#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৮
_________________
“এটা কেন করছো মাদার সালেম? এটার কারণ কি সামুরা? তুমি চাও ড্যাড আমাকে যেই কোম্পানিটা দিতে চাচ্ছে সেটা সামুরার হোক? এটাই তোমার চাওয়া? এর জন্যই এত কিছু করছো?”
ক্যানিয়ল একদৃষ্টে নাইলা সালেমের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললো কথাগুলো।
নাইলা সালেম বুঝতে পারছেন তিনি ধরা পড়ে গেছেন। ক্যানিয়লের কথা ঠিক। সে ওই কোম্পানিটা বিশেষ পছন্দ করে রেখেছিলেন। সে চায় ক্যানিয়লকে দিতে চাওয়া কোম্পানিটা সামুরার হোক। আর সেজন্যই তিনি পণ করেছিলেন কোম্পানিটা যাতে ক্যানিয়ল গ্রহণ না করে সেজন্য তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন। তাই করেছেন। ফোন দিয়ে হুমকি, এমন কী শারীরিক আঘাত পর্যন্ত করতে তিনি দ্বিধা বোধ করেননি। অবশ্য এই ব্যাপারটা ছাড়াও অন্য আরও অনেক ব্যাপারে সে ক্ষুব্ধ ক্যানিয়লের উপর। ক্যানিয়ল ম/রে গেলেও তার যায় আসে না। ক্যানিয়লকে সে প্রচণ্ড ঘৃণা করে! ক্যানিয়লের জন্ম থেকে এখন পর্যন্ত ক্যানিয়ল তার কাছে অসহ্য এবং বিরক্তির একটা নাম। যেমন অসহ্য ছিল ক্যানিয়লের মম, ঠিক তেমনি অসহ্য ক্যানিয়ল। বেলা লিমাসকে তো তাও বিতাড়িত করা গেছে, কিন্তু ক্যানিয়লকে তিনি কিছুতেই তাড়াতে পারেননি। মুহাম্মদ ইসহাক যেন সর্ব পুত্র অপেক্ষা ক্যানিয়লকেই বেশি ভালোবাসেন। একদিন ক্যানিয়লের সম্পর্কে কথা বলতে গিয়েছিল মুহাম্মদ ইসহাকের সাথে। অবশ্যই ক্যানিয়লের ব্যাপারে খারাপই বলতে গিয়েছিল সে। কিন্তু একটা বাক্য সে সম্পূর্ণ করতে পারেনি তার আগেই মুহাম্মদ ইসহাক তাকে সাফ জানিয়ে দিলেন– ক্যানিয়লের যা ইচ্ছা ক্যানিয়ল তাই করবে। ক্যানিয়লের জন্য সবকিছু উন্মুক্ত। এ ব্যাপারে তার সাথে ফারদার যদি আর কোনো কথা কেউ বলতে আসে তাহলে ক্যানিয়লের জন্য নয়, কথা বলতে আসা মানুষটাকে সে শাস্তিস্বরূপ কিছু উপহার দেবে।
মুহাম্মদ ইসহাকের কথা শুনে সেদিন নাইলা সালেম বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন মুহাম্মদ ইসহাককে বুঝিয়ে কিছু হবে না। তাই তিনি এরপর থেকে ক্যানিয়লের ব্যাপারে আর কিছুই বলেননি তার কাছে। যত ক্ষোভ, রাগ, ঘৃণা, ষড়যন্ত্র নিজের কাছেই জমা রেখেছে। ক্যানিয়লকে তাও আগে পোষ মানানো যেত। কিছু বললেও ক্যানিয়ল চুপচাপ তা মেনে মাথা নিচু রেখে চলে যেত। কিন্তু বেশ কয়েক বছর ধরে ক্যানিয়ল এমন হয়ে গেল যে কিছু বললেও ওর গায়ে লাগে না। উদ্ভট হয়ে গেছে!
নাইলা সালেম বললেন,
“তুমি কী বলছো আমি বুঝতে পারছি না ক্যানিয়ল! আমাকে নিয়ে এসব অন্যায় কথা বলার সাহস করো কীভাবে?”
ক্যানিয়ল ওষ্ঠ বাঁকিয়ে হাসলো,
“কলে হুমকি, রোডে অ্যাটাক, আমার উপর নজরদারি…সব কিছুই তো তুমি জানো মাদার সালেম! এসব বন্ধ করো। আমি ড্যাডের কাছে বলতে চাইছি না এসব তুমি করছো। ভাই-বোনদের ভিতর সামুরা আমার সবচেয়ে প্রিয়। ওর সাথে অন্তত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করে দিয়ো না আমার।”
নাইলা সালেম দমবন্ধকর হেসে বললেন,
“আমি সত্যিই জানি না তুমি কোন ব্যাপারে কথা বলছো।”
“অভিনয় না করে সাবধানী হও। আফসোসের স্বীকার হয়ো না।”
ক্যানিয়ল আর দাঁড়ালো না। নাইলা সালেমের রুম থেকে বের হয়ে নিজের রুমে এলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ভাবতে লাগলো নানান কিছু। এসবের পিছনে নাইলা সালেম আছে এ ব্যাপারটা নিশ্চিত করেছে মি. হেনরি। মি. হেনরির দেওয়া তথ্য ভুল হতে পারে না এটা সে খুব ভালো করে জানে। নিজের মমকেও মনে পড়লো। মানুষটা এই বৃহৎ রাজপ্রাসাদে তাকে একলা ফেলে কেন চলে গেল? চলে না গেলে স্মৃতির পাতা জুড়ে আজ হয়তো অনেক সুখী মুহূর্ত থাকতো। যেগুলো এখন দুঃখী মুহূর্তে পূর্ণ! মিরান্ডাকে নিয়ে ভাবতেও কার্পণ্য করলো না তার মন। মিরান্ডা! একজন ভালো বন্ধুর নাম। কিন্তু এনগেজমেন্ট হওয়ার পর থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্কটা আর অটুট নেই। সম্পর্কটা এখন কেমন যেন হয়ে গেছে। কেমন হয়েছে তা ব্যাখ্যাহীন! সেই এনগেজমেন্ট হওয়া থেকে বার বার শুধু একটা কথাই মনে হয়, মিরান্ডাকে বিয়ে করা আসলে তার পক্ষে সম্ভব নয়! তবুও সে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তার কাছে শুধু ব্যর্থতা ধরা দিয়েছে। মিরান্ডার জন্য একচুল পরিমাণ ভালোবাসার অনুভূতি অনুভব করতে পারেনি। মিরান্ডা কাছে আসলে তার নিঃশ্বাস ভারি হয়নি কখনও, হৃদয় অদ্ভুত আচরণেরও স্বীকার হয়নি। তবে হৃদয় প্রথমবারের মতো অদ্ভুত আচরণ করেছিল সেদিন। নিঃশ্বাসও এলোমেলো হয়েছিল তখন, যেদিন ইরতিজা তার মাথায় হাত রেখে বলেছিল,
‘এরপর থেকে যখন কাঁদবে, তখন আমাকে জানাবে যে তুমি কাঁদছো। তোমার কান্নার মাঝে আমি গিয়ে তোমার মাথায় হাত রাখবো।’
ইরতিজার বলা একেকটা শব্দকে খুব যতনে অনুধাবন করে চলছিল ক্যানিয়ল। কলের শব্দে ভাবনা স্থগিত হয়ে নিজের আসন উঠিয়ে নিলো মস্তিষ্ক থেকে। ইউনিভার্সিটির লেকচারার স্টিভেন কল করেছে। ফোনটা কানে ধরে বললো,
“হ্যাঁ বলো মিস্টার স্টিভেন।”
ওপাশ থেকে স্টিভেন বললো,
“ট্রিপ।”
ক্যানিয়ল ভ্রু কুঁচকালো,
“ট্রিপ?”
“হ্যাঁ, আগামীকাল ট্যুরে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা আছে আমার আর প্রফেসর ব্রুসের। তুমি কি আমাদের সাথে যোগদান করবে?”
“নো ওয়ে, তোমাদের সাথে কেন যাব? তোমরা প্রয়োজন হলে তোমাদের ওয়াইফ-বেবি নিয়ে যাও। আমাকে কেন ডাকছো?”
“বিবাহিত হলে নিশ্চয়ই ওয়াইফ-বেবি নিয়েই যেতাম। তোমার কারণেই আমার বিয়েটা আটকে রয়েছে। আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে যদি আমার ব্রেক আপ না হতো তাহলে এতদিনে আমি বিবাহিত থাকতাম। ওইদিন আসলে তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া উচিত হয়নি!”
“এটা নিয়ে কি তুমি আফসোস করছো মি. স্টিভেন?” ভারি বিস্ময়ে কথাটা জিজ্ঞেস করলো ক্যানিয়ল।
“হ্যাঁ করছি। সেদিন তোমাকে না নিয়ে গেলে আমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে দেখা হতো না তোমার। আর ও দেখা মাত্রই তোমার প্রেমে পড়ে যেত না। মরিয়া হয়ে উঠতো না আমার সাথে ব্রেকআপ করার জন্য।”
“এখন কি আমি দায়ী হলাম তোমাদের ব্রেক আপ হওয়ার জন্য?”
“হ্যাঁ।”
“তো এখন কী করতে পারি? তোমার গার্লফ্রেন্ডের সাথে তোমার ব্রেকআপ হওয়ার জন্য যেহেতু আমি দায়ী, তাহলে কি তুমি আমার সাথে প্রেম করবে?”
স্টিভেন থতমত খেয়ে গেল। ঘোর বিস্ময়ে বললো,
“তুমি আমার সাথে এরকম রসিকতা করছো ক্যানি?”
“রসিকতা নয়। যদি তুমি আমার সাথে প্রেম করতে চাও তাহলে বলো। আমি তোমাকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য মুখিয়ে থাকবো।”
ওপাশে লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা পেল না স্টিভেন। একজন স্টুডেন্ট তার সাথে এমন রসিকতা করছে এটা ক্যাম্পাসে প্রকাশিত হয়ে গেলে তার মান-সম্মান ধুলোয় মিশে যাবে।
__________________
আজকের আবহাওয়া ভারি সুন্দর। চকচকে রোদ, মৃদু হাওয়া, সেই সাথে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য। পাহাড়ের ভ্যালিগুলো ভালো করে দেখা যাচ্ছে। তবে এই মুহূর্তে এই সব কিছু বিতৃষ্ণা লাগছে ইরতিজার। গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে গ্রিন লেক পার্কের উদ্দেশ্যে। ড্রাইভিংয়ে আছে সাজিদ। ড্রাইভিংয়ের পাশের সিটটায় ইরতিজা। এখানে বসতে একদম ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু জুহির পীড়াপীড়িতে বসতে হলো! পিছনের সিটে আছে জুহি, রিশন এবং আন্দ্রেজ। প্রথমে যাওয়ার কথা ছিল শুধু সাজিদ, ইরতিজা আর জুহির। কিন্তু জুহি সাথে আন্দ্রেজকেও নিয়ে এলো। যদিও আন্দ্রেজ আসতে চায়নি। জুহি জোর করেছে সাথে আসতে। রিশন এসেছে নিজ ইচ্ছায়। ওখানে গিয়ে ভিডিয়ো শুট করবে এটাই তার প্রধান উদ্দেশ্য।
ইরতিজা একদমই চায়নি সাজিদের সাথে ঘুরতে আসতে। তবে পরিবারের লোকেরা ঘুরতে আসার ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিল। জোর করে পাঠিয়ে দিলো সাজিদের সাথে। সব কিছু মিলিয়ে দিনকে দিন তার বিরক্ত ধরে যাচ্ছে সাজিদের প্রতি। পরিবারের লোকেরা তো চাচ্ছে সাজিদের সাথে তার বিয়ে হোক। কিন্তু এদিকে সে তো তাতে সম্পূর্ণ বিরোধী। কিছুতেই পারবে না সাজিদকে বিয়ে করতে। মেনেই নিতে পারবে না সামান্য একটা ঘটনা থেকে তার এনগেজড হয়েছে, এবং সেই এনগেজমেন্ট থেকে বিয়েও হবে! মাঝে মধ্যে ইচ্ছা হয় দূরে কোথাও হারিয়ে যায়। যেখানে সে সবকিছু তার নিজের মতো করে করতে পারবে। কেউ চাইলেই কিছু চাপিয়ে দিতে পারবে না তার উপর। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসছিল ইরতিজার বুক চিরে। জোনাসকে সামনে পেলে এই মুহূর্তে অনেক কিছু বলতো সে। শুধু ওর জন্য… ওর জন্য আজ তার জীবন এমন হয়ে গেছে! বিয়ের মতো একটা বিষয় জোর করে তার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে ওর জন্য! কথাটা ভেবে কান্না পাচ্ছিল ইরতিজার।
সাজিদ মিররে ইরতিজার মুখখানি লক্ষ করে বললো,
“কাঁদবেন না। সকল কান্না আমাদের বিয়ে পর্যন্ত জমিয়ে রাখুন। বাসর রাতে চোখের জল আর নাকের জল উভয়তেই স্বামীর বুক ভিজিয়ে দেবেন।”
কথাটা শোনা মাত্র সাজিদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো ইরতিজা। সাজিদ মুচকি হাসলো।
ভাগ্যিস কথাটা পিছনের সিটে থাকা কেউ খেয়াল করেনি। করলে তো লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছা হতো। লজ্জা কি সে এখনও পায়নি? পেয়েছে তো। ইরতিজা জানালার দিকে মুখ করে খানিক বিরক্ত কণ্ঠে বিড়বিড় করলো,
“লোকটা আসলেই নির্লজ্জ!”
“কী বলছেন?”
ইরতিজা আবার তাকালো। একবার পিছনে দৃষ্টি দিয়ে দেখলো তাদের দিকে কেউই ভ্রুক্ষেপ করে নেই। সে আস্তে করে সাজিদকে বললো কথাটা,
“নিজের বদনাম শোনার কি এতই ইচ্ছা আপনার?”
“বদনাম? আমি তো ভাবছিলাম আমি সুনাম পাওয়ার যোগ্যতা রাখি।”
ইরতিজা ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বললো,
“সুনাম? আপনি আসলে বদনামেরও যোগ্য না। আপনি আমার স্বামী হওয়ারও যোগ্যতা রাখেন না।” নিচু স্বরে বললো ইরতিজা। যেন পিছনের কারো কানে কথাটা স্পষ্ট না পৌঁছায়।
সাজিদও ইরতিজার মতো নিচু স্বরে বললো,
“ভুল। যদি যোগ্যতার প্রশ্নই ওঠে তাহলে আপনি আমার যোগ্য নন।”
কথাটা শুনতে খারাপ লাগলো না ইরতিজার, বরং আশায় মুখটা চকচক করে উঠলো। বললো,
“তাহলে আমার আব্বুকে বলে এই বিয়ে ভেঙে দিন।”
“না। বিয়ের পর তোমাকে আমি আমার যোগ্য বানিয়ে নেবো।”
কথাটায় মুখ গোমড়া হয়ে গেল ইরতিজার।
______________
গ্রিন লেক পার্ক!
জায়গাটা এত সুন্দর না আসলে বুঝতে পারতো না ইরতিজা। এখন উইন্টার। ঘোরাঘুরির জন্য সবচেয়ে ভালো হচ্ছে সামার সিজন। বিশেষ করে লেক ঘুরতে আসার জন্য। তবে আজকের দিনটা অনেকটা গ্রীষ্ম দিবসের মতোই মনে হচ্ছে ইরতিজার। পরিবেশ তেমন শীতল নয়। নাতিশীতোষ্ণ অনুভব হচ্ছে তার। সুদীর্ঘ লেক। টলমলে নীল জলের উপর রোদের আলো থই থই করছে। লেকের পাশ ঘেঁষে আছে ওয়াকিংয়ের জন্য সুবিশাল ওয়াক ওয়ে। বসার জন্য আছে বেঞ্চি। বেঞ্চিতে বসে উপভোগ করা যায় লেকের চোখ জুড়ানো মনোরম শান্ত দৃশ্য। পানির মাঝে যাওয়ার জন্য রয়েছে কাঠের তৈরি পথ। এছাড়া সিঁড়ি আছে এখানে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে সেখান থেকে পুরো লেকটাকে একনজরে দেখে নেয়া যায়। আজকে অনেকের উপস্থিতিই লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেকে আবার নিজের পালিত কুকুরকে নিয়ে বেরিয়েছে। কুকুরগুলো সুবোধ বালকের মতো হাঁটছে মনিবের পাশে পাশে। ঘাসের চাদরে মোড়ানো ওপেন স্পেসগুলোতে মানুষ শুয়ে-বসে সময় কাটাচ্ছে।
ওরা বোট ভাড়া করে লেকে ঘুরে বেড়ালো কিছুক্ষণ। কিছুটা ক্লান্তি চলে আসলে সবাই রেস্টরুমে চলে এলো। তবে রিশন এলো না। ও আসার পর থেকেই ঘুরে চলছে এদিক-ওদিক। ভিডিয়ো করছে। এখানে আসার আগে তো ভীষণ ঝগড়া হয়েছিল জুহি আর রিশনের মাঝে। জুহি রিশনকে নিজেদের সাথে আনতে চায়নি। এই নিয়ে খুব ঝামেলা হয়েছিল।
জুহি খানিক বিশ্রাম নেওয়া শেষে আন্দ্রেজকে ডাকতে এলো রুমে। কিন্তু দেখলো আন্দ্রেজ নেই। আন্দ্রেজ আর রিশনের জন্য একটা রুম নেওয়া হয়েছে। বেরিয়ে আসার আগে জুহির চোখে পড়লো ছোটো টেবিলটায় আন্দ্রেজের ব্যাগের উপর পড়ে আছে ওর আর্ট খাতা। জুহি কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল। তার ধারণা ছিল এটাতে সে নিজের ছবিও দেখতে পাবে। কিন্তু আশ্চর্য! কোথাও তার একটা ছবি নেই। অথচ ইরতিজার ছবিও আছে। সবশেষে আন্দ্রেজ যে ছবিটা এঁকেছে সেটা মার্টার ছবি। মার্টার হাস্যজ্জ্বল মুখের ছবিটা দেখে জুহির সর্বাঙ্গে রাগের বিস্ফোরণ ঘটলো। হৃদয়েও বয়ে গেল কষ্টের একটা ফোয়ারা। আন্দ্রেজ কোথাও তার একটা ছবি আঁকেনি, অথচ এত যত্ন সহকারে মার্টার ছবি এঁকেছে? জুহি রাগে ছিঁড়ে নিলো পৃষ্ঠাটা। পৃষ্ঠাটা দুমড়ে-মুচড়ে ফেললো দুই হাতের সাহায্যে। রাগে কাঁপছে সে। ইদানিং আন্দ্রেজ একটুখানি সময় মার্টার দিকে তাকালেও সহ্য করতে পারে না সে। সেখানে মার্টার এমন হাস্যজ্জ্বল মুখ আন্দ্রেজের আর্ট খাতায় দেখে ব্যাপারটা হজম করা তার জন্য আসলেই সহজলভ্য হলো না। হ্যাঁ সে জানে আন্দ্রেজ মার্টাকে পছন্দ করে। সে হিসাবে মার্টার ছবি থাকবেই। কিন্তু সে তো মেনে নিতে পারে না এসব।
জুহি খুঁজতে বের হলো আন্দ্রেজকে। আন্দ্রেজ বেঞ্চিতে বসে ছিল নিরিবিলি। জুহি ওকে দেখা মাত্রই ডাকলো,
“আন্দ্রেজ…”
আন্দ্রেজ উঠে দাঁড়ালো। এখানে থাকতে তার খুবই অস্বস্তিবোধ হচ্ছে। জুহিকে একা পেয়ে সে নিজের অস্বস্তি প্রকাশ করতে উদ্যত হলো,
“আমি বলেছিলাম আমি আসবো না। তুমি আমাকে…”
“এটা আমি কী দেখলাম এই মাত্র?” আন্দ্রেজের কথার মাঝে চেঁচিয়ে জানতে চাইলো জুহি।
“কী দেখেছো?” অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো আন্দ্রেজ।
জুহি বলতে চেয়েও বলতে পারলো না, যে খাতায় তার ছবি নেই সেই খাতায় মার্টার ছবি দেখে সে এমন ব্যবহার করছে। সে আরও একটু সামনে এগিয়ে এসে আন্দ্রেজের ক্রাচটা ছিনিয়ে নিলো। টলে উঠলো আন্দ্রেজের পা। জুহির আচরণে রেগে গিয়ে বললো,
“হোয়াট আর ইউ ডুয়িং জুহি?”
জুহির দু চোখে অভিমানী জল। আন্দ্রেজের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,
“আর কখনও মার্টার দিকে তাকিয়ে থাকলে তোমার চোখের অবস্থা খা/রা/প বানিয়ে দেবো আমি। বুঝেছো?”
“আমি ওর দিকে তাকিয়ে থাকলে তোমার সমস্যা কী?” সাথে সাথে পাল্টা আক্রমণ করে বসলো জুহিকে।
“ও, জানো না তুমি? জানো না আমার কী সমস্যা? তুমি কি অবুঝ? বোঝো না কী সমস্যা?”
জুহির কথা আন্দ্রেজকে এবার স্থির করে দিলো। স্থির হয়ে কিছু সময় চেয়ে রইল সে জুহির দিকে। তারপর জুহির হাত থেকে ক্রাচটা কেড়ে এনে ওর চোখে দৃষ্টি রেখে বললো,
“না, আমি জানি না। আর কিছু বুঝিও না। তুমিও আমাকে কিছু জানানো অথবা বোঝানোর চেষ্টা করো না।”
বলে ক্রাচে গটগট শব্দ তুলে চলে গেল আন্দ্রেজ।
এদিকে জুহির মুখটা কষ্টে জর্জরিত হয়ে একেবারে কালো হয়ে গেল।
(চলবে)