এই_ভালো_এই_খারাপ #পর্ব_২০ #প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

0
130

#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২০
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী

আম্বিয়া বেগম বিলাপ করছেন। আফতাব সাহেব গম্ভীরমুখে বসে রয়েছেন। আম্বিয়া বেগম কপালে দুহাত চেপে রেখে বলে যাচ্ছেন,

” তোমার জন্য ওদের সংসারটা ভাঙলে আমি তোমাকে মাফ করবো না বলে দিলাম। তোমার হঠকারীতার জন্য ওদের মধ্যে এত ঝামেলা হচ্ছে। তোমরা বাপ মেয়ে মিলে আমার সোনার সংসারটা ভাঙছো। মাফ দেব না তোমাদের আমি। ”

আফতাব শেখের মুখে কথা নেই। তিনি একদৃষ্টে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছেন। আর ভাবছেন আজলান শেখের কথা। উনাকে শায়েস্তা করার জন্য সে এখন যা খুশি সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বউয়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথাও ভাবতে পারে কারণ বউটাকে তিনি পছন্দ করে এনেছেন। তাই সব দোষ এখন বৌয়ের ঘাড়ে গিয়ে পড়বে। এখন তিনি কোনো কথা বলবেন না। সে কতদূর যেতে পারবে তিনি তা দেখবেন।

ডোডো কাঁদছে। আয়জাও কাঁদছে তার সাথে। সে মায়ের কাছে যেতে চাচ্ছে কিন্তু এখন ওখানে যাওয়া সম্ভব না। ছোট বাটিতে করে সেদ্ধ নুডলস নিয়েছে সে। ডোডো সেটা মুখেও নিচ্ছেনা। সে মায়ের কাছেই যাবে।

তিথি স্যুটকেসে কাপড়চোপড় সব ভরতে ভরতে হাতের উল্টোপিঠে চোখ মুছলো। এই শেখ বাড়িতে হয় সে থাকবে, নয় আজলান শেখ।
আজলান শেখ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এমন চক্রান্তকারী, ষড়যন্ত্রকারী বউয়ের সাথে সে সংসার করবে না। বিশেষ করে যে বরের কথা না ভেবে শ্বশুরের হয়ে কাজ করে তার সাথে তো নয়ই।

তিথি কোনটা চায় জিজ্ঞেস করার পর তিথি জানিয়েছে সে চলে যাবে। বাড়ির ছেলে বাড়িতে থাকুক। আম্বিয়া বেগম কাঁদছিলেন ছেলে চলে যাবে শুনে। কারণ কিছুবছর আগেও সে একবার ঘর বিমুখী হয়েছিলো, একবার ঘর বিমুখী হলে তাকে ঘরমুখো করতে অনেক পোহাতে হবে।
সে এমন এক পাষাণ, বর্বর হৃদয়ের মানুষ যে স্বজনদের ছায়ায় থাকতে না পারলেও বেশ ভালোভাবে বাঁচে।

শ্বাশুড়ির কান্না দেখে তিথি বুঝে গিয়েছিলো তিনি চাইছেন তিথি এমনটাই বলুক। কারণ ঘরের বউ একবার চলে গেলে আবার ফিরিয়ে আনা যাবে খুব সহজে। সে বেশ সহজলভ্য কিনা।
কিন্তু ছেলে গেলে ফিরিয়ে আনা দুষ্কর।

আফতাব শেখ ছেলের প্রতিশোধের ধরণ দেখে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন। উনাকে সে জিততে দেবেনা কিছুতেই। তাই তো কথার পিঠে কথার জবাব না দিয়ে একেবারে মোক্ষম জায়গায় ছালটা দিয়েছে।

রমলা চাচী তিথির পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। সে কাপড় ভরা শেষে বলল,

” ডোডোকে একটু এনে দাও চাচী। ”

রমলা চাচী বললেন,

” পারুম না। ওরে আনা বারণ। ”

তিথি অবাককন্ঠে বলল,

” কেন? ”

” কেন মানে? তুমি একা যাইতেছ তোমার বাপের বাড়িতে, তোমার বাবুরে নিয়ে যাইতে পারবানা। ”

তিথি জিজ্ঞেস করলো,

” আজলান শেখ বলেছে? ”

” হ বলছে। এবার তুমি খুশি হইছো? যাও এবার নাচতে নাচতে বাপের বাড়ি যাও। এটাই চাইছো সবাই। তুমি চলে যাইতেছো যাও, আমিও চইলা যামু। এই বাড়িতে আর কাজকাম করুম না। ”

তিথি স্যুটকেসটা গুছিয়ে ঘরের বাইরে এনে রাখলো। আজলানের সাথে আজ নতুন ড্রাইভার এসেছে। তিনি কাকাদের বয়সী। উপরে উঠে তিথির স্যুটকেসটা নিয়ে গেল। আম্বিয়া বেগম তা দেখে আফতাব শেখকে বললেন,

” তুমি আটকাবে না? কিচ্ছু বলবে না? ”

আফতাব শেখ বললেন,

” এখন তোমার ছেলের হাতে পায়ে ধরতে হবে আমাকে? ও চাইছে আমি ওর হাতেপায়ে ধরে অনুরোধ করি। যাক। বউটাকেও সম্মানে করে উল্টে ফেলছে এমনও না। যাক, কিছুদিন পর নিজে গিয়ে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। বউ তার। মাথাব্যথাও তারই হবে। বাচ্চাকে না দেখে ক’দিন থাকতে পারব ”

আম্বিয়া বেগম কপাল চাপড়ে বললেন,

” বাচ্চাকে দিচ্ছে না ও। আমি এতক্ষণ কাকে কি বলছি? ডোডো ওর মায়ের সাথে যাবে না। ”

আফতাব শেখ রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। বললেন,

” মগের মুল্লুক নাকি? ও এখনো মাকে ছাড়া থাকতে শিখেছে? বর্বর ছেলে। নিজের বাচ্চার প্রতিও তার মায়া মহব্বত নেই। ”

আম্বিয়া বেগম কাঁদতে লাগলেন।

” তুমি করেছ যা করার। আমি কতকিছু সহ্য করি ওদের সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্য। কতকিছু লুকিয়ে যাই। কতকথা চেপে রাখি। তুমি সব শেষ করে দিয়েছো। তোমাকে আমি মাফ দেব না। ”

আফতাব শেখ বললেন,

” আসল কথা হচ্ছে ওর বউয়ের প্রতি ওর নিজের মায়া মহব্বত নেই। কোনোমতে সংসার করছে। বউ চলে যাচ্ছে ভালো করছে। আরও আগে যাওয়া উচিত ছিল।”

ডোডোর কান্না ভেসে আসছে। আয়জা দোল দিতে দিতে বলল,

” চাচী ওর মা কোথায় এখন? ”

রমলা চাচী বলল, ” বেরিয়ে গেছে। ”

আয়জা অবাককন্ঠে বলল, ” কখন? না বলে? ”

সে ডোডোকে নিয়ে দ্রুতপায়ে নেমে গেল।

__

আজলান সুইমিংপুলের পাশে দাঁড়িয়েছিলো। তিথি তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে আজলান ঘাড় ফিরাতেই তাকে বোরকা পড়া দেখে বলল,

” আগে থেকেই মনে হয় প্রস্তুত ছিলে যে চলে যাবে। দারুণ। যাও যাও। বাড়িঘর খালি করো। আফতাব শেখ বুঝুক হঠকারিতার ফল কি হতে পারে। ”

তিথি বলল,

” ডোডোকে আমি নিয়ে যাচ্ছি। ”

আজলান চোয়াল ঝুলিয়ে বলল,

” কোথায়? ”

” আমার সাথে। ”

” ওর ডায়াপার কেনা থেকে ঔষধ খরচ তুমি কিভাবে সামলাবে? বললেই হলো? ”

তিথি বলল, ” হয়ে যাবে। ”

” হয়ে যাবে বললেই আমি মানবো কেন? বাড়ির ছেলে বাড়িতে থাকবে। তোমাকে আমি যেতে বলছিনা তুমি নিজেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছ। তাহলে একা যাও। আমার ছেলেকে টানবে না। ”

তিথি বলল,

” ওর দুধ ছাড়ানো হয়নি এখনো। শুধু রাতে ভাত খায় তাও কম। ”

” সেসব আমি দেখবো। ”

তিথি বলল,

” ও এখনো আমাকে ছাড়া থাকতে শেখেনি। ”

আজলান গর্জে বলল,

” তো থাকো তোমার ছেলেকে সাথে নিয়ে তোমার শ্বশুরবাড়িতে। ”

” থাকব না। ”

” তাহলে যাও। তোমার চেহারা আর দেখিওনা আমাকে।”

আম্বিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে ছুটে এলেন। বললেন,

” আজলান, এমন করিস না আব্বা। তোর বউ বাচ্চার প্রতি কি তোর একটুও মায়া মহব্বত নেই? বাপের উপর রাগ করে ওদের কষ্ট দিস না আব্বা। তুই তোর বউ বাচ্চাকে নিয়ে অন্যত্র চলে যা। তোকে তোর আব্বার সাথে থাকতে হবে না। তোর সেই ক্যাপাসিটি আছে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে ঝামেলা তৈরি করিস না। ”

আজলান বলল,

” তোমার কি মনে হয় শুধু আফতাব শেখ আমাকে অপমানিত করতে চেয়েছিলো? ও চায়নি? ও নিজেই রাস্তা খুঁজছিলো আমাকে অপমান করার। আমি আর কারো কথা ভাববো না। না ওর, না তোমাদের, না আয়জার। ”

আম্বিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে বললেন,

” তোর আব্বার উপর রাগ করে আমাদের কেন শাস্তি দিচ্ছিস? ”

” দোষ শুধু উনার নয়। যারা যারা জড়িত ছিল সবার। ”

তিথি বলল,

” মা তুমি কেঁদো না। আমি স্বেচ্ছায় যাচ্ছি। ”

আম্বিয়া বেগম তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। তিথি উনাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে আজলানের দিকে চেয়ে রইলো। আজলান মুখ ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলো।

মাকে দেখামাত্রই আয়জার কোলে ঝাপটাঝাপটি শুরু করে দিয়েছে ডোডো। চোখের পানিতে গাল ভিজে আছে। তিথি তাকে কোলে নিয়ে দুগালে, কপালে আদর করলো। গাল মুছে দিয়ে গালে গাল ঠেকিয়ে হু হু করে কেঁদে উঠলো। রমলা চাচী মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে কাঁদলো তার সাথে। আম্বিয়া বেগম কেঁদে উঠে স্বামী সন্তানকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

” ছোট বাচ্চাটার উপরও মায়া লাগে না তোদের। তোরা বাপ ছেলে থাক তোদের জেদ নিয়ে।
তুইও কেমন রে বউ? এতদিন হয়ে গেল এই সংসারের প্রতি তোর মায়া জন্মায়নি। তোকে বললো আর তুই চলে যাচ্ছিস। আমার সংসারটা গেল ছারখার হয়ে। ”

ডোডো মায়ের কোলে এসে শান্ত হয়ে গেছে। মাকে কাঁদতে দেখে সে মায়ের মুখের দিকে চেয়ে ডাকলো, ” আম্মাহ আম্মাহ। ”

তিথি বলল, ” জি। ঘুম ঘুম। ”

ডোডো মিছিমিছি চোখ বন্ধ করলো। তিথি তার গালে পুনরায় চুমু খেয়ে আয়জার কোলে দিয়ে দিল। আম্বিয়া বেগম ধরে রেখে বললেন,

” আগে তো যেতে চাইতিনা বউ। আজ এভাবে চলে যাচ্ছিস কেন? তুই যাস না, তোর বরকেও যেতে দিস না। তোরা থাক। আমরা চলে যাই কোথাও। তোর বাবুর মুখ চেয়ে থেকে যা। ওকে সামলাবো কেমন করে? ”

তিথি এর জবাব দিতে পারলো না। শাস্তিটা তার প্রাপ্য। আর আজকের সিদ্ধান্তটা শুধু নিজেকে শাস্তি দেয়ার জন্য নয়। উপলব্ধি করা কতটুকু জড়িয়ে আছে সে এই সংসারের সাথে, যার ঘর করছে তার সাথে। তার আজ যাওয়া উচিত।

আয়জা আজলানের ইশারায় ডোডোকে বাড়িতে ঢুকিয়ে ফেলেছে। সে চেঁচিয়ে কাঁদছে। তিথি গাড়ির দিকে এগিয়ে যেতেই আম্বিয়া বেগম ধরে রেখে বলল,

” যাস না বউ। তোর পাগলামি আমি মেনে নিছি, তোর শ্বশুর মেনে নিছে। এই বাড়িটা তোর শ্বশুরের। তোর থাকার অধিকার আছে। ”

তিথি ঝরঝরে কেঁদে ফেলে বলল, ” যে মানার সে মেনে নেয়নি। মানুক সেটাও চাই না। ”

” আর কবে ফিরবি? তোর বাবুর কথা ভাববি না?”

” ওর কথা ভেবেই চলে যাচ্ছি। বুদ্ধি হওয়ার পর যাতে ওকে দেখতে না হয় ওর মা একজন পাগল, শুনতে নয় হয় ওর মা বস্তি থেকে উঠে এসেছে। কারো যোগ্য বউ হওয়ার কোনো দরকার নেই আমার। আমি একজন যোগ্য মা হতে চাই। ওর বাবা ওকে ভালো রাখবে। তাই আমার কোনো চিন্তা নেই। ”

” তুই কেমন পাষাণ মা? ”

” তোমার ছেলে ভালো বাবা হোক। ”

আম্বিয়া বেগম চিৎকার করে কাঁদলেন। আজলানকে বললেন,

” তুইও চলে যা। তোকেও দরকার নেই আমার। তোরা সবকটা আমার সংসার ভেঙেছিস। যাহ তোকে দরকার নেই আমার। ”

তিথি গাড়িতে উঠে গেল। আজলান গাড়ির কাছে এসে বলল,

” তুমি সত্যি সত্যি যাচ্ছ মেহবুব? ”

” হ্যা। ”

আজলান ড্রাইভারকে বলল,

” নিয়ে যান। ”

গাড়ি ছেড়ে দিতেই আম্বিয়া বেগম বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে লাগলেন। রমলা চাচী টেনে বাড়ির ভেতরে নিয়ে গেল উনাকে। আজলান বাড়িতে ঢোকার সময় থমকে দাঁড়ালো আফতাব শেখের কাছে গিয়ে। বাবা ছেলে একে অপরের দিকে রোষাগ্নি দৃষ্টিতে চাইলো। আফতাব শেখ বললেন,

” বাড়িটা আমার। বাড়ির বউকে তাড়িয়ে তুমি থাকবে তা কি করে হয়? ”

আজলান বলল,

” ডোডোকে নিয়ে আজকেই চলে যাব আমি। আপনার বাড়িতে আমি কিংবা আমার আওলাদ কেউ থাকবে না। ”

আফতাব শেখ কম্পিত কণ্ঠে বললেন,

” আমার বংশধরকে কোথাও যেতে দেব না আমি।”

” আটকে দেখান। ”

আফতাব শেখ বললেন, ” তোমার পায়ে পড়তে হবে এখন? ”

” আপনার কাছে কোনোকিছুরই এক্সপেকটেশন রাখিনা আমি। আমার বিরুদ্ধে আমার বউকে উষ্কেছেন, বাচ্চাকেও উষ্কাতে পারেন। আপনার সান্নিধ্যে কাউকে রাখবো না। ”

আফতাব শেখ শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থেকে বললেন,

” তাহলে একটা কথা কান দিয়ে শুনে রাখো। এই বাড়িতে তোমার আর জায়গা নেই। ”

আজলান ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল,

” এটা বলবেন জানতাম। তাই অবাক হইনি। ”

” বড্ড জেদি হয়েছ তুমি। ”

” জন্মদাতার মতো। ”

ডোডোকে নিয়ে রাতারাতি বান্দরবান পাড়ি জমিয়েছে আজলান।

চলমান….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here