#একটু_একটু_ভালোবাসি
#পর্বঃ১৫
লেখিকাঃ #শাদিয়া_চৌধুরী_নোন
সাবিরের মা চলে যাওয়ার পরও সিরাত একইভাবে বসে রইলো। ঐ লোকটা সাথে নেই। হয়তো চলে গেছে। রেস্টুরেন্টে তেমন ভীড় নেই। কয়েকজন ওয়েটারের হাঁটা-চলার আওয়াজ আর ডিশের টুংটাং আওয়াজ ছাড়া কোনো শব্দ নেই। এমন একটা পরিবেশে কান্নারত সিরাতকে বড্ড বেমানান লাগলো। দূর থেকে সাবিরকে আসতে দেখে সিরাত তাড়াতাড়ি টিস্যু দিয়ে চোখের পানি মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। তার কানে সাবিরের মা আইভির কথা বাজছে। তিনি ভুল কিছু বলেননি।
সাবির পাশে এসে বসলেও সিরাত মাথা নিচু করে রইলো। সাবির ইতস্তত করছে। একবার টেবিলের উপর হাত রাখছে আরেকবার হাত নামিয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে। খানিকক্ষণ পর বসানো গলায় বললো,
—- আম্মু কোথায়?
সিরাত এবার মুখ তুলে সাবিরের চোখে সরাসরি তাকালো। চোখের পাপড়িগুলো এখানো ভেজা। ফোলা গালদুটোয় লাল লালনআভা।
—- উনি একটু কাজে গেছে। কোথায় বলে যাননি। কাজ শেষ হলে চলে আসবেন।
সাবির চমকে গেলো। নিজেদের দুরত্ব কমিয়ে হুড়মুড় করে সিরাতের পাশের চেয়ারে এসে বসলো সে। উত্তেজিত গলায় বললো,
—– তুমি কাঁদছো কেনো? কেউ কিছু বলেছে রাত?
সিরাত কিছু না বলে নিশ্চুপ নয়নে তাকিয়ে রইলো। এতে যেন সাবিরের উত্তেজনা আরও বেড়ে গেলো।
—- বলো কি হয়েছে?
সিরাত এবারও নিশ্চুপ থাকায় সাবিরের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো। দাঁড়িয়ে গলা স্বর উঁচু করে বলতে লাগলো,
—- ওকে কে কি করেছো বলো? কে টিজ করেছে? আমি ছাড়বো না কাউকে, সময় থাকতে বলে দাও। আমার সম্পর্কে আশা করি খুব ভালো ধারণা আছে সবার।
দূর থেকে ম্যানেজার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে এদিকে। সিরাত অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সামান্য একটা বিষয়ে সাবিরের এহেন আচরণ তাকে বিস্মিত করেছে।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সাবিরকে বললো,
—- এখানে আমার ভালো লাগছে না। বাইরে যাবো।
সাবির কঠোর কণ্ঠে বললো,
—- কি হয়েছে না জানা পর্যন্ত যাবো না।
—- কিছু হয়নি। বাইরে যাবো বলেছি না!
সাবিরকে কিছুটা অবাক হতে দেখা গেলো। সিরাত এই প্রথমবার বড় গলায় কিছু বললো। কথা না বাড়িয়ে সে সিরাতকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। পাশের পার্কে বসলো দু’জনে। দুপুরের কড়া রোদটা আস্তে আস্তে মিইয়ে আসছে। বড় বড় গাছের পাতার কারণে তারা নিজের দখলদারিত্ব বজায় রাখতে পারছে না। কয়েকটা শহুরে কাক বেসুরা গলায় ডাকতে ডাকতে ক্ষান্ত হয়ে চুপচাপ বসে আছে। সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো বেঞ্চে বেশ দূরত্ব রেখে বসে সাবির আর সিরাত। তাদের সামনে একটা ছোটখাটো পুকুর। মনোরম পরিবেশে দুজন মানব-মানবীর মস্তিষ্কে দু রকমের চিন্তা ভর করেছে। একজন সংকোচে আরেকজন অস্বস্তিতে। সাবির সামনে চোখ রেখে হুট করে বলে বসলো,
—- আমি কি সবকিছু তোমার উপর চাপিয়ে দিয়েছি রাত?
সিরাত প্রশ্নবোধক চোখে বললো,
—- মানে?
সাবির একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো,
—- এইযে, হুট করে তোমার সাথে পাগলামি করা, জড়িয়ে ধরা,হুটহাট তোমার সামনে হাজির হওয়া, ভালোবাসার কথা বলা সবকিছু। তারপর আমার মা তোমার বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া, তোমার মা-বাবার রাজি হয়ে যাওয়া, আর কয়েকদিন পর বিয়ে সবকিছু তোমার উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তাইনা? তুমি হুট করে এতকিছু সামলাতে পারছো না। ‘বিয়ে’ নামক একটা ভারী বিষয়, যা কয়েকদিন পর তোমার সাথে হতে যাচ্ছে তা তুমি মানতে পারছো না। এসব কিছু তোমাকে অনেক প্রেশার দেয় তাইনা রাত?
সিরাত কি বলবে খুঁজে পেলো না। সাবির যা বলেছে তার একটা অক্ষরও মিথ্যা নয়। তার মাথায় এলোনা, এইসব কথা সাবির কিভাবে জানতে পেরেছে। তার মন আর মস্তিষ্ক ভাবতে লাগলো, তার জীবনে আসলে নিজস্ব কোনো মতামত নেই। বিয়ের মতো এতো বড় একটা সিদ্ধান্তে কেউ তার মতামত চায়নি। শুধু বিয়ে না জীবনের কোনো সিদ্ধান্তই সে নিতে পারেনি। নিজের আবদ্ধ পৃথিবীতেই সে সীমাবদ্ধ। জীবনের এতোগুলো বছর পেরিয়ে গেলো অথচ সে এখনো সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে। আর পাচঁটা মেয়ের মতো সে না। যেখানে নিজের কোনো মতামত নেই সেখানে এই সম্পর্কটাকে জোড়ালো করার ইচ্ছেটাও কেন যেন মরে যাচ্ছে।
—– আমাকে কি বলবে বুঝতে পারছো না তাইনা?
সিরাত উপরনিচ মাথা নাড়লো। তারপর হুট করে কেঁদে দিলো। সাবির আরেকটু ঘনিষ্ঠ হয়ে সিরাতের হাতে হাত রাখলো,
—- জীবন এতো সহজ না রাত। আমি তোমাকে সম্মান করি। এইযে, এতোকিছুর পরও তুমি আমাকে হুট করে ভালোবাসছো না এজন্যও আমি তোমাকে ভালোবাসি। মেয়েদের এমনই হওয়া উচিত। অন্তত আজকাল যুগের মেয়েদের মতো অতি আপডেট না হওয়া, বোকাসোকা, মিষ্টি এই সিরাত নামের মেয়েটাকে আমি ভালোবাসি। এইদিক দিয়ে তুমি বেশ স্ট্রং একটা মেয়ে যে, যেকেউ হুট করেই তোমার মনে ভালোবাসা সৃষ্টি করতে পারবে না।
সিরাত ফুপাতে ফুপাতে বললো,
— তারমানে আপনি বলতে চাইছেন, আমি স্ট্রং?
— হুম, অবশ্যই তুমি স্ট্রং গার্ল। শুনো, নিজেকে নিয়ে কখনো হীনমন্যতায় ভুগবে না। মনে করবে নিজের সিদ্ধান্তই বেস্ট ডিসিশন। নিজের জীবন নিয়ে কক্ষনও আফসোস করবে না। মনেআমি তোমার পাশে সবসময় থাকতে চাই রাত। তুমি পরিপূর্ণ স্বাধীনতা পাবে। আমি কখনোই তোমাকে পিছু ডাকবো না। জীবনটা অনেক সুন্দর হবে, যদি তুমি তাকে উপভোগ করতে জানতে পারো। মা-বাবার প্রতি নিরাশ হয়ো না। একদিন তুমি নিজেই বলবে, তাদের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল না।
—- আপনি এতো ভালো কেনো?
—- কারণ তুমি ভালো তাই!
—- সত্যি আমি স্বাধীনতা পাবো?
—- পাবে। তবে তোমাকে নিজের কাছে রাখার দায়িত্বও আমার।
সিরাতের মন এখন অনেকটা হালকা লাগছে। একটু আগেও পরিস্থিতি এমন ছিল না। এখন মনে হচ্ছে, সবকিছু নির্মল, স্বচ্ছ, পরিষ্কার। আশেপাশের সবকিছু সুন্দর। সাবিরের হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত হলো। সিরাত অস্বস্তি লাগলো না। মুচকি হাসলো সে।
— আমাকে একটু সুযোগ দেবে রাত নিজেকে প্রমাণ করার?
#চলবে….