একটুখানি_আশা পর্ব ১০
#মেহরাফ_মুন(ছদ্মনাম)
প্রতিদিনের মত মুন ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নোট নিয়ে বসলো। আহানের খবর জানার পর থেকে মুন এই কয়েকদিন বাসা থেকে বের হয়নি, কলেজের সবকিছু এরিনের কাছ থেকে নোট নিয়ে পড়েছিল। মুন জানেও না আহান কই এখন! এই কয়দিন পরিবারের সাথে মুনের যোগাযোগ হয়নি কারণ আহান যেকোনো ভাবে মুনের খবরের জন্য তাঁর পরিবারকে আক্রমণ করতে পারে। সে-ই অনুসারে মুনের বাবা মুনের মোবাইল আর কয়েকদিন কোনো যোগাযোগ করতে বারণ করেছিল।
মুন ভাবনায় পড়ে গেল। আচ্ছা, আহান কী আসেনি জাপানে? আহান এই দেশে আসলে তো মুনের সব ডিটেলস জানে তাহলে ওর চরিত্র অনুসারে এখানে এসে যাওয়ার কথা কিন্তু ওর তো খবর নেই।
মুনের হঠাৎ করেই তাঁর পরিবারের কথা মনে পড়ে মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে গেল। কতদিন বাবা-মার সাথে কথা বলা হয়নি, কতদিন ওনাদের কণ্ঠটা শোনা হয়নি। শুধুমাত্র মেয়ের ভালোর জন্য নিজেরাও মেয়ের সাথে কথা বলার ইচ্ছেটাকে ধামা-চাপা দিয়ে দিলেন। তাঁর জীবনটা আজ কোথ থেকে কোথায় এসে দাঁড়ালো। প্রথমে আহানের সাথে মুনের জোর করে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো সবাই আবার বিয়ের দিনই ওর মুখোশ বেরিয়ে এলো। বিয়ের বরের কাছ থেকেই বাঁচতে বাবা-চাচা আজ এতদূর পাটালো মুনকে তাঁর উপর মুনের স্বপ্নটাও বাস্তবায়িত হলো। এখন সবকিছুই যখন ঠিক হলো আবারও আহান হাজির। মুন এসব ভেবেই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
মুন আর এত কিছুর দিকে মাথা না দিয়ে পড়তে বসলো। কারণ এসব ভাবতে গেলেই মুন এখন ইমোশনাল হয়ে পড়বে আর এভাবেই আর কোনো পড়া হবে না। এসব কিছু ঝামেলার জন্য এই কয়দিন মুন পড়তে পারেনি। এরিন ক্লাসের নোট দিয়ে গিয়েছিল সব জমে রয়েছে।
হঠাৎ ফুফি উৎফুল্ল হয়ে রুমে ঢুকে মুনের কাছে এসে মুনের কানে মোবাইল ধরাই দিল।
-‘কে ফুফি?’ মুন বই থেকে মুখ তুলে ফুফির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে উঠলো।
-‘আগে কথা বল, এখন আমি যায়।’ এই বলে ফুফি হাসিমুখে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
মুন মোবাইল কানে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলতেই ওই পাশ থেকে বাবার কণ্ঠ ভেসে উঠলো।
-‘কেমন আছিস মা?’ বাবার উৎফুল্ল কণ্ঠ।
মুনের এত্তোদিন পর বাবার কণ্ঠ শুনে এক অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেল মনের ভেতর। মুনের আবেগে কান্না এসে গেল। মুন কোনোমতে কান্না চেপে ধরে বাবার কথার প্রতিত্তুর করল,
-‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি বাবা। তুমি কেমন আছো?’
-‘তোর টেনশনে এতদিন কীভাবে ভালো থাকতে পারি মা বল? তবে এখন বাবাও আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি মা।’
-‘এখন হঠাৎ এত ভালো বাবা!’ মুন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে বলে উঠলো।
মুনের কথার উত্তর দিতে যাবে তখনই মুনের মা এসে মোবাইল নিয়ে নিলো। ‘হয়েছে মেয়ের সাথে অনেক বলেছো এবার আমাকে বলতে দাও, দেখি।’ ওইপাশ থেকে মোবাইল নিয়ে বাবা-মা দুজনের মধ্যে টানাটানি শুনে মুন হেসে উঠলো।
-‘হ্যালো মুন মা, কেমন আছিস? খাবার-টাবার ঠিকমতো খেয়েছিলি তো এতদিন? আর শরীর কেমন? আর তুর পড়ালেখা…!’
-‘হয়েছে মা একসাথে এত্তোগুলো প্রশ্ন করলে আমি কোনটা রেখে কোনটার উত্তর দিব বলো?আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি, সব আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছে, এইবার তোমাদের খবর বলো মা। তুমি, চাচা-চাচী আর আরিফারা কেমন আছে মা?’ মুন মাঝপথে মাকে থামিয়ে বলে উঠলো।
-‘আমরাও আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি রে মা। তোর চাচা-চাচী আর আরিফাও ভালো আছে। এই নেয় আরিফার সাথে কথা বল। মেয়েটা অনেক্ষন ধরে তোর সাথে কথা বলার জন্য বসে আছে।’
-‘হ্যালো আপু কেমন আছো?’ আরিফা হাসি হাসি কণ্ঠে বলে উঠলো।
-‘আমি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোর খবর বল, তুই কেমন আছিস আর রিহানের কী খবর?’
-‘আমিও আলহামদুলিল্লাহ। দাড়াও আপু আমি আগে রুমে যায় তারপর কথা বলছি।’ আরিফা এদিকে বড়ো আম্মু আর বড়ো আব্বুর দিকে তাকিয়ে মিনমিন করে কথাগুলো বলে মুখের উপর একটা বোকা বোকা হাসি ঝুলিয়ে বেরিয়ে গেল।
আর এদিকে আরিফার কান্ড দেখে শফিক আহমেদ আর মুনের মা দুজনেই মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো। মোবাইনের সাউন্ড লাউট থাকার কারণে মুনের কথাটা ওরা দুজনেই শুনেছিল তাই আরিফা কথার প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে মোবাইল নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
আরিফা নিজের রুমে এসে দরজা লক করে বুকে হাত দিয়ে হাঁফাতে লাগলো। আরিফা কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে বলে উঠলো,’ এটা কী করলে আপু?’
-‘কেমন দিলাম?’ মুন মজা করার কণ্ঠে বলে উঠলো।
-‘আরেকটু হলে বড়ো আব্বু-আম্মুর কাছে ধরা খেয়ে যেতাম। আমার বুক ধরধর করছে আপু।’ আরিফা ইনোসেন্ট কণ্ঠে বলল।
-‘বাহ্ বাহ্! এত ভয় তো মনে হয় রিহানের সাথে ঘুরতে গিয়েও পাসনি। শোন তোর কথা আমি বাবাই-মাকে ইঙ্গিত দিয়েছি। একদিন সময় করে সব বলবো, কারণ আমার রিহানকে ভালো লেগেছে, তোর জন্য পারফেক্ট। এখন যদি বাবাই-মাকে কোনোমতে রাজী করে রাখতে পারি তাহলে পরে চাচা-চাচী ঠিকই রাজী হবে। তখন আর কোনো বাঁধা থাকবে না। বুঝতে পেরেছিস পাগলী?’
-‘আপু তাই তো তোমাকে এত্তো এত্তো ভালোবাসি। আমার কাজে আমার কোনো মাথা ব্যথা নেই, সবকিছুই তুমি সহজ করে দাও। আচ্ছা আপু তোমার জন্য খুশির খবর আছে। আহান সেদিন এয়ারপোর্ট এ গিয়ে আবারও ধরা খেয়েছিলো। ওর সেদিন জামিন হয়নি ও জেল থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। এখন আবারও জেলে। তোমার ভাগ্য ভালো। কিন্তু এইবার শুনেছিলাম বড়ো বাবা না-কি তোমাকে এই কয়েকদিনের ভেতর দেশে আনবে আর বিয়েও দিয়ে দিবে একটা ভালো পাত্র দেখে। কারণ আহানের ক্ষমতারে সাথে বড়ো বাবারা কোনোদিন পেরে উঠবে না সে যেকোনো ভাবে আবারও জেল থেকে বের হবেই আর জেল থেকে বের হলে তো আবারও তোমার খোঁজ নিয়ে ফেলবে,তাই বড়ো বাবা তোমাকে নিয়ে আর কোনো রিস্ক নিতে চাচ্ছে না।’
মুন কী বলবে বুঝতে পারছে না। এতকিছু হয়ে গেল এই কয়দিনের ভেতর! সে ভাবেনি তাঁর বাবা এত্তো তাড়াতাড়ি আবারও বিয়ের প্রসঙ্গটা টানবে। মুন কোনোমতে বলে উঠলো,
-‘বি..বিয়ের কথা চলছে?’
-‘উহু, চলছে না। শুধু ভাবছে। এখনো কেউ জানে না, তোমার মত পাওয়ার পর বড়ো বাবারা সবকিছু ঠিক করবেন। তবে তোমাকে এর ভেতর বাংলাদেশে আনবে। যেভাবেই হোক তোমার বিয়েটা পড়িয়ে ফেলবে। তবে তোমার মত না থাকলে হবে না।’
আরিফার সাথে কথা বলা শেষ করে মুন বসে পড়লো। এক ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসতেই আবারও..! এই আহানটা মুনের জীবন অতিষ্ট অতিষ্ট করে দিয়েছে।
–
–
রাতে ডিনার করার উদ্দেশ্যে মুন নিচে নামল। কান্না করার ফলে মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে, চোখগুলো লাল আকার ধারণা করেছে। তবুও ফুফির জন্য খেতে নামল। আর কয়দিন-ই বা এখানে আছে মুন! এই কয়েকমাসে এই পরিবারটা মুনের অনেক আপন হয়ে গিয়েছিল। প্রচুর মিস করবে এনাদের।
প্রতিদিনের ন্যয় সবাই খেতে বসলো। আদ্রাফ ভাইয়া, শাফিন-অহনা, ফুফি-সবার দিকেই মুন একবার চোখে বুলিয়ে নিলো। এর মাঝেই ফুফি মুনের ব্যাপারে বলে উঠলো।
-‘মুন বাংলাদেশ চলে যাবে কয়েকদিনের ভেতর।’ ফুফি মলিন মুখে বলে উঠলো।
-‘কী বলো? কেন, কোনো সমস্যা হচ্ছে কী!’ফুফা খাওয়া ছেড়ে অবাক দৃষ্টিতে ফুফির দিকে তাকিয়ে বলল। শাফিন-অহনাও অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
-‘না, সমস্যা হচ্ছে না।’ ফুফি শুরু থেকে সবকিছু খুলে বলল। আর সব শুনে সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
আর এদিকে মুনের বিয়ের কথা শুনে আদ্রাফের চোখ-মুখ শক্ত আকার ধারণা করেছে। সে এক দৃষ্টিতে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। এক পর্যায়ে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। আদ্রাফের হঠাৎ উঠে যাওয়াতে উপস্থিত সবার দৃষ্টি ওর দিকে নিবদ্ধ হলো।
-‘আমি রুমে যাচ্ছি।’
-‘কিন্তু মাত্রই তো খেতে বসলি!’ ফুফি বলে উঠলো।
-‘খাওয়া শেষ।’ এই বলে সিঁড়ি বেয়ে চলে যাওয়ার আগে মুহূর্তে মুনের দিকে একফলক তাকিয়ে চলে গেল।
মুনও খাওয়া শেষ করে রুমে চলে আসলো। টেবিলে আছে আর অহনা-শাফিন আর মুনের ফুফি-ফুফা।
মুনের ফুফি সুমাইয়া আহমেদ খেতে খেতে তাঁর হাসব্যান্ড আদ্রাফের বাবার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
-‘আমি আদ্রাফের বিষয়ে ভাবছি। তুমি কী একমত হবে আমার প্রস্তাবে?’
-‘আগে বলো, শুনি।’ ফুফা উত্তরে বলল। অহনা-শাফিনরাও তাঁদের মা কী বলবে সেটা শোনার জন্য উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইল।
সুমাইয়া আহমেদের প্রস্তাবটা শুনে তাঁর হাসব্যান্ড খুশি হয়ে সম্মতি জানালো।
-‘কিন্তু আদ্রাফ কী রাজী হবে?’ মুনের ফুফা ভাবুক স্বরে বলল।
-‘আদ্রাফের ব্যাপারটা আমার উপর ছেড়ে দাও। আমি জানি আমার এই ছেলেটা আমার মতকে সস্নেহে গ্রহণ করবে। আর আমার বিশ্বাস ভাইজানও দ্বিমত করবে না।’
অহনা-শাফিনরাও সুমাইয়া আহমেদের কথা শুনে উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। প্রস্তাবটা শুনে সবার খুশিমনে সম্মতি দেখে সুমাইয়া আহমেদের মুখেও হাসি ফুটে উঠলো।
#চলবে ইনশাআল্লাহ।
(অনেকদিন পর ফিরে এলাম। কেমন হয়েছে জানাবেন আর ভুল-ভ্রান্তি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন দয়া করে।)