#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২৪
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
মা ছেলের মধ্যে কথা শেষ হতে পারেনি তার আগেই আম্বিয়া বেগম কান্নাকাটি শুরু করে দিয়েছেন। আজলান রাগত স্বরে বলল,
” তুমি এভাবে কাঁদলে আমি আর ফোন দেব না মা। ”
আম্বিয়া বেগম ক্ষীণ স্বরে বললেন,
” আরেক মায়ের কোল থেকে বাচ্চাকে কেড়ে নিয়ে তুই আমাকে মা ডাকিস না। পাঁচদিন তোর গলা না শুনে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। সেখানে ওই দুধের বাচ্চাটাকে না দেখে ওর মায়ের কেমন লাগছে বুঝতে পারছিস তুই? কতটা পাষাণ রে তুই। ”
আজলান বলল, “কেঁদোনা। আমি দেখছি কি করা যায়। আগামী দুসপ্তাহ কাজের মধ্যে ডুবে থাকবো তাই সুযোগ হবে না। তারপর দেখি তোমাকে নিয়ে আসতে পারি কিনা। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” ওর মা কতবার ফোন দিয়েছে ডোডোর খবর জানার জন্য। তুই ওর সাথে কথা না বল কিন্তু বাচ্চাটার গলা তো শুনতে দিবি। এ কেমন রাগ তোর? ”
আজলান বলল,
” আমার কাজ শেষ হোক। ডোডোকে এসে তুমি নিয়ে যেও। এখানে আপাতত লোক রেখেছি। ওরা দেখভাল করছে ওর। ”
” আর ওর মা? ওর কাছে ওর বাচ্চাকে দিবি না?”
আজলান কোনো কথা বললো না তিথির ব্যাপারে শুধু জানার ছিল ও ফোন দিয়েছে কি দেয়নি। আম্বিয়া বেগম আফতাব সাহেবের অসুস্থতার কথাও চেপে গিয়েছেন। ছেলের উপর উনার অনেক রাগ কিন্তু তা দেখালেন না। ডোডোর কাছে পৌঁছানোর জন্য উনাকে শান্ত হয়ে কথা বলতে হবে। আজলান ফোন রাখার সাথে সাথে আফতাব শেখ জানতে চাইলেন,
” আজলান শেখ কেন ফোন দিয়েছে? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
“নিজের ছেলেকে এভাবে সম্বোধন করছো কেন? ”
” ছেলে আমাকে কিভাবে সম্বোধন করে দেখেছ? ”
” এসব তুমি শিখিয়েছ ওকে। ”
” তোমার ছেলে চায় টা কি বলোতো। কি চায় সে? বাচ্চাটাকে তার মায়ের কাছ থেকে দূরে রেখে কি প্রমাণ করতে চাইছে? ”
আম্বিয়া বেগম রেগেমেগে বললেন,
” সব তোমার জন্য হয়েছে। তুমি সব নষ্টের মূল। তোমার ছেলে কেমন তুমি জানতে না? ওরকম মেয়ে পছন্দ করে এনেছ কেন? ”
” এর চাইতে ভালো মেয়ে তো চোখের সামনেই ছিল। তোমার ছেলে তাকে পাত্তা দেইনি। তাই সে নিজের মতো করে কাউকে পেয়ে ভেগেছে। ডোডোর মাও এমন ভেগে গেলে ভালো হতো। ”
সরোষে চেঁচিয়ে উঠলেন আম্বিয়া বেগম,
” মুখে অলক্ষুণে কথা এনো না। তোমার বোনের মেয়ে তলে তলে ব্যাটামানুষ হাত করে রেখেছিলো। সেই মেয়ের সাথে তুমি আর তোমার বোন আমার ছেলের বিয়ে ঠিক করলে কোন সাহসে? ”
আফতাব সাহেব নির্লিপ্ত গলায় বলল,
” তোমার ছেলেকে হুর-পরী এনে দিলেও সে দোষ খুঁজে বের করতো। হেনারও দোষ খুঁজে বের করেছিলো সে। তাই হেনা বুঝে গিয়েছিলো ওর সাথে বাকি জীবন কাটানো সম্ভব না। তাই পালিয়ে গিয়েছে। এখন বৌমার হাত পা তো বাঁধা তাই তাকে বাগে পেয়ে তোমার ছেলে তাকে শাস্তি দিচ্ছে। ”
” তোমার বোন, তোমার ভাগ্নি সবকটা বেঈমান। ওদের সাথে ডোডোর মাকে মিলাবে না। তুমি আর তোমার ছেলের কারণে ওকে ঘর ছাড়তে হয়েছে। তোমার ছেলে ওকে ছেড়ে দিলে ও যাবেটা কোথায়? খবরদার বলছি এসব ভুলভাল কথা কারো সামনে বলবে না। ”
আফতাব শেখ বললেন,
” তুমি কি তোমার ছেলেকে ডোডোর মতো দুধের শিশু ভেবেছ নাকি? ওর মাথায় কি ঘোরে তা তুমি বুঝতেও পারবে না। ও বৌমাকে জব্দ করতে পারলেই খুশি। ওই ছেলেকে আমি চিনি। আমার রক্ত তো। ও মরে যাবে কিন্তু বৌমার কাছে মাথা নত করবে না। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” বউ কি ও আনছে? বউ আমরা আনছি। ওর বউ আমি রাখবো। ও রাখার না রাখার কে? আমি ওকে আজকে গিয়ে নিয়ে আসবো। ”
” তোমার কি মনে হয় ডোডোর মা তোমার সাথে আসবে? যার সাথে ঘর করবে সেই ওকে পাত্তা দিল না আর তোমার কথায় চলে আসবে? ”
” কি বলতে চাইছো তুমি? ”
” আমি কিছু বলতে চাইছিনা। তোমার ছেলে যেটা করতে চাইছে সেটা আন্দাজ করে বলছি ও বৌমার সাথে সংসার করতে ইচ্ছুক নয়। এইসব ভং ওর অজুহাত মাত্র। ”
আম্বিয়া বেগম টলমলে চোখে চেয়ে রইলেন।
_______
দিন বিশ একুশ দিনের মতো গড়িয়ে গেছে।
ঝড়বাদলের দিন। সকাল বিকেল রাত তিনবেলা নিয়ম করে বৃষ্টি পড়ছে। নিস্তার নেই। ভীষণ আলসে আর বিষণ্ণ সময় কাটছিলো সবার।
মাগরিবের নামাজ পড়ছিলেন মালেকা বেগম। তিথি নামাজ পড়ে চা বসিয়েছে চুলায়। মফিজ সাহেব নামাজ পড়ে এসে চা খান। চায়ের পানি টগবগ করে ফুটে উঠামাত্রই তুষার এসে বলল,
” আপা কে যেন এসেছে। তোকে খুঁজছে। ”
তিথি সন্দিগ্ধ গলায় বলল, ” কে? ”
তুষা কি যেন বললো। তিথি শুনতে পেল না ঠিকঠাক। কিন্তু তুষারের উত্তরের অপেক্ষা করেনি সে। বারান্দার চেয়ারে যারিফকে বসে থাকতে দেখে অবাকচোখে চেয়ে বলল,
” আপনি? ”
যারিফ তাকে দেখামাত্রই দাঁড়িয়ে পড়লো। বলল, ” ভাবি আপনি একটু ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিন। আমরা বান্দরবান যাব।”
তিথি উত্তেজিত হয়ে বলল, ” বান্দরবান? কেন? ডোডো কোথায়? ওর কাছে নিয়ে যাবেন? ”
যারিফ বলল, ” জি। আমি বাইরে গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছি। ”
তিথি ব্যাকুল হয়ে বলল, ” আমার ডোডো কেমন আছে? ”
যারিফ বলল,
” সব ঠিক আছে। আপনি রেডি হয়ে নিন। ”
তিথি আচ্ছা বলে ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়াতে যেতেই থমকে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
” আপনার স্যার নিশ্চয়ই নিয়ে যেতে বলেনি? ”
যারিফ বলল,
” স্যার আমার সাথে কথা বলেনি। উনি কথার বলার মতো সিচুয়েশনে নেই। আমার মনে হলো এই মুহূর্তে আপনাকে দরকার। তাই এসেছি। ”
তিথি ঘরে চলে গেল। ছোট একটা ব্যাগ গুছিয়ে নিল। কিছুই খুঁজে পাচ্ছে না সে। হাতটা ভীষণ রকম কাঁপছে। কতদিন পর ডোডোকে দেখবে সে।
দুটো শাড়ি, গামছা, কিছু জরুরি জিনিসপত্র আর কিছু টাকা নিয়ে নিল সে। বাকি টাকাগুলো মায়ের হাতে দিল। বলল,
” ডোডোর কাছে যাচ্ছি আম্মা। আমি ফোন দেব তোমাকে। ”
মালেকা বেগম চুপ করে রইলেন। বেরোনোর সময় মফিজ সাহেব বললেন,
” মাথা ঠান্ডা রেখে কাজ করিস মা। তোর এখন একটা বাচ্চা আছে। এখন নিজের কথা ভাবলে চলবে না। ওর কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নিবি।”
তিথি বাবাকে জড়িয়ে ধরে চুপ করে রইলো। তারপর বেরিয়ে এল যারিফের সাথে।
পুরো শহরটা তখন নির্জীব। যানবাহনের চলাচল না থাকলে আর কোনো শব্দই থাকতো না কোনোখানে। সড়ক বাতির আবছা আলোয় পিচঢালা রাস্তা চকচক করছে। কানের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে শোঁশোঁ বাতাসের শব্দ।
ডোডোর মুখটা কয়েকবার কল্পনা করলো সে। পেটে মুখ গুঁজে দিলে খিলখিল করে হাসিতে ফেটে পড়তো ডোডো। হাসিটাতে কি মায়া! এত মায়া কভু দেখেনি তিথি। তার চোখে জল নামলো। সাথে সাথে মুছে নিল সে। একবার ডোডোকে পেলে জাপ্টে জড়িয়ে বুকের মধ্যে লুকিয়ে ফেলবে সে। আর একমুহূর্তের জন্যও ছাড়বে না।
দুনিয়া উল্টে যাক কিন্তু ডোডোকে আর ছাড়বে না সে।
পথিমধ্যে একটা দোকান দেখতে পেয়ে নেমে গেল সে। ফিরে এল কিছু চিপস, আর মিনি বিস্কিটের প্যাকেট নিয়ে। ডোডো এখন খেতে শিখেছে। মাকে দেখামাত্রই যদি মুখের দিকে চেয়ে থাকে? মা খালি হাতে এসেছে ব্যাপারটা কেমন দেখাবে?
যারিফ তার উত্তেজনা বুঝতে পারলো। মায়েরা এমনই হয়। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে গাড়িটা একটা সেন্ট্রাল হসপিটালের পার্কিং প্লেসে গিয়ে থামলো। তিথি অবাককন্ঠে বলল, ” হসপিটালে কেন? আপনার স্যারের কিছু হয়েছে? ”
যারিফ বলল,
” তিন তলায় যেতে হবে। চলুন। ”
তিথি ওর পিছু পিছু কম্পিত পায়ে হেঁটে গেল।
আয়জা আর আম্বিয়া বেগম হসপিটালের লাউঞ্জে বসে আছেন। আয়জার পায়ের কাছে বড় একটা ব্যাগ। কোলে ছোট্ট একটা কাপড়ের ব্যাগ। ব্যাগটাতে ডোডোর ছোট ছোট কাঁথা আর প্যাম্পাস রাখতো সে। তাকে দেখে আম্বিয়া বেগম হাঁ করে চেয়ে রইলেন। তিথি ছুটে গিয়ে বলল,
” কার কি হয়েছে মা? আমার ডোডো? কোথায় ও?”
কেউ কিছু বললো না।
ভয়ের চোটে আম্বিয়া বেগমকে একটা সজোরে ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁদে উঠলো তিথি। আম্বিয়া বেগমও এতক্ষণ পর ফুঁপিয়ে উঠলেন। তিথি স্তব্ধ হয়ে গেল। আয়জাকে বলল,
” ডোডো কোথায়? আমার ডোডো। ”
আয়জা আঙুল দিয়ে কেবিনটা দেখিয়ে দিল। তিথি দৌড়ে গিয়ে জানালার কাচ বরাবর দাঁড়াতেই কেবিনের মধ্যে একটা ছোট্ট বাচ্চাকে দেখতে পেল। নিজের ছেলেকে নিজে চিনতে ভুল করলো তিথি। হাতে ক্যানোলা, নাকে অক্সিজেন। শুকিয়ে এতটুকুনি হয়ে গেছে হৃষ্টপুষ্ট শরীরটা। গায়ের রঙটা পর্যন্ত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিথি চেয়েই রইলো। কাঁদতে ভুলে গেছে সে। শুধু চোখ ফেটে উত্তপ্ত জল গড়িয়ে পড়লো।
শ্বাসকষ্টের জন্য কিছু খেতে পারছিলো না ডোডো। হা করে নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে কাঁদছিলো ভীষণ। নিউমোনিয়ার লক্ষ্মণ বুঝে তিনদিন আগে ডোডোকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন জাফর আহমেদ। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯২ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিলো প্রায়। তিথি সবটা শুনে জড়পদার্থের ন্যায় বসেছিলো অনেকক্ষণ। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার কারণ হিসেবে ডাক্তার জানিয়েছে বুকের ভেতর শুকনো কফ জমে গিয়েছিলো।
তিথি করিডোরের মেটাল ফ্রেমের সোফায় বসে ডোডোর কাছে যাওয়ার অপেক্ষায় বসেছিলো। কেবিনে সিস্টার আর ডাক্তারদের আনাগোনা আছেই।
কেবিনে যাওয়ার অনুমতি পেতেই আর দেরী করেনি। মা এসেছে শুনে ডাক্তার একনজর তাকে দেখে নিল। তখন অক্সিজেন মাস্কটা খুলে ফেলা হয়েছে। ডোডো নড়েচড়ে উঠে আবার ঘুমে তলিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে ক্যানোলা দিয়ে ইনজেকশন পুশ করে তিথির কোলে তুলে দিল। তিথি দেখলো পনের মাসের বাচ্চাটা কেমন ছয়মাসের বাচ্চার মতো হয়ে গেছে। এতক্ষণ চেপে রাখা কান্নাটা এবার আর কোনো বাঁধ মানলো না। ছেলের গালে আদর করতে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে বলল, ” আমাকে এতবড় শাস্তি দিস না ডোডো। ”
তার কান্নার ফাঁকে ডোডো চোখ মেলে তাকিয়েছে। তিথি বড়বড় চোখ করে বলল,
” আব্বা চোখ খুলেছে! মা দেখো ডোডো চোখ খুলেছে।”
আম্বিয়া বেগম এসে বসলেন তার সামনে। ডোডো মায়ের মুখের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলো। তিথি সশব্দে কেঁদে বলল,
” মাকে শাস্তি দিচ্ছিস ডোডো? ”
ডোডোর ঠোঁটদুটো নড়ে উঠলো। তিথি বুঝলো। সে আম্মা ডাকতে চাইছে। সে মুখে অজস্র আদর দিয়ে নিজের গালের সাথে ছোট্ট গালটা লাগিয়ে রেখে বলল,
” তোকে ছেড়ে আর কোত্থাও যাবো না ডোডো। একবার আম্মা ডাক। ”
কাঁদতে গিয়ে গলাও ভেঙে গেছে ছেলেটার।
অনেকক্ষণ পর সুচিক্কণ ভাঙা স্বরটা কানে এল তিথির। মা ডাক শুনে তিথি পাগলের মতো কাঁদলো। আম্বিয়া বেগম সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
” আর কাঁদিস না। একটা কথা সারাজীবন মনে রাখবি, মায়ের মতো করে কেউ ভালো রাখতে পারে না বাচ্চাকে। ”
তিথি ডোডোর গালে গাল ঠেকিয়ে চোখ বুঁজে রইলো।
সারারাত মা ছেলে জেগে ছিলো। ডোডোর একদৃষ্টে চেয়ে থাকা দেখে তিথি মনে মনে ভাবছিলো হয়ত সে ভাবছিলো, এই মা এতদিন কোথায় ছিল? ভোরবেলায় মা ছেলে দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রায় সকাল দশটার দিকে তিথির ঘুম ভেঙেছে। ডোডো তখনো তার বুকের উপর নির্বিঘ্নে ঘুমাচ্ছে। যেন কতরাত সে এভাবে ঘুমাতে পারেনি।
আফতাব শেখ এসেছেন তখন। খাবার দাবার এনেছেন। ডাক্তারদের সাথে পরামর্শ করার পর ডাক্তার জানিয়েছেন আজ রাতেই ডোডোকে রিলিজ দেয়া হবে।
তিথি কেবিন থেকে বের হয়নি। দু-পিস পাউরুটি খেয়েছে জেলি দিয়ে।
ডাক্তার এসে শেষ ইনজেকশনটা পুশ করলো। ঔষধ খাওয়ানোর সময় আর ইনজেকশন পুশ করার কেবিন ফাটিয়ে কেঁদেছে ডোডো। আম্বিয়া বেগম বললেন, ডাক্তার দেখামাত্রই সে কান্না শুরু করে। কান্নার এক পর্যায়ে তিথিকে জড়িয়ে “আম মাম মা” বলে ডেকে চুপ করে গেল। তিথি তার গালে আদর করতে করতে বলল,
” আমার আব্বা সুস্থ হয়ে গেছে। আর মারবে না ওরা। আমরা এবার বাড়ি যাবো। ”
ডোডো তার শাড়িটা ধরে রাখলো শক্ত করে। কাঁধে মাথাটা ফেলে রাখলো। তিথি তাকে কোলে নিয়ে হাঁটার সময় খেয়াল করলো সে একদম হালকা হয়ে গিয়েছে। অথচ আগে বেশিক্ষণ কোলে রাখলে কোমর ব্যাথা করতো।
__________
আজলান শেখের কথা তিথি জিজ্ঞেস করবে ভেবেছে কিন্তু করেনি। কারণ সে নিজেই অপেক্ষায় ছিল কবে আজলান শেখ আসবে। কিন্তু এল না। হয়ত নিজের পরাজিত মুখখানা তিথিকে দেখাতে চায়নি কিংবা নিজের ছেলের অসুস্থতার দায়ে তিথিকে দায় করতে গিয়ে নিজেই ফেঁসে যাবে তাই সামনে আসেনি। তিথির এতকিছু ভাবতে ইচ্ছে করলো না। তার ছেলে তার বুকে আছে এটাই এখন তার সবচাইতে বড় পাওয়া।
আয়জা, আম্বিয়া বেগম এমনকি আফতাব শেখও কিছু বলেনি এই ব্যাপারে। তিথি খেয়াল করেছে ঔষধ আনা, খাবারদাবার আনা নেওয়া, সব ছোটাছুটি যারিফই করছে। তার কাছে নিশ্চয়ই তার স্যারের খোঁজ থাকতে পারে। কিন্তু সে জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। ডিসচার্জ পাওয়ার পর ডোডোকে ভালো করে কাঁথা দিয়ে মুড়িয়ে নিয়ে শিশু ওয়ার্ড থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তিথি আম্বিয়া বেগমকে ডেকে বললো,
” আয়জা কোথায়? তোমরা যাবে না? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” তোর ছেলে সুস্থ হয়েছে। আমার ছেলে নয়। ”
তিথি ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। আফতাব শেখ এসে বললেন,
” বৌমা তোমাকে বাংলোয় যেতে হবে। আমরা বাড়ি যেতে পারছিনা আপাতত। যারিফ তোমাকে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে ওটা ডোডোর বাপের স্যারের বাংলো। ওখানে উনার স্ত্রী আর একজন সিটার আছেন। রান্নাবান্না তোমাকে করতে হবে না। তুমি চলে যাও। ”
তিথি মাথা নাড়লো। যারিফ ব্যাগপত্র নিয়ে এসে বলল,
” ভাবি চলুন। ”
তিথি যেতে যেতে আরও একবার ফিরে তাকালো। আম্বিয়া বেগমের চোখে জল থৈথৈ করছে। তিথি যেতে যেতে যারিফকে জিজ্ঞেস করলো, ” কি হয়েছে আপনার স্যারের? ”
যারিফ একটু চমকে যেতেই তিথি বলল, ” আমি বুঝতে পেরেছি কিছু একটা হয়েছে। ”
যারিফ সংকোচ ঝেড়ে তাকে জানালো, পনের দিন আগে হাসানুজ্জামান নামের এক অবৈধ অস্ত্র পাচারকারী বিদেশী পিস্তল নিয়ে নাশকতার উদ্দেশ্যে টেলাপাড়া এলাকায় অবস্থান নিয়েছে বলে র্যাবের কাছে সংবাদ আসে। ওই সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-7 পূর্বাচল ক্যাম্পের একটি দল অভিযান চালিয়ে পিস্তল সহ হাসানুজ্জামানকে আটক করে। আটকের খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়লে সেই দলের এক সদস্য আড়াল হতে গুলি ছুঁড়ে। আর সেখানেই..
তিথির কন্ঠস্বরে কাঁপুনি।
” সেখানে?..
” স্যারের ফুসফুসে বুলেটের আঘাত লেগেছে। ”
তিথি আটকে রাখা দমটা সবেগে ছেড়ে বলল, ” ওহহ। ”
ডোডোকে যারিফের কোলে দিয়ে দ্বিতীয় তলার একটা সাদা কাচের কেবিনের ভেতর সিডেটিভে আচ্ছন্ন হয়ে শুয়ে থাকা আজলান শেখকে দেখে তিথির অন্তরআত্মা কেঁপে উঠেছিলো। দাপুটে যার চলনবলন, আর ধারালো যার কথা। তাকে এমন পরাজিত সৈনিকের মতো পড়ে থাকতে তিথির আপনমনে বলল, ” তুমি আমাকে তোমার বিরোধীদল ভাবলেও আমি তোমাকে সবসময় বিজয়ীর বেশে দেখতে চেয়েছি। এভাবে নয়। ”
তার ঠিক তের কি চৌদ্দ দিনের মাথায় আজলান শেখের গাড়ি এসে থামলো বাংলোর সামনে। ডোডো তখন দোলনায় চড়ছে আর হাসছে। গাড়িতে বসে একদৃষ্টে তার বাবা তার দিকে চেয়ে রইলো। বাবা এখনো জানতে পারেনি তার অনুপস্থিতিতে ছেলেকেও হাসপাতালে ঘুরে আসতে হয়েছে। তবে ছেলের সবল দেহ, মুখের ঝলমলে হাসিই বলে দিচ্ছিলো এই বাংলোয় তার মায়ের উপস্থিতি।
আফতাব শেখ গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে বললেন,
” এসো, এসো। বেলাশেষে পাখি নীড়ে ফেরে। ”
আজলান গাড়ি থেকে নেমে আসতেই আয়জার কোল থেকে ডোডোও নেমে এল হামাগুড়ি দিয়ে। এসে তার পায়ের কাছে বসে মুখ তুলে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে পা ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো পায়ের পাতায় ভর দিয়ে। হাত দুটো বাড়িয়ে দিয়ে ডাকলো, ” পাপ্পাহ। ”
চলমান…..