উমা [কপি করা নিষেধ] ৫১তম_পর্ব

#উমা [কপি করা নিষেধ]
৫১তম_পর্ব

দীপঙ্কর অপ্রাসঙ্গিক কথায় বিরক্ত হলেন অভিনব বাবু। হুংকার ছেড়ে বললেন,
“খলসা করে বলো দীপঙ্কর”

এবার দীপঙ্কর বললো,
“শাশ্বত একা আপনাকে ফাঁসায় নি, রুদ্রদাদা ছিলো পেছনে। আমি ভেবে পাই না, ছেলে হয়ে নিজের বাবাকে এভাবে ফাঁসাতে পারে?”

দীপঙ্করের হেয়ালী কথা ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে এলো অভিনব সিংহের। গম্ভীর সন্দিহান কন্ঠে সে প্রশ্ন ছুড়লো,
“তোমার মাথা কি ঠিক আছে? রুদ্র আমার ছেলে, আমার রক্ত। নিজের বাবার পেছনো ছোরাঘাত সে করবে না।”
“আপনি বড্ড সরল মনের জ্যেঠু, কিন্তু রুদ্র দাদা তেমন নয়। আপনার মনে নেই! সে কিভাবে গত নির্বাচনের সময় আপনার শত্রুদের সাথে হাত মিলিয়ে আপনার বিরোধী দলে যোগ দিয়েছিলো। আপনার বিরুদ্ধে কত বড় ষড়যন্ত্র করেছিলো। কোন ছেলে নিজ পিতার সাথে এমনটা করে! আমাদের প্রতিটা ছেলে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়েছিলো। ভোট চুরি তো দূরে থাক আমরা একটা ব্যালোট ছুতে ও পারি নি। রুদ্র সেখানে উপদথিত না থেকেও আমাদের সকল কাজ ভেস্তে দিয়েছিলো। জ্যেঠু, রুদ্রদাকে আপনি ভালোবাসলেও সে আপনাকে নিজের বাবা হিসেবে মানে না। আসলে ক্ষমতা জিনিসটাই এমন! শাহজাহান বলুন বা আওরঙ্গজেব সবাই এই গদির লোভে নিজের বাপকেও ছাড়ে নি। আর এতো আমাদের রুদ্র দাদা। সামনে ভোট, আপনি যেনো মনোনয়ন পত্র না পান সেটার পুরো ছক কষেছে রুদ্র দাদা। নয়তো গোপনীয় খবর গুলো শাশ্বত দাদা জানলো কি করে জ্যেঠু। সব রুদ্র দাদার পরিকল্পনা। ছেলে বেলা থেকে আপনার নুন খেয়েছি। আপনার প্রতি আমার দূর্বলতা আছে, যতই হোক বাপের জায়গায় আপনাকেই দেখে এসেছি। তাই বলছি, জ্যেঠু অন্ধবিশ্বাস পতনের মূল”

অভিনব সিংহের মুখশ্রীতে এক চিন্তার রেখা ভেসে উঠলো। উদ্বিগ্নতা তাকে গ্রাস করছে ধীরে ধীরে। বৃদ্ধ শরীরের ভেতরের মজিবুত হৃদয় টলোমলো হয়ে গেলো। বুকটা চেপে ধরে এলো তার। সন্তানের প্রতি প্রছন্ন ভালোবাসাটা মাথা তুলে দাঁড়ালো। চোখটা জ্বলছে, জ্বলছে কাঁচের মতো স্বপ্নগুলো ভেঙ্গে যাওয়ায়। অভিনব সিংহ ও দূর্বল হয়, তারও অদম্য প্রাচীর হাটু গেড়ে বসে। সেও সাধারণ মানুষের ন্যায় কাবু হয়। বিষাদ যন্ত্রণা তাকেও হানা দেয়। সে কিছু বললো না। এর মাঝেই কন্সটেবল এসে তীক্ষ্ণ অবহেলিত স্বরে বললো,
“সময় শেষ, চলেন”

দীপঙ্করের মাঝে তীক্ষ্ণ অস্থিরতা, অস্থিরতা জ্যেঠুর প্রতিত্তোরের। সে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো অভনব সিংহের দিকে। কিন্তু তাকে হতাশ করে অভিনব সিংহ বললো,
“তুমি আমার বেইলের ব্যবস্থা করো দীপঙ্কর। আর রুদ্রকে একবার দেখা করতে বলো”

বলেই সেই কন্সটেবলের সাথে চলে গেলো। চরম বিরক্তি এবং ক্রোধে দীপঙ্করের মুখ বিকৃত হয়ে এলো। মুখ খিঁচিয়ে বললো,
“শালা বুইড়া”

অভিনব সিংহের এলোমেলো পদক্ষেপ তাকে নিয়ে গেলো তার বর্তমান বাসস্থানে। চৌদ্দ শিকের এই ঘরটি ই তার আবাস্থল। চুন খোয়া নোংরা দেওয়ালটির দিকে চাইলে এই ইহজীবনের কর্মগুলো সিনেমার মতো চিত্রিত হতে লাগলো। নিজের সকল পাপ কাজ গুলো জীবন্ত হয়ে উঠলো অভিনব সিংহের চোখে। আজ নিজেকে পরাজিত এক সেনানায়ক লাগছে। মহাভারতের জমিতে থাকা সেই কৌরভ সেনানায়ক, যাকে পরাজিত করেছে নিজের আপনজন, হ্যা নিজের আপনজন_____

—————

উমা নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। হাতজোড়া উদর আগলে রয়েছে। হিনহিনে বাতাসে সাপের মতো প্যাচানো চুলগুলো উড়ছে। হাওয়া মুখশ্রী ছুয়ে যাচ্ছে পরম আদরে৷ আবার সেই বদ্ধ কারাগারেই তাকে ফিরতে হলো৷ প্রতিনিয়ত অসহ্য যন্ত্রণার অগ্নি ভেতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিচ্ছে।নিখিলের মৃত্যুর পর রুদ্রকে আকড়েই তার দুনিয়াটা ছিলো৷ ছিলো তার নিবিড় ভালোবাসার উৎস। ছোট উমা জানতোই না ভালোবাসা কি! পরিবারের বাইরেও কারোর প্রতি আবেগের সঞ্চার হতে পারে! রুদ্র সেই মানুষটি যার প্রতি তার প্রথম আবেগ জন্মেছিলো, সেই পুরুষ তার আলিঙ্গনে অস্বস্থির বদলে স্বস্থির ছোয়া পেতো। সেই মানুষটির উষ্ণ হাসির ছাপে নিজেকে আবিষ্কার করতো উমা। ঢাল হয়ে সকল কন্টককে নিজের মাঝে সমাহিত তাকে এগিয়ে দিতো ধরণীর ফুলজড়িত পথে। সেই মানুষটি কি করে এতোটা নিষ্ঠুর হতে পারে! উমা সেদিন গভীর রাতে পুনরায় সেই পাতালের ঘরে গিয়েছিলো। কিন্তু কাউকে খুজে পায় নি। অর্থাৎ রুদ্র খুব নিপুন ভাবে তাদের সরিয়ে ফেলেছে। উমা যখন তাদের তন্নতন্ন করে খুজছিলো তখন রুদ্রের প্রবেশ ঘটে। ভারী গম্ভীর থমথমে কন্ঠে বলে,
“তারা এখানে নেই”

উমা চমকে উঠে পিছনে চাইলে রুদ্রের রুদ্রমূর্তি দেখতে পায় সে। চোখজোড়া রক্তিম বর্ণ ধারণ করে রয়েছে। সরু তীর্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার পানে৷ উমার বুক কেঁপে উঠলো। কেনো যেনো সেই মূহুর্তে রুদ্রকে বড্ড অচেনা লাগছিলো তার। চেনা মুখের আদলে অচেনা মানুষটিকে দেখে অজানা ভয়ে হাত পা শীতল হয়ে এলো। রুদ্র ধীর এগিয়ে আসতে লাগলে উমা পেছাতে থাকে। পেছাতে পেছাতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে ঈষৎ চমকে উঠে উমা। তখন রুদ্র উমার সম্মুখে চলে আসে। তার উষ্ণ নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে; রুদ্র ধীর কন্ঠে বললো,
“ভয় পাচ্ছো?”

উমা রুদ্রের চোখে চোখ রাখে। কি উত্তর দিবে সে! এতো বছরের পরিচিত মুখখানা অপরিচিত যে বড্ড অপরিচিত ঠেকছে! উমাকে চুপ থাকতে থেকে রুদ্র বলে,
“চিন্তা করো না, তোমার কোনো ক্ষতি আমি করবো না। পারবো না, ভালোবাসি যে”
“নিষ্ঠুর পশুরাও কাউকে ভালোবাসতে পারে?”

উমার কথায় বাকা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে রুদ্র। তারপর বিদ্রুপের টানে বলে,
“পশুরাই ভালোবাসতে পারে। মুখোশধারী ভালোমানুষগুলোই সেই ভালোবাসার অপমান করে পদে পদে করে। উমা, সর্বদা চোখের দেখাটাই সত্য হয় না৷ সত্য অনেক গভীর। সেই গভীরত্ব মেনে নেওয়াটাই দুষ্কর”
“আমিও জানতে চাই। সেই সত্যকে আমিও অনুধাবন করতে চাই।”
“অহেতুক এসব এ জড়ানোর কি আদৌ কোনো মানে আছে? ভালোই তো আছো আমার মহলে। রাজরাণীর মতো রাখবো। আমাকে আমার কাজ করতে দাও। আমি চাই না তুমি আমর অবাধ্য হও”

রুদ্রের কথায় চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে উঠে উমার। এতোসময়ের ভীতু নারী নির্ভীক মূর্তিতে পরিণত হয়৷ নিজেকে সংযত রাখতে পারলো না সে। একজন মানুষের ভেতরটা সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে গেলে অন্তরের ভয়গুলো এক এক করে বাস্পীভূত হতে থাকে। আজ উমার নিজেকে নিঃস্ব মনে হচ্ছে। তীব্র ঝাঝালো স্বরে বললো,
“যদি বাধ্য হয়ে না থাকি তবে?”

উমার প্রশ্নে ভ্রু কুঞ্চিত হয়ে আসে রুদ্রের। থমথমে স্বরে বলে,
“আমি প্রতারকদের সাথে কি করি তা হয়তো তোমাকে বুঝিয়ে বলতে হবে না। রুদ্র ভালোবাসলে যেমন সব উজার করে ভালোবাসে, ঘৃণা করার সময় ও সব ধ্বংস করতে দুবার ভাবে না।”

রুদ্র এবং উমার দৃষ্টি বদল হয়৷ কেউ কাউকে ছাড় দিতে রাজী নয়। নিজেদের মূল্যোবোধের কাছে বাঁধা তারা। উমার সেদিনের কথা মনে হতেই চোখ ঝাপসা হয়ে উঠে। বুকের ভেতরের চব্বিশ ঘন্টা জ্বলমান অগ্নিকুন্ড কিছুতেই নিভসে না। তার ভয় হয়, নিজের জন্য নয়। নিজের অনাগত সন্তানের জন্য৷ এই কেমন পরিবারে নিজের সন্তানকে আনতে চলেছে সে। সে কি আদৌ স্বাভাবিক জীবনটা পাবে? উমা পরমূহুর্তে চোখ মুছে নেয়। সত্যের সন্ধান সে করবে! রুদ্র যদি ভুল পথকে বেঁছে নেয় তবে স্ত্রী হিসেবে তাকে বাধা সে দিবে। শেষ একটা চেষ্টা করতে চায়! নিজের জন্য নয়, নিজের সন্তানের জন্য।

শাশ্বতের সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে সুমন এবং রাজশ্বী। শিবপুরের জমিদখলের কান্ডের বিবরণ দিয়েছে সুমন। সুমনের কথাগুলো শুনে কিছুসময় চুপ করে থাকে শাশ্বত। এতোবড় অরাজকতা চলছে অথচ তারা কেউ জানেও না। শাশ্বতকে চুপ করে থাকতে দেখে রাজশ্বী প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,
“দিনের পর দিন এমন হয়ে চলেছে স্যার, আমরা কি কিছুই করতে পারি না?”
“কিন্তু আমাদের কাছে প্রমাণ নেই রাজশ্বী”
“প্রমাণ নেই বলে কি হাতের উপর হাত রেখে বসে রইবো আমরা? কিছুই করবো না? আমরা তো সাংবাদিক, সমাজের দর্পন আমরা। ওখানের থানার পুলিশেরা প্রচুর টাকা গিলে বসে আছে। ওদের কাছে গেলে বলে, আমরা নাকি তিলকে তাল করি। এভাবে আর কতোদিন অরাজকতা চলবে?”

শাশ্বতের মুখ থমথমে হয়ে যায়। কিন্তু সে ইতিমধ্যে অন্য খবর কভার করছে এই জমি দখলের খবরে হাত দিতে পারছে না। গম্ভীর স্বরে বলে,
“স্ট্রিং অপারেশন করতে পারবে?”

শাশ্বতের কন্ঠে এক সুপ্ত ভয় লুকায়িত৷ সুমনের মুখখানা লম্বাটে হয়ে যায়। কিন্তু সকলকে অবাক করে রাজশ্বী বলে উঠে,
“আমি রাজী”

শাশ্বতের ঠোঁটে স্মিত হাসি ফুটে উঠে। রাজশ্বীকে দেখে তার উমার কথা মনে পড়ে গেলো। সেই একই মুখের আদল, সেই একই তেজ, সেই একই উদ্যমী মনোভাব। শাশ্বত পুনরায় বললো,
“তুমি সত্যি রাজী?”
“জ্বী স্যার, আমি রাজী”
“বেশ, কাল তবে তোমরা এই অপারেশনটি করবে। অপারেশনটি হবে। আমি ঢাকা থেকে কিছু ভালো ক্যামেরা এবং ভয়েস রেকর্ডিং পেন এনে দিবো। মনে থাকে যেনো, সাবধানে। প্রচুর রিস্কি একটা কাজ। এরা কিন্তু মানুষ রুপী হিংস্র জানোয়ার।”

রাজশ্বী সম্মতি প্রদান করলো। কিন্তু সুমনের মুখখানা চুপসে গেলো। তার ভয় হচ্ছে। সে মানুষ রাতারাতি মানুষের গলা কেটে দেয় তারা কতটা ভয়ংকর ধারনার অতীত………

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আগামীকাল দুটো পর্ব পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]

মুশফিকা রহমান মৈথি

৫০তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/448248733563571/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here