উড়ো পাতার ঢেউ পর্ব: ৪৭

0
587

#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৪৭
_________________

আজ জুহির জন্মদিন। সন্ধ্যায় ছোটো-খাটো একটা পার্টির আয়োজন করা হবে সেই উপলক্ষ্যে। আন্দ্রেজের মায়ের কল এলো আজ সকাল সকাল। আন্দ্রেজের ফ্যামিলি বলতে শুধু আন্দ্রেজের মা’ই আছে। আন্দ্রেজের মায়ের সাথে জুহির ভালো সম্পর্ক। আজ এত সকাল সকাল কল দেওয়ার মানে বুঝতে অসুবিধা হলো না জুহির। আন্দ্রেজ তার জন্মদিনের কথা ভুলে গেলেও আন্দ্রেজের মা ভুলে যায়নি। ফোন পাওয়ার কিছুক্ষণ পরই জুহি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। তাদের বাসা থেকে আন্দ্রেজের বাসায় গাড়িতে আসতে মাত্র তেরো-চৌদ্দ মিনিট লাগে। আন্দ্রেজের বাসায় এসে পৌঁছলে প্রথমেই আন্দ্রেজ এবং তার মা এডালিন জুহিকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। জুহির জন্য একটা কেকও তৈরি করে রেখেছিলেন এডালিন। আসলে তিনি জরুরি কাজের জন্য গ্রামে যাবেন। তাই জুহির জন্মদিনের পার্টিতে থাকা হবে না তার। তাই যাওয়ার আগে এভাবে আজকের সকালটুকু উপহার দিলেন জুহিকে।
কেক কাটার পরপরই এডালিন চলে গেলেন। যথাসময়ে তার সেখানে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে।
আন্দ্রেজদের ঘর তেমন বড়ো নয়। একটা ছোটো লিভিংরুম, ছোটো কিচেন, একটা বেডরুম। কিচেনের নিচে আছে একটা বেজমেন্ট। বেইজমেন্টটা বেডরুম স্বরূপ ব্যবহার করেন এডালিন। ঘরের জিনিসপত্রেও তেমন বিলাসবহুলতার ছোঁয়া নেই। দেখে বোঝা যায় আন্দ্রেজের পারিবারিক অবস্থা অন্যদের তুলনায় একটু অসহায়। আন্দ্রেজ জানতে চাইলো,
“তুমি কি ব্রেকফাস্ট করে এসেছো?”

“তুমি ব্রেকফাস্ট করাবে?”

আন্দ্রেজ উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“বসো। মম ব্রেকফাস্টও রেডি করে রেখে গেছে। আমি নিয়ে আসছি।”

বলে ক্রাচে ভর দিয়ে কিচেনের দিকে এগোতে লাগলো আন্দ্রেজ।
জুহি নিজের হাতের দিকে তাকালো। একটা সুন্দর ঘড়ি তার হাতে শোভা পাচ্ছে। এডালিন জন্মদিনের গিফট হিসেবে দিয়েছে এটা। আন্দ্রেজ কিছু দেয়নি। হয়তো পার্টিতে থাকাকালীন দেবে। তবে জুহির তর সইছে না আন্দ্রেজ কী গিফট দেবে সেটা দেখার জন্য। আন্দ্রেজ নিশ্চয়ই তার জন্য ইতোমধ্যে গিফট কিনে রেখেছে। জুহি চুপিচুপি আন্দ্রেজের রুমে চলে এলো। পরিপাটি রুম। রুমের এক জায়গায়ও অগোছালোভাব নজরে পড়ছে না। ওয়্যারড্রোবের কাছে এলো সে। সাধারণত আন্দ্রেজ এখানেই রেখে থাকবে। কিছু সময় খোঁজাখুঁজি করার পর এক জোড়া হেয়ার ক্লিপ নজরে পড়লো শুধু। আর কোনো কিছু দেখে এমন মনে হলো না যে সেটা আন্দ্রেজ তাকে গিফট হিসেবে দিতে পারে। হ্যাঁ, এটাই আন্দ্রেজ তাকে গিফট দেবে। তাকে গিফট না দিলে আন্দ্রেজ ক্লিপ দিয়ে করবে কী? আন্দ্রেজ নিজে তো আর চুলে ক্লিপ দিয়ে বসে থাকবে না। আর এটা নিশ্চয়ই সে নিজের মমের জন্যও কেনেনি। সুতরাং এটা তো তার জন্যই কিনেছে। জুহির খুব পছন্দ হয়েছে ক্লিপ জোড়া। এটা তেমন মূল্যবান কোনো বস্তু নয়, খুবই সাধারণ। তবুও এটা এই মুহূর্ত থেকে তার কাছে বিশেষ হয়ে গেছে।
লিভিং রুম থেকে আন্দ্রেজের ডাক ভেসে এলো,
“জুহি, কোথায় তুমি?”

জুহি দ্রুত ড্রয়ার আটকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে এলো। আন্দ্রেজ বললো,
“আমার রুমে কী করছিলে?”

জুহি প্রস্তুত কণ্ঠে উত্তর দিলো,
“আমার একটা নোটের প্রয়োজন ছিল, দেখছিলাম তোমার কাছে সেটা আছে কি না। নেই তোমার কাছে।”

“কী নোটের প্রয়োজন ছিল?”

জুহি এবার একটু অপ্রস্তুত হলো। আমতা আমতা করে বললো,
“ওইতো একটা ইম্পরট্যান্ট বিষয়ের। আমার, টিজার, রিশনের তিনজনেরই প্রয়োজন। সমস্যা নেই বেথের কাছ থেকে নিয়ে নেবো।”

জুহি চেয়ার টেনে বসলো। লিভিংরুমের এক কর্ণারে ছোটো ডাইনিং টেবিল আছে, সেখানে। জুহির ঠোঁটে লেগে আছে আলতো মুচকি হাসি। আনন্দের এই হাসিটুকু সরছে না ঠোঁট থেকে। আন্দ্রেজ ওর হাসি লক্ষ করে বললো,
“হাসছো কেন?”

“তুমি এত ভালো কেন আন্দ্রেজ?”

আন্দ্রেজ চমকে উঠলো। জুহির হঠাৎ তাকে প্রশংসা করার মানে খুঁজে পেল না। জুহি আর কিছু বললো না। আন্দ্রেজও জানতে চাইলো না কিছু। জুহি হাসি হাসি বদনে খেতে লাগলো। আর আন্দ্রেজ অবাক হয়ে দেখতে থাকলো তাকে।

_________________

“চলো।”

ক্যানিয়ল মোবাইলে গেম খেলতে খেলতেই উত্তর দিলো,
“কোথায়?”

“সাইকোলজিস্টের কাছে অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে তোমার।”

মোবাইল স্কিনে চালিত হাত থেমে গেল ক্যানিয়লের। বিস্ময় নিয়ে তাকালো মি. হেনরির দিকে,
“কার অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে?”

“তোমার।”

“মানে? কখন, কীভাবে, কেন আমার অ্যাপয়ন্টমেন্ট আছে সাইকোলজিস্টের কাছে?”

“তোমার ড্যাড রেখেছে অ্যাপয়ন্টমেন্ট। তুমি না কি গতকাল গার্লফ্রেন্ড-বয়ফ্রেন্ড নিয়ে কীসব আবোল-তাবোল বলেছো? যার মানে কেউ বুঝতে পারেনি। ওনার ধারণা মানসিক কোনো সমস্যা হয়েছে হয়তো তোমার। যার কারণে কাল ওরকম আজব কিছু বলেছো। এছাড়া মিরান্ডাকে বিয়েও না কি করবে না বলেছো। এজন্য ওনার ধারণা কোনো একটা প্রবলেম আছে তোমার।”

ক্যানিয়ল উপরের দিকে তাকিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
“ড্যাড এমন কেন?”
মি. হেনরির দিকে তাকালো ক্যানিয়ল,
“আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে আমার মানসিক কোনো সমস্যা আছে?”

“না।”

“তাহলে?”

“কিন্তু তোমার একবার যাওয়া উচিত সাইকোলজিস্টের কাছে। যেহেতু তোমার ড্যাড অ্যাপয়ন্টমেন্ট রেখেছে।”

“অসম্ভব। আজ পর্যন্ত আমি যত মানুষকে মেরেছি বলতে গেলে সবাই একেকজন ছোটো-খাটো সাইকো ছিল। এখন আমি যদি সাইকোলজিস্টের কাছে যাই, আর সেই খবর যদি এই ছোটো-খাটো সাইকো গুলো পেয়ে যায়, তাহলে আমার সম্মান কিছু কি আর অবশিষ্ট থাকবে? তুমি চাও আমার মানসম্মানে দাগ লাগুক?”

ক্যানিয়ল কাউচ থেকে উঠে গেল। দরজার দিকে যেতে যেতে বললো,
“ভায়োলেট কুইনের কী খবর? ও কি সুস্থ হয়েছে এখন পুরোপুরিভাবে?”

মি. হেনরি পিছন পিছন আসতে আসতে বললো,
“মনে হচ্ছে হ্যাঁ। দেখেছি জুহি আর রিশনের সাথে শপিংয়ে গিয়েছে। আজ জুহির জন্মদিনের পার্টি আছে সন্ধ্যায়।”

ক্যানিয়ল থেমে গেল। পিছন ফিরে জিজ্ঞেস করলো,
“কোনো ইনভাইটেশন কার্ড আসেনি আমার জন্য?”

মি. হেনরি দুই পাশে মাথা নাড়লো। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো ক্যানিয়লের। বললো,
“কত বড়ো বেয়াদব! আমাকে ইনভাইট করেনি? সামুরাকে করেছে?”

“হ্যাঁ, ওর জন্য সকালেই ইনভাইটেশন কার্ড পাঠিয়েছে।”

ক্যানিয়লের আত্মসম্মান চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার গুড়গুড় শব্দ হলো। সে রাগে কিড়মিড় করে বললো,
“ওরা সবকটা বদ! এমনকি ইজাও!”

বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল রুমটা থেকে। বেরিয়েই দেখতে পেল মাদার ইয়াদার বড়ো পুত্র, অর্থাৎ তাদের সবচেয়ে বড়ো ভাই এখানে আছে। ড্যাডের সাথে দাঁড়িয়ে কিছু নিয়ে কথা বলছে। এক বোনও আছে তাদের সাথে। ক্যানিয়লদের থেকে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে তারা। ক্যানিয়ল এই মুহূর্তে আর ড্যাডের চোখের সামনে পড়তে চাইলো না। তাই চুপচাপ অন্যপথ দিয়ে বেরিয়ে এলো মাইক্রোসফট বিল্ডিং থেকে। ক্যানিয়ল এতক্ষণ যে মাইক্রোসফট বিল্ডিংটায় ছিল ওটা মুহাম্মদ ইসহাকের সবচেয়ে উন্নত এবং বড়ো কোম্পানির একটা। এই কোম্পানিটাই মুহাম্মদ ইসহাক ক্যানিয়লকে দিতে চাইছেন। কদিন ধরে কোম্পানি গ্রহণ না করতে বলে যে হুমকিমূলক কল আসতো, সেটা আর পাচ্ছে না ক্যানিয়ল। নাইলা সালেম কি মেনে নিলেন?

______________

জুহিদের বাসার সামনের লনটা সাজানো হয়েছে। নানা রং-বেরংয়ের বাতি এবং ফ্লাওয়ার দিয়ে সাজানো হয়েছে। একটা টেবিলে কেক রাখা, যা এখনও উন্মুক্ত করা হয়নি। লনে চেয়ার রাখা হয়েছে অনেকগুলো। অনেকটাতে মানুষজন বসে আছে, অনেকটা আবার খালি। মানুষজন বলতে এখানে জুহির কিছু ফ্রেন্ডস এবং প্রতিবেশীরা আছে। চার ধরনের ড্রিংকস সার্ফ করা হচ্ছে। সাথে দুটো বিশেষ আইটেমের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যে যার চাহিদা অনুযায়ী তা গ্রহণ করতে পারবে।
জুহির পরনে সিলভার রঙের একটা গাউন। গাউনটা রিশন নিজের টাকায় কিনে দিয়েছে। শুধু জুহিকে নয়, ইরতিজা আর নওরিনকেও দুটো ড্রেস গিফট করেছে। একজন সফল ইউটিউবার তো, ভালো টাকাই ইনকাম করে সে।
শীত থাকলেও জুহি কোনো শীতবস্ত্র পরেনি। এই শীতের মাঝে মেয়েটা কীভাবে শীতের পোশাক না পরে ঘুরছে ভাবছে ইরতিজা। ইরতিজার পরনের পোশাকটা গাঢ় নীল। সাথে ম্যাচ করে মাথায় হিজাব। এই হিজাবটাও ক্যানিয়লের দেওয়া সেই একশ হিজাবের ভিতর একটা। সেই একশ হিজাবের বেশি আর হিজাব প্রয়োজন হয় না তার। ইরতিজা চেয়েছিল ক্যানিয়লের দেওয়া ক্যামেরাটা দিয়ে আজ কিছু ফটো তুলবে। কিন্তু ক্যানিয়ল তো ওই ক্যামেরার জন্য সকল ছেলেদের নিষিদ্ধ করেছে। ফটো তুলতে গিয়ে যদি ভুল করে কোনো ছেলের ফটো উঠে যায় ক্যামেরায় তাহলে চরম অন্যায় হয়ে যাবে। অন্য ছেলে কেন? ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুলতে দেখলেই তো রিশনও এসে ছবি তোলায় ভাগ বসাবে। ইরতিজা ভিড়ের মাঝে রিশনকে খোঁজার চেষ্টা করলো। দেখতে পেল রিশন নিজের সবচেয়ে প্রিয় কাজ, মানে ভিডিয়ো শ্যুট করছে। নিশ্চয়ই ইউটিউবের জন্যই এই ভিডিয়ো শ্যুট করা। ইরতিজা হেসে ফেললো। এই ছেলেটা কি ভিডিয়ো শ্যুট, আর এডিট করা ছাড়া আর কিছু পারে না?
আজাদ চৌধুরী আর শারমিন ফিরে এসেছেন আজকে বিকালে। আজাদ চৌধুরী কিছুক্ষণ আগেও এসে ইরতিজাকে বলে গেছেন,
“তুমি কি অসুস্থ বোধ করছো? অসুস্থ ফিল হলে রুমে গিয়ে রেস্ট নাও। এখানে থাকার দরকার নেই।”

ইরতিজা অসুস্থ বোধ করছে না। অসুস্থ বোধ করলে সে নিজ থেকেই রুমে চলে যাবে, এমন বলেছে বাবাকে।
আজকে ক্যানিয়ল পার্টিতে আসলে ভালো হতো এমন অনুভূত হচ্ছে ইরতিজার। অথচ জুহি ক্যানিয়লকে ইনভাইট করেনি! জুহি প্রথমে চেয়েছিল ক্যানিয়লকেও ইনভাইটেশন কার্ড পাঠাবে। কিন্তু রিশন তাতে একমত পোষণ করলো না। মূলত ক্যানিয়ল হসপিটালে থাকাকালীন রিশনকে যা যা বলেছিল সেজন্য রিশন চায় না ক্যানিয়ল পার্টিতে আসুক। পরে রিশন জুহিকেও কী কী যেন বুঝালো, এরপর জুহিও রিশনের সাথে সহমত হলো। আর ইনভাইট করলো না ক্যানিয়লকে।
জুহি গতরাতে হসপিটাল থেকে বাসায় ফেরার পর হঠাৎ জানতে চেয়েছিল,
“তোমার আর ক্যানির মাঝে বিশেষ কোনো সম্পর্ক চলছে টিজা?”

প্রশ্নটা এমন বিব্রতকর ছিল যে ইরতিজা কোনো উত্তর দিতে পারেনি। আর উত্তর দেবে কী? তাদের মাঝে ঠিক কী চলছে? তাদের সম্পর্কটা এমন যে এর কোনো নাম নেই। তবে মনে হয় নাম না থাকলেও তাদের সম্পর্কটা বিশেষ কিছুই, এটাকে শুধু বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বলা যায় না। এই সম্পর্ক ব্যাখ্যা করা যায় না। কেবল অনুভূতিটুকু ব্যাখ্যা করা যায়। ইরতিজার কিছু বলতে হয়নি। জুহিই বলেছিল,
“তোমাদের দুজনের মাঝে গভীর অনুভূতি চলছে একে অন্যের জন্য। আমি তোমাদের এই অনুভূতি হিংসা করি। আন্দ্রেজ কেন আমার অনুভূতি বুঝতে পারে না? কেন ওর মাঝে আমার জন্য অনুভূতি নেই?”
কথাগুলো বলে কান্না করে দিয়েছিল জুহি। ইরতিজা বুঝতে পারছিল আন্দ্রেজের জন্য জুহির অনুভূতি বিশুদ্ধ। জুহি হয়তো মজার ছলে অনেক ছেলের আকর্ষণ পাওয়ার চেষ্টা করেছে, ডেটও করেছে কয়েকজনের সাথে। কিন্তু ওর আসল অনুভূতির মানুষটা হচ্ছে আন্দ্রেজ। কথাটা ভাবতে ভাবতে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো ইরতিজা।
আজকে সাজিদেরও আসার কথা ছিল। কিন্তু তাকে আবারও অফিসিয়াল কাজে লস এঞ্জেলেসে যেতে হয়েছে। ইরতিজার বার বার মনে হচ্ছিল জোনাস হয়তো তার আশেপাশেই আছে। পার্টিতে উপস্থিত মানুষজনের সাথে মিশে চুপিচুপি দেখছে তাকে। কিন্তু দু চোখের শান্ত চাহনি জোনাসকে কোথাও দেখতে পায়নি। অবশেষে ইরতিজা ধরে নিয়েছে তার অনুমান ভুল।

“টিজা!”

হঠাৎ সামুরার ডাক শুনতে পেল ইরতিজা। সামুরার দিকে তাকিয়ে একগাল হাসলো। ইরতিজার হাতে কোনো ড্রিংকসের গ্লাস না দেখতে পেয়ে সে একটা গ্লাস এগিয়ে দিলো ইরতিজার দিকে। ড্রিংকস বলতে এখানে আছে ফলের রস দিয়ে বানানো তিন রকমের পানীয় এবং যাদের মদ্যপানের অভ্যাস আছে তাদের জন্য রেড ওয়াইন। সামুরা ইরতিজাকে আনারস দিয়ে বানানো ড্রিংকসটা দিয়েছে। ইরতিজা আনারস পছন্দ করে না। আর সেজন্য সে পানও করলো না। অবশ্য সামুরা যদি দাঁড়িয়ে থাকতো তাহলে তাকে ভদ্রতার খাতিরে একটু হলেও খেতে হতো। কিন্তু সামুরা তাকে গ্লাসটা দিয়েই চলে গিয়েছে।

জুহির ধারণা ছিল আন্দ্রেজ তাকে গিফট স্বরূপ সেই ক্লিপ জোড়া দেবে, কিন্তু না, আন্দ্রেজ তাকে একটা পারফিউম দিয়েছে। পারফিউমটা দেখার পর জুহি প্রায় বলেই ফেলেছিল ক্লিপ জোড়ার কথা।

“পারফিউম? সেই ক্লিপ জোড়া?”

“কোন ক্লিপ?”

জুহির মনে হলো আন্দ্রেজ হয়তো তার সাথে না জানার ভাণ ধরছে। ক্লিপ জোড়া তার জন্যই কিনেছে, হয়তো পরে দেবে। সে বললো,
“না, কিছু না।”

হঠাৎ পার্টি এরিয়ায় ক্যানিয়লকে ঢুকতে দেখে জুহি বিস্মিত হলো। ঝটপট এগিয়ে এসে বললো,
“তুমি? তোমাকে তো ইনভাইট করিনি তুমি এসেছো কেন?”

ক্যানিয়ল আস্ফালন চোখে চেয়ে বললো,
“আমার আসতে যেতে ইনভাইটের প্রয়োজন পড়ে না। আমি যেখানে ইচ্ছা সেখানে রাজত্ব করতে পারি।”
বলে জুহিকে ঠেলে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো। তারপর শিথিল পা ফেলে এগোতে লাগলো সামনে। তার থেকে কিছুটা দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ইরতিজা। ইরতিজার দু চোখে মুগ্ধতা। ছেলেটা কি আজকের দিনে বেশি সুন্দর হয়ে উঠেছে? না কি সব সময়ই এত বেশিই সুন্দর লাগে ছেলেটাকে? ইরতিজা টের পাচ্ছে তার হৃৎপিণ্ডের চলন স্বাভাবিক অবস্থা হারাচ্ছে। ক্রমশ অস্বাভাবিক হয়ে উঠছে।
ক্যানিয়ল ইরতিজার সামনে এসে থামলো। ক্যানিয়লের চোখ জোড়ায় চোখ পড়তেই কোন জাদুবলে ইরতিজার দৃষ্টি আটকে গেল কে জানে! ক্যানিয়ল মৃদু স্বরে বললো,
“আমার ভায়োলেট কুইন, এত মুগ্ধ চোখে চেয়ে থেকো না। তোমার এমন দৃষ্টিতে আমার সৌন্দর্য লজ্জা পেয়ে মুখ লুকাবে।”

ইরতিজা হঠাৎ লজ্জা পেয়ে গেল ক্যানিয়লের কথায়। চোখ সরিয়ে নিলো সে।
জুহি এসে ক্যানিয়লকে শুধালো,
“তুমি এমনিতেই বিনা ইনভাইটে এসেছো, তারউপর একটা গিফটও আনোনি?”

ক্যানিয়ল জুহির দিকে চেয়ে বললো,
“আমার মতো ধনী একজন ব্যক্তি তোমার মতো নগণ্য একজন মানুষের জন্মদিন পার্টিতে এসেছে, সেটাই যথেষ্ট নয়? এটা নিয়েই গর্বিত থাকা উচিত তোমার।”

“আমি নগণ্য?” রেগে গিয়ে বললো জুহি।

“অবশ্যই, তুমি গণ্য করার মতো ব্যক্তি নও। পৃথিবীর বুকে অতি সামান্য একটা প্রাণী।”

“আর তুমি খুব অসামান্য?”

“তার থেকেও বেশি কিছু।”

“আজ আমার জন্মদিন, তোমার সাথে কথা বলে মুড নষ্ট করতে চাইছি না আমি।”

“হ্যাঁ, তুমি এখন আমার সামনে থেকে সরে যাও। আমিও তোমার এত সুন্দর মুখে দাগের সৃষ্টি করতে চাইছি না।”

“এর মানে?”

ক্যানিয়ল জুহির দিকে একটু এগিয়ে এসে বললো,
“তোমার কি ধারণা আমার হাতের একটা ঘু’সি তোমার মুখে দাগ তৈরি করতে অক্ষম?”

জুহির ভিতরে থাকা রাগ নিজেদের উন্মুক্ত করতে মরিয়া হয়ে উঠছিল, কিন্ত তা উন্মুক্ত হওয়ার আগেই ইরতিজা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। সে জুহির কাছে এসে বললো,
“এটা তোমার বার্থডে পার্টি। মাথা গরম করে পরিবেশ নষ্ট করো না। বদনাম হবে। ওদিকে চলো।”

ইরতিজা জুহিকে নিয়ে ওদিকটায় যাওয়া দিলে ক্যানিয়ল ইরতিজার একহাত ধরে ফেলে বললো,
“হোয়্যার আর ইউ গোয়িং? আমাকে তোমার দেখা হলেও, তোমাকে দেখা সম্পূর্ণ হয়নি আমার। আমার সামনে স্থির থাকো। আর আমার দৃষ্টি জোড়া স্থির থাকুক তার প্রিয়র উপর। তুমি কিন্তু আমার প্রিয় নও পাকিস্টানি গার্ল! তবে কি তুমি আমার চোখের প্রিয়? না কি তুমি আমার মনের প্রিয়?”

ইরতিজার অন্তঃকরণে সুপ্ত অনুভূতির ধারা ঝরলো। কিন্তু হঠাৎই আবার তা ঝাঁঝাঁ রোদ্দুরে শুকিয়ে কাঠ হলো ভয়ে। তার বুক ধকধক করে উঠলো। গলা শুকিয়ে আসছে। ক্যানিয়লের তো ভয় নেই, কিন্তু তার আছে। ক্যানিয়ল এখানে এমন সময়ে এমনভাবে তার হাত ধরতে একবারও ভাবেনি, কিন্তু এমনভাবে হাত ধরেছে বলে তার ভাবতে হচ্ছে শত কথা। শত চিন্তা মস্তিষ্ক খাঁমচে ধরেছে। ফ্যামিলির কেউ যদি ক্যানিয়লের এই হাত ধরার দৃশ্যটা দেখে তাহলে নিশ্চয়ই তার জীবনে আরও একটা বিপর্যয় নেমে আসবে! ঠিক যেমন অর্টন চুমু খেয়েছিল বলে নেমে এসেছিল, ঠিক তেমনিভাবে। ইরতিজা আশেপাশে একবার সচকিত নজর বুলিয়ে নিলো। ফ্যামিলির কাউকে আশেপাশে দেখতে পেল না। স্বস্তি অনুভব করলো সে। কিন্তু তার ধারণায় রয়ে গেল একটা ভুল। ফ্যামিলির একজন ঠিকই দেখেছে সবটা। ক্যানিয়লের প্রবেশ থেকে শুরু করে এ যাবৎ ঘটা কিছুই তার দৃষ্টি এড়ায়নি।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here