এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_১৪ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0
71

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_১৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আজলান কাজে বেরোনোর আগে পইপই করে বলে দিয়ে গেছে ” মেহবুব আইজানকে ভেজা অবস্থায় বেশিক্ষণ ফেলে রাখবে না। ওয়াশরুমে যাওয়ার আগে মাকে অথবা আয়জাকে ডেকে নেবে। খাওয়ানোর পর ওকে কোলে নিয়ে বেশি দোল দেবে না, হাসাবে না। ”

তিথি লক্ষীটির মতো মাথা নেড়েছে। আজলান নিশ্চিন্তে কাজে গিয়েছে। ফিরতে দেরী হলেও তিথির জন্য একটা ফুল আনতে ভুলেনি। যদিও ফুলটা বাসি। সহকর্মী উনার ওয়াইফের জন্য কেনার সময় একটা আজলানকে দিয়ে বলেছিল,

” আপনার বিবিকেও দেবেন। দেখবেন ভালোবাসার অভাব হবে না। ”

ভালোবাসা শব্দে আজলানের একপ্রকার এলার্জি আছে। বিয়ে করলে সংসার হবে, বাচ্চা-কাচ্চা হবে, বউকে পরিমিত আদর সোহাগে রাখতে হবে, পাশাপাশি পরিমিত শাসনও করতে হবে এটাই হচ্ছে মূলকথা। এখানে ভালোবাসা টালোবাসা শব্দগুলোর জায়গা কোথায়? যত্তসব অপ্রাসঙ্গিক কাব্যিক কথাবার্তাকে মানুষের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। যার ফলে সে এত আদর সোহাগে রাখার পরও তার বউ বলে সে কাঠখোট্টা মানুষ, রোম্যান্টিক নয়, প্রেমিক নয়। বিয়ের পর সাংসারিক ক্যাঁচাল নামক সুখ দুঃখ, আনন্দ বেদনার মধ্যে জীবনের আসল স্বাদ খুঁজে নিতে হয়, সেখানে প্রেমের জায়গা কোথায়? বাচ্চা হওয়ার পর যেখানে বিছানায় ভালোমতো জায়গা হচ্ছে না সেখানে আবার প্রেম না ছাই!

এসব প্রেম ভালোবাসার মতো সস্তা সস্তা লেকচারগুলো কবি সাহিত্যিকরা আবিষ্কার না করলে প্রতিটা মানুষ সংসারী হওয়ার প্রতিযোগীতায় লেগে পড়তো। কিন্তু এখনকার মাথামোটা পাবলিকগুলো কবি সাহিত্যিক নামক উজবুকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রেম আর ভালোবাসার গভীর মর্মার্থ খুঁজতে গিয়ে স্বামী সংসার কিচ্ছু চেনেনা। মাঝেমধ্যে বোধহয় স্বামীকে বলতে ভুলে যায়, ” কে গো তুমি? কোথায় থাকো? কোথা থেকে এসেছ? তুমি নারী না পুরুষ?”

ফুলটা আনার পর সেটাকে সে বেডসাইড টেবিলে রেখে ওয়াশরুমে চলে গিয়েছে। তিথি ফুলটা দেখামাত্র চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিল। ফোনটা তার সহকর্মী দিয়েছে একথা তিথি বিশ্বাস করবে না। পুরুষ মানুষ কেন পুরুষ মানুষকে ফুল দেবে? এ অসম্ভব। সে কিনেছে একথাও ভুল কারণ বাসি ফুল কেউ কিনবে না তাও একটা। অতএব দাঁড়াচ্ছে ফুলটা কোনো মেয়েমানুষ তাকে দিয়েছে। রাগারাগির ফাঁকে কান্নাকাটিও করে ফেললো তিথি। চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আজলানের কিছুই করার রইলো না।

আজলান এমনিতেও রাতে ভালো করে ঘুমাতে পারেনা। মা ছেলে দুজনেই বকবক বকবক করে। শ্বশুরের বাইশ তেইশ বছরের বাচ্চাটা তার দুইমাস বয়সী বাচ্চাটার সাথে সারাক্ষণ বকবক তো রয়েছেই সাথে সে কি হাসি! যেন তারা একে অপরের ভাষা বুঝে ফেলে। আজলান কানের উপর বালিশ চাপা দিয়েও ঘুমোতে পারেনা। মাঝরাত অব্দি বকবক করতে গিয়ে যখন দু’জন ক্লান্ত হয়ে পড়ে তখন মা তার ছেলেকে বলে,

” ডোডোরে তোর বাপটা সারাদিন কত কষ্ট করে বাইরে। কত কষ্ট করে রোজগার করে আমাদের জন্য। তোর জন্য আমি তোর বাপের কাছেও ঘেঁষতে পারিনা। একটু মাথাও টিপে দিতে পারিনা। তোর মনে কি দয়ামায়া নেই ডোডো? ”

আজলানের তখন রাগ হবে, নাকি নিজের অদৃষ্টের পরিহাস ভেবে সে দুঃখ যাপন করবে কিছুই ভেবে পায় না সে।

____

সেদিন কাজে বেরোনোর সময় আজলান দেখে, তিথি ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখ নিয়ে কোনোমতে উঠে বসেছে। সে যাওয়ার সময় একটু এগিয়ে দেয়ার জন্য ঘরের বাইরে বের হয়। আজও তাই। আইজান তখন ঘুম। তার ঘুমন্ত মুখে কয়েকটা আদর দিয়ে আজলান বেরিয়ে যাওয়ার সময় যখন বললো,

” বাবুকে চোখে চোখে রাখবে। ”

তিথি হাই তুলে বলে উঠে, ” ও আমাকে চোখে চোখে রাখে যাতে তোমার কাছে না যেতে পারি। ”

আজলান বলল, ” ননসেন্স মহিলা। ”

তিথি বলল, ” তোমার সাদা পায়জামায় হলুদ হলুদ যে রঙটাকে আমি তরকারির ঝোল বলেছি ওটা আসলে ডোডোর পটির রঙ ছিল। আমি ভাই বুঝিনা কিছু। ও খায় সাদা তরল জিনিস। পটি কেমনে হলুদ হয়? ”

বেরোনোর সময় মাথা গরম করতে চায়নি আজলান। কিন্তু তিথির কথায় রাগ চেপে রাখতে পারেনি। বাহু চেপে ধরে বলল,

” পায়জামা ধুয়ে পরিষ্কার করে রাখবে। দাগটা না গেলে আমি তোমাকে সোজা বের করে দেব। ”

তিথি বলল, ” আমি তো সেটাই চায় বস। একবার বের করে দেখো না। বাচ্চাকে ফিডার খাওয়াতে, হাগুমুতু পরিষ্কার করতে কি মজা হাড়ে হাড়ে বুঝবা। ”

______

আজলান বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে এসে ডোডোকে কোলে নিয়ে বাইরে থেকে ঘুরে আসে। কোলে নিয়ে হাঁটলে ডোডোর চাইতে খুশি আর কেউ হয় না। আজলান তার নরম নাকটাতে নিজের নাক ঘষে আদর করে। তখন অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ করে ডোডো। যেন কতকিছু বুঝে সে। হঠাৎ হঠাৎ ঢেঁকুর তুলে। ছোট্ট শরীরটার ঘ্রাণ অদ্ভুত লাগে আজলানের। কোনো কৃত্রিম সুগন্ধি মাখতে হয় না তারপরও মিষ্টি একটা সুঘ্রাণ বাচ্চাটার গায়ে। আজলান তার গালে টুপটাপ আদর করে তাকে হাসালো। আর তার পরপরই গলগল করে দুধবমি করে দিল সে। আজলান দেখলো তার হাত আর বুকের কাছে শার্টটা ভরে গেছে বমিতে। তিথিকে ডাকতেই তিথি দৌড়ে এল। হায়হায় করে বলল,

” যা খেলি সব বের করে দিলি ডোডো? তুমি আমাকে বকো এখন নিজেই ওকে এমন করে হাসালে কেন? ও তো সব বের করে দিল। নিজে কি ওকে খাওয়াতে পারবে? ওকে খাওয়ানোর মুরোদ তো নেই শুধু বের করে দেয়ার মুরোদ আছে তোমার। আরও মুখে কত বড় বড় লেকচার। ”

নিজের ওড়না দিয়ে সব বমি মুছে নিয়ে তিথি ডোডোকে কোলে নিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলো,

” হ্যা রে ডোডো তোর আক্কেল জ্ঞান কখন হবে? খাওয়ামাত্রই সব বের করে দিস। এখন কিছুক্ষণ পর আবার চিল্লাবি খিদে পেয়েছে বলে। আমার কি তোকে খাওয়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই?তোরও কি খাওয়া আর হাগুমুতু করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই? মায়ের হয়ে তোর বাপকে দুটো কথা তো বলতে পারিস না। হাতে হাতে কাজ করার মুরোদও তোর নেই। শুধু পারিস ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে। বেয়াদব ছেলে একটা। সর, আর কাঁদিস না। তোদের বাপ ছেলের ঢং দেখলে বাঁচি না। ”

আম্বিয়া বেগমের কোলেও বেশিক্ষণ ছেলেকে রাখবে না সে। তেল মাখা শেষে কোলে নিয়ে ফেলবে। গোসল করানোর সময় ধরতে দেয়, ও খাওয়ার সময় কোলে দেয়, নামাজ পড়ার সময় দেয়। বাকিসময় ছেলেকে কোল থেকে নামাবে না। আম্বিয়া বেগম বলল,

” তুই এক ব্যাটামানুষের মা হলি। আমাদের গুলো জলে জলে ভেসে ভেসে আসছে।”

তিথি ভৎসনা করে বলে,

” তোমরা হচ্ছো পুরোনো আমলের অশিক্ষিত আনপড়াহ মেয়ে মানুষ। আমি হচ্ছি স্মার্ট মাদার। একুশ শতাব্দীর মায়েরা কি তোমাদের মতো বাচ্চাকে রশি দিয়ে বেঁধে সেই রশি কোমরে গিঁট বেঁধে ঘরের কাজ করবে? ”

আম্বিয়া বেগম বললেন, “তোর এক ঠোঁট আছে। কেউ পারবে না তোর সাথে। তুই একটা জিনিস।”

তিথি বলল,

” আমাকে সবাই বলতো তুই কেমনে সংসার করোস দেখমু। জীবনেও তোর ঘর সংসার হবে না। তোর মতো পাগলছাগলের জীবনেও স্বামী সংসার হবে না। এখন আমি তাদের বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিয়েছি। বলে এসেছি, দেখে আয় কিভাবে শ্বশুর শ্বাশুড়ি আর বরটাকে জব্দ করেছি। ”

আম্বিয়া বেগম বললেন,

” সর। ”

______

ডোডোর মুখে ভাত ছোঁয়ানো হয়েছিল অনেক আগে। পাঁচ কি ছয় মাস বয়সে। এখন তার বয়স ১৩ মাসে পড়েছে। ডোডো এখন টুকটাক খেতে শিখেছে । এখন তিথি তাকে ভাতের পাশাপাশি ঠান্ডা চা খাওয়ানো শিখিয়েছে। আর চায়ে তার এত নেশা হয়েছে যে সে চায়ের কাপ দেখলেই হাত ঝাপটানো শুরু করে। সাবু খেতে না চাওয়ায় আজলান ধমক দিতেই সে কি কান্না। তিথির কাঁধে মাথা ফেলে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে গেল। ছেলের দুঃখে মাও কেঁদে ফেলবে এমন অবস্থা। তিথি বলল,

” আমার ছেলেকে অমন করে বকবে না। আমরা মা ছেলে এই বাড়িকে ঠ্যাং দেখিয়ে চলে যাবো বলে দিচ্ছি” বলেই ডোডোকে বলল, ” ডোডো ডোডো পাহ কোনটা দেখা তো। পাহ পাহ। ”

ডোডো পা দুটো দোলাতে লাগলো।
আজলান হতভম্ব হয়ে গেল।
রেগে গিয়ে ডোডোর হাত পা বেঁধে দুধ খাইয়ে দিতে দিতে বলল,

” চুপচাপ খাও। মেহবুব তুমি ওকে কি শেখাচ্ছো এসব?”

তিথি বলল,

” কচু।এসব কি হচ্ছে? আমার ছেলেটার উপর এভাবে অত্যাচার করছো কেন? ”

আজলান ধমকে বলল,

” শাট আপ। ”

তিথি ডোডোর কাছে এসে জিভ বের করে বললো,

” এই ডোডো, ডোডো! তোর বাপকে ভেঙচি দে তো। ”

ডোডো জিভ বের তাকালো আজলানের দিকে। আজলান অবাক হয়ে তাকাতেই তিথি হেসে উঠলো। সাথে ডোডোও খিকখিক করে হাসতে লাগলো। রাগে আগুন হয়ে আজলান তিথিকে ধরতে যেতেই তিথি পালিয়ে গেল। আটঘাট বেঁধে আজলান তাকে ধরতে নেমেছে দেখে তিথি ছুটে এসে তাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। মুখ তুলে রাগান্বিত মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল,

” আদর করার জন্য মিষ্টিসুরে ডাকতে হয় এটা তুমি কবে শিখবে আফিষাড়? ”

আজলান কিছু বলতে যাবে তার আগেই
“ডোডো ডোডো চোখ বন্ধ কর” বলে তিথি চোখ বন্ধ করে দেখালো। ডোডো তার দেখাদেখি চোখ বন্ধ করতেই তিথি আজলানের মাথা টেনে গালে ঠোঁট চেপে চুমু খেয়ে বলল,

” ডোডো চোখ খোলার আগে আমার পাওনা দিয়ে ফেলো বস। তুমি তো আবার ঋণী হয়ে থাকতে চাওনা।”

আজলান বলল, ” আগামী সাতদিনের মধ্যে ওর চায়ের নেশা কমাবে নয়ত তোমাকে আমি বাড়ি থেকে সোজা বের করে দেব। ”

তিথি বলল, ” সাথে ডোডোকে ফ্রি। ঠিক কিনা? জোরে বলো ঠিক ঠিক। ”

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here