#উড়ো_পাতার_ঢেউ
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ৫৬
_________________
ম্যাক এসে খবর দিলো সাজিদ দেখা করতে অনিচ্ছুক। কিন্তু জোনাস হার মানলো না। সে নিষেধ না শুনে নিজ থেকেই চলে এলো অফিসের অভ্যন্তরে। সোজা সাজিদের ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়ালো। সাজিদ চোখ তুলে তাকালো। জোনাসকে দেখে একদমই ভালো লাগলো না তার। বিরক্ত হলো সে।
জোনাস বললো,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে, কিছু দেখানোর আছে।”
“কিন্তু আমি তোমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নই। আমার হাতে অনেক কাজ আছে। আমাকে সেগুলো কমপ্লিট করতে হবে। আমি নিজের কাজের ক্ষতি করতে পারি না। স্যরি!”
“মানছি আমার সাথে কিছু সময় ব্যয় করলে তোমার কাজের ক্ষতি হবে। কিন্তু এটার জন্য তুমি নিশ্চয়ই তোমার চাকরি হারাবে না?”
ম্যাক তাকিয়ে আছে এদিকে। সাজিদ আর জোনাসকে দেখছে। অফিসের আরও কিছু স্টাফ তাকিয়ে আছে। সাজিদের অস্বস্তি হচ্ছে। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
“কথা বলার জন্য খুবই অল্প সময় দেবো তোমায়।”
জোনাস হেসে বললো,
“লোকে দুই মিনিট বলে দুই ঘণ্টা সময় নেয়, কিন্তু আমি কথা দিচ্ছি আমি দুই মিনিটের কথা বলে বিশ মিনিটের বেশি সময় নেবো না।”
সাজিদ আর জোনাস অফিসের ক্যান্টিনে এসে বসলো। সাজিদ দুই কাপ কফি এবং স্যান্ডউইচ অর্ডার করলো ভদ্রতার খাতিরে। জোনাস বললো,
“আমি এই মুহূর্তে তোমাকে যেটা দেখাবো সেটা দেখার পর তোমার ভিতরের অনুভূতি কেমন হবে সেটা দেখার জন্য আমি বেশ কৌতূহল বোধ করছি। আমার ধারণা তুমি বিষয়টা সম্পর্কে একেবারেই কিছু জানো না।”
সাজিদ ভ্রু কুঁচকালো। জোনাস নিজের মোবাইলটা এবার সাজিদের সামনে ধরলো। সাজিদের চোখ চমকে উঠলো মোবাইলের দিকে তাকিয়ে। সে দেখতে পাচ্ছে জোনাসের মোবাইলে একটা স্থির চিত্র। যেখানে দেখা যাচ্ছে তুষারপাতের মাঝে ইরতিজা একটা ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে আছে। ছেলেটা ইরতিজার হাতে চুমু খাচ্ছে। তুষারপাতের কারণে ছবিটা ভালো না আসলেও ইরতিজাকে চিনতে সাজিদের একদমই কষ্ট হয়নি। সে বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে রইল ছবিটার দিকে। জোনাস সাজিদের দিকে তাকিয়ে গোপনে হাসলো। শান্তির হাসি। আরও কিছু ছবি দেখালো সে সাজিদকে। ছবিগুলো মেরিমুর পার্ক, জুহির বার্থডে পার্টি আর ldylwood park এ থাকাকালীন মুহূর্তের কিছু ছবি। যেখানে প্রত্যেকটা ছবিতে ইরতিজার সাথে ক্যানিয়লকে দেখা যাচ্ছে। ছবিগুলো দেখে ধীরে ধীরে আক্রোশ জন্ম নিচ্ছে সাজিদের মাঝে। ছবি দেখানোর পাশাপাশি জোনাস মুখেও বলে চললো নানা কথা। যা সাজিদের প্রতি রক্ত কণায় রাগের সংঘর্ষণ ঘটালো। সে জোনাসকে কিছু বলতে পারলো না। প্রমাণ সে নিজের চক্ষু দ্বারা দর্শন করছে! জোনাসকে কী বলবে আর? ইরতিজা কীভাবে পারলো এটা?
_______________
বিকেলের শান্ত রোদ্দুর ইরতিজার মুখখানি ছুঁয়ে দিতে পারছে না। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে কিছু গাছ। এই গাছগুলোয় পাতা ভরপুর। গাছের ফাঁকফোকর দিয়ে একটু-আধটু রোদ কোনো রকমে রাস্তায় ঢুকেছে। ইরতিজা যাচ্ছে এন্ডারসন হাউজে। ক্যানিয়লের সাথে দেখা করতে। ক্যানিয়ল এখন কেমন আছে জানে না সে। গতরাতে ক্যানিয়লের সেই কান্নার সুর, চিৎকার এখনও তার হৃদয়ে ক্লেশের ঝঞ্ঝা গড়ে তোলে। ওটা যেন এক দুঃস্বপ্ন! গা ঝমঝমিয়ে উঠলো ইরতিজার। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস! বেলা লিমাসের হাসি মুখটি এখনও ইরতিজার মানসপটে ঘুরে বেড়ায় হন্নে হয়ে। মনে পড়ে বেলা লিমাসকে। আজ সকালে বেলা লিমাসকে কবর দেওয়া হয়েছে। ইরতিজার থেকে খানিক দূরে একটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়িটা দেখেই চিনতে পারলো ইরতিজা। গাড়ি থেকে সাজিদ নেমে এলো। সে ইরতিজার সাথে দেখা করতে ইরতিজার বাড়ি যাচ্ছিল, কিন্তু রাস্তাতেই দেখা হয়ে গেল। সম্পূর্ণ পথ যেতে হয়নি তাকে। অর্ধ পথেই দেখা হয়েছে। অর্ধ পথ। যেমন তাদের সম্পর্কটাও অর্ধ! সে ইরতিজার সামনে এসে দাঁড়ালো। মোবাইল বের করে সেটা ইরতিজার সম্মুখে ধরাকালীন সে ইরতিজার হাতের আংটিটাও দেখতে পেল। রাগে মাথা চড়ে গেল তার। সে কর্কশ স্বরে মোবাইলে থাকা ছবিটাকে ইঙ্গিত করে জানতে চাইলো,
“এটা সত্যি?”
ইরতিজা সাজিদের মোবাইলে তার এবং ক্যানিয়লের ছবি দেখে ভীষণ চমকে গেল। এই ছবি সাজিদের মোবাইলে কীভাবে? ইরতিজা ভেবেচিন্তে উঠতে পারলো না বিষয়টি। ক্যানিয়ল যখন তাকে আংটি পরিয়ে দিয়েছিল তখন কেউ তো ছিল না আশেপাশে। তবে এই ছবি কে তুললো লুকিয়ে লুকিয়ে? জোনাস? ইরতিজার মন এক মুহূর্তেই নিশ্চিত হয়ে যেতে সক্ষম হলো। তবে সে এই মুহূর্তটাকেই সবকিছু সাজিদের কাছে বলে দেওয়ার জন্য উপযুক্ত মনে করছে। সে আগেও বলেছিল সাজিদকে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে। কিন্তু সাজিদ অবিশ্বাস করেছিল সে কথা। আজ তো তা পারবে না। ইরতিজা যথেষ্ট দৃঢ়তার সাথে বলতে চেষ্টা করলো,
“হ্যাঁ এটা সত্যি। এটা আমি…”
ইরতিজা এ পর্যন্ত বলা মাত্রই সাজিদ তার গালে একটা চ’ড় মারলো। অন্যদিকে হেলে গেল ইরতিজার মুখ। দু চোখ খিঁচে ধরলো সে। সাজিদ চিৎকার করে উঠলো ইরতিজার উপর,
“এরকমটা কীভাবে করতে পারলেন ইরতিজা? এতদিন ভাবতাম আপনি একটা পাগল মেয়ে, সেই সাথে বোকাও আছেন। কিন্তু আসলে সবচেয়ে বড়ো বোকা তো আমি। আমি ভুল ভাবতাম। আমি ভাবতাম, জোনাসের জন্য আপনার মনে অনুভূতি আছে। কিন্তু আসলে আপনার অনুভূতিতে অন্য কেউ ছিল আর এখনও আছে! আমি ভুল ছিলাম। আমার অনেক আগেই বোঝা উচিত ছিল, যখন এই ছেলের কাছে আমাকে আপনার ভাই বলে পরিচয় দিয়েছিলেন তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল। আমি একটা গর্দভ! নিজে একটা গর্দভ হয়ে আপনাকেও গর্দভ ভাবতাম বলেই আপনার কোনো কথাকে কখনও সিরিয়াস ভাবে নিইনি আমি। মজার ছলে নিয়েছিলাম সব কিছু। কিন্তু এখন এটাই সিরিয়াস বলে প্রমাণিত। আর আমার ভাবনাগুলো ভ্রান্ত!”
সাজিদ নিজের গাড়ির দিকে এগোতে লাগলো। ইরতিজা পিছন থেকে রাগে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
“আপনার সাহস কীভাবে হলো আমাকে চ’ড় মারার? কোন সাহস, অধিকারে আপনি এটা করেছেন?”
সাজিদ পিছনে তাকালো। দেখতে পেল ইরতিজার দু চোখে অশ্রু টলমল করছে। যেকোনো সময়ে টালমাটাল হয়ে ঝরে পড়তে পারে তারা। হঠাৎ সাজিদের কী যেন হলো। তার মনটা এই মুহূর্তে ভীষণ নরম হয়ে এলো ইরতিজার প্রতি। সে আবারও এগিয়ে এলো ইরতিজার কাছে। ইরতিজা কান্না চেপে রেখেছে। তার স্পষ্ট একটা ছাপ ফুঁটে আছে তার বদনখানিতে। ইরতিজা বললো,
“আমি আপনাকে ব…”
থমকে গেল ইরতিজা। সাজিদ হুট করে তার গালে চুমু খেয়েছে! সেই গালেই, যে গালে সাজিদ চ’ড় মেরেছিল। ইরতিজা স্তব্ধ হয়ে গেছে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকালো সাজিদের দিকে। সাজিদ বললো,
“আশা করি জায়গাটা বেশি ব্যথা করবে না।”
বলে ইরতিজার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে গাড়িতে গিয়ে বসলো।
ইরতিজা এমন হতবাক হয়ে গেছে যে কিছু বলতেও পারলো না। সাজিদ চলে যাওয়ার পর সে চিৎকার করে উঠলো রাগে। সাইড ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে গালটা মুছতে লাগলো। লোকটা কীভাবে এমনটা করলো? কী জঘন্য! ইরতিজা কেঁদে ফেললো। শুধু রুমাল দিয়ে মুছলে হবে না। পানি প্রয়োজন। পানিতে রুমাল ভিজিয়ে তারপর মুছতে হবে।
ওই ঘটনার পর ইরতিজা আর ক্যানিয়লের সাথে দেখা করতে যাওয়ার মন পেল না। ভীষণ বাজে স্মৃতি হয়ে দাঁড়ালো এটা। ঘৃণা লাগছে দৃশ্যটা মনে করতে। সে বিকেলটুকু পার্কে এসে কাটালো। বাজে স্মৃতিটার পাশাপাশি আরও বেশ কিছু বিষয় তার মস্তিষ্ককে খুঁচিয়ে যেতে লাগলো। সে একশ ভাগ নিশ্চিত ছবি তোলার কাজটা জোনাস করেছে! ও ছাড়া আর কেউ করেনি এটা। কিন্তু এটা সাজিদকে কীভাবে দিয়েছে? দিয়ে কী বলেছে? সাজিদ সবটা শুনে এমন রেগে গেছে কেন? সে তো আগে থেকেই জানতো ও তাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নয়, তারপরও ব্যাপারটা জানার পর এত হাইপার হয়ে গেল কেন? লোকটা কী করবে এরপর? বাসায় জানিয়ে দেবে না কি সবটা? যন্ত্রণায় ইরতিজা মাথা চেপে ধরলো দুইহাত দিয়ে।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ওয়েদারও খারাপ হচ্ছে ক্রমশ। ইরতিজা তাড়াতাড়ি পার্ক থেকে বেরিয়ে সোজা বাসায় চলে এলো। এসে দেখলো বাসার পরিবেশ থমথমে। শারমিন সন্তর্পণে কাঁদছেন। আজাদ চৌধুরী বসে আছেন গম্ভীর মুখে। নওরিনের মুখ উদ্বিগ্ন। সাজিদকে বাসায় দেখে যা বোঝার বুঝে গেল ইরতিজা। ভয়ে তার গলা শুকিয়ে আসছে। ভিতরটাকে এই মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত করেই গৃহে প্রবেশ করা উচিত ছিল তার। সে কাঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“কাঁদছো কেন মা?”
শারমিন জবাব দিলেন না, অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।
ইরতিজা বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“কী হয়েছে আব্বু?”
আজাদ চৌধুরী শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“পারলে তোমাকে এই মুহূর্তে একটা চড় মারতাম আমি!”
ইরতিজার হৃদয় ছ্যাঁত করে উঠলো। মনে হলো তার বিশ্ব-ভূখণ্ড কেঁপে উঠেছে বাবার এই একটা কথায়। তার দু কান অবিশ্বাসের হাওয়ায় দোদুল হয়ে উঠলো। বাবা তার সাথে কখনও একটু কঠিন স্বরেও কথা বলেনি, সেখানে আজ চড় মারার কথা বলছে? ইরতিজার দু চোখ ফেঁটে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। সিক্ত কণ্ঠে ডাকলো,
“আব্বু!”
“তুমি জানো তোমার বিয়ে সাজিদের সঙ্গে ঠিক হওয়া, তোমার আঙুলে সাজিদ আংটি পরিয়ে দিয়েছিল। তুমি সেই একই আঙুলে কী করে অন্য একজনের আংটি পরে আছো? তুমি কি নিজের বিবেককে ভুলে গেছো ইরতিজা?”
ইরতিজা কান্না ভেজা আঁখিতে চেয়ে ডানে-বায়ে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“আমি ভুলিনি। আমি কোনো ভুল করিনি। আমি তোমাকে এবং মি. সাজিদকে অনেক বার বলেছিলাম আমি এই বিয়ে করবো না। এমনকি তুমি জানো এনগেজমেন্টের পরের দিন আমি ওনার সাথে দেখা করে বিয়ে ভাঙার চেষ্টা করেছিলাম। আমি বিয়ে করবো না এই কথাটা তোমাকে এবং সাজিদকে অনেকবার বলার পরও তোমরা কেউই আমার কথাকে গ্রাহ্য করোনি। না সাজিদ করেছে, আর না তুমি!”
“গ্রাহ্য করিনি কারণ ভাবতাম ওটা তোমার পাগলামি, এটা এক সময় থাকবে না। কারণ তুমি বুঝবে সাজিদ তোমার জন্য কত নির্ভুল একটা মানুষ। কিন্তু তুমি অন্যদিকে হেঁটে গেছো! যে রাস্তা সম্পর্কে আমার মস্তিষ্ক একটিবারের জন্যও ভাবেনি।”
“ভুলটা তোমাদের ছিল, কারণ তোমরা ভাবোনি। ভুলটা আমার ছিল না।”
“ভুল তোমারই ছিল। যখন তুমি জানতে তুমি অন্য কারো স্ত্রী হওয়ার জন্য নির্ধারিত তখন তুমি কীভাবে পারলে সেই ছেলের প্রেমে পড়তে?”
“পারলাম কারণ আমি চাইনি সাজিদের স্ত্রী হতে। চাই না আমি তাকে বিয়ে করতে। সেই শুরু থেকে আমি তোমাদের এই কথাটা বলছি, কেন বুঝছো না তোমরা? কেন বুঝতে চাইছো না?”
ইরতিজার কান্নার ধ্বনি তীব্র হলো।
আজাদ চৌধুরীর ইরতিজার কান্না দেখে খারাপ লাগলেও তিনি নিজের দুর্বল রূপকে সম্মুখে উপস্থাপন করলেন না। শক্ত কণ্ঠে বললেন,
“এটা বললেই তোমার দোষ ছিল সেটা মিথ্যা হয়ে যায় না। তুমি সাজিদকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক নও সেটা ঠিক, কিন্তু তোমার উচিত ছিল এটাতে নিজের সম্মতি স্থাপনের চেষ্টা করা, কিন্তু তুমি তা করোনি। তুমি অন্য আরেক জনের জন্য নিজের অনুভূতি সঁপে দিয়েছো। যা ঠিক করোনি। তোমার উচিত ছিল সাজিদকে নিয়ে তোমার অনুভূতির সাথে সন্ধি ঘটানোর একটা চেষ্টা করা। তুমি সেই চেষ্টা না করেই অন্য কিছু আঁকড়ে ধরেছো।”
আজাদ চৌধুরী ইরতিজাকে একটা ছবি দেখিয়ে বললেন,
“এই ছবি সম্পর্কে তোমার অভিমত কী? মানুষ এই ছবি দেখিয়ে বাজে কমেন্ট করছে! কেন করছে? এটাতেও কি তোমার দোষ জড়িত নয়?”
ইরতিজা দেখলো এটা এমন একটা ছবি যা ওষ্ঠ চুম্বনের দৃশ্যকে ইঙ্গিত করছে! ছবিটা ক্যানিয়লের পিছন দিক থেকে তোলা হয়েছে। ক্যানিয়লের সামনে সে দাঁড়ানো ছিল, যার কারণে এমন একটা ধারণার সৃষ্টি করতে সক্ষম এই ছবি। আসলে ওখানের দৃশ্যপট এমন ছিল না। এই ক্লিকটা তখনই নেওয়া হয়েছে যখন ক্যানিয়ল আংটি পরানোর পর ইরতিজা কেঁদেছিল। যখন ক্যানিয়ল ওর চিবুক স্পর্শ করে বলেছিল,
“হেই, কেন কাঁদছো? কী হয়েছে?” তখনই এই ক্লিকটা নেওয়া হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে জোনাস এটা করেছে। ইরতিজার এটা বুঝতে একটুও কষ্ট হলো না। ঘৃণায় তার আত্মা কাঁপলো। বললো,
“এই ছবি মিথ্যা! এমন কিছুই ঘটেনি। ব্যাপারটা এমন ছিল না। ব্যাপারটা ছিল এক রকম, কিন্তু তোমাদের সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে অন্য রকম! তোমরা ভুল বুঝো না প্লিজ। আব্বু, তুমি অবিশ্বাস করছো আমায়?”
শারমিন আহমেদ চড়া গলায় বললেন,
“চুপ করো ইরতিজা।”
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বলতে আরম্ভ করলেন,
“তুমি আমাদের বোকা ভাবো? তুমি যা বোঝাবে তাই বুঝবো আমরা? তোমার বিয়ে সাজিদের সাথে ঠিক হয়ে থাকা সত্ত্বেও কীভাবে অন্য কারো সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছো? কীভাবে অন্য কারো আংটি আঙুলে পরেছো? এটা পরার অর্থ কী? তুমি ওই ছেলেকে বিয়ে করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছো?”
ইরতিজা কিছু বললো না। শারমিন ক্ষণকাল তাকিয়ে রইলেন ইরতিজার দিকে। তারপর আজাদ চৌধুরীর দিকে চেয়ে বললেন,
“ও তো তোমার মেয়ে না! তোমার মেয়ে হলে ও কিছুতেই এমন করতে পারতো না। ও তো ওই পাপী লোকটার মেয়ে! ওর শরীরে ওই পাপীর রক্ত বইছে!”
আজাদ চৌধুরী বললেন,
“চুপ করো শারমিন। কীসব বলছো তুমি!”
“না বলতে দাও আমায়। ও ওর নিজের পরিচয়কে ভুলে গেছে একেবারে। ও ভুলে গেছে ও কীভাবে তোমার রক্তের সম্পর্কিত না হয়েও তোমার এত আপন হয়ে উঠেছে, তোমার মেয়ে হয়ে উঠেছে। কী করে ভুলে যেতে পারে এসব? আমি আসলে ভুল করেছি। যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম সেই সিদ্ধান্তেই অটল থাকা উচিত ছিল আমার। উচিত হয়নি তোমার কথা শোনা। উচিত ছিল ও পৃথিবীর আলো দেখার আগেই…”
ইরতিজা আর সহ্য করতে পারলো না। দুই কান চেপে ধরে চিৎকার করে বললো,
“স্টপ…”
ওর চিৎকারে পুরো ঘর কেঁপে উঠলো। পাশের ইউনিটে থাকা মানুষগুলোর কর্ণকুহরও নাড়িয়ে দিলো ওর চিৎকার। ইরতিজা আজাদ চৌধুরীর দিকে চেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বললো,
“আমি তোমার মেয়ে আব্বু। মাকে এসব বলতে নিষেধ করো প্লিজ! কেন বলছে সে এসব কথা? আমি তোমারই মেয়ে। আমি তোমার মেয়ে ছিলাম সেই জন্মকাল থেকে, আছি এবং আমার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব পর্যন্ত আমি তোমার মেয়েই থাকবো। পুরো পৃথিবী যদি একজোটে এসেও বলে আমি তোমার মেয়ে নই, তাও আমার পরিচয় পাল্টে যাবে না। আমি তোমারই মেয়ে থাকবো। আমি তোমারই মেয়ে।”
আজাদ চৌধুরীরও হৃদয়ের পাড় ভাঙছে। লক্ষ করে দেখলে বোঝা যায় তার চোখেও জল এসেছে। সে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“হুম, তুমি আমার মেয়ে, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।”
ইরতিজা কান্নার মাঝেও একফালি সূর্যের রশ্মির মতো হাসলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বললো,
“শুনেছো, আমি আব্বুর মেয়ে? এর বাইরে আর কোনো পরিচয় নেই আমার। আর বলবে না এরকম। আমি আব্বুর মেয়ে না এটা শুনলে আমার হৃদয় জ্বালা করে! পৃথিবী ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায় আমার!”
ইরতিজা দৌড়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাইরে বৃষ্টি পড়ছে। টিপটিপ বৃষ্টি নয়, ঝুম বৃষ্টি। ইরতিজা যখন বাসায় এসেছিল তখন আকাশের অবস্থা খারাপ ছিল। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ছিল।
জুহি আর রিশন ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ইরতিজাদের কলহ শুনছিল। ইরতিজাকে এমন ঝুম বৃষ্টির মাঝে বাইরে নামতে দেখে দুজনই প্রায় উদ্বিগ্ন হয়ে একই সঙ্গে বলে উঠলো,
“টিজা, কোথায় যাচ্ছ?”
ঘটনায় দুজনই বিমূঢ় হয়ে রইল। কী করা উচিত না ভেবে দুজনই ঝাপসা আলো-আঁধারের পথে তাকিয়ে রইল অপলক। ইরতিজা ইতোমধ্যে নিজের দ্রুত বেগের দৌড়ের ফলে চলে গেছে তাদের দৃষ্টির বাইরে। একটু পর দেখলো এই বৃষ্টির মাঝে সাজিদও ব্যস্ত পায়ে দৌড়ে নেমে যাচ্ছে। এবার আর দুই ভাই-বোন জিজ্ঞেসও করতে পারলো না সাজিদকে কিছু। সাজিদও চলে গেল দৃষ্টির বাইরে। পড়ে রইল বৃষ্টিমুখর শূন্য রাস্তা।
এর মাঝে ঘরের ভিতর থেকে নওরিনের কণ্ঠ ভেসে এলো জুহি আর রিশনের কানে।
(চলবে)