কথার বিয়েটা হলো হুট করে, কোনো আয়োজন নেই, আত্মীয় স্বজনের বালাই নেই। রান্না বান্নার মধ্যে সকালে মামাকে বাজার থেকে একটা মুরগি ঝুলিয়ে ঝুলিয়ে আনতে দেখা গিয়েছিল। এ ছাড়া আর ভালো কিছু রান্নাও বোধহয় হয়নি। তাছাড়া আত্মীয় স্বজন বলতে কথার তেমন কেউ নেই। এই যে এ বাড়ির মামা, মামি আর কথার বোন কবিতা ছাড়া। যে ছেলে বিয়ে করতে এসেছে তার সাথেও তেমন কাউকে দেখা গেলো না। শুধু পাশে দুজন মুরব্বি গোছের লোক দেখা গেলো, হয়ত সাক্ষীর জন্য এনেছে। ছেলেটি এসেছে সাধারণ চেক শার্ট ও জিন্স প্যান্ট পরে। যেখানে সে বসেছে তার ঠিক মুখ বরাবর কথার ঘর। দরজার ফাঁক দিয়ে স্পষ্ট ছেলেকে দেখতে পাচ্ছে কথা।
আজই যে কথার বিয়ে হবে এ ব্যাপারে সে নিজেও জানতো না। নিত্যদিনের মতো সকালে একটা রুটি খেয়ে, একটা ভালো জামা গায়ে জড়িয়ে সে টিউশনির উদ্দেশ্যে বের হচ্ছিল। ঠিক তখুনি মামি এসে বললেন,
“আজ কোথাও বেরোস না মা, বাড়িতে মেহমান আসবে।”
সচারাচর এত ভালো করে তার মামি কখনও কথা বলে না। যদিও মাস শেষে টিউশনির কিছু টাকা তুলে দেবার সময় এরকম বলে। তবে সারা মাস মামির কন্ঠ দিয়ে আগুন বের হয়। ঝাঁঝালো কন্ঠ শুনে কবিতা প্রায়ই কেঁদে কেঁদে বলে,
“আপারে, মামি এত জোরে বকাবকি করে কেনো? আমার মাথায় যন্ত্রণা করে।”
বিয়ে শেষ হবার ঘন্টা খানিক পরে কবিতা হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো। তার চোখে মুখে আতঙ্ক। বলল,
“তোর বিয়ে হয়ে গেছে আপা?”
কথা উত্তর দিলো না। তার মুলত উত্তর দেওয়া দুর টু শব্দ করতে ইচ্ছে করছে না।
হুট করে বিয়ে হওয়ায় সে কিছুটা ঘোরের মধ্যে আছে৷ বিয়ের ব্যপারটা আগে থেকে না জানানোরও কিছু কারণ আছে। প্রতিবার ছেলেপক্ষ দেখতে এলে তাদেরকে কথা নিজ দায়িত্ব তাড়িয়ে দেয়। একেকসময় তাদের একেক কথা বলে।
এই যেমন কিছুদিন আগে আসা পাত্রটিকে সে বলেছিল, সে প্রেগনেন্ট, প্রেগনেন্সির বয়স তিনমাস।
কথার উত্তর না পেয়ে কবিতা আবার বলল,
“আমাকে মামি ঐ পাশের ঘরটায় আটকে রেখেছিল রে আপা, আমি কিচ্ছু করতে পারলাম না তোর জন্য, কিচ্ছু না।”
এ পর্যায়ে সে কান্নায় ভেঙে পড়লো। ঠিক এমন মুহূর্তে মামি ঘরে ঢুকলেন। কবিতাকে কাঁদতে দেখে তার কোনো ভাবান্তর হলো না। বললেন,
“বরের মুখ দেখেছিস কথা? দেখবি? একবার কথা বলবি শশুড় বাড়ি যাবার আগে?”
কথা মুখ খুলল,
“একেবারে শশুড় বাড়ি গিয়ে তার মুখ দেখবো মামি, নয়তো বাসর ঘরে।”
মামি কিছুটা থতমত খেলেন। কে বলবে মেয়েটাকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে! কাজি যখন কবুল বলতে বলল তখনও সে ঝটপট কবুল বলে দিয়েছে। কাজি লোকটা নিজেও হতভম্ব হয়ে বসে ছিলেন। তার এত বছরের জিবনে এত দ্রুত কোনো কনেকে কবুল বলতে দেখেননি।
মামি ঘর ছেড়ে বেরুনোর সাথে সাথে কবিতা বলে উঠলো,
“আরিফ ভাইকে কী বলবি আপা? তাকে কিভাবে সামলাবি?”
কথা বলল,
“তোকে সেসব ভাবতে হবে না। তারচেয়ে তোর দুলাভাইয়ের কাছে যা, সে তোকে এত দামী মেকাপ বক্স গিফট করেছে এজন্য ধন্যবাদ বলেছিস?”
কবিতা দ্রত বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। বিস্ফোরিত গলায় বলল,
“বিশ্বাস কর আপা আমি একদম নিতে চাইনি, সে জোর করে আমার হাতে তুলে দিয়েছে।”
“তবে যে বললি তোকে মামি এতক্ষণ ঘরে আটকে রেখেছিল? ”
কবিতার মুখ চুপসে গেলো। সে প্রতিবার মিথ্যে বললে আপা ধরে ফেলে। কিভাবে ধরে কে জানে!
সে মিনমিন করলো,
“মাফ করে দে আপা।”
কথা বলল,
“দেবো, তার আগে আমার ফোনটা এনে দে।”
“কোথায় আছে ফোন?”
কথা কন্ঠ গম্ভীর করলো,
“না জানার ভান করবি না, মামি সকালে আমার ফোন কেড়ে নিয়ে গেছে জানিস না?”
কবিতা ফোন আনতে ছুটলো। দরজা পেরুনোর আগে কথা বলল,
“দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে যাস তো, দরজার ফাঁক দিয়ে তোর দুলাভাইকে দেখতে দেখতে হাঁপিয়ে গেছি।”
কবিতাকে ফোন নিয়ে আসতে হলো না। ফোন নিয়ে এসেছেন মামি। আজ তার চেহারার মধ্যে খুশি খুশি ভাব দেখা যাচ্ছে। অন্যান্য দিন দেখা যায় বাংলা সিনেমার রিনা খানের প্রতিচ্ছবি।
মামি ফোনটা কথার হাতে গুজে দিয়ে পাশে বসলেন। বললেন,
“তুই আমাকে যতটা খারাপ ভাবিস, আমি কিন্তু ততোটা খারাপ নই কথা। আরিফ আমার নিজের বোনের ছেলে, তাকে আমি তোর থেকেও ভাল মতো চিনি। সে কখনই তোকে বিয়ে করতো না।”
কথা নড়েচড়ে বসলো। শাড়িতে গা চুলকাচ্ছে তার। শাড়িটা বহুদিন আলমারির এককোনায় পরে ছিল, মায়ের শাড়ি৷ ধুলো বালি জমে একাকার। সে বলল,
“ছেলেটা কী আমাদের চেয়েও গরিব মামি? মানে হতদরিদ্র টাইপের? ”
“কোন ছেলে?”
“যার সাথে আজ আমার বিয়ে দিলে।”
“কী বলিস, হতদরিদ্র হবে কেনো? ভালো পজিশনে চাকরী করে, নিজের ফ্লাট বাড়ি…”
“তবে একটা বিয়ের শাড়ি কিনতে পারলো না? ”
রুবিনা বেগম গলায় অত্যাধিক মিষ্টতা যোগ করে বললেন,
“কেনো রে কথা, তোর পরনের শাড়িটা কী খারাপ নাকি? তোর নিজের মায়ের শাড়ি! রংটাও তোর উপর খুব ফুটেছে। আপাকে এই শাড়িটা পরে কী ভালো দেখাতো!”
কথা বলল,
“ছেলে নাকি বিয়ের বাজার করার জন্য তোমায় বেশ মোটা টাকা দিয়েছিলো, সেগুলো দিয়ে কী করলে?”
রুবিনা বেগম ঝটপট খাট ছেড়ে উঠে দাড়ালেন। কথা পাশের টেবিল থেকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো।
“গলা শুকিয়ে গেলে পানি খাও মামি।”
রুবিনা বেগম গ্লাস হাতে নিলেন না৷ উল্টো রক্ত চক্ষু করে তাকালেন। এবং প্রায় সাথে সাথে গটগট হেটে ঘর ছেড়ে বেরুলেন।
কথা সাবধানে পা ফেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালো। শাড়িটা পরে আর থাকা যাচ্ছে না, বদলাতে হবে।
ছোট্ট কাঠের টেবিলটার উপর থেকে সে একটা ডায়েরি তুলে নিলো। খয়েরী মলাটের সস্তার ডায়েরী। অথচ কত স্মৃতি বুকে জড়িয়ে আছে তার।
সে কলম নিয়ে লিখতে বসলো,
“আমার ছোট্ট ঘরটায় ছোট্ট জানালটা দিয়ে অনেকদিন হলো দখিনা বাতাস দোলা দেয় না, আমি অপেক্ষা করি..অধীর অপেক্ষায় দিন গুনি। আমার আকুতি দখিনা বাতাস শোনে না, শোনে ঝড়ো বাতাসের দলেরা। অথচ ঝড়ো বাতাসে আমি ভয় পাই।”
কথার ফোন বেজে উঠলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
“রূপকথা! ”
“হুম বলো।”
আরিফ বলল,
“তুমি বিয়ে করে ফেলেছো রূপকথা, বিয়ে করে ফেলেছো? আমার কথা একটিবারও মনে পরলো না তোমার?”
কথা বলল,
তোমার বন্ধু নাঈমের বোন আমার বান্ধুবি, সে কথা তুমি জানো?”
ওপাশ থেকে বেশ কিছুক্ষণ কোনো শব্দ ভেসে এলো না। কথা মৃদু হেসে বলল,
“নাঈমের কাছে যা বলেছো, সেসব কথা আমার কানে এসেছে আরিফ, আমি সব জানি।”
“কী শুনেছো তুমি?”
“তুমি যা বলেছো সেটাই।”
আরিফের অসহায় গলা শোনা গেল,
“ও তোমায় মিথ্যে বলেছে রূপকথা, তুমি আমায় বিশ্বাস করো না? আমি তোমায় ভালবাসি! খুব বেশি ভালবাসি! ”
“সত্যি যদি বাসতে!”
কথা ফোন কেটে দিলো। গলার কাছে কান্নারা দলা পেকে আছে। কথা কাঁদতে পারে না৷ হাজার চেষ্টা করেও চোখ থেকে এক ফোঁটা পানি বের হয় না তার। যেদিন চোখের সামনে বাবা মারা গেলেন, কথার হাত ধরে বারবার কিছু বলার আকুল চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে হাসপাতালের বারান্দায় নিথর দেহ নিয়ে শুয়ে ছিলেন। ঠিক সেদিন থেকে কথার কান্না পায় না।
অথচ এক সময় সামান্য আঘাতে কেঁদে বাড়ি ভাসাতো সে। সময় কী সত্যিই মানুষকে এতটা পরিবর্তন করে দেয়? হয়তো দেয়।
- #একজন_রূপকথা
#পর্ব_১
#নুশরাত_জেরিন