#উমা [কপি করা নিষেধ]
২য়_পর্ব
এরই মাঝে হট্টগোল শোনা গেলো। বাহিরে গোল লেগেছে। রতী দেবী ছুটে গেলেম বাহিরে। এর মাঝেই উমার কানে এলো,
“পুলিশ এসেছে, বিয়ে এবার বন্ধ।”
কথাটা শুনতেই বুক চিরে স্বস্তির এক দীর্ঘশ্বাস বের হয় উমার। সত্যি কি বিয়েটা বন্ধ! সে কি তবে মুক্ত হতে পেরেছে। এক আকাশ সমান আশার বীজ উঁকি দিলো ষোড়শী উমার মনে। কিশোরীর মনের এই ইচ্ছাটা খুব নিপুণ ভাবেই আড়াল করলো সে। নিজের ঘরের পশ্চিমের জানালা দিয়ে নজর দিলো আঙ্গিনায়। পুলিশ সত্যি এসেছে। শুধু তাই নয়, এক যুবকের কন্ঠও শোনা যাচ্ছে। বেশ সুমধুর কন্ঠ, কিন্তু বেশ জোড়ালো। সে সরাসরি অভিনব সিংহের সাথে তর্ক জুড়ে দিয়েছে,
“একজন নাবালিকার বিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন কি ভেবে মামা মশাই? বিয়েটা কি ছেলে খেলা? রুদ্র মাতাল অবস্থায় সিঁদুর পড়িয়েছে! এই সিঁদুরের কি মূল্য? না মন্ত্রপাঠ, না কোনো রীতির বালাই! অহেতুক আপনাদের অজ্ঞতার জন্য একটা নিস্পাপ পেয়ের জীবনটা বিষিয়ে যাবে!”
“বড্ড বেশি কথা হচ্ছে না শাশ্বত? তুমি ভুলে যেও না দুখানা বই পড়ে কেউ বিদ্যাধারী ঈশ্বরচন্দ্র হতে পারে না।”
যুবকের নাম শাশ্বত চ্যাটার্জি। রাজধানীর নামী পত্রিকার সাংবাদিক সে। হ্যা এটা ঠিক, তাকে মানুষ অনেক অংশে এই অভিনব সিংহ ই করেছেন। শাশ্বত এর মা মালিনী দেবী অভিনব সিংহের একমাত্র বোন। বোনের প্রতি তার দরদ একটু বেশি হবার জন্য তিনি বিধবা হবার পর তার সংসারে কিছু টাকা দিতেন। সেভাবেই শাশ্বতের আজ শিক্ষিত হওয়া। কিন্তু এতো দুধকলা দিয়ে এতো দিন কালসাপ পোষার মতো হাল হলো, যারটা খেলো তাকেই ফোস করছে। শাশ্বতকে সাংবাদিক করার উদ্দেশ্য ছিলো যেতো অভিনব সিংহের ঢাল হতে পারে। কম চোরা কারবারি তো করে না সে। কিন্তু শাশ্বত হয়েছে একেবারেই বিপরীত। সৎ মানুষ প্রচন্ড ভয়ংকর, সে অন্যায়কে ভয় না পেলেও অন্যায় তাকে ঠিক পায়। রুদ্রও খুব ভয় পায় তাকে। এই পুজোর কটা দিন যখন গ্রামে থাকে সে রুদ্র এবং অভিনব সিংহের মনে ত্রাস জন্মায়। তাদের প্রতিটা কদম বেশ মেপে চলতে হয়। নয়তো শাশ্বত কথা বলা ছাড়ে না। এই কদিন বেশ ক’বার মামাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলো শাশ্বত। কিন্তু লাভ হলো না, উলটো মা মালিনী দেবী ছেলেকে গালমন্দ করলেন। কিন্তু আজ যখন অবিচার সীমা ছাড়াচ্ছে তখন আর থেমে থাকতে পারলো না শাশ্বত। সরাসরি পুলিশ নিয়েই হাজির। প্রথমে পুলিশ একটু টু টা করছিলো বটেই কিন্তু সাংবাদিক ট্যাগটা খুব কাজের। অমনেই বাধ্য হয়ে পদ বাঁচাতে এখানে ছুটে আসা। শাশ্বত কঠিন স্বরে অভিনব সিংহকে বললো,
“এ অন্যায় করবেন না, মামা মশাই। সিঁদুর দিয়েছে বিয়ে হয় নি। একটা বাচ্চা মেয়ের জীবন, সে একটা মানুষ। তাকে নিয়ে এভাবে খেলবেন না।”
শাশ্বত এর কথায় সায় মেলালো রকিবুল মাস্টার। জোড়ালো স্বরে বললো,
“অভিনব সাহেব, আপনার ছেলে ভুল করেছে। মাতাল ছিলো, সিঁদুর পড়ালে বিয়ে হলে তো সিনেমার সবাই বিবাহিত থাকতো। মেয়েটা মাত্র ষোল বছর, তার সামনে অদূর ভবিষ্যৎ। সে পড়াশোনায় বেশ ভালো। হয়তো একটু চেষ্টা করলে আরোও ভালো হবে। এই বিয়েটা দিবেন না। একাবিংশ শতাব্দীতে এসে এখন এই মতবাদ আমরা ছাড়ি। এ অন্যায়।”
“ন্যায় অন্যায় কি তুমি শিখাবে আমায়! জানো তো না কচু। আইনে মেয়ের বয়স ষোল হয় নি। কিন্তু মেয়ের বয়স ষোল হয়ে গিয়েছে। মেয়ের বাবা বলেছে। স্কুল কলেজে একটু কমিয়ে দেওয়া হয়। এ আমরা সবাই জানি। জন্ম নিবন্ধন কি তবে ভুল? আর সিঁদুর দান কি ছেলে মানুষী! বাপু বিয়ে খেতে এসেছো খাও। অহেতুক বাগড়া দিচ্ছো কেনো?”
অভিনব সিংহের চ্যালা বাবুল বলে উঠে এই কথা। রকিবুল মাস্টার দমেন। কিন্তু শাশ্বত দমার পাত্র নয়। সে বলে উঠে,
“একটা ভুলকে হাওয়া দিলে সেই ভুল চরম পর্যায়ে চলে যায়৷ রুদ্র কেমন গ্রামের কারোর অজানা নয় তাই সে ভুল করেছে। তখন তার হুশ ছিলো না, আমরা সেই ভুলটাকে কেনো হাওয়া দিবো? সিঁদুর দান বেশ মূল্যবান মানছি, কিন্তু রুদ্র মাতাল ছিলো। আইন এ বিয়ে মানে না। সই সাক্ষর হয় নি, মন্ত্রপাঠ হয় নি, না হয়েছে সাত পাক। তবে কিসের জন্য একটা মরীচিকার পেছনে ছুটবেন মামা। এমনটা করবেন না।”
এবার অভিনব সিংহ পুনরায় মুখ খুললেন। তিনি নিখিল বাবু এবং রতীকে ডাকলেন। কড়া স্বরে বললেন,
“নিখিল মেয়ে তোমার, এবার সিদ্ধান্ত তোমার। এই গ্রামে এমন অনেক মেয়ে রয়েছে যার বিয়ে ষোল বছরে হয়। আর বাংলাদেশে কত মেয়ের বিয়ে স্কুল পাশ করে হয় তা তো তোমাদের জানাই আছে। এমন অনেক মেয়ের বাচ্চাও আছে। আর আমার ছেলের বউ হওয়া তোমার মেয়ের ভাগ্য। এবার সিদ্ধান্ত তোমার।”
নিখিল বাবু শুকনো ঢোক গিললেন। এখন হয় করো নয় মরো। শাশ্বত গ্রামে আর ক দিন, এর পর সে পাড়ি দিবে ঢাকা। তাই তার ভরসায় বসে থাকা অত্যন্ত বোকামী। আর রকিবুল মাস্টার, সে তো বাবুলের কথায় দমে যায়। সে কি পারবে চেয়ারম্যানের সাথে টক্করে! সে এই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না। চেয়ারম্যানের পুত্রকে ফিরিয়ে দিলে সেটা হবে অভিনব সিংহের অপমান। অভিনব সিংহ কি মানবেন? জীবনটা ঝাঝড়া হয়ে যাবে তার পরিবারের। রতী তার পেটে কেনো দিয়ে স্বর খাঁদে নামিয়ে বলে,
“কি ভাবছো! এই গ্রামে তোমার থাকতে হবে। ভুলে যেও না আমাদের আরেকটি মেয়ে আছে। চেয়ারম্যানের সম্বন্ধী মানে আমাদের ই লাভ”
নিখিল বাবু শুকনো গলায় বললেন,
“আমার মেয়ের জন্ম ১৯৮৬ তে। এখন সাল ২০০৪ সেই অনুযায়ী এখন তার বয়স আঠারো। তাই মেয়ে আমার সাবালিকা। আর রুদ্র ছেলেটা খারাপ না, একটু আধটু বেওয়ারা পুরুষ মানুষ হয় ই। বিয়ে হলে শুধরে যাবে। দারোগা সাহেব আপনি আসতে পারেন। বিয়েটা রুদ্রের সাথেই হবে।”
“তবে থাকে ডাকা হোক। সে যেহেতু প্রাপ্তবয়স্ক, তার মতামতের একটা দাম তো আছে।”
“আমার মেয়ের মতামত আছে বিয়েতে।”
অভিনব সিংহের মুখে প্রশান্তির হাসি। নিখিল তাই করেছে যা সে চেয়েছে। এদিকে রুদ্র হাসছে, হাসছে নিজের জিতের জন্য নয় বরং শাশ্বতের হারের উপর। শাশ্বতকে কোনো কালে তার পছন্দ নয়। ছেলেটা অতিরিক্ত সাধুপনা দেখায়। বড্ড এসেছিলো তার বিয়ে ভাঙ্গতে। পরাজিত শাশ্বত চেষ্টা করতে গেলে রতী দেবী তীক্ষ্ণ স্বরে বললেন,
“বাছা, মেয়ে আমার। ভালোমন্দ বোঝার জ্ঞান তো আছে নাকি। তুমি কটা বই গিলে নিজেকে কি ভাবছো বলো দেখি! শোনো, শুভ কাজে ব্যাঘরা দিতে নেই। অতিথি মানুষ, দুটো খেয়ে যেও।”
উমা মেয়েটাকে না দেখেই তার জন্য করুনা হচ্ছে শাশ্বতের। পৃথিবী কোথায় এসে ঠেকেছে সেখানে ক্ষমতার কাছে ন্যায়কে মাথা নত করতে হচ্ছে! কোথায় গিয়েছে তাদের চিন্তাধারা! মনে মনে বললো,
“বিবেক ধ্বংসস্তুপ, তবুও বড়াই করি আমরা মানুষ”
আঙ্গিনার ঘটনাগুলো কাতর চোখে দেখলো উমা। বিষাদের নীল বিষ বুকটাকে জ্বালিয়ে ফেলছে। সদ্য উদ্দীপ্ত আশার কিরণটা ধপ করে নিভে গেলো। তাকে এই জঞ্জাল থেকে মুক্ত করার কেউ নেই! সত্যি কেউ ই নেই! কেউ সত্যি বলেছে,
“জীবনের গল্পের রাজকন্যাদের সাদা ঘোড়ায় চড়া রাজকুমার বাঁচাতে আসে না, তাদের নিয়তির টানাপোড়েন হয় নিজেদেরকেই দূর করতে হয় নয় তারা এই জঞ্জালে আটকে থাকে চিরটাকাল”
উমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিয়তি কঠিন হলে তাকেও কঠিন হতে হবে! সিংহরায় বাড়িতে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। ভয় পেলে কাপুরুষ হয়ে যাবে সে। সব কিছুর মোকাবিলা করে টিকে থাকাটা বীরত্ব। উমা কাপুরুষ নয়। সে বীরঙ্গণা হতে চায়! তার জীবনের গল্পটায় এক নতুন অধ্যায় শুরু হচ্ছে। দেখা যাক অদূর ভবিষ্যৎ তার জন্য কি লিখে রেখেছে বিধাতা!
বিয়েটা হলো, বিয়েটা হলো তার সঠিক লগ্নে। মন্ত্রপাঠ হলো, রীতি মানা হলো, সাত পাক ও হলো। অগ্নিকুন্ডের সামনে বসে রইলো স্তব্দ উমা। চোখ বেয়ে জল গড়াচ্ছে কিন্তু অগ্নির তাপে তা বোঝা যাচ্ছে না। টোপর মাথায় মানুষটার দিকে এক দফা তাকাতেও ইচ্ছে হলো না তার। তাকিয়ে বা কি হবে! শারীরিক সৌন্দর্য কি সব কিছু! যে মানুষের মনটাই ধরা ছোয়ায় বাহিরে তার দিকে তাকিয়ে কি বা হবে। আগুনটা জ্বলছে, দাও দাও করে। উমার ভেতরটাও জ্বলছে। “মেয়েদের এতো কষ্ট কেনো?”
প্রশ্নটা তাকে ভাবাচ্ছে, তাদের মুখ থাকতেও তারা বলার অধিকার পাচ্ছে না। উমারা কি এভাবে অত্যাচারিত হবে এই পৃথিবীতে। অজ্ঞতা, মূর্খতা এভাবেই কি তাদের শিকলে জড়াবে! তাদের মুক্তি কবে হবে! স্রষ্টা নারীদের বানিয়েছেন অসীম ধৈর্য দিয়ে। তাই তো এই রুদ্র এবং অভিনব সিংহের মতো মানুষেরা তাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা নেয়। তার উমা আড় চোখে নিখিলের দিকে চাইলো। নিজের বাবাকে তার কাছে পোকার নেয় মনে হলো। শিরদাঁড়াহীন পোকা। যাদের ক্ষমতার সামনে নত হওয়াটাই স্বভাব। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো আবার। তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটের কোনে উদ্দীপ্ত হলো। তাচ্ছিল্য এই সমাজের প্রতি।
পকেটে হাত গুজে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকলো শাশ্বত। তার গাটা রাগে কাঁপছে। সে চেয়েও মেয়েটিকে বাঁচাতে পারলো না। এমন কতো উমারা আমাদের সমাজে রয়েছে, যাদের জীবন পিষিয়ে দেয় সমাজে অধিক জ্ঞানী মানুষেরা। যাদের মতামত টুকু নেওয়া হয় না। তাদের বাবা মাই তাদের বিয়ে দেন। সেটাই হয় তাদের ভাগ্য। রকিবুল মাষ্টার এসে দাঁড়ালো তার পাশে। করুন স্বরে বললো,
“তোমার মামার সাথে কেউ পারে না শাশ্বত। হেরে গেলে তো। নিখিল ভয় পেয়েছে। দারোগার কাছে তার কথাই শেষ কথা। উমার জন্য কষ্টই হচ্ছে৷ মেয়েটা বড্ড সরল। কিন্তু আমাদের হাতে কিছুই নেই। তোমার প্রসার বাড়ছে, টাকা বাড়ছে। সব কালো টাকা।”
কালো টাকা শুনতেই শাশ্বতের দৃষ্টি যায় রকিবুল মাষ্টারের দিকে। রকিবুল মাষ্টার ধীর স্বরে বলে,
“তোমার মামা ততটা সাধু নন যা সবাই দেখে………
চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে দিবো।]
মুশফিকা রহমান মৈথি
১ম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/412110257177419/