#এই_ভালো_এই_খারাপ
#পর্ব_৫
#প্রিমা_ফারনাজ_চৌধুরী
তিথির চেঁচামেচি শুনে আম্বিয়া বেগম ছুটে এসেছেন। দরজা ধাক্কা দিয়ে বলতে লাগলেন,
” তোরা কি শুরু করেছিস বলতো। শান্তিতে একটু বসতেও দিবি না? ”
আজলান দরজা খুলে দিতেই আম্বিয়া বেগম আর আয়জা ঘরে ঢুকে পড়লো। দুজনেরই চক্ষু ছানাবড়া তিথিকে দেখে। মুখে টেপ, হাত পা বাঁধা। তিথি পা দুটো লম্বা করে টেনে টিভিতে গোপাল ভাঁড় দেখছে। আয়জা ঠোঁট টিপে হাসলো। আম্বিয়া বড় বড় চোখ করে বললেন,
” কি করলি এটা? ”
আজলান বলল, ” এই বাড়িকে নাকি ঠ্যাং দেখিয়ে চলে যাবে। তাই বেঁধে রেখেছি। ”
আম্বিয়া বেগম তিথিকে জিজ্ঞেস করলো,
” এবার ভালো লাগছে তোর বজ্জাত মেয়ে? ”
তিথি উপরনীচ মাথা দুলিয়ে জানালো “হ্যা”। আম্বিয়া বেগম অবাককন্ঠে বলল,
” হারামজাদি। ”
তিথি কথা বলতে পারছেনা তাই চোখদুটো ট্যারা করে তাকালো। আজলান ফোল্ডিং আইরন টেবিলে তার ইউনিফর্মটা আইরন করাচ্ছিলো। করার সময় ঘাড় ফিরিয়ে তিথির দিকে একপলক তাকাতেই দেখলো সে ট্যারা চোখে তাকাচ্ছে। আয়জা হাসছে। আম্বিয়া বেগম ক্ষেপাটে চোখে চেয়ে আছেন। বললেন,
” উচিত হয়েছে। একদম ঠিক কাজ করেছে। থাক তুই এভাবে। ”
তিথি চোখের আইরিশ ঘুরাতে লাগলো। আম্বিয়া বেগম কাছে মাথায় একটা চড় মেরে চলে গেল। আয়জা গেল না। বলল,
” ভাইয়া খুলে দেই? ”
আজলান আইরন টেবিল ফোল্ড করে বলল,
” এত দরদ আসছে কোথাথেকে? ”
আয়জা মাথা নামিয়ে চলে গেল।
তিথি আজলানের দিকে চোখ ট্যারা করে চেয়ে রইলো। আজলান বলল,
” গাধাকে পিটালেও সে গাধাই থাকবে। তোমার ক্ষেত্রেও সেই দশা। থাকো এখানে পড়ে। ”
গন্ডারের ঘরে একা থাকতে তিথির ভয় করে তাই পা দিয়ে বিছানায় ধপাস ধপাস মারলো তিথি। আজলান দরজা বন্ধ করে চলে গেল।
বাইরে দাঁড়িয়ে ফোনালাপ সাড়ছিলো সে । হঠাৎ সামির আর আভিরা ছুটতে ছুটতে এলল। বলল,
” মামা মামা! মামণি কাত হয়ে পড়ে গেছে। ”
আজলান ফোন সরিয়ে বলল,
” কোথায়? ”
আম্বিয়া বেগম চেঁচাতে চেঁচাতে আসছেন।
” বাচ্চাটারে কি মারার পরিকল্পনা করতেছোস সবাই মিলে? ওরে ওভাবে বেঁধে রাখছোস, ও গড়াতে গড়াতে পড়ে গেছে পালঙ্ক থেকে। গিয়ে দেখি ব্যাথায় কোঁকাচ্ছে। ”
আজলান ফোনটা পকেটে পুরে ঘরের দিকে পা বাড়ালো। আম্বিয়া বেগম চেঁচাতে চেঁচাতে বললেন,
” পরের মেয়েরে কি দোষ দেব? আমার নিজেরটাই তো দোষে ভরা। ”
আজলান গিয়ে দেখলো তিথি ব্যাথায় কোঁকাচ্ছে। আয়জা পায়ের বাঁধনটা খুলতে ব্যস্ত। আজলানের দিকে তাকালো না সে। আজলান বলল,
” গবেট কোথাকার। গড়াতে গিয়েছ কেন? পড়ে যাবে সেটা জানতে না? ”
তিথি জবাব দিল না। আয়জা পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই তিথি পা নামালো। আয়জা বলল, ” কোথাও ব্যাথা পাচ্ছ? ”
পিছুপিছু আম্বিয়া বেগম এসে বলল, ” পেটে লাগেনি তো বউ? এসময় কত সতর্ক হতে হয় মেয়েদের। আল্লাহ তোদের কেন যে বুদ্ধিসুদ্ধি দেয় না!”
তিথি কারো কোনো জবাব দিল না। বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। হাঁটতে গিয়ে কঠিন ব্যাথা অনুভব করলো কোমরে। কিন্তু কাউকে কিচ্ছু বললো না। কাউকে দুর্বলতা দেখাতে নেই। এদেরকে তো নয়ই।
তাকে হাঁটতে দেখে আজলান বড়সড় শ্বাস ফেলে বলল,
” হুদাই টেনশন করছো। ওর কিচ্ছু হয়নি। ”
আম্বিয়া বেগম বললেন, ” ওর সাথে যেমন তেমন করতে পারবিনা কিন্তু আজলান। বাচ্চাটার কিছু হলে আমি তোদের ছাড়বো না একদম। ”
__
রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে তিথি আয়জার কাছে চলে গেল। আয়জা বলল, ” তুমি তোমার ঘরে চলে যাও ভাবি। ভাইয়া আমার উপর ক্ষেপে যাবে। ”
তিথি বলল, ” তো আমি কি করব? ”
আয়জা বলল, ” ভাইয়া আমাকে বকবে। ”
তিথি বলল, ” কিছু হতে না হতেই আমাকে মেঝেতে ঘুমাতে বলবে। আমি অনেক সহ্য করেছি। এখন আমার সাথে আমার বাচ্চা আছে। আমাকে কিছু বলা মানে আমার বাচ্চার অপমান। কিছু বলবে না। চিল মুডে থাকো। ”
আয়জা বলল, ” সামনে তোমার ইনকোর্স পরীক্ষা। পরীক্ষা দেবে না? ”
” জানিনা। ” বলেই তিথি কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। এবার ব্যাথাটা ক্রমশ বাড়ছে। উফফ কি জ্বালা রে। কোমরের হাড্ডি বোধহয় গেল ভেঙে। সকালে ঘুম থেকে উঠে খেয়াল করলো মেঝেতে পা বসাতে অব্দি কষ্ট হচ্ছে। এতটা এতটা ব্যাথা করছে কোমরে। কোনোমতে পা টিপে টিপে ঘরে বিয়ে দেখলো ঝকঝকে তকতকে মেঝে, বিছানা। ইউনিফর্ম পড়ে মাথা চুল ঠিকঠাক করছে আজলান শেখ। তিথি এসেছে দেখে ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। তিথি আহত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। কেউ কিছু বললো না।
তিথি ব্রাশে টুথপেষ্ট লাগিয়ে নিল। ব্রাশ করতে করতে লাগলো। এত শব্দ করে কুলি করতে লাগলো যে আজলানের বিরক্তির সীমা রইলো না। কাতকুত করে গলা পরিষ্কার করতে লাগলো। যেন গলা নয় ইটের কারখানা। আজলান বেরিয়ে গেল।
তিথি মুখ মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হালকা করে কোমরের দিকে উন্মুক্ত করে দেখলো ফুলে গেছে সেখানটাতে। কি টনটনে ব্যাথা!
আজলান তক্ষুণি ঘরে প্রবেশ করতেই তিথি চেঁচিয়ে উঠে বললো, ” ছিহ। ”
আজলান তার টুপিটা নিতে ভুলে গিয়েছিলো। সেটা হাতে নিয়ে তিথির দিকে তাকিয়ে বলল,
” সমস্যা? ”
তিথি আয়নার আজলানের দিকে চেয়ে বলল,
“বিরাট সমস্যা। আমি যখনই আমার কাপড় সরাবো তখনই তোমাকে চলে আসতে হবে। শয়তানটা তোমাকে বলে দেয় না? তোমার সাথে ওর খুব ভাব? ”
” শাট আপ। ”
তিথি চুপ করে গেল। আজলান তার বাহু ধরে তার দিকে ফিরিয়ে বলল,
” ঘর, বিছানা, ওয়ারড্রব কিছু যেন এলোমেলো না হয়। ”
তিথি বলল, ” ওকে বস। ”
আজলান বলল, ” এডভোকেট তসলিমা খাতুনকে বলে দিয়েছি পেপারটা যেন আর ন’টা মাস পর দেয়। ”
তিথি চেঁচিয়ে বলল, ” ডিভোর্স পেপার? ”
আজলান বলল, ” হ্যা। ”
তিথি বলল, ” সত্যি সত্যি ডিভোর্স দেবে আমাকে?”
আজলান বলল, ” জাস্ট শাটআপ। উনার কাছে তুমি গিয়েছিলে সো উনি যা বলেছেন আমি শুধু তোমাকে তাই বলেছি। সবকিছুতে আমাকে ইনভলভ করাটা বন্ধ করো। এন্ড ইউ নৌ হোয়াট! তুমি একটা অসহ্য বাদড়। ”
তিথি বলল, ” আরেহ না না। বাদড় না। গন্ডারনি। ”
আজলান বলল, ” মানে? ”
” মানে হচ্ছে গন্ডারের বউকে গন্ডারনি বলে। ”
আজলান কন্ঠ একটু খাদে নামিয়ে বলল, ” তোমাকে আমি এই বাড়ি থেকে চিরতরে বের করে দিতাম। পারছিনা কেন জানো? জাস্ট বিকজ ইউ আর মাই সো কল্ড ওয়াইফ এন্ড মাদার অফ মাই চাইল্ড। ”
তিথি বলল, ” আর কিছু? ”
আজলান বলল, ” আমি এসে যদি দেখি তুমি সবকিছু এলোমেলো করে ফেলেছ তাহলে সোজা বাড়ির বাইরে আউট। তোমার জায়গা বস্তিতে। ”
তিথি মুখ বেঁকিয়ে বলল, ” বস্তির জামাই। ”
আজলান কাজে চলে গেল। তিথি রমলা চাচীর সাথে তালে তাল মিলিয়ে রান্নাঘরের কাজবাজ করে নিল। রমলা চাচী একমাত্র তার দুঃখ বোঝে। বলল, ” তুমি আইলা ক্যান এই বাড়িত? তুমি যহন ছিলানা তোমার নামে কত কি বলছে সবাই মিলে।”
” কি বলছে? ”
রমলা ফিসফিস করে বলল, ” তোমার জামাইরে আরেকডা বিয়া করাইবো বলছে। ”
তিথি হেসে উঠে বলল, ” এরকম হলে আমার চাইতে বেশি খুশি কেউ হবে না বুঝলে? ”
রমলা চাচী অবাককন্ঠে বলল, ” তুমি হাসতেছো বউ? জামাই যখন অন্য কাউরে সোহাগ কইরা কথা বলবো তখন দেখবা কেমন লাগবে। ”
তিথি হাসতে হাসতে বলল, ” কি যে বলো না। আমার জামাই জীবনেও সোহাগ কইরা কথা বলতে পারবে না। ওই ব্যাটা সেসব জানে নাকি? ”
রমলা চাচী বলল, ” বাচ্চা পেটে আসছে তারপরও এইসব কথা বলবা? ”
তিথি বলল, ” দেখো চাচী বাচ্চা পেটে আসার জন্য প্রেম ভালোবাসার দরকার পড়েনা বুঝলে। তুমি দেখো কত মানুষের সংসার হয়ে যাচ্ছে প্রেম ভালো বাসা ছাড়া। জগতের নিয়ম তাই সবাই সংসার করছে। একসাথে ঘুমাচ্ছে, বাচ্চা নিচ্ছে, তাদের মানুষ করছে। ভালোবাসা থাকে গুটিকয়েকটা দম্পতির মধ্যে। ওরাই আসল সুখী। বুঝলে?”
রমলা চাচী বলল, ” তুমি তোমার জামাইরে ভালাটালা বাসো না?”
তিথি ব্যঙ্গ করে বলল, ” পারিনা আজকেই ছেড়ে যাই। আবার বলো ভালোবাসা!
ভালো কাকে বাসা যায় জানো যে ওসবের মূল্য দেবে। তুমি কারো জন্য একটু রান্না করলে সে তোমার রান্নাটা খেল না। তোমাকে অবজ্ঞা করলো। তার প্রতি তোমার ভালোবাসা আসবে? তুমি কারো জন্য সাজলে সে তোমাকে দেখে বিশ্রীভাবে কটাক্ষ করলো। তোমার মধ্যে ভালোবাসা আসবে? তুমি কারো কপালে মলম লাগিয়ে দিলে যত্ন করে। তোমার হাতে পেঁয়াজের গন্ধ বলে সে তোমার দিকে ঘৃণাভরে তাকালো। তোমার তার প্রতি ভালোবাসা আসবে? ভালোবাসা কি অত ক্যালকুলেশন করে হয় বলো? আমি যতবার ভালোবাসতে গিয়েছি, ততবারই আঘাত পেয়ে ফিরে এসেছি। তাই ওসবের উপর আমার বিশ্বাস নেই। ”
রমলা চাচী বললো, ” অত কঠিন কথা বুঝিনা বাপু। বিয়া হলেই জামাই বউয়ের মধ্যে ভালোবাসা হইয়া যায়। তোমাদের হইলো না ক্যান? ”
তিথি হেসে বলল, ” আমাদের হবেও না। ”
” এইভাবে সংসার করবা? ”
” মোটেও না। সংসার কি জেলখানা যে বেরোতে পারব না? একটা সময় দেখবে ফুড়ুৎ করে বেরিয়ে যাবো। তোমাদের বাবু ভাবে আমি বড়ই অসহায়। এসব অবজ্ঞা আর তাচ্ছিল্য পেয়ে থেকে যাবো। কিন্তু তা হবে না বস। আমি হলাম মেহবুবা মাহনূর তিথি, মুখের কথায় না হলে মারপিট করে জিতি। ”
রমলা চাচী বলল, ” বাবু আইনের মানুষ। তুমি তার লগে মারপিট করবা? ”
তিথি হেসে বলল, ” আইনের মাইরে মাপঝোঁক আছে বুঝলে? কিন্তু আমার মাইর মাপঝোঁক ছাড়া। ”
রমলা চাচী এবার হাসলো। বলল,
” বিয়ার পর তুমি কিন্তু কথাও বলতানা। এখন কত কথা বলো। ”
তিথি বলল, ” শোনো মেয়েরা যখন মা হয় না! তখন তারা বর কেন পুরো পৃথিবীর সাথে লড়াই করার ক্ষমতা রাখে। তাই হয়ত একটুআধটু গলাবাজি করি। ”
রমলা চাচী বলল, ” হ্যা তাই তো। কিন্তু তুমি তো বাচ্চাটারে মাইরা ফেলতে চাইছিলা। ”
তিথি আর জবাব দিল না। তার শেকড়ে ভয়। যদি শেকড় একবার গেড়ে যায় বহু গভীরে। এই অবজ্ঞা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য, অপমান তাকে সারাজীবন সয়ে যেতে হবে । মেয়েরা চাইলেই সব পারে না। আবার সব পারলেও সব জায়গায় একটু না একটু ত্রুটি থেকেই যায়।
রাত আটটার দিকে আজলান বাড়ি ফিরলো। ইউনিফর্ম পাল্টে নিয়ে কোচের উপর শুয়ে আরাম করছিলো।
তিথি বড় কাতলা মাছ কেটে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে সবেমাত্র ঘরে প্রবেশ করেছে। আজলান কোচ থেকে উঠে নাক টেনে বললো, ” আঁশটে গন্ধ। এই মেহবুব মাছ কেটেছ?”
কোমরের ব্যাথায় তিথির সব বিরক্ত লাগছে। আজলানের এমন প্রশ্ন শুনে বললো,
” হ্যা তো? আঙুল দিয়ে মাছের নাড়িভুঁড়ি গু মুত সব বের করছি। তারপর সেগুলো দিয়ে কচলে কচলে ভাত খেয়ে আসছি। তোমার জন্যও রাখা আছে। ”
আজলান শেখের মুখের এমন অবস্থা হলো যেন বমি তার মুখের সামনে এসেই পড়েছে। গর্জে উঠে বলল,
” অ্যাই চুপ। একদম চুপ। ”
তিথি বলল, ” চুপ করবো না। এই মাছের গন্ধ নিয়ে তোমার সাথে মাখামাখি করবো আজ। ”
তিথি যেন তখনই তাকে জড়িয়ে ধরতে যাচ্ছিলো! সে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। নীচে গিয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দিল। তিথি পা টিপে টিপে নীচে যেতেই আতিফা বলল,
” ভাইয়া এসব পছন্দ করেনা জানো। তারপরও বলতে যাও কেন? ”
তিথি বলল, ” সেটা আমার আর উনার ব্যাপার। তুমি সেখানে নাক গলাচ্ছো কেন? ”
আম্বিয়া বেগম বললেন, ” সবেমাত্র বাড়ি ফিরেছে। তুই একটু শান্তিতে ওকে বসতেও দিলি না। ”
তিথি বললো, ” তোমার সামনেই তো সাবান দিয়ে ডলে ডলে হাত ধুলাম। তোমার ছেলে বলে আমার গায়ে নাকি আঁশটে গন্ধ! ”
আম্বিয়া বেগম আর কিছু বললেন না। আতিফা বলল,
” মাছ কাটার সাথে সাথে তোমাকে ভাইয়ার সামনে যেতে হবে কেন? ”
তিথি বলল, ” আমি আমার বরের কাছে কখন যাব সেটা তুমি বলে দেবে? ”
আয়জা বলল, ” আপু তুই কেন ভাবিকে বকছিস? ভাইয়ার দোষ আছে। এত খুঁত ধরলে আমার নিজেরও রাগ লাগবে। ”
আজলান বাড়িতে ঢুকে এল। কারো দিকে তাকালো না। চুপচাপ ঘরে চলে গেল।
তিথি যখন ঘরে গেল তখন আজলান সবেমাত্র গোসল শেষ করে বের হয়েছে। উদাম গায়ে ঘরময় পায়চারি করতে করতে মাথা মুছছে। গায়ে সাবানের খুশবু! তিথি নাক টানতে টানতে বলল,
” কি বিচ্ছিরি গন্ধ রে বাবা। এসব সাবানও মানুষ ব্যবহার করে আজকাল! ”
আজলান তার দিকে তাকালো। বললো,
” বস্তির লোকজন এই সোপ কখনো চোখেও দেখেনি ব্যবহার করা তো দূর। ”
তিথি ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো বাঁকা হেসে। সাবানটা দিয়ে ডলে ডলে মুখহাত ধুয়ে নিল। কামিজের ওড়নাটা বালতিতে ডুবিয়ে রেখে বেরিয়ে এল। আজলান নাক টেনে বলল,
” তুমি আমার সোপ ইউজ করেছ? ”
তিথি বলল, ” কই না তো। ”
আজলান এগিয়ে এসে তার হাত ধরে শুঁকে বললো,
” মিথ্যে বলছো কেন? ”
তিথি বলল, ” শুধু হাত দিয়ে ধরেছি। ”
আজলান তার কপালের কাছে শুঁকে বলল,
” মুখও ধুয়েছ। সাবানে আবারও চুল লাগিয়ে রাখোনি তো? ”
তিথি বলল, ” ওটা দিয়ে তো চুলও ধুয়েছি দুপুরে। ”
আজলান দাঁত কিড়মিড় করতে লাগলো। তিথি বিড়বিড়িয়ে বলল, ” ফাটাকেষ্ঠর পছন্দ আছে। আহা কি মিষ্টি গন্ধ! আচ্ছা এসব গন্ধ মেখে মেয়ে মানুষের সামনে হাঁটলে তো তারা পাগল হয়ে যাবে। জড়িয়ে ধরতে চাইবে। সে জড়িয়ে ধরে নাক টেনে বলল,
” বাপ্রে কি খুশবু! ”
আজলান চোখ নীচু করে তাকে দেখে বলল,
” এসব কি হচ্ছে? ছাড়ো। তুমি আমার গায়ে পড়ো কোন সাহসে? ”
তিথি বললো,
” চুপ চুপ আমার গায়ে তোমার ওই রাতের শয়তানটা এসে বসেছে। ”
” মানে? ”
” মানে আদর পেতে ইচ্ছে করছে। একটু করো না গো। ”
আজলান তাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বলল,
” আমার মেজাজ খারাপ করে এসেছ আদর চাইতে? আর হোয়াট ইজ আদর? এসব ওয়ার্ড শুনতে কেমন লাগে? ”
তিথি বললো,
” ভালোই তো লাগে। ”
আজলান কপাল চেপে ধরে বললো, ” উফ। ”
তিথি বললো, ” আমাদের পাড়ার ওই রাতুল ভাই ছিল না? সেও তোমার মতো এরকম করতো। উফ যা লাগতো না তখন। ”
বলেই তিথি কপাল চেপে ধরে উফ বলে আজলানের মতো হাঁটতে লাগলো। আজলান বলল,
” সে শয়তানটা আবার কে? ”
তিথি ফিক করে হেসে উঠে বলল,
” চাইল্ডহুড লাভ। তোমার যেমন একটা পিংকি ছিল। আমারও তেমন একটা ডিংকি ছিলো। তাকে দেখলেই আমার দিলের ধারকান বাইড়া যেত। সেখানে শব্দ হতো ধুপধাপ ধুপধাপ। যেন ভেতরে ডিজে চলছে। আহ কি ফিলিংস মাইরি! কোথায় হারিয়ে গেল সেসব ফিলিংস। কপালে একটা ফাটাকেষ্ঠ জুটে গেল, আর আমার সেসব ফিলিংসের মাইরে বাপ হয়ে গেল। ”
বলতে না বলতেই বেসিনের কাছে ছুটে গিয়ে গলগল করে বমি করলো তিথি। পানির ঝাপটা মেরে ঢলে পড়তে পড়তে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো বহুকষ্টে। আজলানের দিকে চেয়ে বলল,
” তুমি যত্তগুলা চুমু খেয়েছ সব এখন বের হচ্ছে। আগেই বলেছিলাম আমার পেটে ভালো কিছু সহ্য হয় না। ”
আজলান তাকে ধরতে আসলে তিথি এক ঝটকায় দূরে ঠেলে দিয়ে বলল,
” আয়েম ওকে বস। ”
আজলান বলল,
” বমি-টমি করেছ। তাই একেবারে গোসল করে ফেলাটাই বেটার হবে। ”
তিথি ছুটে গিয়ে সোজা বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। আজলান তাকে চিৎ করে শোয়াতেই টের পেল তিথি জ্ঞান হারিয়েছে।
জ্ঞান ফিরতেই তিথি দেখলো তার মুখের উপর একটা পুরুষ মানুষ লেবু পাতা কচলাচ্ছ। তিথি চোখ মেলামাত্রই দেখলো খুশবুওয়ালা। আহ কি খুশবু রে! আজলান তাকে চোখ খুলতে দেখে বলল,
” তুমি আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছ। ”
তিথি তার গলা জড়িয়ে ধরে বলল, ” ডাক্তার কিন্তু চুমু খেতে বারণ করেনি। দেখি জোরসে একটা চুমু দাও তো। এখন ফিলিংস এসেছে। ফিলিংসের বারোটা বেজে গেছে। তেরটা বাজলে সমস্যা। কুইক। ”
আজলান বলল, ” অসম্ভব। আগে ব্রাশ করো। ”
তিথি বলল, “একটা চুমুর জন্য ব্রাশ! লাগবে না চুমু।”
________
তিথি আজলানকে খুঁজতে খুঁজতে সুইমিংপুলের ধারে চলে এসেছে। আজলান ফোনালাপে ব্যস্ত। তিথির কোমর ব্যাথাটা বাড়ছে। কিসের উপর ভর করে হাঁটছে সে নিজেই জানে না। ফাটাকেষ্ঠকে বলা ছাড়া উপায় নেই। নইলে পরে দেখা যাবে অবস্থা কেরোসিন হয়ে গেছে। তখন আর রক্ষে নেই। সে হাঁটতে না পারলে ফাটাকেষ্ঠ তাকে নিজের মর্জিমাফিক ব্রাশ করাবে, আর গোসল করাবে।
সে গিয়ে বললো, ” একটা জরুরি কথা। ”
আজলান রাগত দৃষ্টিতে চেয়ে ইশারা করলো চুপ থাকতে। ভীষণ ব্যস্ত ভঙ্গিতে কথা বলছে সে। তিথি তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
” ভীষণ জরুরি। আর সহ্য হচ্ছে না। ”
আজলান আঙুল তুলে ঠোঁটের কাছে রেখে চুপ থাকতে বললো। তিথি তার শার্ট টেনে ধরলো।
“একবার শোনো। রাতে আমার ঘুম হবে না। ”
আজলান তাকে চুপ করানোর জন্য মাথাটা টেনে চেপে ধরলো বুকে। যদি ইট পাথরের উপর চেপে ধরতো এতক্ষণে তার কপাল ফেটে রক্ত গড়াতো। এতটা জোরে চেপে ধরে মানুষ!
তারপর ফোনের ওপাশের জনকে একের পর এক কমান্ড দিয়ে গেল। থামার নয়। তিথি খুশবুতে মগ্ন হয়ে রইলো। তাই নড়াচড়া করেনি। ব্যাপারটা তার মন্দ লাগেনি।
শেষে, “ওকে ফাইন, গুড নাইট ” বলার পর ফোনটা পকেটে রাখতে দেরী। তিথি মুখ তুলে চেয়ে কিছু বলার আগেই আজলান জোরসে একটা চুমু খেয়ে ছেড়ে দিয়ে বলল,
” আজব পাবলিক! কথা বলছি সেখানে এসে ডিস্টার্ব করছে। অসহ্য। ”
বলেই গটমট পায়ে হেঁটে চলে গেল।
তিথি হতচ্ছাড়ার মতো তার যাওয়ার পথে চেয়ে রইলো। ঠোঁট মুছে বললো, ” ওমা চুমুতে কি কোমরের ব্যাথা যাবে? এই লোক! আরেহ আরেহ ব্রাশ তো করিনি। ”
চলমান…….