#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০২
_____________________
এই পৃথিবীকে আদতে আমরা যতটা কঠিন মনে করি, আসলে পৃথিবী তার থেকে অনেক বেশি কঠিন। এখানে কোনো কিছুই সহজলভ্য নয়। মানুষ জীবনের পথে চলতে চলতে এই চরম সত্যটা উপলব্ধি করতে শেখে।
রাত্রিকালে ছাদের হিমেল হাওয়া এবং তুষারপাতে স্তূপকৃত বরফের ছোটো ছোটো তুষার পাহাড়ের মাঝে বসে কথাগুলো হঠাৎই ইরতিজার মনে অহেতুক অনিবার জেগে উঠলো। হঠাৎ কেন জেগে উঠলো জানে না। ইরতিজা এ নিয়ে নিজের ভাবনার বিস্তৃতি ঘটালো না। তার ভাবনা থাকা উচিত এখন সাজিদ আহসানকে নিয়ে। লোকটা কীসে খারাপ? ভালো চাকরি, দেখতে সুদর্শন, কথাবার্তা ভালো, তার মা-বাবাও কী অমায়িক! কোনো খারাপ বিষয়ই চোখে ধরা পড়ছে না। এমন কাউকে লাইফ পার্টনার হিসেবে পেলে সুখী বোধ করা উচিত। কিন্তু সে আজ দেখা করে কত কী বলে আসলো। লোকটা নিশ্চয়ই এতক্ষণে বাবাকে ফোন করে সব জানিয়ে দিয়েছে। বলেছে, আপনার মেয়ে এই এই বলেছে আমাকে।
আসলে এটাই চায় ইরতিজা। নিজে প্রথমে সরাসরি বাবাকে কিছুতেই বলতে পারবে না এই বিয়ে করবে না। কিন্তু যা বলে এসেছে লোকটা যদি তার সাথে কিছু বাড়িয়ে বাড়িয়েও দুর্নাম বলে, তাও বাবার কাছে এরপর বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে এই বিয়ে করবে না। হয়তো কিছুটা আজব তার চিন্তাধারা, কিন্তু সে যথেষ্ট দৃঢ় তার চিন্তা ধারার উপর।
শীতল হাওয়ার ঝাপটা এসে লাগলেই কেঁপে উঠলো ইরতিজা। ঠান্ডার মধ্যে ছাদে এসে বসে থাকতে তার আসলে খারাপ লাগে না। যত ঠান্ডাই হোক সে এসে ছাদে বসে থাকে প্রায়ই। বসার জন্য জায়গা আছে ছাদে। সেখানে বসে রাতের শহর দেখার মাঝে অন্য রকম ভালো লাগা, তৃপ্তি খুঁজে পায় সে। দূরের বিশাল বড়ো বড়ো এপার্টমেন্ট গুলোতে আলো জ্বলছে। নেইবরহুডদের বাড়িতে জ্বলমান আলো রাস্তায় ছিটকে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে। ইরতিজা ছাদে একবার নজর বুলালো। বরফ গলানোর জন্য ছাদে লবণ ছিটানো হয়নি। বরফগুলো পাশে ঠেলে রেখেছে শুধু। একেকটা স্তুপ দেখে মনে যে শব্দটা আসে প্রথমে সেটা হলো- তুষার পাহাড়। কয়েকটা বালতিতে বরফ সংরক্ষণ করা হয়েছে। মূলত তৃতীয় ফ্লোরের স্টিফেন আঙ্কল করেছে কাজটা। ইরতিজা ক্ষুদ্র নিঃশ্বাস ত্যাগ করলো।
কারো হেঁটে আসার পদ শব্দ হচ্ছে। না তাকিয়েই অনুমান করলো বাবা। তাও ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিলো। হুম, বাবাই। আজাদ চৌধুরীর গায়ে কালো জ্যাকেট। হাত দুটোকে শীত থেকে বাঁচাতে পকেটে গুঁজে রেখেছে। ইরতিজা ঘাড় ফিরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। জানে বাবা এখন আজ সে সাজিদের সাথে দেখা করে যা যা বলেছে সেই সম্পর্কে কথা বলবে। ভয় পাচ্ছে না। বাবা যাই বলুক সেও বলে দেবে বিয়ে করবে না সাজিদকে। কোনো এক কারণে মেনেই নিতে পারছে না এই এনগেজমেন্ট।
বাবা পাশে এসে দাঁড়ালে ইরতিজা ওপাশে সরে গিয়ে বাবাকেও বসার জায়গা দিলো।
আজাদ চৌধুরী বসলেন। ইরতিজা সেই যে ঘাড় ফিরিয়ে সোজা হয়ে বসেছিল আর বাবার দিকে তাকায়নি। আজাদ চৌধুরী এক দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিছু ভাবলেন না। ভাবনারা সব নিশ্চল। শুধুই তাকিয়ে রইলেন। সময় গেল।
আজাদ চৌধুরী এক পর্যায়ে বললেন,
“আজ সাজিদের সাথে দেখা করে কী কী বলেছো তুমি?”
ইরতিজা বাবার দিকে তাকালো। চোখে চোখ পড়লে চেয়ে থাকার সাহস হলো না। চোখ নামিয়ে ফেললো। ভয় নয়। ভয়হীন বিচলিত ভাব কাজ করছে তার অন্তঃ মাঝে। রিনরিনে কণ্ঠে বললো,
“আমি কী কী বলেছি সেটা নিশ্চয়ই মিস্টার সাজিদ তোমাকে বলেছে!”
“নিজেকে খারাপ বলে প্রমাণ করতে এত উঠে-পড়ে লেগেছো কেন?”
ইরতিজার চক্ষু ভিজে এলো। বাবার চোখে চেয়ে করুণ কণ্ঠে বললো,
“আমি সাজিদ আহসানকে বিয়ে করতে চাই না আব্বু।”
“কেন?”
“জানি না। কিন্তু আমি এটা মেনে নিতে পারছি না। অর্টনের সাথে তো আমার রিলেশন ছিল না, তাহলে কেন এই এনগেজমেন্ট মানতে হবে আমার?”
“এনগেজমেন্ট যেহেতু হয়ে গেছে, সাজিদের সাথেই বিয়ে হবে তোমার।”
“আব্বু!” কোমল কণ্ঠের ডাক ইরতিজার।
আজাদ চৌধুরী কিছু বললেন না। শান্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখের পলক পড়লো না। ইরতিজাও ক্ষণকাল স্থবির চেয়ে থেকে গলায় জোর দিয়ে বলে উঠলো,
“ওই লোককে বিয়ে করবো না আমি।”
“তুমি এরকম করলে রেডমন্ড যাওয়ার আগেই তোমাদের বিয়ে পরিয়ে দেবো। তুমি কি সেটা চাও?”
ইরতিজার অন্তর কম্পিত হলো। অবিশ্বাস্য কণ্ঠে বললো,
“রাগি বাবাদের মতো কেন আচরণ করছো আব্বু? আমি এখনও অনেক ছোটো। এত অল্প বয়সে তুমি মেয়ের বিয়ে দেবে?”
“দরকার হলে তাই দেবো। তুমি বিশে পা রেখেছো। বিয়ের জন্য উপযুক্ত তুমি।”
আজাদ চৌধুরী উঠে দাঁড়ালেন। কয়েক পা দূরে চলে যাওয়ার পর ইরতিজা পিছন থেকে চেঁচিয়ে বললো,
“ওই লোক আমার থেকে নয় বছরের বড়ো!”
আজাদ চৌধুরী থামলেন। কণ্ঠে শীতলতার ছোঁয়া রেখে বললেন,
“আমি তোমার মায়ের থেকে বারো বছরের বড়ো।”
ইরতিজা দমে গেল। মুখে আশা-ভরসা হারিয়ে যাওয়ার করুণ দৃশ্যের চিত্রাঙ্কন ফুঁটে উঠলো। সে জানে তার মা এবং বাবার মাঝে বয়সের পার্থক্য বারো বছর। কিন্তু দুজনকে দেখে একদমই বোঝার উপায় নেই তা। দু জনের মাঝে কী গাঢ় মিল, ভালোবাসা! ইরতিজার মাঝে মাঝে মনে হয়, সম্পর্কে বয়সের ব্যবধান যত বেশি হবে ততই যেন ভালোবাসাও গাঢ় হবে। যদিও তার ধারণা যুক্তিহীন। তবুও তার এটা মনে হয়।
আজাদ চৌধুরী যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলেন। কী মনে হতেই থামলেন আবার। পিছন ফিরে বললেন,
“আর হ্যাঁ, সাজিদ বলেছে তোমার এমন আচরণ ওর খুব মনে ধরেছে। তুমি নিজেকে খারাপ বলে দাবি করেছো, ওকে বিয়ে করতে নিষেধ করেছো, এসবে ও মুগ্ধ হয়েছে।”
বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম ইরতিজার। ধীরে ধীরে তার বিস্ময় লজ্জাতে রূপ নিলো। বাবার থেকে চোখ সরিয়ে এনে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলো। মুখে লজ্জাভাব আলপনা আঁকতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঠোঁটের কোণে লজ্জামাখা হাস্য দুত্যি ছড়িয়ে পড়লো। ইশ, লোকটা কী? লোকটা একটা…জানে না লোকটা কী, তবে লোকটার বড়ো একটা খারাপ দিক, অর্থাৎ খুঁত খুঁজে পেয়েছে সে। খুঁতটা হলো, লোকটা একটা বেশরম! তা না হলে নিজের হবু শ্বশুরের কাছে ‘আপনার মেয়ের আচরণ মনে ধরেছে’ এটা এত সহজে বলে দিতে পারে? নিজেরই তো শুনতে লজ্জা লাগলো। লোকটার বলতে লজ্জা লাগেনি? বেশরম একটা!
___________________
গত চারদিন ধরে প্রকৃতি মেঘলা ছিল। কিন্তু আজ সূর্য তার দুত্যি ছড়িয়ে দিয়েছে ধরণী মাঝে। চকচকে সোনালি দিন। তুষারপাতের চিহ্ন এখনও কিছু কিছু জায়গায় বিদ্যমান রয়ে গেছে। যেমন ইরতিজাদের বাড়ির সামনেই ছোট্ট লনটার এক সাইডে এখনও বরফ আছে। সেই বরফের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল সাজিদ। ইরতিজার আগমনে দৃষ্টি সরে গেল। ইরতিজা রুমে প্রবেশ করে শুধালো,
“আপনি চা খাবেন? না কফি?”
ইরতিজার হাতে দুটো কাচের কাপ। দেখাই যাচ্ছে তাতে রং চা। সাজিদ বললো,
“নিয়েই তো এসেছেন চা, আবার প্রশ্ন করছেন কেন?”
ইরতিজা হকচকিয়ে গেল। প্রশ্নটা তো করেছে সে ভদ্রতার খাতিরে। লোকটার এমনভাবে উত্তর দিতে হবে? হ্যাঁ, সে চা নিয়ে এসেছে। কিন্তু প্রশ্নটা যখন করেছে তখন লোকটাও তো ভদ্রতার পরিচয় দিয়ে উত্তর দিতে পারতো, ‘আমি চা খাবো’। তা না করে অভদ্রের মতো চটাং চটাং উত্তর দিলো। যাই হোক, কথা বাড়াবে না এ নিয়ে। ইরতিজা বারান্দায় এসে সাজিদের দিকে একটা কাপ বাড়িয়ে দিয়ে দৃষ্টি দিলো প্রকৃতি পানে। প্রকৃতির উজ্জ্বলতা দেখলে মন ভালো হয়ে যায়। আকাশের নীল বুকে সাদা পেঁজা তুলো ঝুলে আছে। আকাশের দিকে তাকিয়েই সে চায়ের কাপে চুমুক দিলো।
“এত নিশ্চিন্ত দেখাচ্ছে যে আপনাকে? আমার জন্য বউ খুঁজে দেওয়ার কথাটা কি বেমালুম ভুলে গেছেন?”
ইরতিজা তেরছা চোখে তাকালো।
“ভুলে তো যাইনি। আপনাকে তো বলেছি, আমি আপনাকে বউ খুঁজে দেবো। রেডমন্ড যাচ্ছি। রেডমন্ডে গিয়ে বউ খুঁজবো আপনার জন্য।”
“তাই?”
ইরতিজা হাসি মুখে মাথা নাড়লো। তার মুখে কোনো চিন্তা নেই। যেন রেডমন্ড গিয়ে সত্যিই একটা বউ খুঁজে পাবে সে।
সাজিদ হালকা ওদিকে ঘুরে গিয়ে হাসলো। মেয়েটাকে বড্ড বোকা মনে হচ্ছে তার। আর এই বোকা বোকা ভাবটাই ভীষণ ভালো লাগছে। বোকাতেই অনেকে বেশি সুন্দর হয়, যা বিচক্ষণ হলে হয় না।
“আর যদি বউ খুঁজে না পান?” প্রশ্নটা করে চায়ের কাপে চুমুক দিলো সাজিদ।
“পাবো না কেন? নিশ্চয়ই পাবো। দরকার হলে খুঁজতে খুঁজতে আমি পুরো ওয়াশিংটন ত্যানা ত্যানা করে ফেলবো।”
ইরতিজার আসলেই কোনো চিন্তা নেই। তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস। উত্তেজনা অনুভব করছে। এখন বাজে বেলা এগারোটা। তারা বিকেলে রেডমন্ড যাওয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করবে। নতুন শহর, নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার মাঝে একটা আনন্দ আছে। আর শুনেছে রেডমন্ড অপূর্ব সুন্দর একটা শহর। ইরতিজার বড়ো চাচা হামিদুল চৌধুরী রেডমন্ড থাকে। ইরতিজার বাবারা মোট চার ভাই-বোন। বড়ো হচ্ছে ফুফু, যার কাছে জোনাস ছবি এবং ম্যাসেজ পাঠিয়েছিল। ফুফুর যমজ হচ্ছে বড়ো চাচা। যিনি রেডমন্ড থাকেন। এরপর ইরতিজার বাবা। তারপর আর এক ফুফু আছে। সে বাংলাদেশে শান্তিতে বসবাস করছে। আমেরিকা আসার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা তার নেই।
ইরতিজা আমেরিকা এসেছে তিন বছর হলো। বাবা অনেক আগে থেকেই আমেরিকা থাকেন। সিটিজেনশিপ পাওয়ার পর ফ্যামিলি আনার ব্যবস্থা করেন। মা, বোন ইরতিজার এক বছর আগেই আমেরিকা চলে আসে। কিন্তু ইরতিজা আসতে পারছিল না। এক্সামের জন্য তার এক বছর অপেক্ষা করে তারপর আসতে হয়েছে। সেই এক বছর নানা বাড়িতে ছিল।
“হেই টিজা!”
দূরের ডাক কানে এসে লাগলো। কেঁপে উঠলো বক্ষৎপঞ্জর। রাস্তায় তাকাতেই দেখতে পেল জোনাস দাঁড়িয়ে আছে। ওর সাইকেলটা পাশেই দাঁড় করানো। তাকিয়ে আছে দ্বিতীয় তলার বারান্দায়। যেখানে এই মুহূর্তে সে এবং সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে। কোন সাহসে এখানে এসেছে ছেলেটা? ইরতিজার রাগ লাগলো খুব। চায়ের কাপটা রেলিংয়ে রেখে রুমে এসে পড়লো। চেয়ারে বসে ছটফট করতে লাগলো। ছেলেটার সাহস দেখে সে অবাক হচ্ছে!
সাজিদও চলে এলো বারান্দা থেকে। এসে প্রশ্ন করলো,
“এটা সেই ছেলে না, যে অহনা আন্টির কাছে ছবি পাঠিয়েছিল?”
ইরতিজা কোনো ভণিতা ছাড়াই হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লো।
সাজিদ বললো,
“কিন্তু এরকম ভাবে চলে আসাটা উচিত হয়নি তোমার। ডাক দিলো তো সে।”
ইরতিজার মেজাজটা এবার আরেকটু খারাপ হলো। সাজিদ তাকে ‘আপনি’, ‘তুমি’ মিলিয়ে সম্বোধন করে। যা একদম ভালো লাগে না। গত কয়েকদিন ধরে এই কাজই করেছে সে। ইরতিজা বিরক্ত হয়ে বলে দিয়েছিল,
“আপনি আমার সাথে ইংলিশে কথা বলবেন এরপর থেকে।”
কিন্তু সাজিদ একদমই ইংলিশ ছুঁইয়ে দেখে না তার সাথে। সব কথা বাংলাতেই বলে।
“ও আমার ফ্রেন্ড নয়। ওর সাথে ফ্রেন্ডশিপ ভেঙেছি আমি। সুতরাং ও ডাকুক আর যাই করুক আমার কিছু যায় আসে না।”
সাজিদ আর কথা না বাড়িয়ে বললো,
“তোমার ইচ্ছা সব।”
বলে সে বারান্দায় এলো আবার। রাস্তায় তাকিয়ে দেখলো জোনাস নেই। কিন্তু ওর সাইকেলটা দাঁড়িয়ে আছে।
কিছুক্ষণ পর শারমিন আহমেদের আগমন ঘটলো। তিনি দরজায় দাঁড়িয়ে ইরতিজাকে বললেন,
“জোনাস তোমার সাথে দেখা করতে এসেছে।”
ইরতিজা মায়ের দিকে না তাকিয়েই বললো,
“ওকে চলে যেতে বলো।”
“যে বাড়িতে এসেছে দেখা করতে তাকে চলে যেতে বলা অভদ্রতা। লনে ওয়েট করছে তোমার জন্য। গিয়ে দেখা করো। ও তোমার বন্ধু। চলে যাওয়ার আগে ওর সাথে দেখা করা উচিত তোমার। তোমার বাবা দেখা করতে যেতে বলেছে।”
ইরতিজা মায়ের দিকে তাকালো। বাবাকে এখন একটুও বুঝতে পারছে না সে। যে ছেলেটা তাদের ফ্যামিলিতে অশান্তি লাগানোর মতো কাজ ঘটিয়েছিল, সে ছেলের সাথে কেন দেখা করতে যাবে? বাবা কেন অনুমতি দিচ্ছে? দেখা করতে বলছে?
ইরতিজা সাজিদের দিকে তাকালো। সাজিদ বললো,
“দেখা করুন। শত হলেও সে আপনার বন্ধু।”
ইরতিজা আর কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। লনে এসে দেখলো নিচ ফ্লোরের মিসেস এপ্রিলের কুকুর বাঁধা লনে। মিসেস এপ্রিলকে দেখতে পাচ্ছে না। কুকুর বেঁধে রেখে সে যেখানে-সেখানে চলে যায় মাঝে মাঝেই। জোনাস কুকুরটার সাথে স্প্যানিশ ভাষায় কীসব বলছে। ইরতিজা বুঝতে পারছে না। পিছনে থেকে বললো,
“তুমি আবার কেন এসেছো? তুমি না সেদিন বলে গেলে ‘শেষ দেখা’?”
“আসা-যাওয়া সবই আমার ইচ্ছা।”
জোনাস পিছনে ফিরলো। ইরতিজাকে আগা-গোড়া একবার দেখে নিলো। কালো জিন্স এবং সাদা শার্টের উপর কালো হুডি পরেছে ইরতিজা। জোনাস হেসে জানালো,
“ইউ লুকিং সো প্রেটি টিজা।”
উঠে দাঁড়ালো সে। ইরতিজার কাছে এসে থামলো। তাকালো ইরতিজার রুম সংলগ্ন বারান্দায়। সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে। ইরতিজাকে প্রশ্ন করলো,
“হু ইজ হি? ইওর ফিয়ন্সে?”
“ইয়াহ!”
“বেশ হ্যান্ডসাম! আমার থেকেও অনেক সুন্দর বলা চলে। সে বেঙ্গলি?”
“আমি এ বিষয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি না। তুমি কী বলতে এসেছো সেটা বলো।”
“গত রাতে সকল ফ্রেন্ডরা তোমার সাথে শেষ দেখা করতে এসেছিল। তেমনি আমিও এলাম। আমি হয়তো রাতে না এসে সকালে এসেছি, এটা কি তেমন কোনো অপরাধ?”
ইরতিজা কিছু বললো না। জোনাস বললো,
“হাত দাও।”
“কেন?”
“চুমু খাবো।”
ইরতিজা চোখ রাঙিয়ে বললো,
“হোয়াট?”
জোনাস হেসে গিফট বক্সটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“বিদায়ী উপহার।”
ইরতিজা নিলো। ছোটো একটা বক্স। কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে দেখলো। হঠাৎ অনুভব করলো জোনাসের গিফট নেওয়াটা উচিত হয়নি তার। বক্সটা জোনাসের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
“আমি নেবো না তোমার গিফট।”
“এরকম করো না। পরে না নেওয়ার কারণে নিজেই কষ্ট অনুভব করবে। নিশ্চয়তা দিতে পারি এটার।”
ইরতিজা কিছু বললো না। বাবা জানতে পারলে হয়তো বলবে, কেউ গিফট দিলে সেটা গ্রহণ না করা চরম একটা অভদ্রতা।
“তোমাকে একবার হাগ করতে পারি টিজা?”
ইরতিজা এক পা দূরে সরে গিয়ে রাগে গমগম কণ্ঠে বললো,
“দূরে থাকো আমার থেকে।”
“কেন? অর্টন তোমায় চুমু খেতে পারলে, আমি হাগ করতে পারি না?”
বলে জোনাস কাছে এগিয়ে এসে হাগ করতে নিলেই ইরতিজা মাথা নিচু করে জোনাসের হাতের নাগাল কাটিয়ে দূরে সরে গেল।
জোনাস শব্দ করে হেসে উঠলো,
“তোমার সাথে মজা করতে অনেক ভালো লাগে টিজা।”
আরও কিছুক্ষণ একই রকম হাসলো জোনাস। অতঃপর হুট করেই মোমবাতি নেভানোর মতো দপ করে হাসি নিভিয়ে ফেললো। মুখ কঠিন করে কেমন হৃদয় স্তব্ধ চাহনি দিলো ইরতিজার চোখে। বললো,
“এই গিফটের জন্য তুমি আমাকে বার বার স্মরণ করবে টিজা। কিন্তু বিশ্বাস করো, আমি চাই না তুমি আমাকে মনে করো। একদম মনে করবে না আমায়। তোমার মনের বিন্দু পরিমাণ স্থানেও থাকতে চাই না আমি। পুরোপুরি ভুলে যাও আমায়। আর যদি তুমি ভুলতে না পারো, তবে আমিও পিছু ছাড়বো না তোমার।”
“এর মানে কী?”
“এটার মানে বুঝবে না এতটাও বোকা তো তুমি নও টিজা।”
জোনাস ইরতিজার স্তব্ধ দৃষ্টির সামনে থেকে সরে পড়লো। রাস্তায় নিজের সাইকেলের কাছে এসে বললো,
“আমার সাইকেলটা তোমার জন্য কাঁদে টিজা! মাত্র একবার চড়েছিলে আমার সাইকেলে। বেহায়া সাইকেলটা আবার তোমার পরশ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছে। ভাবছি বিক্রি করে দেবো সাইকেল। যাকে আমি ঘৃণা করি তার পরশ পাওয়ার জন্য আমার সাইকেলের ব্যাকুলতা আমি সহ্য করবো না।”
বলে আর অপেক্ষা করলো না জোনাস। সাইকেল নিয়ে চলে গেল। ফেলে গেল ধূ ধূ শূন্যতা। ইরতিজা হাতের গিফট বক্সের দিকে তাকালো। তারপর বারান্দায়। বারান্দায় সাজিদ দাঁড়িয়ে আছে। তারই দিকে তাকিয়ে আছে। কথা স্পষ্ট শুনতে না পেলেও সাজিদ স্পষ্টতর একজন প্রত্যক্ষদর্শী ছিল এই মুহূর্তটার।
(চলবে)
গ্রুপ লিংক―
https://facebook.com/groups/3087162301558677