উমা [কপি করা নিষেধ] ৪৫তম_পর্ব

#উমা [কপি করা নিষেধ]
৪৫তম_পর্ব

উমার প্রশ্নে শ্রাবণ ধীর কন্ঠে বলে,
“জ্বী, উনার জ্ঞান ফিরেছে। কিন্তু একটা খারাপ খবর ও আছে।”
“খোলশা করে বলুন তো”
“উনার জ্ঞান ফিরেছিলো গতকাল রাতে, কিন্তু আজ সকালেই উনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি জানি আপনাকে বিরক্ত করাটা ঠিক হবে না। কিন্তু না করে উপায় ছিলো না। আপনি কি একটু থানায় আসতে পারবেন?”

শ্রাবণের কথায় চুপ করে গেলো উমা। লোকটিকে পাওয়া যাচ্ছে না কথাটা মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষে বারংবার ঝংকার তুলছে। লোকটিকে তিনদিন পূর্বে দেখতে গিয়েছিলো সে। ডাক্তার জানিয়েছিলো অবস্থা ভালো নেই, অন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। মাথায় রক্তক্ষরণের কারণে তার জ্ঞান ফিরছিলো না। ডাক্তারের ধারণা তিনি কোমায় চলে গিয়েছে। উমার জোড় করার কারণেই রুদ্র পুলিশে একটা রিপোর্ট লিখিয়েছিলো। লোকটির গত রাতে জ্ঞান ফিরেছিলো, সে কথা বলার চেষ্টা করছিলো। অথচ আজ সকাল থেকেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। রাতারাতি কোথায় চলে যেতে পারে সে। শ্রাবণের কন্ঠে উমার স্বম্বিত ফিরে, সে নিজেকে সামলে কাঁপা স্বরে বলে,
“আমি সকালে থানায় এসে দেখা করে যাবো”
“ধন্যবাদ, এই অবস্থায় আপনাকে বিরক্ত করার জন্য সত্যি ক্ষমাপ্রার্থী”
“না না, সমস্যা নেই। আপনি উনার পরিবারের খোঁজ পেয়েছেন?”
“জ্বী, খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পেরেছি উনি উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ডাক্তার। থাকেন শিবপুরের কাছাকাছি। লোকটি বিগত আটমাস থেকে গায়েব। পরিবারের লোক সদর থানায় কমপ্লেইন তো করেছে কিন্তু কাজ হয় নি। পুলিশ গা ছাড়া দিয়েছে। উনার স্ত্রী, বাচ্চা ঢাকা থাকে। লোকটির খোঁজ না পেয়ে স্ত্রী আসেন। ছয়মাস খোঁজ না পাওয়ায় তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। অথচ সেই কিছুদিন পূর্বে আপনার গাড়ির সামনে এসে পড়েছে। উনাকে কারা বেঁধে রেখেছিলো। কি উদ্দেশ্য জানা নেই। আমি তো সব কিছু রুদ্র সাহেবকে জানিয়েছিলাম, উনার সাথে আমার ফোনেও কথা হয়েছিলো”

উমা শ্রাবণের কথায় অবাক হয়। কারণ রুদ্র এমন কোনো কথাই তাকে জানায় নি। বরং উমা নিজ থেকে জিজ্ঞেস করলেও সে চেপে গিয়েছে। উমা অবাক কন্ঠে বলে,
“উনি আমায় কিছু জানান নি”
“হয়তো আপনার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে আপনাকে বলেন নি। আমি আজ উনাকেই ফোন করতাম। কিন্তু উনার ফোন বন্ধ তাই আপনাকে ফোন করেছি”
“হতে পারে, উনি আমাকে নিয়ে বড্ড চিন্তা করেন কি না। আচ্ছা আমি রাখছি। আগামীকাল দেখা হবে। আমার সাধ্যমত আপনাদের সাহায্য করবো।”

ফোনটি রেখে দেয় উমা। তার শরীরটা ভালো লাগছে না। লোকটির নিখোঁজ শুনেই মাথাটা ঝিম ধরে গিয়েছে। এককাপ চা হলে মন্দ হতো না। চায়ের মিনুকে হাক দেয় উমা। মিনু ছুটে আসে। ক্লান্ত কন্ঠে বলে,
“ফুলির মাকে একটু চা দিতে বলো তো মিনু”
“দুধ তো পুড়ে গেছে। এখন খালারে কইলে উনি আমারে দাবরাইবো”
“চা করতে দুধ লাগে কে বলেছে তোমায়। রঙ চা বলেও কিছু আছে সেটা কি জানা আছে?”

মিনু ঘাড় কাত করে। উমা তখন বলে,
“যাও, এক কাপ রঙ চা আদা আর লং দিয়ে দিতে বলো। আজ রাজী এসেছে?”
“না ছুটো দিদিমনি এখনো আয় নাই”
“আয় নাই কি? বলো আসে নি”
“আসে নি”

বাধ্য মেয়ের মতো উমার কথা আওড়ায় মিনু। উমা স্মিত হেসে বলে,
“আচ্ছা শোনো। চা টা দিতে বলে আবার আমার রুমে আসবে। মাথাটা দপদপ করছে তেল দিয়ে দিবে। পারবে?”
“জ্বে পারবো।”
“যাও, তবে”

মিনু চলে গেলে ঘড়ির দিকে চোখ দেয় উমা। রাজশ্বীর জন্যও চিন্তা হয় খুব, মেয়েটা রাত করে বাড়ি ফিরে। সে নাকি দুটো ছাত্র পড়ায়। পড়ানোতে আপত্তি নেই উমার। কিন্তু সময়টা তো দেখবে। এখন দিত ভালো না। এই কিছুদিন পূর্বে একটি মেয়েকে ধর্ষণ করা হলো। ধরনী কল্যান সংগঠন থেকে আন্দোলন ও করেছে শিউলীরা। উমার শরীর ভালো নেই বলে শিউলী তাকে বাড়িতেই থাকতে বলেছে। তাদের আন্দোলনে পুলিশ একটু নড়ে চড়ে উঠেছে। আজকাল ধর্ষণের মাত্রা বেড়েই চলেছে। কিন্তু আইন গা ছাড়া দিচ্ছে। মাঝ থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মেয়ের পিতামাতা। এটাই সমাজের কঠোর চিত্র। যা আমরা চাইলেও বদলাতে পারছি না। কারণ চাওয়ার পরিমাণটা খুব স্বল্প। আর বিকৃত মানসিকতার মানুষের পরিমাণ কল্পনাতীত।

রাজশ্বী ফিরলো সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ, রাজশ্বীর সাথে সাথে রুদ্র ও ঘরে প্রবেশ করলো। রাজশ্বীকে দেখে রুদ্র জিজ্ঞেস করে উঠলো,
“তুমি এতো রাত অবধি কোথায় ছিলে?”

রুদ্রের প্রশ্নে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় রাজশ্বী। কাঁপা স্বরে বলে,
“আসলে আজ সময়ের দিকে খেয়াল ছিলো না। প্রাইভেট পড়াতে পড়াতে দেরি হয়ে গিয়েছে। আরেকটা নতুন ছাত্রীর পড়ানো শুরু করেছি তো”

রাজশ্বীর দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালো রুদ্র। ললাটে ঘাম জমেছে। কন্ঠ কাঁপছে। রুদ্র আন্দাজ করতে পারছে রাজশ্বী কিছু লুকাচ্ছে। মেয়েটির মুখখানা ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। রুদ্র তখন নিজেকে স্বাভাবিক করে ধীর স্বরে বলে,
“দিদি জানে?”
“না, আজ বাঁচিয়ে দিয়েন জামাইবাবু। আর হবে না। মায়ের দিব্বি”
“বেশ, তাহলে যে ঘুষ দিতে হয়”
“কেমন?”
“দিদি থেকে বাঁচালে আমাকে সত্যিটা জানাবে এতো রাত অবধি কোথায় ছিলে! আমি মিথ্যে ধরতে পারি, আর যাদের মিথ্যে বলার অভ্যেস নেই তাদের মিথ্যে সহজে ধরে ফেলি”

রাজশ্বী জমে যায় রুদ্রের শীতল কন্ঠে বলা কথায়। তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলে,
“ঠিক আছে”

রুদ্র এবার প্রসারিত হাসি আকে ঠোঁটে তারপর একত্রে বাড়িতে প্রবেশ করে। উমা তখন বসার ঘরে পেপারের পাতা উল্টাচ্ছিলো। রাজশ্বীকে ঢুকতে দেখে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“কটা বাজে?”

উমার গম্ভীর কন্ঠে রাজশ্বী শুকনো ঢোক গেলে। উমা যতই ভাই বোনকে ভালোবাসুক না কেনো বড্ড শাসনে রাখে তাদের। এবং মিথ্যে তার মোটেই পছন্দ হয় না। রাজশ্বী এই সাংবাদিকতার কাজটি শুরু করেছে উমার কাছ থেকে লুকিয়ে। উমাকে বললে হয়তো দ্বিমত করতো না। কিন্তু সাহস করে উঠে নি রাজশ্বী। কারণ পেশাটি খুব ই ভয়ংকর এবং ঝুকিপূর্ণ। বাবার মৃত্যুর পর উমা তার কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে বেশ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। তাই উমার কাছ থেকে লুকিয়েই বিগত চারমাস যাবৎ কাজ করেছে রাজশ্বী। কিন্তু আর হয়তো লুকানো সম্ভব হবে না। রাজশ্বী কিছু বলার পূর্বে রুদ্র বলে উঠে,
“আমার সাথে ছিলো, আমি একটু কেনাকাটা করাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। তোমার এই অবস্থায় তোমাকে বের করাটা ভালো দেখায় না। তাই ওকে নিয়ে বের হলাম।”

উমা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালে রুদ্র তার হাতে রাখা ব্যাগটি এগিয়ে দেয়। উমা সেটি খুলতে একটি সুন্দর লাল পাড়ের শাড়ি দেখতে পায়। উমা রুদ্রের পানে প্রশ্নোবোধক দৃষ্টিতে তাকালে সে বলে,
“কি হলো? আমি বউ এর জন্য শাড়ি কিনতে পারি না?”

উমা রাজশ্বীর উদ্দেশ্যে বলে,
“যাও উপরে গিয়ে কাপড় ছেড়ে নাও। চা পাঠাচ্ছি”

রাজশ্বী ঘাড় কাত করে উপরে চলে যায়। উমা শাড়ীটি সোফায় রেখে রুদ্রের উদ্দেশ্যে বলে,
“আপনার ফোন বন্ধ কেনো?”
“বন্ধ নাকি?”
“হ্যা, শ্রাবণ বাবু ফোন করেছিলেন। বন্ধ পেয়েছেন। আমিও ফোন করেছিলাম। পাই আপনাকে। আপনি বন্ধ করে রাখেন নি?”

উমার প্রশ্নে রুদ্র তার পকেটে হাত দেয়। কিন্তু ফোনটি পায় না। রুদ্রের কপালে ভাঁজ পড়ে, চিন্তিত কন্ঠে বলে,
“আমার ফোন বোধ হয় চুরি গেছে।”
“সে কি কথা? চুরি যাবে কিভাবে?”

রুদ্র তখন বিরবির করে বলে,
“আমি বোধহয় ওখানে রেখে এসেছি”
“কোথায় রেখে এসেছেন?”
“একটা পার্টির সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম। হয়তো ওখানেই রেখে এসেছি। যাক গে, কাল নতুন একটা মোবাইল কিনে নিবো। শ্রাবণ কি বলছিলো?”
“ওই যে লোকটি, যে আমাদের গাড়ির সামনে চলে এসেছিলো। উনি সকাল থেকে নিঁখোজ। কাল আমাদের থানায় যেতে হবে।”

উমার কথা শুনে রুদ্রের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“তোমার যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমি যাবো ক্ষন”
“কিন্তু”
“আমার ক্ষুধা লেগেছে। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি”

বলেই রুদ্র ভেতরে চলে যায়। উমা কিছু বলতে যেয়েও বলতে পারে না। রুদ্রের এরুপ বিরুপ আচারণে অবাক হয় উমা। রুদ্রের এতোটা এড়িয়ে যাবার কারণ বুঝে উঠে না সে। মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন উঁকি দেয় তার। কিন্তু উমা প্রশ্নগুলোকে পাত্তা দেয় না। শাড়িটির দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

তিনদিন পর,
শাশ্বতের মুখোমুখি বসে রয়েছে মাহমুদ সরদার। তার ভারী মুখখানা শুকিয়ে রয়েছে। সে যাতাকলে পিসছে তা বুঝতে বাকি রইলো না শাশ্বতের। শাশ্বত তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন লিখেছে। যা তুমুল ঝড় তুলেছে। শাশ্বতের সাথে সাথে অন্যান্য সাংবাদিকরাও প্রতিবেদন লিখেছে। শাশ্বত চাপের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“আমাকে ডেকেছেন অথচ চুপ করে বসে আছেন, সরদার বাবু আমার তো সময়ের দাম আছে নাকি”
“আমার খবরটা ধামা চাপা দেবার কি উপায় নেই?”
“উপায় বলেছিলাম আপনি রাজী হন নি, বলি তো নিজেই হচ্ছেন”
“উত্তম বাবুকে আমি খুন করি নি”
“জানি, কিন্তু তার খুনের পেছনে কে ছিলো সেটাও তো বলছেন না।”
“বললে আমাকে জ্যান্ত রাখবে না।”

ভয়ার্ত কন্ঠে কথাটা বলে মাহমুদ সরদার। সরদারের ভয় দেখে শাশ্বত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কে? কে জ্যান্ত রাখবে না?”

সরদার আশেপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আপনার মামা অভিনব সিংহ রায়………

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল বিকেলে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

৪৪তম পর্বের লিংক https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/445429960512115/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here