উপন্যাস প্রপর্ণ, পর্ব-৯

0
4128

#উপন্যাস_প্রপর্ণ(৯)
#কুরআতুল_আয়েন

একপ্রকার ধড়ফড়িয়েই ঘুম থেকে উঠেছে বুরাগ।জানালার থাইগ্লাস দিয়ে বাহিরের পরিবেশটাকে ঝকঝকে দেখায় বিছানার পাশে বিদ্যমান সাইড বক্স টার উপর থেকে ফোন টা নিয়ে নিলো।সময় দেখে মাথায় হাত দেয়ার উপক্রম।আজ অফিসে একটু আগেই যেতে চেয়েছিলো।খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে।কিন্তু,আজকেই অন্যদিনের তুলনায় লেইট হয়ে গিয়েছে।বুরাগ পাশে চোখ বুলিয়ে বেলীর খোঁজ লাগালো।বিছানায় বেলীকে দেখতে না পেয়ে কিছুটা বিরক্ত বোধ হলো।বিরক্ত বোধ থেকেই বিরবির করতে লাগলো,প্রতিদিন ঠিকই ডেকে দেয় আমাকে আর আজকে নিজে ঠিকই উঠেছে কিন্তু আমাকে ডাকার প্রয়োজন মনে করলো না।রাতে তার কথার জবাব দেয় নি বলে আজকে অফিসের বারোটাই বাজিয়ে দিয়েছে।বিরবির করেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।দরজাটা অনেকটাই জোরে লাগিয়েছে।বলতে গেলে বেলীর রাগ টা দরজার উপরেই দেখাচ্ছে।

বারান্দার বেতের চেয়ারটার উপর অনেকটা এলোমেলো হয়েই বসে ঘুমিয়ে আছে বেলী।ঘাড় টা একপাশে বাঁকা হয়ে আছে।রাতে বেলকনি থেকে আর রুমে আসে নি।সেখানেই দাঁড়িয়ে চন্দ্রবিলাস করেছে আর চোখের অশ্রুত্যাগ করেছে।কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে তা বেলীর খেয়াল ছিলো না।কান্না বেশি করার ফলে মাথাটা ব্যাথায় অনেকটাই চেপে ধরেছিলো আর সেই সাথে ঘুমেরা উঁকিঝুঁকি বাইছিলো।যার দরুন অবস্থার ফলে বেলী বারান্দায় ঘুমিয়ে পড়েছে।
বুরাগ হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে আসলো ওয়াশরুম থেকে।শরীর টা ভিজাই আছে তার।তাড়াহুড়োর মধ্যে সে তোয়ালে নিতেই ভুলে গিয়েছিলো।শুধু ধূসর রঙের প্যান্ট টা পড়ে বের হয়েছে।শরীর টা মোছার জন্য বারান্দার দিকে গেলো।কিন্তু,বারান্দার বেতের চেয়ারটার মধ্যে বেলীকে ঘুমোতে দেখে যেনো অনেকটাই রেগে যায়।বুরাগ চোয়াল শক্ত করে একবার বেলীর দিকে তাকালো।বারান্দায় মেলানো তোয়ালে টা টান মেরে নিয়ে চলে এলো রুমে।বুরাগের মনে শুধু একটাই ভাবনা,কালকে বেলীর প্রশ্নের উত্তর দেয়নি বলে বেলী ইচ্ছা করে এইসব করছে।ইচ্ছে করে রুমে না ঘুমিয়ে বারান্দায় ঘুমিয়েছে।
এইসব ভাবনা চিন্তা এক সাইডে রেখে বুরাগ কোনোমতে রেডি হয়ে নিলো।ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে ধপাধপ্ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো।

সূর্যের আলো চোখে পড়তেই চোখ,মুখ ঘুমের মধ্যেই কুঁচকে ফেললো বেলী।তার উপর গরম লাগছে।ঘুমের ঘোরেই বুঝতে পারছে তার মুখ,নাক,গলা সব ঘামছে।পিটপিট করে চোখ খুলে আশপাশ টা বুঝার চেষ্টা করছে।মাথাটা সোজা করতেই ঘাড়ে অসহ্যকর ব্যাথার ফলে কিছুটা কুঁকড়িয়ে উঠলো।ঘাড়ে হাত রেখে সোজা করতে গেলেই চোখ,মুখ খিঁচিয়ে বন্ধ করে নিলো।প্রায় মিনিট দশেকের মতো ঘাড়ে হাত দিয়ে বসেছিলো বেলী।যখন বুঝতে পারে সে বারান্দায় তখনই চট করে উঠে দাঁড়ায়।দ্রুত পা চালিয়ে রুমে ঢুকে বুরাগকে দেখতে না পেয়ে কিছুটা মন খারাপ হয়ে গেলো।কখন গেলো তাও বুঝতে পারেনি।এমনকি একটাবার বলেও গেলো না তাকে।অন্যদিন তো তাকে বলেও যাও সেই সাথে কপালে ভালোবাসার স্পর্শও দিয়ে যায়।আজকে সব কেমন উল্টো হয়ে গেলো।শুধুমাত্র রাতে ওই প্রশ্নটা করার জন্য।জীবনটা তার কাছে খুবই অদ্ভুত লাগছে।ভেবে নিয়েছিলো বুরাগ তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।কিন্তু,তা নিতান্তই মিথ্যা।বুরাগ তাকে ভালোবাসে নি।এমনকি আদোও ভালোবাসবে কি না তাও জানে না বেলী।ভাবতেই বেলীর ভিতর থেকে একটা তপ্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে আসলো।

অফিসের ক্যান্টিনে বসে আছে বুরাগ আর জয়নব।কয়েকদিন আগেই আজাদ রহমান বড়সড় একটা খানাপিনার অনুষ্ঠান আয়োজন করেন।সেখান থেকেই তাদের পরিচয়।তবে বুরাগ জয়নব কে তেমন একটা পছন্দ করে না।অসম্ভব রকমের গায়ে পড়া মেয়ে।হুট করেই বুরাগের কেবিনে ঢুকে পড়ে।এইটা বুরাগ কিছুতেই পছন্দ করে না।কাজের সূত্রে আসলে তা মানা যায়।কিন্তু,জয়নব ঠিক তার উল্টে।এমনকি বুরাগ অনেকবারও বলেছিলো আজাদ রহমানকে জয়নবের ব্যবহারে।তার বিপরীতে আজাদ রহমান কোনো প্রত্যুত্তর করলেন না।মুখে মুখে সম্পর্ক রেখেছে বুরাগ জয়নবের সাথে।তাও আবার ব্যবসার খাতিরেই।
একটু আগের ঘটনা প্রতিদিনের মতোই আজকেও পারমিশন ছাড়াই কেবিনে ঢুকে পড়ে জয়নব।এতে অনেকটাই চটে যায় বুরাগ।সকাল থেকেই তার মাথা আগুন হয়ে আছে।তার উপর আবার অফিসে জয়নবের আগমন।এতে যেনো আগুনে হালকা করে একটু ঘি ঢালা হয়েছে।জয়নব চেয়ার টেনে বসতে না বসতেই বুরাগ উঠে দাঁড়ালো।একপ্রকার তাড়া দিয়ে জয়নবকে ক্যান্টিনে নিয়ে এলো।তারপর থেকেই বুরাগ মুখে তালা দিয়ে বসে আছে।আর,জয়নব রাগে ফোসফাস করছে।সে ভেবেছিলো কেবিনে কিছুটা সময় কাটাবে তার সাথে।একদিন তার বাবাকে মায়ের সাথে কথা বলতে শুনেছিলো বুরাগের সাথে তার বিয়ের কথা।তারপর থেকেই সে বুরাগের উপর অনেকটা দূর্বলতা হয়ে যায় পড়ে।যা দিন দিন গাঢ় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

বেলীর মনটা খুব উশখুশ করছে বুরাগকে ফোন করার জন্য।কিন্তু,বিপত্তি হলো বেলীর কোনো ফোন নেই।ফোন জিনিসটা বরাবরই অসহ্য লাগে বেলীর।বাড়িতে যখন ছিলো তখন ফোনের কোনো প্রয়োজন ছিল না।কিন্তু,এখন মনে হচ্ছে একটা ফোন খুবই প্রয়োজন তার।অত্যন্ত বুরাগের একটা খবর নেয়ার জন্য হলেও।আজকে সারাদিনটা খুব অস্থিরতায় কেটেছে বেলীর।কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারেনি।জোর করে তো আর কোনো কিছুর উপর মন বসানো যায় না।ঠিক তেমনিই বেলীর আজকে কোনো কিছুতেই ভালো লাগছে না।সারারুম জুড়ে পায়চারি করেও বেলীর অশান্ত মন শান্ত হওয়ার নামেই নিচ্ছে না।মনে হচ্ছে!এখন বুরাগের সাথে কথা না বললে অনেক কিছুই হয়ে যাবে।একবার ভাবে ফুপির কাছে যাবে কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে পড়ে ফুপি বাসায় নেই হাসি আর খুশিকে নিয়ে কোচিং এ গিয়েছে।আজকেই ভর্তি হয়েছে।তাই সাথে যাওয়া।বিছানায় রোবটের মতো বসে পড়ে বেলী।উহুহু!তাও শান্তি পাচ্ছে না।কিছু একটা ভেবেই হুট করে উঠে দাঁড়ালো।গুটিগুটি পায়ে শ্বাশুড়ির রুমের দিকে এগিয়ে গেলো।পর্দার আড়াল ভেদ করে বেলী বলে উঠলো,

–“মা!আসবো!”

আফিয়া তখন আলমারির কাপড় গোছাতে ব্যস্ত ছিলেন।হঠাৎ করে বেলীর কন্ঠ কর্ণকুহরে পৌঁছতে চট করে দরজার দিকে তাকালেন।মুখে হাসি রেখে বললেন,

–“ওহহ্ বেলী আয়!অনুমতি নিচ্ছিস কেন?”

আগের ন্যায় গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গেলো বেলী।বিছানার কোণায় কিছুটা ঠেস দিয়ে বসেছে।আফিয়ে বেলীর দিকে একবার পরোক্ষ করে নিলেন।বেলীর মুখটাকে শুকনো দেখায় কপালের তিনটির মতো ভাজের রেখা ফুটে উঠেছে।কাপড়চোপড় গোছানো বাদ দিয়ে বেলীর পাশে বসে পড়লেন।হাত দুটো ধরে কিছুটা কোমল কন্ঠে বলে উঠলেন,

–“কিছু হয়েছে তোর বেলী।মুখটা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে।”

শ্বাশুড়ির কথার বিপরীতে দ্রুত মাথা নাড়ায় বেলী।যার অর্থ কিছু হয়নি তার।পরমুহূর্তেই জিহবা দিয়ে নিচের ঠোঁট টা ভিজিয়ে নিলো।কিছুটা আঁটকে গলায় বললো,

–“মা!একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”

আফিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।কিন্তু ঠোঁটে তাঁর হাসি।এমতাবস্থায় বললেন,

–“এতো ইতস্তত করার কি আছে।আমাকে জাবেদা ভেবে গড়গড় বলে দে।ভেবে নে আমি তোর আম্মা শ্বাশুড়ি নই।”

বেলী মাথাটা নিচু করে বললো,

–“মা!আপনার ফোনটা একটু হবে।একটু উনাকে ফোন দিতে চেয়েছিলাম।আসলে!সকালে কখন উনি বেরিয়ে গিয়েছিলেন তা বুঝতে পারে নি।”

–“এই কথাটা বলতে এতো সময় লাগছে তোর।টেবিলের উপর ফোনটা আছে ওইখান থেকে নিয়ে যা তোর রুমে।ফোনে লক নেই।কল লিস্টে গিয়ে বুরাগ লিখে সার্চ দিলেই হয়ে যাবে।”

বেলীর মনটা কিছুটা শান্ত হয়।ফোনটা নিয়ে বেরিয়ে আসলো।খুব তাড়াতাড়িই হেঁটেই যাচ্ছে তার রুমে।বেলীর হাবভাব দেখে অনেকটাই খুশি হন আফিয়া।বেলী চলে যেতেই আবারও কাপড়চোপড় গোছাতে লেগে পড়লেন।
————————–
এতোক্ষণ বসে বসে জয়নবের মাথা যেনো অনেকটাই খারাপ হয়ে গিয়েছে।তার উপর বুরাগের ভাবলেশহীন ভাবে বসা থাকা।জয়নব অনেকটা রাগান্বিত গলায় বললো,

–“এইরকম কোলাহলের মধ্যেই বসতে নাও পারতে বুরাগ।তোমার কেবিনটাই যথেষ্ট ছিলো আমাদের দু’জনের জন্য।”

বুরাগ এখন পা’য়ের উপর পা তোলে বসলো।মুখে একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব টেনে বললো,

–“এখানে বসতে পারলে বস না হলে চলে যাও।অনেক কাজ আছে আমার।”

–“এইভাবে বলার কি আছে বুরাগ।চলে যাওয়ার জন্য তো আসি নি আমি।”

বুরাগও সাথে সাথে পাল্টা জবাবে উত্তর দিলো,

–“তোমার সাথেও সময় কাটানোর জন্য আমিও অফিসে আসি নি।”

জয়নব অনেক কষ্টে নিজেকে ঠিক রাখার চেষ্টা করছে।বুরাগের এক একটা কথা তাকে পোড়ানোর জন্য যথেষ্ট।আবারও কিছু বলতে যাবে তখনই বুরাগের ফোনটা বেজে উঠলো।তাই বাধ্য হয়ে চুপ হয়ে যায়।
ফোনের আওয়াম পেয়ে বুরাগ অনেকটাই খুশি হয়।যে ফোন দিয়েছে তাকে মনে মনে অনেকটাই ধন্যবাদ জানায়।পকেট থেকে ফোনটা বের করে ফোনের স্ক্রিনে মায়ের নাম্বার দেখে জয়নবকে কিছুটা তাড়া দিয়ে বললো,

–“আমি উঠছি।আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই জয়নবকে একপ্রকার ইগনোর করে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে আসলো বুরাগ।বুরাগের যাওয়ার দিকে জয়নব কটমট চোখে তাকিয়ে আছে।সেও রাগে উঠে চলে যায় ক্যান্টিন থেকে।

বুরাগ ফোনটা রিসিভ করে “হ্যালো” বলতে যাবে তার আগেই তাকে কেউ একজন জাপটে ধরে ফেললো।এতে বুরাগ অনেকটাই হকচকিয়ে যায়।মুখটাকে গম্ভীর করে পিছনে তাকালো।কিন্তু,পিছনে ফিরে তার ছোটবেলাকার বন্ধু রায়ান কে দেখে অনেকটাই বিস্ময় হয়ে যায়।প্রায় সাত মাস পর দেখা হয়েছে রায়ানের সাথে।ফোনটাকে ওইভাবে রেখে দিয়েছে।এমনকি ফোন আসার কথাটাই ভুলে গিয়েছে।

–“কিরে শালা!বিয়ে করে ফেললি।কপালটাই খারাপ আমার তোর বিয়েতে ছিলাম না।”

–“আগে বস!তারপর এইসব বলিস।”

বুরাগের কথায় রায়ান হেসে ফেললো।পুনরায় আবারও ক্যান্টিনের দিকে পা বাড়ালো।নিরিবিলি একটা জায়গা দেখে বসে পড়লো দু’জনে।বুরাগ কিছু খাবার অর্ডার দিয়ে রায়ানের দিকে তাকালো।রায়ান একগাল হেসে বললো,

–“বিয়ে করলি বেশ ভালো কথা।কিন্তু কপাল মন্দ আমার।তোর বিয়েতে আমি থাকতেও পারলাম না।”

–“আমি নিজেই তো প্রস্তুত ছিলাম না বিয়ের জন্য।বলতে গেলে একপ্রকার ঝড়ের মতোই বিয়ে হয়ে গেলো।”

–“এবার ভাবির ছবি দেখা।আগে ছবিতে দেখি আমাদের ভাবিকে তারপর না হয় সামনাসামনি দর্শন করে আসবো।”

রায়ানের কথায় বুরাগ অনেকটা আমতাআমতা করে বললো,

–“দোস্তো!তোর ভাবির কোনো ছবি নেই আমার কাছে।”

রায়ান একদম হাবলার মতো তাকিয়ে রইলো বুরাগের দিকে।কেন জানি কথাটা মানতে পারছে না।তাই বুরাগের কথায় বলে উঠলো,

–“তোদের বিয়ে এতোদিন হয়ে গেলো কিন্তু ভাবির একটা ছবিও নেই তোর কাছে।ব্যাপার টা কেমন জানি লাগছে আমার কাছে।”

–“তুই একটু বেশিই ভাবিস।অবশ্য ভাবারই কথা।সেই স্কুল লাইফ থেকেই তোর অনেক কিউরিসিটি।”

বলেই বুরাগ হেসে উঠলো।তবে বুরাগ হাসলেও রায়ান হাসে নি।গম্ভীর গলায় বুরাগকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“তুই কি এখনো স্নিগ্ধাকে ভালোবাসিস বুরাগ!”

বুরাগ হাসি থামিয়ে দেয়।হুট করেই রায়ানের মুখে এমন একটা কথা শুনে কথা গুলো কেমন যেনো প্যাঁচ পাকিয়ে যাচ্ছে।সেইম এইরকম অনুভূতি কালকে বেলীর প্রশ্ন শোনার পরেও হয়েছিলো।বুরাগকে কিছু বলতে না দেখে রায়ান আবারও বলে উঠলো,

–“কি হলো বল!আচ্ছা এইটা বল ভাবিকে ভালোবাসিস।”

এবারও বুরাগ চুপ।কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না।প্রশ্ন গুলো তার কাছে খুবই কঠিন মনে হচ্ছে।

–“কি হলো বল।চুপ করে আছিস কেন।”

বুরাগ নিঃশ্বাস ফেলে জবাবে বললো,

–“স্নিগ্ধাকে ভুলা আমার পক্ষে সম্ভব না।তবে তোর ভাবিকে আমি ভালোবাসি না।আর কোনোদিন ভালোবাসতে পারব কিনা তাও জানি না।

বুরাগ আর রায়ানের সব কথাই বেলীর কানে এসে পৌঁছছে।বুরাগ ফোন রিসিভ করার সাথে সাথে বেলীর মনটা ময়ূরের মতো নেচে উঠেছিলো।আপনাআপনিই ঠোঁট দুটো প্রসারিত হয়ে গিয়েছিলো।ফোনে তার সাথে কথা না বললেও বুরাগের কন্ঠস্বর টা শোনে ঠিকই ভিতরে জ্বলণ টা কমে এসেছিলো।তাই তো বেলী ফোনটা কানে চেপে রখেছিলো।কিন্তু লাস্টের কথাটা শোনার পর নিজেকে ঠিক রাখতেই কষ্ট হচ্ছে তার।ফোনটা কেটে দিয়ে বিছানার উপর ফেলে দিয়ে হাঁটুগেঁড়ে বসে পড়লো।দু’হাত দিয়ে মুখ চেপে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।
—————————————
–“করিম ভাই আপনি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন।”

করিম ভিতরে ভিতরে অনেক বিরক্ত হচ্ছে।যখনই দেখা হয় তখনই শিউলি এই প্রশ্ন টা করে থাকে।আর,করিম এই প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে একদম বিতৃষ্ণা এসে গেছে তার মধ্যে।তাও কিছুটা গম্ভীর গলায় বললো,

–“তোমারে না ভালোবাসলে কি আমি তোমার এক কথায় পান খাওয়া ছাইড়া দিতাম।তুমি কওয়ার পর থাইকাই তো আর পান খাই না।”

শিউলি মুখটাকে চোখা করে রেখেছে।কেন জানি করিমের উত্তর টায় তার মনে ভরে নি।করিম ভ্রু কুঁচকে শিউলিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

–“তোমার আবার কি হইলো।এমনে মুখটা রাখছো কেন?”

শিউলি কিছুটা অভিমানী গলায় বললো,

–“আগে বললে আপনি আমার হাত দুটো ধরে বলতেন তোমারে না ভালোবাসলে আর কারে ভালোবাসবো আমি।তুমিই আমার সব।আর আজকে কি একটা কথা বললেন!ভালোবাসার সাথে পান না খাওয়ার কি সম্পর্ক করিম ভাই।পান পানের জায়গায় আর ভালোবাসা ভালোবাসার জায়গায়।”

করিমের যেনো রাগে নিজের চুল ছিড়তে ইচ্ছা করছে।মনে মনে ভাবছে কেনই যে ওর সাথে প্রেমের অভিনয় করতে গেলাম।কিছুক্ষণ পরেই এইসব ভাবনা দূরে সরিয়ে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,

–“আগে আমারে ভাই কওয়া বাদ দাও।জামাইরে কেউ ভাই কয় নাকি।পরের বার থাইকা আর ভাই কইও না বুঝবার পারছো শিউলি ফুল।”

শিউলি লজ্জায় নেতিয়ে যায় একদম লজ্জাবতী গাছের মতো।মাথাটা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে।করিম শিউলির দিকে কামনার একটা হাসি টেনে বললো,

–“এহনই এতো লজ্জা তোমার শিউলি ফুল।বিয়ার পর কি হইবো তাহলে।”

শিউলি যেনো লজ্জায় আরো নেতিয়ে যাচ্ছে।করিম শিউলির আড়ালে মুখটাকে কঠিন করে একটা নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
—————————————
শোয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে বেলী।পাশেই বুরাগ সোজা হয়ে শুয়ে আছে আর পা দুটো নাড়াচ্ছে।অফিস থেকে আসার পর বুরাগ ভেবেছিলো বেলীর উপর কিছুটা রাগ দেখাবে কিন্তু বেলীর মায়াবী মুখটা দেখে রাগ যেনো হাওয়াই মিঠার মতো উধাও হয়ে গিয়েছে।বেলী কিছুই বলে নি।শুধু নিজের মতো করে বাকি কাজ গুলো করে গিয়েছে।এমনকি বুরাগের দিকেও তাকায়নি।ভিতরে ভিতরে সে ঠিকই পুড়েছে কিন্তু বাহিরে পোড়ার গন্ধ আসতে দেয় নি।বেলী আয়নার সামনে বসে বিনুনি টা শেষ করে রাবার পেঁচিয়ে বিছানার কাছে এগিয়ে গেলো।বুরাগের থেকে কিছুটা দূরত্বে বালিশ টা নিয়ে শুয়ে পড়লো।
বুরাগ এতোক্ষণ আঁড়চোখে বেলীর কাজ গুলোই পর্যবেক্ষণ করছিলো।বেলীর চুপ থাকাটা যেনো কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না।

চোখ বন্ধ করে রেখেছে বেলী।আর বুরাগের কথাগুলো বারবার আওড়াচ্ছে।আরো বেশি কষ্ট দিচ্ছে বুরাগ যখন বলেছিলো আর কোনোদিনও তাকে ভালোবাসতে পারবে কি না।নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে এইসব ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে বেলী।কিন্তু,ভাবনা গুলো যেন তাকে কিছুতেই ছাড়তে চাইছে না।

বুরাগের খুব ইচ্ছা করে বেলীর কাছে যেতে।বেলীর চুপ থাকাটা তার কিছুতেই ভালো লাগছে না।তাই আর কোনো কিছু না ভেবেই বেলীর হাত টা ধরে নিজের কাছে নিয়ে আসে।বেলীর উপর নিজের শরীরের অর্ধেকাংশ ভর ছেড়ে দিলো।

বেলী ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বুরাগের দিকে।এইরকম কিছুর জন্যই সে প্রস্তুত ছিলো না।বেলীর চাহনি পর্যবেক্ষণ করে বুরাগ মুচকি হেসে দিলো।আচমকাই বেলীর গলার ভাজে মুখ লুকিয়ে ফেললো।বেলীর সারা শরীর শিরশির করে উঠলো।একটু পরেই বেলী অনুভব করতে লাগলো বুরাগ তাকে ভিজা ঠোঁটের চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে।বেলী ঠোঁট কামড়ে এসব সহ্য করে নিচ্ছে।চোখে তার পানিতে টলমল করছে।যেকোনো মুহূর্তে গড়িয়ে পড়বে।বুরাগ বেলীকে নিজের ইচ্ছামতো চুমুতে ভরিয়ে দিতে লাগলো।বেলীকে কাছে পাওয়ার আকাঙ্খায় বুরাগ গলা থেকে একটু নিচে নেমো এলো।বুকের মাঝামাঝি আসতেই বেলী আর না পেরে শব্দ করে কেঁদে উঠলো।বুরাগের প্রতিটি স্পর্শই বেলীর কাছে খুব খারাপ লাগছে।বুরাগের কাছে থাকতে তার দমবন্ধ হয়ে আসছে।

বেলীর কান্নার আওয়াজে বুরাগ মাথা তোলে তাকালো।হুট করে বেলীর কান্নাটা কিছুতেই বোধগম্য হচ্ছে না তার।বেলীকে কান্না করতে দেখে বুরাগ অনেকটাই অস্থিরতা হয়ে পড়লো।বেলীর গালে হাত রেখে বললো,

–“কি হয়েছে বেলী।কান্না করছো কেন?”

বেলী কিছু বলে না।বরং,আগের থেকে কান্নার প্রকোপ টা বেড়ে গিয়েছে।বুরাগ বেলীর উত্তরের অপেক্ষায় না থাকে বেলীকে জড়িয়ে ধরলো।বেলী এখনো কান্না করে যাচ্ছে।বুরাগ যত্ন করে বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

বেলীর কাছে সবই কেমন ধোঁয়াশা লাগছে।বুরাগের বুকে মাথা রাখলেও তার কষ্ট কমে নি।আরো বেড়ে যাচ্ছে।তাই বেলী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো,”আর কিছুতেই এইখানে থাকবে না সে।বুরাগের সাথে তো আর কিছুতেই থাকতে পারবে না।নিজেকে কষ্ট করে হলেও সামলিয়ে নিবে।যেখানে ভালোবাসা নেই সেখানে আর না থাকাই শ্রেয়।সে বুরাগের ভালোবাসা চায় কোনো শারীরিক সম্পর্ক চায় না।শারীরিক সম্পর্ক কখনো সুখী করতে পারে না যদি না ভালোবাসা থাকে।”

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here