#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_২৬
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
আরও কয়েকটা দিন কেটে গেছে বাংলোয়। পুরো বাংলো আর বাংলো ভর্তি মানুষ একদিকে, তিথি আর তার বাচ্চা অন্যদিকে। মা ছেলের হাসাহাসি পাগলামি দেখে সবার মন ভালো না হয়ে যাবে কোথায়?
ডোডো দ্রুত হামাগুড়ি দিতে জানে। তিথির পিছু পিছু এমন দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে পাগলা ষাঁড়কেও হার মানাবে। তারপর ধরতে পারলে খামচি দিয়ে নিজের রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবে।
তিথি পাগলা ডাকলে মাথা ঝুঁকে ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো তাকাবে। তিথি হেসে খুন।
ঘরের দরজার ওপাশে, জানালার ওপাড়ে আর পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আজলান শেখ মা ছেলেকে চুপচাপ পর্যবেক্ষণ করে যায়। তাকে দেখামাত্রই মা ছেলে এমন সাধুসন্ন্যাসী হয়ে যায় যা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্যকেও হার মানাবে।
বিদায়বেলা ঘনিয়ে আসতেই জাফর আহমেদ বললেন, ” আয়জার বিয়েতে আমরা দাওয়াত না দিলেও যাচ্ছি। আর হ্যা ওদের বিয়ের পর আবারও এই বাংলোয় দাওয়াত। বৌমার কিন্তু বেশ লেগেছে এই বাংলোয় থাকতে। তাই না বৌমা? ”
তিথি মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। আজলান বলল,
” সে দেখা যাবে। ”
” দেখা যাবে টাবে পরে। বৌমা তোমাকে বলছি। যখনি মন খারাপ হবে এই মশা মাছির আখড়ায় চলে আসবে। মশা মাছিগুলোকেও কিন্তু তখন বন্ধুর মতো লাগবে। তোমার জন্য সবসময় এই বাংলোটা খোলা। ”
তিথি বলল, ” আপনারা কিন্তু আগেভাগে চলে যাবেন। মা তুমি কিছু বলো আন্টিকে। ”
তাহেরা বেগম বললেন,
” বাড়ির বউ দাওয়াত দিয়েছে এতেই হয়েছে। উনাকে আর বলতে হবে না। আমরা যাবো। কিন্তু ডোডোবাবু চলে যাচ্ছে দেখে ভীষণ মন খারাপ হচ্ছে। ”
ডোডো আয়জার কোলে বসে চুপচাপ সবাইকে দেখে যাচ্ছে। যেন মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছে সে। তাহেরা বেগম তাকে কোলে নিয়ে নিল।
ডোডো উনার কোলে বসে ডাকলো, ” দাদ্দাহ “।
সবাই হাসলো। তাহেরা বেগম তার গালের সাথে গাল ঠেকিয়ে বলল,
” দেখেছ, আরও মায়া ফেলছে দাদা ডেকে। আবার এসো দাদুভাই। তোমরা মা ছেলেকে রেখে দিতে ইচ্ছে করছে আমার। ”
তাহেরা বেগম আর জাফর আহমেদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে সবাই গাড়িতে উঠে বসলো। শায়লাকে তার পারিশ্রমিক দিয়ে দিয়েছে আজলান।
শেখ বাড়িতে পৌঁছানোর ঘন্টাখানেকের মধ্যে রমলা চাচী এসে হাজির। সাথে মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। উনার মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তিথিকে দেখে বুকে টেনে নিয়ে বলল,
” আমার মাইয়্যার বিয়ায় তোমরা থাকবা। আমার ডোডোভাইও যাবে। তুমি আসছো শুনে চইলা আইছি। বলছিলাম কি তোমার জামাই এখন সুস্থ হয়ছে তো? ”
তিথি বলল, ” তুমি গিয়ে জিজ্ঞেস করো। ”
” আমি কেমনে কইতাম? তুমি যাওয়ার পর আমি তারে কত কথা শুনাইছি জানো? জীবনেও তার সামনে দাঁড়ায় কথা বলছি আমি? সেইদিন গায়ে মনে হয় ভূত ভর করছিলো। কথা শোনাইয়া মুখ ঝামটা দিয়া চইলা গেছি। বলছি, আর জীবনেও আসমু না এই বাড়িত। তুমি কি তার লগে কথা কওনা? ”
” কথা থাকলেই তো বলব। ”
রমলা চাচী ভুরু কুঁচকে চেয়ে রইলো। বলল,
” আইচ্ছা পরে কথা বলবোনে। যাও বাচ্চা নিয়ে ঘরে যাও। ”
তিথি সোফায় বসে থেকে জবাব দিল।
” এখন ঘরে যাওয়া মানা। পরিষ্কার করছে। অনেক ধূলো জমে আছে। ”
রমলা চাচী মুখ বেঁকিয়ে বললেন,
” তোমার জামাইটা একটা বদ্ধপাগল বুঝলা বউ? মাথা খারাপ ছেলে। মানুষ এত জার্নি করে বাড়িত আইসা একটু আরাম করে। আর তোমার জামাই করতেছে ঘর পরিষ্কার। ”
তিথি বোরকাটা খুলে কোলের উপর নিয়ে চুপ করে বসে রইলো। আজলান কাশতে কাশতে এল। ডোডোর উদ্দেশ্যে বলল,
” ডোডো ঘরে আসতে পারো এবার। ”
ডোডো মিষ্টি খাচ্ছে বসে বসে। বাবার কথা শুনে চোখ তুলে চাইলো। হাতের মিষ্টি বাড়িয়ে দিল বাবার দিকে।
তিথি তাকে কোলে নিয়ে ঘরে চলে যেতে যেতে বলল,
” মানুষ কি পাগল হয়ছে যে তোর লালা খাবে? পাগল তো আমি। ”
ডোডো হা করে চেয়ে রইলো মায়ের মুখের দিকে। তিথি অবাক। আজকাল হা করে মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কথা শুনে সে। কি বুঝে আল্লাহ জানে।
আজলান টি টেবিলে মিষ্টির কাটুন দেখে বলল,
” মা মিষ্টি কে এনেছে? ”
রমলা চাচী এসে বলল,
” আমি আনছি বাবু। ওই, আমার রুম্পার বিয়া ঠিক হয়ছে তো তাই।”
আজলানের ভুরু কুঁচকে গেল। রমলা চাচী অপ্রতিভ হেসে বলল,
” মিষ্টি খাইবা এখন? নাকি গোসল কইরা খাইবা? ”
আজলান কেশে বলল,
” ছেলে কি করে? ভালো করে জেনেশুনে দিচ্ছো তো? ”
রমলা চাচী ভড়কে গেলেন। আবার রুম্পার বিয়ে ভেঙে দিবে না তো? আমতাআমতা করে বললেন,
” পোলা ভালা। পাইপ ফিল্টারের কাজ করে। পয়সা কামাই ভালো। ”
” পয়সা তো এখন ভিক্ষুকও কামায়। ছেলের আগপিছ কোনো ভালোমন্দের রেকর্ড আছে কিনা দেখেছ? বিয়ে একবারই হয়। ”
রমলা চাচী হেসে বললেন,
” না না ছেলে বড়ো ভালো। রুম্পারে পছন্দ করছে ইস্কুলে যাওয়ার সময়। ”
” ওর বয়স আঠারো হয়েছে? ”
” হ হয়ছে। ঊনিশে পড়ছে। বিয়াতে তুমি যাইবানা?”
” যাব। ছেলে কি কি নিচ্ছে? ”
” তেমন কিছু না। দুই পদ ফার্নিচার আর চারশো বৈরাতী। আশেপাশের মাইয়াদের বিয়া দিতে আরও বেশি খরচা লাগছে সেইখানে রুম্পার জামাই তেমন কিছুই নিতাছে না। ”
” টাকাপয়সা যোগাড় হয়েছে? ”
” হয়ছে লাখ দুখানেক। আমার মামাতো ভাই, ফুপাতো ভাইরাও দিতেছে সামর্থ্য অনুযায়ী। কোনোমতে হাতে তুলে দিতে পারলেই হলো। ”
আজলান বলল, ” রুম্পার বাবা ভাই কেউ নাই সেটা জেনেও এতকিছু দাবী করলো কেন? ”
রমলা চাচী ভড়কে গেলেন। আম্বিয়া বেগম এসে বলল,
” এ রমু রুম্পার বিয়েতে কি চাস তুই? ”
রমলা চাচী একটু জিরিয়ে বাঁচলেন। সাহস করে বললেন,
” একটা পালঙ্ক আর একটা ওয়াল শোকেস চাইছে ভাবি। ওয়াল শোকেসটা দিলেই হইবো। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” আচ্ছা ওটা আজলান দিবে। তোর বড়বাবুর কাছ থেকে কিছু চাস। দিবে। ”
” না না বড়বাবু দোয়া কইরা দিলে হইবো।”
আজলান বলল,
” ওদের আক্কেল দেখে আমার আক্কেলগুড়ুম অবস্থা। স্বচক্ষে দেখছে চাচী একা মেয়েটাকে মানুষ করেছে তারপরও এত দাবীদাওয়া! ”
আম্বিয়া বেগম ধমক দিয়ে বললেন,
” এর চাইতে আরও বেশি নেয়। যা জানিস না তা নিয়ে কথা বলিস না। আজকাল যৌতুক ছাড়া বিয়ে হচ্ছে নাকি? সবাই তোর মতো আইন বুঝে না। ও যা চাইছে তা দিয়ে দে। মেয়েটা সুখে থাকলেই হলো। ”
আজলান মাথা দুলিয়ে ঘরে যেতে যেতে ভাবলো,
” একজন না আইন বানাতে পারে, না ভঙ্গ করতে। মানুষের কবে যে সুবুদ্ধি হবে। ”
__
বাংলোয় দুটো শাড়ি পড়ে কাটিয়েছে তিথি। স্যুটকেসটা তাদের বাড়িতে। সব কাপড়চোপড় সেখানে। পুরো ঘরে ডোডোর জিনিসপত্রে ভরা অথচ তার কাপড়চোপড় খুঁজলে আর পাওয়া যাচ্ছে না। যেগুলো দামী শাড়ি সেগুলো আজলান শেখের কাবার্ডে। ওই কাবার্ডে বিয়ের পর থেকে হাতও দেয়নি তিথি।
আম্বিয়া বেগম এসে বললেন,
” তোর ভাইকে বল স্যুটকেসটা যাতে দিয়ে যায়। ”
তিথি বলল, ” না না। আমি গিয়ে নিয়ে আসবো। ওর এইচএসসি পরীক্ষা চলছে। ”
” তুই আবার কখন যাবি? এখন আর কোথাও যাস না।”
তিথি বলল,
” একেবারের জন্য যাচ্ছি না। আমার আর যাওয়ার জায়গা আছে? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” আমি তোর ড্রাইভার কাকাকে বলব ও যাতে নিয়ে আসে। তোর মাকে বলে রাখিস। ”
তিথি বলল, ” তুমি ভয় পাচ্ছ? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন,
” পাচ্ছি কারণ ও যদি অন্য কিছু মনে করে? ছেলে তো আমার তাই আমি বুঝি কোন সময় কোন কাজ করাটা ঠিক হবে না। তুই এখন বাপের বাড়ি উঠলে ও মনে করবে তুই ওর উপর জেদ দেখাচ্ছিস। আর অশান্তি ভালো লাগেনা বউ। ”
তিথি বলল,
” আচ্ছা কাকাকে পাঠাও। ”
আম্বিয়া বেগম খুশি হলেন। বললেন,
” আচ্ছা। ”
তিথি ডোডোর হাতটা ধুয়ে দিল বেসিনের পানি ছেড়ে। মুখটা মুছে দিল। তারপর গালে ঠোঁট চেপে বলল,
” এবার ঘুমা ডোডো। ঘুম ঘুম। ”
ডোডো চোখ বন্ধ করলো মিছিমিছি। তিথি হেসে উঠে বলল,
” অভিনয়টা ভালো জানে পাজি ছেলে। ”
ডোডো খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তিথি তার গালে গাল চেপে ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
______
বাবা ছেলে অনেকক্ষণ ধরে কথা বলছে। আফতাব শেখ কথা বললেন কম খোঁচা মারলেন বেশি। আম্বিয়া বেগম তামাশা দেখছেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আজলান যদি বলে, আপনার মেয়ের বিয়ে নিয়ে কি ভাবছেন?
তিনি উত্তরে দেন,
” সে আমার মেয়ে কম তোমার বোন বেশি। যাকে পছন্দ করেছে সে আমার পরিচিত কম কিন্তু তোমার পরিচিত বেশি। তাই সব সিদ্ধান্ত তোমার। আমি শুধু পায়ের উপর পা তুলে দেখবো। ”
আজলান চুপ করে রইলো উনার এমন উত্তর শুনে। তারপর কিছুক্ষণ ভাবুক হয়ে রইলো। পরে জিজ্ঞেস করলো,
” ওর আগে-পরে চাকরি হয়ে যাবে। আপাতত বৌ পালার মতো পয়সা কামাচ্ছে। সো দেরী করছেন কেন? মেয়েকে পাত্রস্থ করুন। আপনার পেছনে আমি আছি। কি বলেন? ”
” আমার পেছনে থেকে লাভ নেই। আমার সামনে থাকো। আমি বরঞ্চ তোমার পেছনে থাকি। ”
” আপনি মুরব্বি মানুষ। আপনাকে পেছনে রাখলে বেয়াদবি হয়ে যায় না? ”
আফতাব শেখ হো হো করে হেসে বললেন,
” তোমার সুবুদ্ধির উদয় হয়েছে দেখে আমি বড়োই সন্তুষ্ট। ”
আজলান বলল,
” ওকে তাহলে আমি উঠি। আপনি যাবতীয় ব্যবস্থা করে ফেলুন। মা তুমি কি কোনো যৌতুক দিচ্ছ তোমার মেয়ের জামাইকে? ”
আম্বিয়া বেগম হতচ্ছাড়ির মতো চেয়ে রইলেন। কোন কথা টেনে খোঁচা মারছে ছেলেটা দেখেছ? পুরো বাপের মতো হয়েছে বজ্জাত ছেলে।
আফতাব শেখ বললেন,
” যৌতুকে এই বাড়িটা লিখে দেব ভাবছি। ”
আজলান বলল,
” গুড ডিসিশন। যারিফকে জানিয়ে দিচ্ছি। সে আর যাইহোক একটা চমৎকার মহৎপ্রাণ শ্বশুর পেতে চলেছে। ”
আফতাব সাহেব হেসে উঠলো উচ্চস্বরে। তিথি আর আয়জা পাশাপাশি দাঁড়িয়েছিলো। তিথি আয়জাকে কনুই দিয়ে গোঁত্তা মেরে বলল,
” ফাইনালি। ”
আয়জা চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তিথি বলল,
” মন খারাপ কেন? ”
আয়জা বলল,
” কতকিছু হয়ে গেল আমার জন্য। ঝড়টা ডোডো আর তোমার উপর দিয়ে গেল। ভাইয়ার উপরও কতবড় বিপদ গেল। ”
তিথি বলল, ” ওসব কথা বাদ দাও। তোমার উপর আমার কোনো রাগ নেই। ”
” কারণ তুমি রাগ করতে জানো না ভাবি। ”
” তাহলে তো আরও ভালো। আমার দিক থেকে সব পরিষ্কার। এতদিন ভাইয়ের সেবা করেছ। মনে হয় না সে তোমার উপর রেগে আছে। ”
” ওটা বোন হিসেবে করেছি। ভাই অসুস্থ থাকলে কোনো বোন চুপ করে বসে থাকতে পারবে? কিন্তু এতকিছু হয়ে গেল সব আমার জন্য। ”
তিথি বলল, ” তোমাকে একটা বুদ্ধি দেই শুনো। ”
আয়জা তার বুদ্ধি কান পেতে শুনলো।
আজলান হাতের মুঠো বন্ধ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কয়েক কদম হেঁটে বড়সড় শ্বাস ফেলছে আর নিচ্ছে। সে কতটুকু সুস্থ হয়েছে তা হয়ত নিজের ভেতর অনুধাবন করার চেষ্টা করে।
আয়জা পা টিপে টিপে ঘরে এসে দাঁড়িয়ে থাকলো। আজলান তাকে পরখ করে ভুরু কুঁচকে ফেললো। বলল
” কোনো সমস্যা? ”
আয়জা চুপ করে রইলো। আজলান বলল,
” কি বলতে এসেছি বলে চলে যা। ”
আয়জা বলল,
” তুমি আমার উপর রেগে আছো? ”
আজলান ভুরুগুলো আরও কুঁচকে এল। বলল,
” এত নাটক করে কথা বলা কে শিখিয়েছে? ”
আয়জা ভড়কে গিয়ে বলল,
” কেউ না। আমার মনে হলো তাই বলছি। ”
” মনে হলেই সব বলতে হবে কেন? ”
আয়জা আর কোনো কথা না বাড়িয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল জিভ কেটে। তিথিকে গিয়ে বলল,
” তুমি জিও ভাবি। কিভাবে এর সাথে বাকি জীবনটা কাটাবে আমি ভেবেই মরছি। ”
তিথি বলল, ” ত্যাড়া জবাব দিয়েছে? ”
” হ্যা। আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছি। পুরো ইমোশোনলেস মানুষ ভাইয়াটা। আমার ভাই কি করে এমন হলো বুঝিনা। ”
তিথি বলল,
” আচ্ছা ওসব বাদ। তোমাকে তো দাঁড়িয়ে বিয়ে দিচ্ছে নাকি? আর চিন্তা কিসের? যাও ফূর্তি করো তোমার ভাইপোকে নিয়ে। ”
আয়জা ডোডোকে ছোঁ মেরে কোলে নিয়ে ফেলে বলল,
” আব্বা তোমার পাপ্পাহ কিরকম করে হাঁটে বলোতো। ”
ডোডো উঃ উঃ করে কাশার মতো অভিনয় করলো। তিথি অবাক। আয়জা হেসে উঠে ডোডোর গালে গাল চেপে ধরে আদর করতে করতে বলল,
” আম্মাকে জিভ দেখাও। ”
ডোডো জিহ্বা বের করে দেখালো। তিথি হাঁ করে চেয়ে রইলো। কপাল চাপড়ে বলল,
” তোর সভ্য বাপ বলবে এসব আমি শিখিয়েছি। ”
___
আয়জার বিয়ের কথাবার্তা এক বৈঠকে সেড়ে নিয়েছে আজলান। সে অত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলা পছন্দ করে না।
যারিফের বাবার গ্রামের বাড়িতে বাড়িঘর আছে। উনারা বংশধর মানুষ কিন্তু অভাবের তাড়নায় চাকরি খুঁজতে গিয়ে শহরে উঠার পর আর গ্রামে ফিরতে পারেননি। বড় ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত করিয়েছেন, ছোট ছেলেটা এখনো নবম শ্রেণীতে পড়ছে। তিনি এখনো একটা কাপড়ের কারখানায় কর্মচারী হিসেবে কাজ করেন। বেশ আত্মনির্ভরশীল মানুষ। আজলানের কথা তিনি আগে যারিফের মুখে শুনলেও দেখা হয়েছে এই প্রথম। তিনিও সোজাসাপটা কথায় বিশ্বাসী। দেনাপাওনা কথা উঠলে বলে দিলেন,
” আমি এর আগেও আপনার আব্বাকে বলেছি বিয়েটা ঘরোয়া ভাবে হবে। আমার ছেলের এখন ধরাবাঁধা চাকরি বাকরি নেই তাই আমি কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছি না। যদি আল্লাহ কখনো তৌফিক দান করেন তাহলে ও একটা ওয়ালিমার ব্যবস্থা করবে। লোকদেখায় কোনোকিছু দিতেও হবে না আপনাদের মেয়েকে। আমার ঘরে মেয়ে নেই ঠিকই কিন্তু একটা মেয়ের জন্য যা যা আসবাবপত্র লাগে সব আছে। যা নেই তা ধীরেধীরে ওরা জুড়িয়ে নেবে। আপনাদের যদি তাতে অস্বস্তি থাকে কিংবা আপনাদের মেয়ের ঘর সাজানোর জন্য কিছু দিতে চান তা আপনাদের মেয়ের সাথে পরামর্শ করে তারপর দেবেন। আগে সে ঘরে উঠুক। আমার মনে হয় না তার বাবার কাছে তার কোনোকিছু চাইতে হতে পারে। ”
আজলান চুপ করে শুনলো। জায়গির হোসেনের কথায় সে মোটামুটি সন্তুষ্ট। বলল,
” আমার বাবা উনার মেয়েকে কিছু না দিয়ে বিয়ে দেবেন বলে মনে হয় না। সে যাইহোক সেটা উনার ব্যাপার। উনি উনার মেয়ের ঘর সাজিয়ে দিতে চাইলে দিক।
আমাদের মধ্যে কথা হবে শুধু বিয়ে নিয়ে। আমি আমার নিকটাত্মীয়দের জানাবো আপনিও আপনার নিকটাত্মীয়দের জানাবেন। মেয়েকে আপনারা কি দেবেন তা ফয়সালা করে নেবেন নিজেরাই। সময়টা আগামী সপ্তাহের দিকে ফেললে ভালো হয়। কারণ তার পরের সপ্তাহ থেকে আমি ডিউটিতে জয়ন করব। ব্যস্ত হয়ে যাবো। এখন ধীরেসুস্থে সবটা সামলে নিতে পারবো। ”
জায়গির হোসেন বললেন,
” তাহলে সেটাই কথা থাকলো। ”
______
বিয়ের ধুমধাম শুরু হতে না হতেই বাড়িটা মেহমানে ভর্তি হয়ে গেল। আজলানের ফুপু, খালা, মামিরা এসে পড়েছে। এর আগে ডোডোর আকীকায় এসেছিলো সবাই কিন্তু মেঝ ফুপু আসেনি। এবার তিনি এসেছেন। সাথে মেয়েকেও নিয়ে এসেছেন। মেয়েটা কোথাও যায় না তেমন। ঘরের মধ্যে বেশিদিন বন্দী হয়ে থাকতে কার ভালো লাগে?
হেনা আপাকে দেখে আয়জা তেমন খুশি না হলেও
ভাইয়ার প্রতিক্রিয়া দেখার অপেক্ষায় ছিল সে।
একসময় হেনা আপা তাদের বাড়িতে থাকতো। তখন দাদীমা বেঁচে ছিলো। দশম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েছিলো এই বাড়িতে থেকে। ভাইয়া তাকে আর হেনা আপাকে পড়াতো। হেনা আপা ভাইয়ার জন্য পাগল ছিল। ভয় পেত সামনে দাঁড়িয়ে দুটো কথা বলতে কিন্তু পাগলামির শেষ ছিল না। এমনকি তাদের বিয়ে নিয়ে দুই পরিবারের মধ্যে কথাবার্তাও ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিলো।
ভাইয়ারও কোনো আপত্তি ছিল না এতে। হেনা আপার প্রতি তার বিশেষ কোনো অনুভূতি দেখা না গেলেও দূরছাইও করেনি কখনো। না আপার অনুভূতিকে কখনো অসম্মান করেছে।
কিন্তু ভাইয়ার চাকরি হওয়ার পর কি যেন হয়ে গেল! দাদীমাও মারা গেল, হেনা আপা কলেজে উঠে গেল, ভাইয়ারও চাকরি হয়ে গেল। দু’জন দুদিকে।সেই ফাঁকে হেনা আপা বদলে গেল চোখের পলকে। চোখের আড়াল হলেই কি মানুষ মনের আড়াল হয়ে যায় এত সহজে? কত সহজে হেনা আপা অন্য একজনকে ভালোবেসে ফেললো। এটা আদৌ কি ভালোবাসা ছিল নাকি মোহ? কত সহজেই হেনা আপা সেদিন বলে দিল,
” ওর মতো রোবটের সাথে সংসার করতে পারবো না আমি। আমি এর চাইতে ভালো কাউকে পেয়েছি। বেটার কাউকে জীবনসঙ্গী করার রাইট আমার আছে। আমি এবার উপলব্ধি করেছি আমি এতদিন আবেগের বশে পাগলামি করেছি কিন্তু ভেবে দেখেছি তোর ভাইয়ের সাথে সংসার করা অনেক কঠিন। একেই সে ওসিডি রোগী, দ্বিতীয়ত ওর এমন মেজাজ, তৃতীয়ত রসকষহীন একটা পাথর, জীবনেও কোনো মেয়ে ওর সাথে সুখী হতে পারবে না, ওর মধ্যে প্রেমিক ভাবটা নেই। ”
আয়জা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলো। বাড়ির কেউ হেনা আপাকে বিয়ে করতে ভাইয়াকে চাপ দিয়েছে এমনও না। ভাইয়া নিজেই রাজী ছিল কারণ তার যুক্তি ছিল এই, হেনা আপা তাকে ছোট থেকে চেনে সেহেতু তার সাথে মানিয়ে নিতে পারবে খুব সহজে যেটা বাইরের একটা মেয়ে কোনোদিনও পারবে না। কিন্তু হেনা আপা তার এই ভরসা, বিশ্বাসের মূল্য দেয়নি। বরঞ্চ তার পাগলামি, আবেগ সবকিছুকে মিথ্যে প্রমাণ করে বিয়ের সপ্তাহখানেক আগেই সে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গেল। কিন্তু কপালে সুখ সয়নি। শ্বশুর শ্বাশুড়ি, ননদ ননাসের অত্যাচারে বেহাল দশা তার। পালিয়ে বিয়ে করায় কেউ নূন্যতম সম্মান দেয় না। স্বামীও গায়ে হাত তুলতে দুবার ভাবে না। এখন চার মাস হয়েছে বাপের বাড়িতে এসে উঠেছে, স্বামী একবার খোঁজও নেয়নি। মেঝ ফুপু এখন এই দুঃখে মরে যান।
” এটা তো পুরা রসগোল্লা। কি নাম রে ওর? ”
” শেখ তাশদীদ আইজান। ওর মা ডোডো ডাকে। এখন আমরাও ডাকি। ”
ডোডোকে আদর করে দিল হেনা। বলল,
” ওর মাকে তো দেখিনি। ”
আয়জা বলল, ” কাজ করছে। রান্নাঘরে চলো। ”
হেনা বলল, ” না থাক। এখানে এলে দেখবো। ”
” ঘরে বসে থাকবে? ”
” হ্যা, একেকজন একেক কথা বলছে। বাদ দে। ”
আয়জা ডোডোকে আদর করতে করতে বের হয়ে এল। আম্বিয়া বেগম তাকে চুপিসারে বললেন,
” তোর মেঝফু’র আক্কেলটা দেখেছিস? এমনিতেই চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলে। তারউপর মেয়ে একটা এনেছে। ওই মেয়ের মুখ দেখতে ইচ্ছে করেনা আমার। ”
আয়জা বলল, ” আহা এসব বলো না তো। ভাবিকে সরিয়ে রাখো ফুপুর সামনে থেকে। কখন কি বলে বসে। ”
” দেখছি। ”
তরতর করে হেঁটে রান্নাঘরে চলে গেলেন আম্বিয়া বেগম। তিথি মেহমানদারি করছে। যেন সবাই তার ঘরের মানুষ। কেউ কেউ খোঁচা মেরে তার বাপের বাড়ির কথাও জানতে চাইছে। কিছুদিন আগে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো সেই কথাও জানতে চাইছে। আরও কতশত কথা! তিথি হাসিমুখে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। আম্বিয়া বেগমের গা জ্বালা করছে। বিরক্ত হয়ে নিজের বোনকে বললেন,
” এত কথা বলিস না তো। ওর বাচ্চাকে খাওয়ানোর সময়টুকু পাচ্ছে না সকাল থেকে। এই বউ তুই যা আমার নাতিটাকে খাইয়ে দিয়ে আয় আগে। আয়জার কোলে চেঁচাচ্ছিলো। ”
তিথি চায়ের কাপগুলো ধুয়ে বলল,
” আচ্ছা যাচ্ছি। মেঝ ফুপু চা খায়নি। ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। ফুপুকে একটু নিমকি চা দাও। ”
মেঝ ফুপু বললেন,
” আর দিতে হবে না। আমাদের তোষামোদি করতে হবে না অত। বাপের বাড়িতেই তো এসেছি। নিজে করে খেয়ে নেব। ”
আম্বিয়া বেগম মুখ বাঁকালেন আড়ালে।
তিথি ডোডোকে খাওয়াচ্ছিলো। আয়জা হেনাকে নিয়ে তখনি ঘরে প্রবেশ করলো। তিথি সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছিলো। আয়জা বলল,
” সমস্যা নেই। হেনা আপা এসেছ। তুমি তো নাম শুনেছ।”
তিথি হেনাকে বলল,
“বসুন। ”
হেনা বসলো। তিথি তাকে আপাদমস্তক দেখে নিল। আয়জা তাকে এই মেয়ের ব্যাপারে সব বলেছেন বাংলোয় থাকাকালীন।
সেদিন বোকামো না করলে এই ঘর সংসার মেয়েটার হতো। জীবনটা কি অদ্ভুত!
আয়জা বলল,
” আচ্ছা তোমরা গল্প করো। আমি আসি। ”
আয়জা চলে যাওয়ার পর তিথি আর হেনার মধ্যে অনেক কথা হলো। হেনা ঘরটাতে চোখ বুলিয়ে বলল,
” পড়াশোনা কন্টিনিউ করেছেন? ”
” না সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল দিইনি। এবার দেব ভাবছি। ডোডো হাঁটা শিখলে আমার আর সমস্যা হবে না। ”
” বাচ্চা তার মায়ের চেহারা পেয়েছে, আর বাবার রঙ। ”
তিথি মৃদু হাসলো। ডোডো মুখ বের করে একবার হেনাকে চাইলো। হেনা হাসতেই সে আবারও মুখ লুকিয়ে নিল। তিথি বলল,
” দুষ্টুমি শিখেছে। আপনার ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছে?”
হেনা চমকে উঠে বলল, ” না না। হয়নি। হবে আর কি। ”
তিথি হাসলো। বলল, ” কিছু খাননি? ”
” খেয়েছি। খিদে নেই তেমন। আসার সময় ভাত খেয়েছিলাম। ”
দুজনের কথার মাঝখানে সোজা ঘরে ঢুকে এল আজলান। ডোডো মুখ তুলে বাবাকে দেখে ডেকে উঠলো, ” এ পাপ্পাহ। ”
হেনা বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো। আজলান হেনাকে দেখে বলল,
” ভালো আছিস? ”
হেনা দ্রুত জবাব দিল।
” হ্যা আছি। ”
তারপর সোজা বেরিয়ে গেল সে। তিথি ডোডোকে মেঝেতে নামিয়ে দিল। সে হামাগুড়ি দিয়ে ছুটে গিয়ে বাবার পা জাপ্টে ধরলো। আজলান চোখ নামাতেই দু-হাত বাড়িয়ে দিল। আজলান কোলে তুলে নিয়ে বলল,
” পা ধরার অভ্যাস হলো কবে থেকে? ”
ডোডো চোখ উল্টে তাকালো। আজলান বলল,
” এসব শেখালো কে? ”
ডোডো হাতদুটো তুলে চেঁচিয়ে বলে উঠলো।
” আম মাম মা। ”
তিথি হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইলো। মাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে সে?
আজলান বলল,
” আর করলে খবর আছে। ”
ডোডো হাতদুটো দিয়ে তার মাথার চুল টেনে ধরলো। এত শক্ত করে ধরলো ছাড়ার নাম নেই। তিথি কাছে গিয়ে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো কিন্তু সে ছাড়লো না। আজলান তাকে বিছানায় ফেলে হাতদুটো শক্ত করে ধরে ধীরেধীরে ছাড়িয়ে নিয়ে মাথায় হাত চেপে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। ডোডো বিছানায় শুয়ে চুপ করে বাবার দিকে চেয়ে হাসতে লাগলো খিলখিলিয়ে। আজলান একটা বড়সড় রুমাল নিয়ে তার হাতদুটো বেঁধে ফেলে বলল,
” বেশি বাড় বেড়েছ তুমি।”
ডোডো হাত নাড়াতে না পেরে পা নাড়াতে লাগলো। আজলান তাকে ওভাবে রেখে কাবার্ড খুলে তার শার্ট বের করে গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেল তিথির দিকে চোরা চোখে চেয়ে। সে বেরিয়ে যেতেই তিথি ছুটে এসে ডোডোর গালে চুমু দিতে দিতে বলল,
” কেমন লাগছে এবার? ”
ডোডো খুলে দিতে হাত বাড়িয়ে দিল।
তিথি গিঁট খুলতে যেতেই আজলান ঘরে ঢুকে খ্যাঁক করে উঠে বলল,
” খবরদার বলছি। ”
তিথি গিঁট খুলতেই থাকলো। আজলান চুপচাপ চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। সত্যি সত্যি খুলছে দেখে খপ করে তার হাত ধরে ওড়না টেনে দুহাত বেঁধে ফেললো। তিথি ধস্তাধস্তি করেনি বলে শক্ত করে বাঁধতে সুবিধা হয়েছে। তারপর বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
তিথি ডোডোর কাছে গিয়ে বসলো। দু’হাতে মধ্যিখানে ডোডোকে নিয়ে শুয়ে পড়ে বলল,
” তোর জন্য আমাকেও শাস্তি পেতে হচ্ছে ডোডো।”
ডোডো অসহায় মুখ করে শুয়ে থাকলো। কিছুক্ষণ পর আয়জা এসে দেখলো মা ছেলে দুজনেই ঘুম। সে নাকিসুরে কেঁদে বলল,
” আমার গায়ে হলুদের দিন মা ছেলে ঘুমোচ্ছে। এখন আমি..
তখুনি মা ছেলের হাত বাঁধা দেখে হাঁ করে চেয়ে রইলো সে। আজলান তার পেছন পেছন ঘরে ঢুকে বলল,
” ঘুমোক। ঘুম থেকে উঠে বাকি কাজ করবে। ”
আয়জা চুপচাপ বেরিয়ে গেল। আজলান প্রথমেই তিথির হাত খুলতে বসেছিলো। ওড়নার গিঁট খুলতে গেল আর ঠিক তখুনি ঘুমঘুম চোখে তিথির মনে হলো যেন ডোডোকে কেউ একজন তার বুক থেকে তুলে নিচ্ছে ধীরেধীরে। সে খপ করে আজলানের কলার চেপে ধরে হ্যাঁচকা টান দিল। আজলান মুখ থুবড়ে পড়লো তার উপর।
দুজনের মাঝখানে ঘুমন্ত ডোডো চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে রইলো।
সে ভ্যাওভ্যাও কেঁদে উঠতেই দুজনের হুঁশ ফিরলো। আজলানের নাকটা তিথির কান ছুঁয়ে উঠে গেল।
চলমান…..
কি লিখছি নিজেও জানিনা। এতবড় পর্ব রিচেক দেয়া সম্ভব না। সকালে দেবোনে।