#উমা [কপি করা নিষেধ]
৪৩তম_পর্ব
উমার গাড়ি চলছে আপন গতিতে। রুদ্রের কড়া নির্দেশ গাড়ির গতি ধীর রাখতে। উমার যেনো কোনো অসুবিধা না হয়। উমার নজর বাহিরের দিকে। হাতখানা নিজের পেটের উপর। কেউ একজন প্রতিনিয়ত তার মাঝেই বাস করছে ভাবতেই ভালো লাগছে তার। হঠাৎ ক্রমশ জোড়ে ব্রেক কষলো গাড়ি চালক প্রদ্যুত। উমা নিজেকে কোনো মতে সামলালো। ভয়ার্ত কন্ঠে উমা জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে প্রদ্যুত দা? ব্রেক করলে যে!”
“বৌমনি, কেউ গাড়ির সামনে চলে এসেছে। আপনি থাকুন আমি দেখছি।”
বলেই বাইরে বের হলো প্রদ্যুত। গাড়ির সামনে লোকের ভিড় জমেছে। মানুষের গোল শোনা যাচ্ছে। উমার বুক কাঁপছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে ভয়ে। আর বসে থাকতে পারলো না সে। বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে বের হলো সে। ভিড় ঠেলে যে দৃশ্য চোখে পড়লো তা হাত পায়ে হিম ধরিয়ে দিলো উমার, তার গাড়ির সামনে রক্তাক্ত একজন লোক পড়ে আছে অবচেতন অবস্থায়। লোকটির ঠোঁট চিরে রক্ত জমাট বেধে রয়েছে। ময়লা একটি শার্ট তার হায়ে জড়ানো। প্রচন্ড নিষ্ঠুরতার সাথে তাকে আঘাত করা হয়েছে। তার সারা অঙ্গের দাগ দেখে শিহরিত হয়ে গেলো উমা। কম্পিত স্বরে বললো,
“প্রদ্যুত দা, উনাকে হাসপাতালে নেবার ব্যাবস্থা করুন। উনার অবস্থা তো করুন”
“কিন্তু বউ মনি আপনার এই অবস্থায় বাড়ি যাওয়া বেশি জরুরি।”
“আপনি কি পাগল হলেন নাকি! উনার রক্তক্ষরণ দেখুন, উনাকে হাসপাতালে না দিলে মৃত্যু ও হতে পারে। আমি ঠিক আছি, প্রদ্যুত দা। আপনি উনাকে গাড়িতে তুলুন। আমরা এখন ই হাসপাতালে যাচ্ছি।”
উমার জড়তাহীন স্পষ্ট কথার বিপরীতে যুক্তি দাঁড় করাতে পারলো না প্রদ্যুত। বাধ্য হয়ে তাকে রক্তাক্ত মানুষটিকে গাড়িতে তুলতে হলো। গাড়ি যাত্রা করলো হাসপাতালের দিকে।
উমা হাসপাতালে পৌছালো তখন সূর্য ঢেলে পড়েছে পশ্চিম গগণে। লোকটির অবস্থায় বেগতিক অবস্থা দেখে অতিসত্বর তাকে ভর্তি করানো হলো। উমার ভেতরটা ঠান্ডা হয়ে আসছে। লোকটাকে হয়তো কেউ বেঁধে রেখেছিলো। ছুট পেয়ে প্রাণ বাঁচাতে ছুটেছে সে। তার মাঝেই উমার গাড়ির সামনে পড়ে গিয়েছে সে। আতঙ্কে অচেতন হয়ে গিয়েছে লোকটি৷ উমা বারান্দায় বসে রয়েছে। প্রদ্যুত ধীর স্বরে বললো,
“বাড়ি যাবেন না?”
“ডাক্তারের সাথে কথা না বলে যাওয়াটা ঠিক হবে না।”
“রুদ্র দাদা চটবেন যে, সন্ধ্যে হয়ে এলো। আপনাকে সন্ধ্যের আগে বাড়ি নিয়ে যেতে বলেছেন”
“একজন মানুষের প্রাণের চেয়ে কি আপনার রুদ্রদার মনরক্ষা করা বেশি জরুরী?”
“কিন্তু…”
উমার মুখশ্রী বিরক্তিতে ভরে এলো। সরু তীক্ষ্ণ চাহনী প্রয়োগ করলো সে প্রদ্যুতের প্রতি। প্রদ্যুত তার তীক্ষ্ণ চাহনীতে মাথা নামিয়ে নিলো। সে মনে মনে ঠিক করলো রুদ্রকে ফোনে জানিয়ে দিবে। এদিকে উমা অপেক্ষা করতে লাগলো কখন ডাক্তার বের হবে। লোকটিকে কেনো যেনো খুব পরিচিত লাগছে উমার কাছে। কোথাও তো দেখেছে কিন্তু মনে পড়ছে না। এর ই মাঝে ডাক্তার বেড়িয়ে এলো। উমা এগিয়ে যেয়ে জিজ্ঞেস করে,
“উনি কেমন আছেন?”
“রোগীর অবস্থা ভালো নেই। কতোদিন না খেয়ে আছেন ঠিক বলতে পারছি না। এক্স রে করিয়েছি, পাজরের হাড় ভেঙ্গে গিয়েছে। ভেতরে রক্তক্ষরণ হবার সম্ভাবনাও রয়েছে। উনি যে বেঁচে আছে এই ভাগ্য। উনাকে কোথায় পেয়েছেন বলুন তো? এতো অমানুষের মতো কেউ মারে মানুষকে! এ পুরোই পুলিশ কেস”
ডাক্তারের কথায় চিন্তিত উমা জিজ্ঞেস করে,
“বেঁচে যাবেন তো?”
“বলতে পারছি না। তবে এটা পুলিশ কেস, আপনি পুলিশে একটা খবর দিন। এমন হতেই পারে উনি এতোকাল গুম ছিলেন৷ কেউ তাকে মারতে চাইছে, হতেই পারে তারা আবার লোকটির উপর হামলা করবে। বুঝতে পারছেন? কোনো চান্স নেওয়া উচিত হবে না।”
উমা মাথা নাড়ালো। ডাক্তার চলে গেলে উমা একবার ওয়ার্ড এ লোকটিকে দেখে এলো। লোকটির মুখে অক্সিজেন মাক্স লাগানো, বুকটা হাপড়ের মতো উঠানামা করছে। সারা গায়ে ব্যান্ডেজের সাদা পট্টি। উমার দীর্ঘশ্বাস ফেললো। লোকটির করুন পরিণতি তাকে বিচলিত করছে। ভাবাচ্ছে বারংবার। উমা ওয়ার্ড থেকে বের হয়ে করিডোর দিয়ে হাটতে লাগলো। প্রদ্যুতকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো গাড়িতে গিয়ে বসেছে। তাই উমা সেদিকে খেয়াল না করে সামনে হাটতে লাগলো। লোকটাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে, লোকটির বেঁচে থাকা জরুরী। নয়তো কখনোই জানা যাবে না তার সাথে এমন অমানবিক নিষ্ঠুর কাজটি কে করেছে। এর মাঝেই তার ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের স্ক্রিনে তাকাতেই “রুদ্র” নামটি ভেসে উঠলো। উমার বুঝতে বাকি রইলো না প্রদ্যুত কেনো তার জন্য অপেক্ষা করে নি। উমা ফোন ধরতেই অপর পাশ থেকে থমথমে কন্ঠে কানে এলো,
“তুমি এখন কোথায়?”
“হাসপাতালে”
“তোমার তো হাসপাতালে থাকার কথা নয়!”
“অদ্ভুত একটা ঘটনা ঘটেছে, তাই আসতে হয়েছে।”
রুদ্র কিছুসময় চুপ থেকে বললো,
“তোমার কবে বুদ্ধি হবে বলতো? ভোটের সময় ঘনিয়ে আসছে। হরতাল অবরোধ হচ্ছে হরহামেশা। এখন এতো সময় বাহিরে থাকা কি বুদ্ধিমানের? উপরন্তু তুমি একা নও, একজন জীবন তোমার মাঝে। তবুও তোমার এই গা ছাড়ামিটা বন্ধ হলো না।”
“একজন মানুষকে মৃত্যুর মুখে রেখে কিভাবে মুখ সরিয়ে নিন বলুন তো”
উমা কথা বলতে বলতেই এগিয়ে যায় হাসপাতালের গেটের দিকে। হঠাৎ থমকে যায় সে। রুদ্র গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রকে দেখে খানিকটা অবাক হয় উমা। ফোন কেটে সামনে এগিয়ে যায় সে। বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“আপনি এখানে?”
রুদ্র কোনো কথা না বলে জড়িয়ে ধরে উমাকে। রুদ্রের কাজ আরোও অবাক করে উমাকে। তারপর ধীর স্বরে সে বলে,
“প্রদ্যুতের ফোনে তড়িৎ গতিতে এসেছি। দেখো এখনো বুক কাঁপছে।”
“আমি তো ঠিক আছি, কেনো ভয় পান বলুন তো?”
“ভয় কি শুধু শুধু পাই! আচ্ছা আমার কথা শুনলে কি হয়? বাসায় একটা লক্ষী মেয়ের মতো থাকলে কি হয়?মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তোমাকে বন্ধী খাঁচায় আটকে রাখতে। তাহলে যদি আমার চিন্তা কমে।”
“আমি তো চাই না ঘরের চার দেওয়ালে বন্ধী থাকতে। সর্বদাই তো মুক্ত পাখি ছিলাম। তাহলে কিভাবে বন্দী খাঁচায় ধরা দেই!”
রুদ্রের স্মিত হাসিটা মলিন হয়ে যায়। সে জানে উমাকে চার দেওয়ালে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়৷ সে উড়তে চায়, সে তার নিজের পথ নিজে তৈরি করতে চায়। রুদ্র কথা বাড়ায় না। ধীর স্বরে বলে,
“গাড়িতে উঠো”
“আমাদের পুলিশ স্টেশন যেতে হবে একটু”
রুদ্রের চাহনী সরু হয়ে আসে৷ প্রশ্ন করে বসে,
“কেনো?”
“যে মানুষটি আমার গাড়ির সামনে পড়েছিলো তার আত্নীয়দের তো জানাতে হবে। নয়তো তারা জানবে কিভাবে?”
“তোমার এ নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে”
“মাথা ঘামাবো না কেনো? অদ্ভুত কথা বলছেন। মানু্ষটা কে, কি করে জানবো না? আর তার পরিবার ও অধীর আগ্রহে বসে আছে হয়তো। আমার তো মনে হয় লোকটাকে কেউ আটকে রেখেছিলো। কত অমানবিক ভাবে অত্যাচার করেছে আপনার কোনো ধারণা নেই। চোখের সামনে এমনটা দেখেও চুপ করে কিভাবে থাকি বলুন তো?”
উমার কথা শুনে রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। সে গম্ভীর স্বরে বলে,
“শুধু শুধু ঝামেলা কাঁধে নেওয়ার কি আছে?”
“ঝামেলা কেনো বলছেন? এটা জরুরী”
এবার রুদ্র চুপ করে যায়৷ কিছু না বলে দৃষ্টি বাহিরে দেয়। নীরবতা বিরাজমান হয় গাড়িতে। উমার খানিকটা বিরক্তবোধ হয়। রুদ্র তাকে কেনো থামিয়ে দিচ্ছে। গাড়ি পিচের রাস্তা চিরে এগিয়ে যায় গন্তব্যের দিকে।
শাশ্বতের সামনে পুনরায় দাঁড়িয়ে আছে রাজশ্বী। আজ কাজ ভালো ভাবেই করেছে সে। শাশ্বতের মুখে প্রশান্তির ছাপ। স্মিত হেসে বললো,
“অবশেষে তুমি কাজ শিখেছো, যাক ভালো। এখন থেকে আরোও কিছু কাজ দিবো। চাপ বাড়বে কিন্তু”
“জ্বী”
রাজশ্বী ছোট করে “জ্বী” বলে। শাশ্বত মুচকি হেসে বলে,
“সেদিন কি বেশি বকে দিয়েছিলাম? এই কদিন তোমার মুখ ই দেখতে পেলাম না, ডুব দিয়েছো মনে হলো”
“ডুব দেই নি, সুমন দা কাজ বুঝিয়ে দিতো।”
“আমাকে ভয় পাও?”
রাজশ্বী উত্তর দিলো না। শাশ্বত এবার হাসি বিস্তৃত করে বললো,
“চলো নতুন কাজ দেই, সামনে তো নির্বাচন। তোমার কি মনে হয় কে জিতবে?”
“জানি না, অনুমান করা কঠিন।”
“আচ্ছা শোনো, জমি দখলের সে প্রতিবেদনটা সেটা তুমি করবে সুমনের সাথে। আমি কিছুদিন ব্যাস্ত থাকবো। এই নির্বাচন নিয়ে।”
বলেই অভিনব সিংহের ফাইলটা বের করে। এক এক করে অভিনব সিংহের কারসাজির সব প্রমাণ বের করে। রাজশ্বী অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করে?
“এটা কি?
“এটা হলো প্রমাণ, কারোর সুখের সংসারে আগুন ধরাতে এটুকুই যথেষ্ট”
“এগুলো সব আপনি জোগাড় করেছেন?”
“না, সব না। কেউ আমাকে সাহায্য তো করছে। সে কে আমার জানা নেই।”
রাজশ্বী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে বলে,
“কেউ কোনো মনোবাঞ্ছা ছাড়া কেনো সাহায্য করবে আপনাকে?”
রাজশ্বীর প্রশ্নে থমকে যায় শাশ্বত। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে রাজশ্বীকে চলে যেতে বলে। রাজশ্বী চলে গেলে গভীর চিন্তায় পড়ে যায় শাশ্বত। সে কখনো গভীরভাবে চিন্তা করে নি। অভিনব সিংহের পতনে কার লাভ হবে! রকিবুল মাষ্টার নাকি অন্য কেউ! হঠাৎ ফোনের শব্দে চিন্তায় ভেদ ঘটে। ফোনটা রিসিভ করতেই………
চলবে
[গতকাল গল্পটা দিতে না পারার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তাই আগামীকাল দুটো পর্ব পোস্ট করবো। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল বিকেলে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]
মুশফিকা রহমান মৈথি
৪২তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/443486934039751/