#উমা [কপি করা নিষেধ]
১১তম_পর্ব
হাটুগেড়ে নির্বিকারভাবেই বসে রয়েছে উমা। আশা নামক এক চিলতে কিরণও উদয় হচ্ছে না তার বুকে। হয়ত এভাবেই অন্ধকার গহ্বরে থেকে যাবে চিরকাল। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে। প্রতিবাদ নামক শব্দটা অর্থহীন মনে হচ্ছে। চোখ বুজে আসছে অচিরেই। হয়তো মৃত্যু দ্বারে এসেছে। উমার আক্ষেপ নেই, সে মরতে চায়, তার মুক্তি চাই। হঠাৎ পুরোনো কাঠের দরজাটা খুলে গেলো, দরজা খোলার শব্দে কেঁপে উঠলো উমা। অন্ধকার ঘরে এক চিলতে হলুদ আলো প্রবেশ করলো। বাগানের হলুদ আলো, সন্ধ্যে হয়ে গেছে। না, হয়তো রাত নাকি গভীর রাত। ঠিক সময়টা ঠাহর করতে পারলো না উমা। তার চোখজোড়া কুঞ্চিত হয়ে এলো আলোর তীক্ষ্ণতায়। তাই সামনে প্রবেশকৃত মানুষটার দিকেও ঠিক মতো তাকাতে পারলো না সে। একটা কালো অবয়ব প্রবেশ করলো দরজা দিয়ে। উমার দৃষ্টি যেনো ঝাপসা হয়ে এসেছে। ভয়, ত্রাশ, বিষাদ, বেদনার সংমিশ্রন তাকে শারিরীক ভাবে দূর্বল করে দিয়েছে, হাতটা ফুলে উঠেছে। কাঁচগুলো চামড়ায় বিধে আছে। চিনচিনে ব্যাথাটা অসহনীয় যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। মানুষটি যখন তার সন্নিকটে এলো তখন একরাশ ঘৃণায় বিষিয়ে এলো মন। মুখ সরিয়ে নিলো পরমূহুর্তে। ঘৃণা করে এই মানুষটাকে। উমার বিষন্ন, বিমর্ষ মুখখানা দেখে ছ্যাৎ করে উঠে রুদের মনটা। এক তীব্র যন্ত্রণা অনুভূত হয় তার। বিকেলের সময় রাগে ক্রোধে অন্ধ হয়েছিলো। তাই তার চোখে ষোড়শীর যন্ত্রণা, বেদনা। নজরে এলে হয়তো এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারতো না। অবশ্য রুদ্রের কাছে নিজের কাজের যথার্থ যুক্তি আছে। সে কোনো ভুল কার্য করে নি। রতী এবং নিখিল মিলে উমার সরলতার সুযোগ নিচ্ছে আর উমা সেটাও বুঝতে পারছে না। উপরন্তু তখন মাথা গরম ছিল তার, উমার অপমানটা তার সহ্য হয় নি। হবেই বা কেনো? যে রুদ্রকে অপমান করার সাহস সারা গ্রামের কারোর নেই। অথচ সেই উমা তাকে অপমান করেছে। উমার জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো খুন ই করে ফেলতো সে। উমাকে
সবচেয়ে হালকা শাস্তি দিয়েছে।
রুদ্র হাটু গেড়ে বসলো উমার সামনে। আলতো হাতে মুখটা ধরতে নিলেই মুখ ফিরিয়ে নেয় উমা। উমার চোখে নিজের প্রতি ভয় এবং ঘৃণাটা যেনো সহ্য হলো না রুদ্রের। এই ভয়টাই দেখতে চেয়েছিলো সে, কিন্তু সেই ভয়টার সাথে ঘৃণার ছাপ থাকবে সেটা কল্পনা করে নি। অবাককর ব্যাপার এই ঘৃণা তাকে আহত করছে। বুকের মাঝে হাজারো সুই চুবছে যেনো। যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে মুখটা চেপে ধরলো তার। রুদ্র হিনহিনে স্বরে বললো,
“তেজ দেখি কমে নি?ভয় লাগছে না?”
“মৃত মানুষের ভয় থাকে না।“
অস্ফূটস্বরে কথাটা বলে উমা। পরমূহুর্তেই তার দৃষ্টি ক্রমশ আধারে ঢেকে গেল। নিস্তেজ শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। উমার মনে হলো ক্রমশ অন্ধকারের প্রবল গহ্বরে ডুবে যাচ্ছে সে। বাঁচানোর কেউ নেই______________
উমার যখন চোখ খুললো তখন নিজেকে রুদ্রের ঘরে আবিষ্কার করলো সে। চোখ খুলতেই আলোর তীব্রতা চোখে জ্বলছে দিচ্ছে। নিজেকে ধাতস্থ করতে বেশ সময় লাগলো উমার। সে অনুভব করলো হাতটা নাড়াতে পারছে না। চিনচিনে ব্যাথাটা প্রচন্ড রুপ নিলো। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে দেখতেই রুদ্রকে নজরে এলো। উমার স্বাভাবিক দৃষ্টিতেই তাকালো তার দিকে। প্রচন্ড শান্ত দৃষ্টি, যে দৃষ্টিতে নেই কোন রাগ, নেই কোনো দুঃখ, শুধু সুপ্ত ঘৃণা। উমার চোখ খুলতে দেখে এগিয়ে এলো রুদ্র, অস্থির কন্ঠে বললো,
“এখন কেমন লাগছে? দূর্বল লাগছে?”
রুদ্রের অস্থিরতার কারণ বুঝলো না উমা। শুধু অবাক হলো। এই কি সেই ব্যক্তি যে তাকে অন্ধকার রুমে, বিনা খাবার বিনা পানিতে রেখেছিলো? এই কি সে যে তার আর্তনাদ শুনেও না শোনা করে দিয়েছিলো। মানুষ সত্যি পেয়াজের মতো, প্রতি পরদে তার রুপ বদলায়। উমার বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো। কোনো উত্তর দিলো না উমা। ইচ্ছে হলো না। নীরবে রুদ্রের পরিবর্তনীইয় রুপ দেখে গেলো সে।
অভিনব সিংহ ফিরলেন শহর থেকে। অবশেষে নিপুন ভাবে সকল কাজ শেষ হলো তার। তার কাজ করার ধরণই আলাদা। একবার কোনো কাজ করতে বসলে সেই কাজের সমাপ্তি না করে শান্ত হয় না সে। গ্রামের চেয়ারম্যান হলেও তার দৌড় গ্রামের পৌরসভায় সীমাবদ্ধ নয়। সে সাতক্ষীরার উচ্চপদস্থ লোকদের সাথে উঠাবসা করেন। সেই বদৌলতে খুব সহজে তার কাজগুলো হয়। অভিনব সিংহ ফিরেই নিজের ছেলেকে ঘরে ডাকলেন। রুদ্র উপস্থিত হতেই খবরের কাগজ ভাঁজ করতে করতে বললেন,
“আমি সব করে এসেছি। এমন ভুল আর যেনো না হয়। কথাটা কি কানে গেলো?”
“জ্বী বাবা, আর হবে না”
নতমস্তকে কথাটা বলল রুদ্র। অভিনব সিংহ পাইপ জ্বালালেন। জমিদার রক্তে পাইপ খাওয়ার অভ্যাসটা রয়েই গেছে। একটা টান দিয়ে বললেন,
“এখানের কি অবস্থা? আমি যাওয়ার পর কোনো কান্ড করো নি তো?”
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ রইলো। বাবার সাথে কথা বলতে সর্বদা একটু অস্বস্থি লাগে তার। উপরন্তু সে এখানে অনেক কিছুই করেছে। বাবা ব্যাপারগুলোকে ঠিক কিভাবে নিবে বুঝতে পারছে না। রুদ্রের দিকে ভ্রু উঁচিয়ে তাকালেন অভিনব সিংহ। ঝাঝালো স্বরে বললেন,
“কি হলো?”
“কিছুই হয় নি বাবা, চিন্তা করবেন না”
“সামনে সপ্তাহে মাল আসছে। বেনাপুলে যেতে হবে। যাবে তুমি”
“আমি কেনো বাবা?”
“আমার একটু গ্রামে থাকা দরকার। মাস্টার জট পাকালো কিনা দেখতে হবে না? এমনেই তোমার জন্য কতগুলো দিন আমার শহরে থাকতে হলো। কেনো কোনো সমস্যা?”
রুদ্র তড়িৎ গতিতে উত্তর দিলো,
“না বাবা, কোনো সমস্যা নেই। আমি কি যেতে পারি?”
“হু”
রুদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। বের হবার সময়েই অভিনব বাবু বলে উঠলেন,
“বউ তোমার একা না, বউনেটা হয়ো না। ক্ষতি তোমার, তুমি জানো আমার দূর্বলতা পছন্দ নয়। বেশি দুর্বল দেখলে গোড়া থেকেই উপড়ে দিবো”
অভিনব সিংহের কথাটা বুঝতে দেরী হলো না রুদ্রের, সে তাকে ধীর স্বরে বুঝিয়ে দিলেন সময় আসলে উমাকে সরিয়ে দিতে সময় নিবেন না তিনি। অর্থাৎ এখানে কি হয়েছে সকল খবর তিনি পেয়েছেন। রুদ্র উত্তর দিলো না। চুপ করে বেড়িয়ে গেলো।
রান্নাবান্না সেরে নিজ ঘরে ফিরলো উমা। ঘামে গা ভিজে গিয়েছে তার। তুলোর মতো ওজনের মেয়েটি সারাদিন হেসেলেই থাকে। নিখিলের বাড়ি থেকে এই বাড়ির একটা পার্থক্য, এখানে দামী খাবার আর পোষাক জোটে। পুরো স্পিডে ফ্যান চালালো সে। ভাগ্যিস বিদ্যুৎ আছে। খাটে বসে একটু জিরিয়ে নিতে যাবে তখনই…………………
চলবে
[ ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে দিবো।]
মুশফিকা রহমান মৈথি
১০ম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/419098696478575/