#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ০৩
_____________________
রেডমন্ড শহরের সৌন্দর্যের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা হয়। যেদিকেই তাকানো হোক দেখা যায় দূর পাহাড়ের ভ্যালি। কী অপরূপ সেই সৌন্দর্য! আসার পথে যেটুকু দেখেছে তাতেই মন ভরে গেছে ইরতিজার। উবারের জানালা দিয়ে সে পাহাড়ের ভ্যালির দিকেই তাকিয়ে ছিল নির্নিমেষ। ভালো লাগার একটা উন্মাদনার ঝড় ক্রমশ পাক খেয়ে উঠছিল তার ভিতর। মনে হচ্ছিল এই শহর তাকে খুব সহজেই আপন করে নেবে। মিশে যাবে সে এই শহরের প্রকৃতি এবং মানুষের সাথে। হ্যাঁ, খুব শীঘ্রই মিশে যেতে চায় সে।
রেডমন্ডে ঠান্ডাটা একটু কম পড়ে। চারিদিকের সবুজ গাছপালা দেখলে মনে হয় এখন উইন্টার না, গ্রীষ্ম চলছে।
ইরতিজারা যে এরিয়ায় থাকবে সেই এরিয়ায় ইতোমধ্যে অনেক গাছপালা চোখে পড়েছে ইরতিজার। উইন্টারে এত সবুজ গাছপালা দেখতে অভ্যস্ত নয় সে।
এ এরিয়ায় অনেকগুলো বাসা রয়েছে। আছে একটা সুইমিং পুল, জিম এবং বেবি কেয়ার হাউজ। জিম এবং সুইমিং পুলের জন্য আলাদা করে কোনো চার্জ করতে হবে না। কিন্তু বেবি কেয়ার ফ্রি নয়। এখানে গাড়ি পার্কিংয়ের জন্যও আলাদা করে পে করতে হবে না।
পুরো এরিয়াটা ঘুরে দেখতে কতটা সময় লাগবে ভাবছে। ঘুরে দেখতে খুব একটা অসুবিধা হবে না। এখানে বসবাসরত চাচাতো বোন জুহি বলেছে সে সবটা ঘুরিয়ে দেখাবে।
ইরতিজার চাচারাও এই এরিয়ায় থাকে। ইরতিজারা যে বাসায় উঠেছে সে বাসাটা দুই ইউনিটের। এক সাইডে চাচারা থাকে। অন্য সাইডে তারা থাকবে। চাচা-চাচি কেউ বাসায় নেই। নিজ নিজ কাজে বেরিয়েছে। শুধু ইরতিজা’রা আসবে বলে জুহি আজ ভার্সিটি যাওয়া স্কিপ করেছে।
বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখলো। লিভিং রুমটা মাঝারি ধরনের বড়ো। এর থেকে বেশি বড়ো প্রয়োজনও নেই বলে ধারণা ইরতিজার। কিচেনটাও মোটামুটি বড়োই। বাথরুম দুটো। একটা হাফ, একটা ফুল। হাফ মানে হলো যাতে বাথটাব নেই। আর ফুল মানে হলো যাতে বাথটাব দেওয়া আছে। বেড রুম মোট তিনটা। সাথে ফিনিশড বেইজমেন্ট আছে। বেইজমেন্টটাকে একটা বেডরুম হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।
বাড়ির পিছনে ছোটো লন। আছে কিছু গাছপালা। লনে দাঁড়ালে প্রতিবেশিদের কয়েকটা বাড়ি চোখে পড়ে। খারাপ না, ভালোই লেগেছে ইরতিজার। সবচেয়ে পছন্দ হয়েছে কিচেনটা। কিচেন ওপেন নয়, যার কারণে ভালো হয়েছে।
চাচারা আগে থেকেই ঘরের ভেতরকার প্রায় সবকিছু পরিপাটি করে রেখেছিল, যার কারণে অত ভোগান্তি করতে হলো না। নওরিন বেইজমেন্টটা নিজের বেডরুম হিসেবে নিতে চাচ্ছে। কিন্তু বেইজমেন্ট গোছানো নয় বলে আপাতত আজ একটা রুমে থাকবে।
জুহি সবাইকে রেস্ট নিতে বলে বাসায় চলে গেছে। মেয়েটা একটু বেশি বকবক করছিল। ইরতিজার সমবয়সী সে। মুখটায় আদুরে ভাব আছে। গায়ের রং উজ্জ্বল। চিবুকে একটা ডিম্পল আছে। এছাড়া হাসলেও ওর গালে টোল পড়ে। তখন তো আরও মায়াবতী লাগে!
ইরতিজা নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে রুমে ঢুকলো। জামাকাপড় ক্লোজেটের ভিতর ঢুকিয়ে রাখলো। সব জামা কাপড় আনতে পারেনি। রেখে আসতে হয়েছে নিউ ইয়র্ক ফুফুর বাসায়। তবে সেগুলোও এসে যাবে। নিউ ইয়র্ক থেকে বাসে তাদের মোট তিনটা ব্যাগ আসার কথা। কবে এসে পৌঁছাবে কে জানে!
প্রথমে ইরতিজাই গোসল করার জন্য বাথরুমে ঢুকলো। পানি ঠান্ডা ছিল। ঠান্ডা পানিতে গোসল করতে হাত-পা জমে যাচ্ছিল। কাঁপতে কাঁপতে বের হলো বাথরুম থেকে। পরেছে নেভি ব্লু রঙের একটা কুর্তি আর কালো প্যান্ট। কুর্তিটা হবু শাশুড়ি গিফট করেছে গতকাল। কাল তো শুধু সাজিদ একা আসেনি তাদের বাসায়, সাথে সাজিদের মা-বাবাও এসেছিল শেষ দেখা করতে। সাজিদের মা-বাবা দুজনই বেশ অমায়িক। তাদের দুজনকে বেশ পছন্দ হয়েছে ইরতিজার। তবে সাজিদ যেন একটু কেমন। হ্যাঁ, সাজিদের কথাবার্তা সুন্দর। কিন্তু সুন্দরের মাঝে একটা চটাং চটাং ভাব আছে।
সময় বিকেলে গড়িয়ে পড়েছে। ইরতিজার বেডরুমে একটা বড়ো সাদা কাচের জানালা আছে। জানালার কাচ সরিয়ে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে সে। যখন এসেছিল তখন ছিল রোদ। নীল আকাশের বুকে একেক জায়গায় সাদা মেঘ ছড়িয়ে ছিল। কিন্তু এখন আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব ঠেকছে। মেঘলা আকাশের দিকে তাকিয়ে ইরতিজার হঠাৎ জোনাসের কথা মনে পড়লো। ওর সাথে শেষ দেখা হওয়ার মুহূর্তটা খুব মনে পড়ছে। ওর বলা কথাগুলো, ওর দেওয়া গিফট…
গিফটের কথা উঠতেই মনে পড়লো গিফটটা সে এখনও খুলে দেখেনি। খুলতে তটস্থ অনুভব করছে। কী গিফট দিয়েছে জোনাস? অনুমান করতে পারছে না। রেডমন্ড এসেই গিফট বক্স ওপেন করবে ভাবছিল। এখনই ওপেন করা উচিত বলে মনে হলো। ব্যাগের ভিতর থেকে বের করলো বক্সটা। বুক অজানা কারণে থরথর করে কাঁপছে। কম্পমান হৃদয়কে ভয় পাচ্ছে সে। এমন অনুভব করছে কেন? বড়ো করে কয়েকটা নিঃশ্বাস ফেলে গিফট বক্স ওপেন করলো। থমকে গেল বক্সের ভিতরটা দেখে। স্তম্ভিত হয়ে রইল কিছুক্ষণ। এটা কী? ইরতিজার চোখে-মুখে ধীরে ধীরে কাঠিন্যর ছোঁয়া লাগলো। রাগে দপদপ করে উঠলো শিরা-উপশিরা। কিড়মিড় করে উচ্চারণ করলো,
“স্টুপিড বয়!”
বিষয়টা নিয়ে সে এতটাই হাইপার হয়ে গেল যে তাৎক্ষণিক কল করে বসলো জোনাসকে। কল রিসিভ হলেই বললো,
“এটা কোন ধরনের ফাজলামো জন?”
ওপাশ থেকে শান্ত কণ্ঠ বলে উঠলো,
“এত দেরিতে বক্সটা ওপেন করলে টিজা? কাল দুপুর থেকেই তোমার ফোনের অপেক্ষায় ছিলাম। গিফট পছন্দ হয়েছে? হয়নি?”
“তোমাকে আমি লাস্ট বার বলছি জন, আমার সাথে এরকম মজা ফারদার আর কখনও করবে না। কখনও না।”
জোনাস হাসলো,
“কিন্তু তোমার সাথে এরকম মজা করতে আমার ভালো লাগে। তুমি কিন্তু গিফটটা নিয়ে খুব এক্সাইটেড ছিলে টিজা। গিফট বক্সে কিছু না পেয়ে তুমি আমাকে কল পর্যন্ত করে ফেলেছো। এটা কি প্রমাণ করে না যে তুমি আমার প্রতি…”
ইরতিজা আর কথা বাড়ার সুযোগ দিলো না, কল কেটে দিলো। খুব অসহায় বোধ হচ্ছে তার। জোনাস এরকম মজা করেছে তার সাথে? গিফট দেওয়ার নাম করে বক্সের ভিতরটা শূন্য রেখে দিলো? রাগ, অভিমানে গিফট বক্সটা ছুঁড়ে মারলো ফ্লোরে। তার মানসিক অবস্থা নিয়ে পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে সে আশা করছিল বক্সটার ভিতর একটা গিফট বিদ্যমান থাকুক। নাহ, আর মনে করবে না সে জোনাসকে। বার বার স্মরণ করা তো দূরের কথা, এক সেকেন্ডের জন্যও একবার মনে করবে না। তাকে নিয়ে মজা করে? জোনাস তার মন থেকে পুরোপুরি উঠে গেল আজ! ঘৃণার পরিমাণও বাড়িয়ে দিলো।
_________________
“তোমার চায়ে চিনি দেবো টিজা? না কি তুমি সুগার ফ্রি চা পান করো?” কিচেন থেকে চেঁচিয়ে উত্তর জানতে চাইলো জুহি।
ইরতিজা বসে আছে তার চাচার বাসার লিভিং রুমে। চাচারা গিয়েছে তাদের বাসায়, আর জুহি তাকে নিয়ে এলো নিজেদের বাসায়। এখন সন্ধ্যা টাইম।
ইরতিজাও জুহির মতো চেঁচিয়ে উত্তর দিলো,
“দাও চিনি।”
“ও কে।” চ্যাঁচানো স্বরটা আবারও ছুটে এলো কিচেন থেকে।
কিছুক্ষণ পর দুই কাপ চা নিয়ে উপস্থিত হলো জুহি। একটা কাপ ইরতিজার হাতে দিয়ে ওর পাশে বসলো। ফায়ারপ্লেসে কাঠ জ্বলছে। লিভিং রুমের সাথে ফায়ারপ্লেস থাকাটা ভালো লেগেছে ইরতিজার। ফায়ারপ্লেসে যখন কাঠগুলো পোড়ে দেখতে ভালো লাগে তার।
জুহি চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
“তাহলে তুমি কি সাজিদ ব্রোর জন্য বউ খুঁজে দেবে?”
জুহির সাথে ইরতিজা বেশিরভাগ কথাই শেয়ার করে। জুহির সাথে তার দেখা হয়েছে অল্প কয়েক বার। জুহি ওয়াশিংটন থাকে আর সে নিউ ইয়র্ক, তাই দেখা হয়নি তেমন। তবে মোবাইলে নিয়মিত যোগাযোগ বিদ্যমান ছিল তাদের। জুহির থেকে কোনো কিছু লুকোচুরির নেই। জুহিকে ইতোমধ্যে সবই জানিয়েছে।
ইরতিজা কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
“আমার কি দায়বদ্ধতা আছে ওনার জন্য বউ খুঁজে দেওয়ার? কেন ওনাকে বউ খুঁজে দেবো আমি? আমি তো জাস্ট কথাটা বলে তাকে দমিয়ে রেখেছি। এটা একটা বুদ্ধিমত্তা।”
জুহি হাসলো। ইরতিজার হাত লক্ষ করে বললো,
“রিং খুলে রেখেছো?”
ইরতিজা হাতের দিকে তাকালো। এনগেজমেন্ট রিং খুলে রেখেছে। এই এনগেজমেন্টের তো কোনো মানে নেই, তাহলে কেন পরে থাকবে ওই রিং? ঘরের লোক যদি জিজ্ঞেস করে রিং খুলে রেখেছে কেন, বলবে আঙুলে দাগ পড়ে যাচ্ছিল তাই খুলে রেখেছে।
ইরতিজার এই নিয়ে কথা বাড়াতে ইচ্ছা হচ্ছে না। বললো,
“অন্য কিছু নিয়ে কথা বলো জুহি। এ নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছি না।”
ইরতিজা কথাটা শেষ করার সাথে সাথেই দরজা খোলার শব্দ হলো। আগন্তুককে দেখার জন্য দুজনের চোখই চলে গেল সরু করিডোরের দিকে। একটু পরই করিডোর পেরিয়ে দেখা গেল একটা ছেলেকে। তার দু চোখে ও কী? অশ্রু? বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেল ইরতিজা। এটা তার চাচাতো ভাই, রিশন। রিশনের সাথে তার দেখা হয়েছে আরও কম। চাচারা যখন বাংলাদেশে গিয়েছিল, তখন দেখা হয়েছিল। তখন ইরতিজা ক্লাস এইটের ছাত্রী। রিশন আর জুহি কিন্তু আবার যমজ। দুজনের চেহারা প্রায় একই রকম। ওদের জন্ম আমেরিকাতেই। দেখতে বাঙালি হলেও আসলে এদের বাঙালি বলা চলে না। এরা আদতে আমেরিকান। কিন্তু রিশন কাঁদছে কেন? মাথা কিছুটা নিচু করে রাখলেও দেখা যাচ্ছে চোখে অশ্রু। দীর্ঘ সময় পর এই প্রথম রিশনকে সামনা-সামনি দেখলো ইরতিজা। চাচারা নিউ ইয়র্ক গেলেও রিশন তাদের সাথে যেত না, যার কারণে এত বছরে আর সামনা-সামনি দেখা হয়নি।
জুহি ব্যস্ত পায়ে এগিয়ে গেল ভাইয়ের কাছে। রিশন কোনো দিকে না তাকিয়ে লিভিং রুম পেরিয়ে সোজা চলে যাচ্ছিল। এখানে যে দুজন মানবী উপস্থিত আছে সেদিকে তার লক্ষ নেই। জুহি ভাইয়ের এক হাত ধরে থামিয়ে বললো,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড টু ইউ?”
রিশন বোনের দিকে তাকালো। তার দু চোখ লাল। লাল চোখে জল টলমল। কী হৃদয়বিদারক চাহনি! গলার কাছে কান্নারা দলা পাকিয়ে আটকে আছে। সেই কান্না উপেক্ষা করে বহু কষ্টে ঠোঁট দুটো নাড়িয়ে বললো,
“অ্যানডি ব্রোক আপ উইথ মি!”
বলে আর দাঁড়ালো না। গলার কাছে আটকে থাকা কান্নার দলাটা নড়বড়ে হয়ে এলেই সে দ্রুত পা চালিয়ে চলে গেল। রিশন চলে গেলেই হেসে উঠলো জুহি। ইরতিজা জুহিকে হাসতে দেখে অবাক হলো। ভাই কাঁদছে, আর বোন হাসছে? হচ্ছেটা কী? চিন্তিত গলায় প্রশ্ন করলো,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড টু হিম?”
জুহি কেমন ঘাড় বাকিয়ে তাকালো। বললো,
“ব্রেকআপ!”
বিস্ময়ে ভ্রু কুঞ্চিত করলো ইরতিজা। জুহি কাছে এসে শুধালো,
“কানাডিয়ান একটা মেয়ের সাথে ওর রিলেশন ছিল। অক্টোবরে আমরা ফ্রেন্ডসরা মিলে বেলভিউ ঘুরতে গিয়েছিলাম, সেখানে পরিচয় হয়েছিল ওর মেয়েটার সাথে। মেয়েটা খুব সুন্দর সেজন্য একটুতেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিল। আমি তখনই নিষেধ করেছিলাম যাতে মেয়েটার সাথে কোনো রকম রিলেশনশিপে না জড়ায়। কিন্তু শুনলো না। তখনই বুঝেছিলাম মেয়েটার সাথে ওর রিলেশন হলে খুব শীঘ্রই একটা ছ্যাঁকা খাবে ও। দেখলে, দু মাস যেতে না যেতেই ছ্যাঁকা খেয়েছে।”
ইরতিজার মুখে আঁধার ছেয়ে গেল। সূক্ষ্ম একটা ব্যথা জেগে উঠলো বুকে। কষ্ট অনুভব করছে সে রিশনের জন্য। আহারে, বেচারার ব্রেকআপ হয়েছে বলে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরেছে! সে হঠাৎ এত কষ্ট কেন অনুভব করছে রিশনের জন্য? আচ্ছা, জোনাসেরও কি এমন কষ্ট অনুভব হয়েছিল যখন সে ‘না’ করে দিয়েছিল ওকে?
(চলবে)
গ্রুপ লিংক―
https://facebook.com/groups/3087162301558677/