উমা [কপি করা নিষেধ] ৫০তম_পর্ব

#উমা [কপি করা নিষেধ]
৫০তম_পর্ব

হঠাৎ কারোর চিৎকার কানে এলো তার। বুকটা কেঁপে উঠলো। হিম ধরে গেলো শিরদাঁড়ায়। সিড়ি থেকে থেমেই একটি ঘর। যার দরজা আজানো। মশালের হলুদ রশ্নি ফাঁক থেকে চুইয়ে পড়ছে। উমা কাঁপা হাতে দরজাটা খুললো। যে দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠলো তাতে বুক কেঁপে উঠলো তার। চিনচিনে অসহনীয় ব্যাথায় আহত হলো হৃদয়। শাবীব, তূর্য দাঁড়িয়ে আছে। তাদের সামনে চারজন মানু্ষ নগ্ন দেহে হাটু গেড়ে বসে রয়েছে। তাদের শরীর চিরে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। একজনকে খুব সহজেই চিনে ফেললো উমা। বেঁধে রাখা লোকগুলোর সামনে একজন শ্বেত প্রশস্থ দেহধারী মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। তার শরীর ঘামে ভেজা, হাতে একখানা চিকন রডের ন্যায় বস্তু। তাতে তাজা রক্ত লেগে রয়েছে। উমার লোকটিকে চিনতে কষ্ট হলো না। হাতে থাকা মোবাইলটি মাটিতে পড়ে গেলো অগোচরেই। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো একরাশ বিষাক্ত যন্ত্রণায়, মুখ থেকে আড়ষ্ট কন্ঠে বেড়িয়ে এলো,
“নিষ্ঠুর”

উমার কন্ঠ কর্ণপাত হতেই মানুষটি তার দিকে ফিরে তাকায়। রক্তিম হিংস্র চোখজোড়া তীর্যক দৃষ্টি প্রয়োগ করে উমার দিকে। উমা ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তার বুকটা কাঁপছে, অসহ্য যন্ত্রণায় জ্বলছে। সামনে থাকা লোকটিকে যে সে বিশ্বাস করতো, ভালোবাসতো। রুদ্রের পাশবিকতায় বাতাসটি যেনো আজ কলুষিত, বিষাক্ত। রুদ্রের হাতে থাকা রডটি খসে পড়ে মাটিতে। চোখের হিংস্রতা পরিণত হয় দুশ্চিন্তা এবং ত্রাশে। আড়চোখে অবস্থার বিবেচনা করে সে, তারপর দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে উমাকে চেপে ধরে নিজের সাথে। শাবীবের উদ্দেশ্যে বলে,
“এদের ভেতরে নিয়ে যা”

শাবীব তূর্য লোকগুলোকে ওই ঘরের পাশের ঘরে নিয়ে যায়। উমা এখনো স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। আতঙ্কে তার পাজোড়া হিম ধরে গিয়েছে। কালো ভয়ে মস্তিষ্ক ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাসের প্রাচীর ভাঙ্গলে যে রক্তক্ষরণ হয় তা শরীরের রক্তক্ষরণের চেয়েও অধিক অসহনীয় এবং যন্ত্রণাদায়ক হয়। রুদ্র উমার মুখখানা তুলে ধরে আকুল কন্ঠে বললো,
“দুঃস্বপ্ন ছিলো ভুলে যাও”

উমার চোখ বেয়ে সূক্ষ্ণ জলের রেখা গড়িয়ে পড়ে কোমল গালে। বিতৃষ্ণা, ঘৃণা, ক্রোধে ঝাপসা হয়ে যায় চোখগুলো। এতোটা পাশবিকতা কি কোনো মানুষের মাঝে থাকতে পারে। মাথাটা ঘুরছে উমার। মেঝেতে কালো রক্তের ছাপ চোখে পড়তেই গা গুলিয়ে আসছে। দৃশ্যটি এতোটাই রুঢ় এবং নিষ্ঠুর যে মস্তিষ্ক কিছুতেই মেতে নিতে পারছে না। মাথার পেছনটা দপদপ করছে। নিস্তেজ শরীরটা নিজেকে ধরে রাখার শক্তি পাচ্ছে না। চোখের দৃষ্টি আবছা হয়ে এলো। ঢলে পড়লো সে রুদ্রের বুকে। অচেতন শরীরটা ভার ছেড়ে দিলো। তলিয়ে পড়লো উমা নিকষকৃষ্ণ গভীর আঁধারে________

জ্ঞান ফিরতে নিজেকে রুদ্রের ঘরে আবিষ্কার করলো উমা। উমা চোখ ঘুরিয়ে দেখে নিলো স্থানটা। উমার অনুভব হলো যেনো শরীরের ভারটা অধিকগুন বেড়ে গিয়েছে এবং এক বিন্দু শক্তি অবশিষ্ট নেই। শরীরটিকে তুলে ধরা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। গলাটা শুকিয়ে এসেছে। মস্তিষ্ক যেনো নিস্ক্রিয় হয়ে উঠলো৷ কিছুক্ষণ পূর্বের দৃশ্য গুলো চোখের সামনে সিনেমার পর্দার ন্যায় এক এক করে ভেসে উঠলো। সেই দৃশ্য মনে পড়তেই পেট মুচরিয়ে বমি পাচ্ছে। ঘরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। টিউবলাইটের সফেদ আলোতে আঁধার ঘরে সেই দৃশ্য গুলো ভ্রম মনে হতে লাগলো। সত্যি কি যেগুলো ঘটেছিলো? নাকি সব কেবল অবচেতন মনের কল্পনা! এক মূহুর্তের জন্য সব কিছু অবিশ্বাস করতে করতে ইচ্ছে হলো উমার। বাস্তব এবং কল্পনার মাঝে নিজেকেই গুলিয়ে ফেলেছে সে। ঠিক তখন ই রুদ্রের আগমণ ঘটলো৷ জলের গ্লাস হাতে সে প্রবেশ করলো রুমে। উমা সরু দৃষ্টিতে তার পানে চাইলো। সেই হিংস্র চোখজোড়া এখন পরম মায়ায় পরিণত হয়েছে। কিন্তু তার সফেদ শার্টের কোনায় রক্তের ছিটায় উমার সকল ভ্রম বাস্তবতায় পরিণত হলো। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো নোনা বিষাদে। রুদ্র তার দিকে এগিয়ে আসতেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো উমা। তার বিশ্বাস গলা টিপতে দুবার ভাবলো না এই পুরুষটি! এতো পাষন্ড কাউকে আদৌও ভালোবাসতে পারে! সে ভালোবাসা কি আদৌ সত্য ছিলো! নাকি সব কিছুই ক্ষণিকের বাসনা! ক্ষণিকের মরীচিকা! মূহুর্তের রঙ্গিন জীবন ধূসর ছাই বর্ণের হয়ে গেলো! উমার মনে হলো তার রংধনুর মূহুর্তগুলো সব মিথ্যে। রুদ্র চোয়াল শক্ত। তার চোখে শান্ত দৃষ্টি। বুকটা তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে প্রেয়সী চোখে নিজের জন্য ঘৃণার রেখায়। চেয়ারটা টেনে বসলো রুদ্র। জলের গ্লাসটি এগিয়ে দিয়ে শান্ত গলায় বললো,
“জলটা খেয়ে নাও”

উমা ঘৃণাভরা দৃষ্টিতে তাকালো রুদ্রের দিকে। দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষুদ্ধ কন্ঠে বলে উঠে,
“কোনো মানুষ এতোটা পশু হতে পারে আমার জানা ছিলো না!”
“তোমার জানার বাহিরেও অনেককিছু আছে উমা; সবকিছু জানতে হবে এমনটাতো কথা নেই”
“নির্মম পাশবিক অত্যাচার করার সময় হাত কাঁপলো না আপনার! তারাও কারোর পিতা, কারোর ছেলে, কারোর স্বামী। একটি বার নিজের সন্তানের কথাও ভাবলেন না! এই রক্তাক্ত হাতে কিভাবে ছুবেন তাকে! আপনি আমায় কথা দিয়েছিলেন, কথা দিয়েছিলেন এই হাতে কারোর রক্ত লাগতে দিবেন না! কি হলো সেই কথার! সব মিথ্যে! সব ধোয়াশা! কেবল মরীচিকা!”

উমা চিৎকার করে কাঁদছে। তার বিলাপ কানে আসছে রুদ্রের। কিন্তু সে নির্বিকার। শান্ত দৃষ্টিতে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। উমা এক সময় চোখ মুছে নিলো, খুব কষ্ট করে উঠে বসলো সে। মনের জোর যেখানে গুড়ো গুড়ো হয়ে যায় সেখানে শরীর ও কেবল ই মাংসের দলা। উমাকে উঠতে দেখে নড়ে চড়ে উঠে রুদ্র। চেয়ার ছেড়ে উমাকে ছুতে নেয়। উমা তাকে বাধা দেয়,
“ছোবেন না আমাকে, রক্ত লেগে আছে এই হাতে। নিস্পাপ মানুষের রক্ত। অবশ্য অভিনব সিংহের রক্ত কি ভালো হতে পারে! কি অপরাধ ছিলো তাদের! কেনো এতোটা পাশবিক অত্যাচার করছেন! কেনো? ওই ডাক্তারটিকে আপনি এতোদিন আটক করে রেখেছিলেন তাই না? তাই তো যখন হাসপাতাল থেকে সে গায়েব হয়ে গেলো আমাকে পুরো ঘটনা থেকে দূরে রেখেছিলেন। কি দোষ এদের! কেনো এসব! উত্তর দিন!”

উমা রুদ্রের শার্ট আকড়ে ধরে। একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে! এতোসময় পর রুদ্র অবশেষে মুখ খুলে,
“এদের বাঁচার অধিকার নেই, মানুষ রুপী জানোয়ার গুলো পৃথিবীতে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া শ্রেয়। আমিতো তাও এদের বাঁচিয়ে রেখেছি।”

রুদ্রের উত্তরে স্তব্ধ হয়ে যায় উমা। উমার মনে হলো এই রুদ্র সেই পূর্বের রুদ্র, নির্মম, নিষ্ঠুর রুদ্র। যার কাছে মানুষ কেবল ই এক দলা হাড় মাংসের স্তুপ। রুদ্র উমার চোখে চোখ রেখে বললো,
“জিজ্ঞেস করছিলে না এদের দোষ কি! তবে জেনে রাখো, এদের জন্মানোটাই দোষ। আমার কাছে এরা নর্দমার কিট। আর রুদ্র সিংহ রায় কাউকে দয়া করতে শিখে নি। এই ধরণীতে নরকের স্বাদ কেমন লাগে তাদের ও জানা উচিত। উমা, আমি কখনো ভালো ছিলাম না। অভিনব সিংহের রক্ত কি ভালো হতে পারে! আমি এমন ই, আমার সন্তান ও তার জানোয়ার বাবাকে চিনবে!”

উমা স্তব্ধ হয়ে রইলো। আজ মানুষটির কথাগুলোও তার অচেনা লাগছে। অজানা লাগছে সেই চির পরিচিত মানুষটিকে। উমা সঠান হয়ে দাঁড়ালো, রুদ্রের চোখে চোখ রেখে বললো,
“একটা প্রশ্নের উত্তর দিবেন?”
“বলো”
“কেনো? সব তো ভালোই ছিলো”
“আমি এমন ই, আমি তো বলেইছিলাম উমা। নিজেকে বদলাতে পারবো না। এই পৃথিবী ভালো মানুষের নয়। বাদল, মকবুল, এই ডাক্তারের মতো মানুষগুলো তোমাকে ভালো থাকতে দিবে না।”

রুদ্রের হেয়ালী কথার মর্মার্থ বুঝতে পারবো না উমা। উমা তীক্ষ্ণ গলায় বলে উঠে,
“যদি অপরাধী হয়ে থাকে তবে আইন আছে”
“তোমার মনে হয় আইন সত্যি আছে? যখন আইন ই দূষিত থাকে, তখন কোনো আইন সত্যি অন্ধ হয়ে যায়। আর আমি কখনোই আইনের অপেক্ষা করি নি, প্রতিবার শাস্তি নিজ হাতেই দিয়েছি।”

রুদ্র এবার শান্ত গলায় বললো,
“আজ যা হয়েছে ভুলে যাও, ভুলে যাও এখানে এসেছিলে, ভুলে যাও কিছু দেখেছো। আমাদের জীবন যেমন ছিলো তেমন ই থাকবে।”
“সম্ভব নয়! সব ভুলে পুনরায় আগের মতো থাকতে যে পারবো না আমি। মানলাম তারা অন্যায় করেছে। কিন্তু আপনার কোনো অধিকার নেই এই পাশবিক কর্মকান্ড চালানোর। তারা যদি দোষী হয় আপনিও নিষ্কলুষ নয়।”

রুদ্রের উত্তরটা জানা ছিলো। কিন্তু তবুও সে উমার রুঢ়তা নিতে পারছে না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। রুদ্র চোখ বুঝে নিজেকে সামলে নিলো। উমার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আফসোস এই পশুর সাথেই তোমাকে থাকতে হবে। এই প্রশুর সাথেই থাকতে হবে চিরটাকাল। ঘৃণা করো বা ভালোবাসো এই পশুই তোমার সন্তানের পিতা”

রুদ্রের দৃষ্টিতে হিংস্রতা স্পষ্ট, সাথে এক অদম্য জিদ। জিদ উমাকে নিজের সাথে বেধে রাখার। উমা নিশ্চুপ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রুদ্রের দিকে, এতো কাছে থেকেও এক অদৃশ্য দেয়াল তাদের মাঝে। এই দেওয়াল ভাঙ্গা ইহজীবনে কি সম্ভব___________

অভিনব সিংহ মাটিতে বসে আসেন। তার সেলটি অন্যরকম। যথেষ্ট পরিষ্কার, মাটিতে শুলেও মোটা দুটো কম্বল দেওয়া হয়েছে। অভিনব সিংহ সেলে পায়চারী করছেন। তখন ই এক কস্টেবল এসে খুলে দিলো তার সেলের লকাপ। হিনহিনে স্বরে বললো,
“আপনার সাথে দেখা করতে এসেছে। আসুন। সময় পনেরো মিনিট”

অভিনব সিংহের সাথে এমন হেয় ভাবে কথা এই প্রথম কেউ বললো। কিন্তু সে এই অপমান গিলে নিলেন। দেখা করার জায়গায় জালের ওপাশে দীপঙ্গকর দাঁড়িয়ে আছে। অভিনব বাবুকে দেখেই সে জিজ্ঞেস করলো,
“জ্যেঠু, কেমন আছেন?”
“দীপঙ্কর আমাকে দেখে তোমার কি মনে হচ্ছে?”

দীপঙ্কর একটু দমলো। অভিনব বাবু তখন বললো,
“বাহিরের অবস্থা কি?”
“কি বলবো জ্যেঠু, কোনো উকিল আপনার কেস লড়তে চাচ্ছে না। শাশ্বত একেবারে ঝোপে কোপ মেরেছে। এতো নিঃশব্দে এতো বড় চাল চালবে বুঝতেই পারি নি। একেবারে ঘোড়ার আড়াই।”
“বেশি কথা ভালো লাগে না দীপঙ্কর”
“আমাকেই বকে গেলেন জ্যেঠু৷ অবশ্য আপনার ও মাথা কি ঠিক আছে৷ যেখানে দুধ কলা দিয়ে কালসাপ পুষেছেন। ছোবল তো দিবেই। অবশ্য দুটো কালসাপ এক সাথে ছোবল দিলে তো মৃত্যু নিশ্চিত থাকে”

দীপঙ্কর অপ্রাসঙ্গিক কথায় বিরক্ত হলেন অভিনব বাবু। হুংকার ছেড়ে বললেন,
“খলসা করে বলো দীপঙ্কর”

এবার দীপঙ্কর বললো,
“শাশ্বত একা আপনাকে ফাঁসায় নি, রুদ্রদাদা ছিলো পেছনে………..

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

৪৯তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/447535390301572/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here