উমা [কপি করা নিষেধ] ৪৬তম_পর্ব

#উমা [কপি করা নিষেধ]
৪৬তম_পর্ব

শাশ্বতের মুখোমুখি বসে রয়েছে মাহমুদ সরদার। তার ভারী মুখখানা শুকিয়ে রয়েছে। সে যাতাকলে পিসছে তা বুঝতে বাকি রইলো না শাশ্বতের। শাশ্বত তার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবেদন লিখেছে। যা তুমুল ঝড় তুলেছে। শাশ্বতের সাথে সাথে অন্যান্য সাংবাদিকরাও প্রতিবেদন লিখেছে। শাশ্বত চাপের কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
“আমাকে ডেকেছেন অথচ চুপ করে বসে আছেন, সরদার বাবু আমার তো সময়ের দাম আছে নাকি”
“আমার খবরটা ধামা চাপা দেবার কি উপায় নেই?”
“উপায় বলেছিলাম আপনি রাজী হন নি, বলি তো নিজেই হচ্ছেন”
“উত্তম বাবুকে আমি খুন করি নি”
“জানি, কিন্তু তার খুনের পেছনে কে ছিলো সেটাও তো বলছেন না।”
“বললে আমাকে জ্যান্ত রাখবে না।”

ভয়ার্ত কন্ঠে কথাটা বলে মাহমুদ সরদার। সরদারের ভয় দেখে শাশ্বত এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
“কে? কে জ্যান্ত রাখবে না?”

সরদার আশেপাশে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“আপনার মামা অভিনব সিংহ রায়, সব কিছুর কলকাঠি সেই নাড়ে। তার লোকেরা আমাকে হুমকি দিয়ে গেছে। যদি আমি মুখ খুলি আমাকেও মেরে ফেলবে।”

মাহমুদ সরদারের ভয়ার্ত স্বীকারোক্তি শুনে অবিশ্বাসের কালো বাদল জড়ো হয় শাশ্বতের মনে। মস্তিষ্ক রীতিমতো ফাঁকা হয়ে যায়। দৃষ্টি সংকুচিত হয় দ্বিধার মায়াজালে। মাহমুদ সরদারের কথাগুলো যেনো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। তার মামা ক্ষমতালোভী, কালোকারবারিতে পটু; কিন্তু খুনী হতে পারে না। শাশ্বত মুখশ্রী খিচিয়ে বললো,
“কাউকে বাঁচানোর জন্য অন্যের উপর দোষ দেওয়াটা বুঝি অভ্যেসে পরিণত হয়েছে?”
“আমি জানতাম বিশ্বাস বিশ্বাস করবেন না। কিন্তু এটাই সত্যি, আপনার মামাই সবকিছুর মূলে। সেই খুন করেছে আপনার বাবাকে, কারণ আপনার মামার সকল বেআইনি কাজের প্রমাণ ছিলো আপনার বাবার কাছে। সে ফাঁস করে দিতো তার সকল রহস্য”

সালটি ১৯৭৮,
স্বাধীনতার সাত বছর পার হয়েছে। সাতক্ষীরার মতো প্রত্যন্ত এলাকায় অন্যায়ের বীজ বুনেছে গভীরভাবে। নানা অস্ত্র, মাদকদ্রব্য বেআইনি পথে মায়ানমার এবং ভারত থেকে পাচার করা হচ্ছে। বিশেষ করে বেনাপোলের বর্ডার এবং মংলা থেকে, কাস্টমস ও নিজের পকেট পুরে মুখ বন্ধ রাখছে। কালীগঞ্জ থানায় তখন নতুন অসি হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত উত্তম চ্যাটার্জির আন্ডারে নতুন একটি কেস আসলো। মাদকদ্রব্যের ব্যাবহার বেড়ে গিয়েছে বহুগুণ। অপরদিকে দশ পনেরো বছরের ছেলেদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে বেআইনি অস্ত্র, যার কোনো লাইসেন্স নেই। উত্তম চ্যাটার্জির ধারণা একটা র‍্যাকেট এই কাজ করছে। যদি এই র‍্যাকেটটাকে ধরতে পারা যেতো তাহলে তাদের মূল হর্তাকর্তারাও চলে আসতো হাতের ভেতর। সে সূক্ষ্ণ পরিকল্পনা অনুযায়ী চলছিলো। ধীরে ধীরে তার পরিকল্পনা সফল ও হচ্ছিলো। গোপনীয় মিশনে খুব চতুরতার সাথে সে মাহমুদ সরদারকে ধরে ফেলেন, মাহমুদ সরদারের দায়িত্ব ছিলো এসব পাচার কৃত দ্রব্য কাস্টমস থেকে ছোটানো। যা পরবর্তীতে রুদ্র করতো। মাহমুদ সরদারকে পুলিশ কাস্টেডিতে রাখা হয় সাত দিন, রিমান্ডে তার উপর প্রচুর মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার করা হয়। অবশেষে সে তার র‍্যাকেটের সব কিছু বলে উত্তম বাবুকে। তারা ভারত থেকে আসা পেয়াজ, ফল, চালের বস্তায় নানাধরণের মাদকদ্রব্য যেমন ফেন্সিডিল, গাজা, মদ, এবং হেরোইন পাচার করতো। সাথে কিছু বেআইনি অস্ত্র ও। অভিনব সিংহের কাজ ছিলো তার লোক দিয়ে জিনিসগুলো পাচার করে দিতো রাজধানীতে। একগ্রাম গাঁজার দাম ছিলো ১০ টাকা। ফলে তাদের লাভ হতো প্রচুর। অভিনব সিংহের ব্যাবসা বাহিরে থেকে চাল ডালের বড় দোকান। কিন্তু তার চালের আরোদে ভেতর এই গুলো লুকিয়ে রাখতো এই পাচারকৃত দ্রব্য। চালের বস্তা যখন দেশের নানা অঞ্চলে যেতো এই মাদকদ্রব্য, অস্ত্র ও পাঁচার হতো। উত্তম চ্যাটার্জির প্রথমে বিশ্বাস হয় নি তার শ্যালক এমন নিকৃষ্ট কাজ করতে পারে। কিন্তু প্রমান হাতে আসার পর সে সিদ্ধান্ত নেয় নিজ হাতে অভিনব সিংহকে গ্রেফতার করবেন। এদিকে মাহমুদ ধরা পড়ার পর সতর্ক হয়ে যায় অভিনব সিংহ। সে নিজ থেকে যোগাযোগ করে উত্তম বাবুর সাথে। উত্তম বাবুকে দমানোর জন্য বলে,
“দেখো উত্তম, আত্নীয়ের মাঝে এমন ভুলবোঝাবুঝি রাখতে নেই। আরে লুটে খায় তো সবাই, আমি না হয় একটু বেশি লুটছি। এতে এতো অবাক হবার কিছু নেই। আর আমি কিন্তু একা খাই না, অনেক বড় বড় নেতা গোতারাও এই অংশ পায়। তাই ভালোর জন্য বলছি চেপে যাও। প্রতিমাসে ভাগ চলে যাবে। শাশ্বত ছোট, এই পুলিশের চাকরি তে ক টাকা পাও দেখে?”
“উঠুন, উঠে দাঁড়ান”

রোষানলে কাঁপছে উত্তমবাবুর শরীর৷ সে হিনহিনে স্বরে বলে,
“আমার চোখের সামনে থেকে বেড়িয়ে যাবেন। আপনার ওয়ারেন্ট বের হবার পর আমি নিজ হাতে আপনাকে হাতকড়া পড়াবো। ততদিন মন্ত্র যপুন, যম এলো বলে দোয়ারে”

অভিনব সিংহ অবিচল, ভয়ের এক চিলতে রেখাও দেখা গেলো না তার মুখে। সে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো,
“ভালো করলে না উত্তম।”
“সেটা আপনাকে ভাবতে হবে না”

সেই রাতেই বাড়ি ফেবার সময় এক দল মানুষ উঠিয়ে নিয়ে যায় উত্তম বাবুকে। গলা কেটে ফেলে আসে রেলস্টেশনে। উত্তম বাবুর মৃত্যু তদন্ত করে নতুন অসি। সে মোটা টাকা খায় অভিনব সিংহের কাছে। টাকার লোভে তার চোখ চকচক করে উঠে। তাই সে মুখ বন্ধ করে নেয়। এদিকে, বিধবা বোনকে নিজ ঘরে ঠায় দেয় অভিনব সিংহ। মালিনী জানতো তার দাদার চরিত্র। কিন্তু শাশ্বতের জন্য নিজের মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয় লেগেছে তার। নিজের ছেলের প্রাণ বাঁচাতে দাদা যেভাবে বলেছে সেটাই মেনে নেয় সে।

মাহমুদ সরদার সামনে থাকা জল ঢক ঢক করে পান করে। তার গলা শুকিয়ে এসেছে। শাশ্বত এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। সে এতো সময় পর অনুভব করলো তার গাল ভিজে এসেছে। চোখ ঝা ঝা করছে। মামার এমন কালো সত্যি মানতে বুক চিরে আসছে। এই লোকটিকে পিতৃতুল্য ভেবেছিলো সে। সম্মান করেছে মন দিয়ে। কিন্তু আজ তাকে খুন করতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে সব জেনেও কিছু করতে পারবে না। ত্রিশ বছর পূর্বের সত্যিটা সে চাইলেও প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু অভিনব সিংহকে ছেড়ে দিবে না সে। কঠিন থেকে কঠিন শাস্তি দিবে সে। শাশ্বত উঠে দাঁড়ালো। মাহমুদ সরদার তার হাত আকড়ে আকুল আবেদন করলো,
“আমাকে বাঁচান, শাশ্বত বাবু। প্লিজ আমাকে বাঁচান।”

শাশ্বত এক রাশ ঘৃণা নিয়ে রুঢ় হাসি হাসে। স্বর খাঁদে নামিয়ে বলে,
“দোয়া দুরুদ পড়া শুরু করুন, আপনার আযরাইল আর আমার যম আসলো বলে”

শাশ্বত কথা শুনে কলিজা শুকিয়ে আসে সরদারের। কপালে ভয়ের দরুন ঘাম জমতে লাগে। শাশ্বত এক মূহুর্ত দাঁড়ায় না। বেড়িয়ে যায় সরদারের অফিস থেকে। তার চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। চোখে আগুনের ফুলকি জ্বল জ্বল করছে। পারলে এখনি অসুর বধ করতো সে। কিন্তু আইনের কাছে বাঁধা। আইনি খেলা আইনের মাধ্যমেই রফা দফা করবে সে। এতোকাল মামাকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে শুধু। কিন্তু আর নয় এবার মামা চিরতরে শেষ করার পালা। সে ক্ষমতার লোভে তার পিতাকে সে হত্যা করেছে। সেই ক্ষমতা কেড়ে নিবে সে, জেলের কালকুঠুরির ভেতর পঁচে মারবে অভিনব সিংহ কে, নিজের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ শাশ্বত___________

উমার ঘুম ভাঙ্গলো খুব ভোরে। উঠে বসতে গা গুলিয়ে এলো। ছুটলো স্নানঘরে। স্নানঘরে যাবার শব্দে রুদ্রের ও ঘুম ভেঙ্গে গেলো, তার দৃষ্টি গেলো ঘড়ির দিকে। ঘড়ির কাটা পাঁচটার ঘরে এসে ঠেকেছে। রুদ্র শালটা নিয়ে স্নানঘরের কাছে এসে দাঁড়ালো। উমা মুখটা ধুয়ে বের হয়ে রুদ্র গামছাটা এগিয়ে দিলো। তারপর উমাকে শাল দিয়ে ঘিরে দিলো। উমা লজ্জিত কন্ঠে বললো,
“আপনার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিলাম কি?”
“তুমি কষ্ট করবে আর আমি বেঘুরে ঘুমাবো তা কি হয়!”

বলে ধরে ধরে বসায় উমাকে। রুদ্র হাটু গেড়ে নিয়ে বসে। মনোযোগ দিয়ে দৃষ্টি দেয় তার ছোট বউটির দিকে।তার ষোড়শী এখন আর ষোড়শী নেই। একজন পূর্ণ নারী। কিছুদিন বাদে একজন সন্তানের মা হবে সে। সন্তান জন্ম দেওয়া কতোটা কঠিন তা উমার চেহারা দেখলেই আন্দাজ করা যায়। বমি করার দরুন চোখগুলো বসে গেছে উমার। খুব ক্লান্ত লাগছে তাকে। ঘুমটাও গত ল্রাতে ভালো হয় নি। উমার কোমড় জড়িয়ে ধীর স্বরে বলে,
“আমার উপর কখনো রাগ হয় না তোমার?”
“কেনো বলুন তো?”
“এই যে! আমি তোমাকে সময় নিতে পারি না, ব্যাস্ত থাকি নিজেকে নিয়ে। তোমার যত্ন নেই না।”

উমা মুচকি হেসে বলে,
“আপনি যা দিয়েছেন আমার জন্য যথেষ্ট। ভালোই তো আছি। আমার কোনো আক্ষেপ নেই।”

রুদ্র জড়িয়ে ধরে উমাকে। গরম নিঃশ্বাসে পুড়ে যাচ্ছিলো উমার ভেতরটা। তখন রুদ্র ধীর স্বরে বলে,
“তোমার এই উষ্ণ হৃদয়টা কখনো শীতল হবে না তো?”

রুদ্রের প্রশ্নে অবাক হয়ে যায় উমা। কিছু বলা আগেই………

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আজ রাতে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

৪৫তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/445546767167101/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here