায় বেলী আর খবরটা দিতে পারে নি।তাই ভেবে নিয়েছে!ডাক্তারের কাছ থেকে আজকে চেকাপ করিয়ে নিয়ে আসবে।তারপর রিপোর্ট টা বুরাগের হাতের সামনে তোলে দিবে।তাই,বেলী একটু পরেই বেরিয়ে পড়লো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।

চেকাপ করিয়ে রিপোর্ট আনতে আনতে অনেকটা বিকেল হয়ে পড়ে।তার উপর গাড়ির জ্যামে আটকে আছে।হঠাৎ চোখ যায় বেলীর একটা হোটেলের সামনে।বুরাগকে সেখানে ঢুকতে দেখে বেলীর কিছুটা খটকা লাগে।যারফলে,বেলী গাড়ি থেকে নেমে যায়।বুরাগের পিছু নেওয়ার জন্য কিছুটা দ্রুত গতিতে পা চালায়।

হোটেলের ভিতরে ঢুকে বেলী যে এমন একটা দৃশ্য দেখবে তা কিছুতেই বুঝতে পারে নি।তার চোখের সামনে বুরাগ স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে।শুধু তাই নয় একটা বাচ্চা ছেলেকেও নিজের সাথে চেপে ধরে রেখেছে।দেখে মনে হবে একটা পরিবার।বেলী আর সেখানে দাঁড়াতে পারলো না।দৌড়ে বেরিয়ে আসলো।তার সব কিছু পাগল পাগল লাগছে।এইবার বুঝতে পেরেছে এই কয়েকদিনে বুরাগ কেনো তার সাথে ভালো করে কথা বলে নি।তাকে কেনো এড়িয়ে গিয়েছে!তার আসল কারণ হলো স্নিগ্ধা!!
—-
ক্লান্ত হয়ে রুমে ঢুকে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো বুরাগ।সাইড বক্স টার উপর থেকে পানিটা খেয়ে নিলো।বিছানার পাশে চোখ বুলিয়ে শিউলিকে খুঁজতে লাগলো।কিন্তু শিউলির দেখা পায় নি।এমনকি রুমে বেলীর অস্বস্তিও নেই।বুরাগ রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো সারা বাসা খুঁজে বেলীর কোনো খোঁজও পেলো না।দ্রুত গতিতে সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা হলো আফিয়ার সাথে।আফিয়াকে বুরাগ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আফিয়া বুরাগের গালে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো।বুরাগ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আফিয়ার দিকে।আফিয়া চোখের পানিটুকু মুছে নিয়ে বললেন,

–“স্নিগ্ধার সাথে কেমন সময় কাটলো তোর!নিশ্চয় অনেক ভালো।স্নিগ্ধাকে পেয়ে তো বেলীকে এই কয়েকদিন পাত্তাই দিলি না।”

–“মা!তুমি জানলে কি করে স্নিগ্ধার কথা।আর বেলীই বা কোথায়।শিউলিকেও তো দেখছি না।”

–“তুই ওদের কাউকেই পাবি না।ওরা দু’জনেই চলে গিয়েছে।তুই বেলীকে এইভাবে কষ্ট নাও দিতে পারতিস বুরাগ।স্নিগ্ধাকে তুই এখনো ভালোবাসিস সেটা তুই বেলীকে বলেই দিতি।কেনো ওকে অবহেলা করেছিলিস।”

বুরাগ মাথাটা চেপে ধরলো।এমতাবস্থায় বললো,

–“মা!তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে।আমার সবটা কথা আগে তুমি শুনে নাও।”

–“তোর কোনো কথাই আমি শুনতে চাই না বুরাগ।চলে যা আমার চোখের সামনে থেকে।”

আফিয়া চলে যেতেই বুরাগ এলোমেলো পা’য়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।টেবিলের পাশে চোখ পড়তেই বুরাগ আঁতকে উঠলো।সাদা কাগজে ভাঁজ করে রাখা চিঠিটা খোলে পড়তে শুরু করলো,

প্রিয় বুরাগ!
চিঠিতেই আমি আপনাকে নাম ধরে সম্বোধন করলাম।কি লিখবো কিছুই বুঝতে পারছি না।তবে,আসল কথা কি জানেন আমি আপনার জীবন থেকে চলে যাচ্ছি।আপনি আর স্নিগ্ধা খুব সুখী থাকবেন।স্নিগ্ধা ফিরে এসেছে বলেই আপনি আমার সাথে এই কয়েকদিনে ভালো করে কথাও বলেন নি।এমনকি ফিরেও তাকান নি।মাঝরাতে তাহলে,স্নিগ্ধার সাথেই চ্যাটে ব্যস্ত থাকতেন।আমাকে কেনো এতো ধোঁয়াশার মধ্যে রেখেছিলেন আপনি!তবে যাই হোক!আজকে আমি নিজেই আপনার থেকে সরে আসলাম।আর না পাবেন আমার দেখা।আরো একটা কথা!আপনি আবার বাবা হতে যাচ্ছেন।চিন্তা নেই আমি নিজেই ওদের দু’জনকে মানুষ করে নিতে পারবো।টেবিলের উপরেই রিপোর্ট টা রাখা আছে।

চিঠিটা বুরাগের হাত থেকে পড়ে যায়।নিঃস্তব্ধ এই পরিবেশ টায় বুরাগ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।তার একটা ভুলের জন্য আজকে সে সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে।তার মনে পড়ে,এই কয়েকদিনে আসলেই সে বেলীকে অনেকটা অবহেলা করেছে।কথায় কথায় রাগও দেখিয়েছে।আজকে,তার আনন্দ হওয়ার কথা দ্বিতীয় বারের মতো বাবা হতে যাচ্ছে।কিন্তু,আনন্দের বদলে সে এখন কষ্ট পাচ্ছে।তার এখন একটাই চাওয়া।যেকোনো মূল্যে সে বেলী আর শিউলিকে চায়।বেলী যে তার ভালোবাসা!তাদের দু’জনকে ছাড়া তার একমুহূর্তও চলবে না।বেলীকে যে তার অনেক কথা বলার আছে।এই কথা গুলো না বললে বেলী তাকে সারাজীবন ভুলেই বুঝে যাবে।সে সবকিছু এইভাবে ঝরাপাতার মতো ঝরে পড়ে যেতে দিবে না।কিন্তু,এতো রাতে সে খুঁজবে কোথায় বেলীকে।আদোও কি বেলীর দেখা পাবে বুরাগ!!

সমাপ্ত

(সবকিছু এক পর্বে এনে একদম হযবরল করে ফেলেছি।😑
আশা করি পরিশিষ্ট অংশে সব কিছু ক্লিয়ার হবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here