‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৩৭||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৫৫.
মৌমিতা: কি করছিলিস তুই অঙ্কিতের সাথে?
কোয়েল নিজের বেডে চুপচাপ বসে থাকলে আমি ওর পাশে বসে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম ওকে। কোয়েল কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছে সেটা বুঝলাম কিন্তু কি নিয়ে চিন্তা করছে এটা জানতে হবে। আমি যা আন্দাজ করছি সেটা ঠিক কি না ওর সাথে কথা বললেই বোঝা যাবে। কোয়েল আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
কোয়েল: আমার মনে হয় এইবার তোর সবটা জানা উচিত।
মৌমিতা: তোর আর অঙ্কিতের ব্যাপারে?
কোয়েল: (মৌমিতাকে ঝাড়ি মেরে) হাট! ঘোড়ার ডিম। আমার আর অঙ্কিতের ব্যাপারে কি হবে ছাই? 😒 ওর আর আমার মধ্যে কিছু নেই বন্ধুত্ব ছাড়া।
মৌমিতা: ভাগ্যিস নেই। নাহলে বেচারা রাজদার কি হতো বলতো। (মুখ টিপে হেসে)
কোয়েল: (আমতা আমতা করে) তুই কি বলতে চাইছিস হ্যাঁ?
মৌমিতা: আহাহা, উনি জানো কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। (মাথায় টোকা মেরে) তুই কি মনে করেছিস আমি তোর আর রাজদার বিহেভিয়ারে কিছু বুঝিনি? এতই বোকা নাকি আমি? হুহ! সব বুঝি আমি বুঝলি? (ভাও নিয়ে)
কোয়েল: হ্যাঁ, শুধু নিজেরটাই বোঝো না।
মৌমিতা: কাজের কথা বল বাড়তি কথা না বলে। (কথা ঘুরিয়ে)
কোয়েল: হয়ে গেলো ফুস। হাহ! শোন।
মৌমিতা: শোনার জন্যেই বসে আছি।
কোয়েল: হুঁ। আমি যেমন আন্দাজ করেছিলাম তোর আর আদিত্যদার মধ্যে কোনো একটা কানেকশন আছে তেমন অঙ্কিতও আন্দাজ করেছিল। যেদিন তোর পায়ে ব্যাথা লাগলো রণিতের থেকে পালাতে গিয়ে সেদিন তোকে আর আদিত্যদাকে অঙ্কিত দেখেছিল একসাথে। তখন ও’ও কিছু একটা সন্দেহ করে আর পরে আমাকে বলে।
মৌমিতা: তুই কি বলেছিলি?
কোয়েল: আমি এড়িয়ে গেছিলাম। কিন্তু পরে যখন রণিত তোকে প্রপোজ করলো আর আদিত্যদা ওরকম ভাবে রিয়াকট করলো তখন ও আবার আমায় এসে কঠোর ভাবে জিজ্ঞেস করে। সেদিন আর আমি কিছু লুকাইনি কারণ তখনও যদি লুকাতাম তাহলে প্রবলেম হতে পারতো, এটা তুইও জানিস ভালো ভাবে।
কোয়েলের কথাটা ঠিক। আদিত্যের ব্যবহারে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তাতে আমি যদি ভবিষ্যতে ওকে মেনেনি তাহলে সেটা খুব একটা আশ্চর্যের হবে না। তাই আমি কোয়েলের কথায় হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে সায় দিলে কোয়েল বলে,
কোয়েল: এছাড়া অঙ্কিতকে সবটা জানানোর সবচেয়ে বড় কারণ, ও তোকে ভালোবাসে।
কোয়েলের কথাটা শুনে আমি শুধু ওর দিকে তাকালাম আর বললাম,
মৌমিতা: তারপর?
কোয়েল: তারপর ও সবটা শুনে খুব একটা রিয়াকট না করলেও মনে মনে কষ্ট পেয়েছে এটা বুঝেছিলাম। সেদিনের পর থেকে হুট করেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ভয় হতো উল্টো পাল্টা কিছু করে বসবে না তো, এই ভেবে। তাই তোর প্রশ্নও এড়িয়ে যেতাম। আজকে হঠাৎ করেই আমি যখন ক্লাস থেকে বের হই তখন অঙ্কিতের মেসেজ আসে যেটায় বলা ছিলো আমি জানো লাইব্রেরির পাশে থাকা কমন রুমে ওয়েট করি।
মৌমিতা: এইবার বুঝলাম, তাই তুই তখন অভাবে চলে গেছিলি। কি কথা হলো অঙ্কিতের সাথে? কি বললো ও? ঠিক আছে তো?
ফ্ল্যাশব্যাক………………………
কোয়েল কমন রুমে ঢুকেই দেখলো অঙ্কিত চুপচাপ একটা বেঞ্চে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। এই কয়েকদিনেই মুখটা কেমন জানো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে এটা দেখে কোয়েলের খারাপ লাগলো। কোয়েল ধীর পায়ে এগিয়ে অঙ্কিতের কাঁধে হাত দিলে অঙ্কিত উঠে দাঁড়ায়।
কোয়েল: কি অবস্থা করেছো এটা নিজের?
অঙ্কিত: (তাচ্ছিল্য হেসে) ঠিকই আছি। তুই কেমন আছিস?
কোয়েল: ভালো। কোথায় ছিলে এতদিন?
অঙ্কিত: বাড়িতে গেছিলাম আবার কোথায় যাবো?
কোয়েল: তাহলে যোগাযোগ করোনি যে?
অঙ্কিত: (হেসে) নিজেকে সামলাতে চেয়েছিলাম, একা!
কোয়েল মাথা নামিয়ে নিলো পরিস্থিতি বুঝে। অঙ্কিত কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জিজ্ঞেস করলো,
অঙ্কিত: মৌকে বলে দিয়েছিস আমার ব্যাপারে?
কোয়েল: নাহ। ও জিজ্ঞেস করেছিল তোমার ব্যাপারে কিন্তু কিছু বলিনি।
অঙ্কিত: আচ্ছা।
অঙ্কিত চুপ করে বেঞ্চে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। কোয়েল কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না তাই ওখান থেকে সরে আসাটাই ঠিক মনে করলো। কিন্তু কোয়েল সরে আসতে গেলেই অঙ্কিত কোয়েলের গাত ধরে বাঁধ সাধে। কোয়েল অঙ্কিতের দিকে তাকালে অঙ্কিত নিচের দিকে তাকিয়েই বলে,
অঙ্কিত: আমার সাথে এমনটা না হলেই পারতো বল? (ভাঙা গলায়)
কোয়েল: কেউ কখনও আগে থেকে বুঝতে পারে না করে উপর তাদের অনুভূতি আসবে। তুমিও বুঝতে পারোনি এমন কি মৌ নিজেও বুঝতে পারছে না সে আদিত্যদাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার অনুভূতিটা এমনই অঙ্কিত। কেউ খুব জলদি বুঝে যায়, কেউ বুঝতেই পারে না আবার কেউ বুঝেও সেটাকে মানতে চায় না। অনেকে আবেগকে ভালোবাসা মনে করে আসল যাকে ভালোবাসে তাকে দূরে ঠেলে দেয় আবার অনেকে বিশ্বাস করতে পারে না যে তার অনুভূতি ভালোবাসা কারণ সে তো কাওকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। এটাই আদিত্যদার সাথে হয়েছে। আর মৌ? ও নিজেও জানে ও ভালোবাসে কিন্তু সেটা মানতে চাইছে না ওর প্রতি আদিত্যদার করা ভুলের জন্য।
অঙ্কিত: আমি তাদের দলে যারা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলে যে সে কাকে ভালোবাসে, তাই না? (হালকা হেসে)
কোয়েল: সত্যিই কি তাই অঙ্কিত?
কোয়েলের প্রশ্নটা কেন জানো অঙ্কিতের বুকে বিঁধলো। কোনো কিছু না বলেই সে চুপ করে রইলো।
কোয়েল: আমি তোমার অনুভূতিকে অপমান করছি না, আমি শুধু বলতে চাইছি তুমি সিওর? কারণ অনুভূতি বোঝাটা সহজ নয়। ভালোবাসা আর মোহের অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য করা আমার মতে পৃথিবীর সব থেকে কঠিন কাজ। আমরা বুঝতেই পারি না কে মোহ আর কে ভালোবাসা। তখন বুঝি যখন ভালোবাসার মানুষটি দূরে সরে যায় আর প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের তাকে মনে পড়ে। কিন্তু যার প্রতি মোহ ছিলো সে দূরে সরে গেলে অনেকদিন পর আমরা ঠিকই তাকে ভুলে যাই। তাই বলে কি একজন চলে গেলে অন্য একজনকে একসেপ্ট করলে আমরা ভালোবাসিনি? বেসেছি, কারণ দ্বিতীয় মানুষটা আমাদের মনে নিজেদের জন্য আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। যাকে আগে ভালোবেসেছিলাম তার জায়গাটা ঠিকই মনের কোণে রয়ে গেছে তাই হঠাৎ করে মনে পড়লেই একটা কষ্ট অনুভব হয়। কেন? কারণটা হলো, তাকে ভালোবেসেছি!
কোয়েল থামলে অঙ্কিত ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
অঙ্কিত: দূরে সরে যাওয়ার পর বুঝতে পারলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে তাই না?
কোয়েল: হ্যাঁ। ওই জন্যেই তো বললাম, সব থেকে কঠিন কাজ। বুঝে উঠতে না পারলে বা দেরী হয়ে গেলে সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে আর যারা বুঝে যাবে, তারাই ভাগ্যবান।
অঙ্কিত: কিন্তু বুঝবো কি করে?
কোয়েল: দুজন মানুষকে একসাথে ভালোবাসা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর আমি বলবো, হ্যাঁ যায়। কিন্তু একটু তফাৎ থাকবেই। কেউ একজন বিশ আর কেউ উনিশ। মোহ আর ভালোবাসাটা তোমার তখন ওরকমই মনে হবে তাই সেই সময় দুজনের থেকে দূরে সরে দেখো। একজন না একজনের কথা ঠিকই বেশি মনে পড়বে, তফাৎ টা খুবই নিখুঁত ও সামান্য হলেও তখন বুঝতে হবে। সাধে কি আর কঠিন কাজ? (হেসে)
অঙ্কিত: জানি না মৌয়ের প্রতি আমার অনুভূতির আসল নাম কি? যেদিন জানবো সেদিন তোকে ঠিক জানাবো।
কোয়েল: অপেক্ষায় রইলাম, নিজেকে সময় দাও এখন। সবটা খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।
অঙ্কিত: দিলাম তো সময়। এবার কোম্পানি লাগবে তোর।
কোয়েল: (হেসে) তাই হবে।
অঙ্কিত হালকা হেসে চুপ করে গেলে কোয়েল অঙ্কিতের কাঁধে হাত রাখে আর অঙ্কিত কোয়েলের দিকে ছলছল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কোয়েলকে জড়িয়ে ধরে। কোয়েল বাঁধা দিতে পারে না, আলতো ভাবে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় অঙ্কিতের।
কিছুক্ষণ পর কোয়েলকে ছেড়ে দিয়ে অঙ্কিত নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
অঙ্কিত: ক্লাবে যাবি?
কোয়েল: (কিছুক্ষন ভেবে) হোয়াই নট!
প্রেসেন্ট………..……………
কোয়েল: ক্লাবটা অঙ্কিতের দাদার। তোরা না আসলে ওই আমাকে পৌঁছে দিতো।
মৌমিতা: বুঝলাম, এই কথাগুলো রাজদাকে বলিস।
কোয়েল: (চুপ করে থেকে) বলবো তো ভাবছিলাম কিন্তু শুনলো আর কই? চলে গেলো অফিস। (মন খারাপ করে)
মৌমিতা: আবার দেখা যখন হবে তখন বলে দিস। তাহলেই তো হয়।
কোয়েল: আসলে, আসলে দোষটা আমারই।
মৌমিতা: কেন?
কোয়েল: ও আমাকে বলেছিল ভার্সিটিতে নিতে আসবে ছুটির সময় যেটা আমার মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গেছিলো। আমি ওকে জানায়নি একবারও যে আমি অঙ্কিতের সাথে আছি কিন্তু তাও তো তেমন কিছু বললো না আজকে। কি রকম একটা চুপচাপ ছিলো যেটা আমার কাছে খুব অস্বাভাবিক লেগেছে।
মৌমিতা: (হঠাৎ করে) কোনোভাবে তোকে আর অঙ্কিতকে কমন রুমে দেখে নেয়নি তো?
কোয়েল আমার কথা শুনে চমকে উঠলো আর তারপর ভাবতে লাগলো কিছু একটা।
কোয়েল: (মনে মনে– হতেই পারে মৌ যেটা বলছে সেটা ঠিক। আমি আসছি না এই দেখে ও ভার্সিটিতে ঢুকেছিলো নিশ্চই। আর ও তো জানে আমি লাইব্রেরি তে থাকি ভার্সিটি শেষ হওয়ার পর মাঝে মধ্যে, স্কুলেও থাকতাম। লাইব্রেরির পাশের রুমেই তো ছিলাম, কোনোভাবে দেখে নিয়ে ভুল বুঝলো না তো? হয়তো কথাগুলো শুনতে পায়নি আজকে না হোক আগামীকাল আমি ওকে জানাবো পুরো ঘটনাটা। আমি অঙ্কিতকে ভালোবাসি ভেবে না আবার দূরে সরে যায় ছেলেটা।)
মৌমিতা: এত ভাবিস না এখন। রাজদার সাথে দেখা হলে সবটা বলিস তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
কোয়েল: হম। আচ্ছা মৌ, তুই এতটা স্বাভাবিক কীভাবে? দেখে মনে হচ্ছে জানতিস সবটা।
মৌমিতা: সিওর জানতাম না, আন্দাজ করেছিলাম পুরো বিষয়টা। অঙ্কিতের বিহেভিয়ারে আন্দাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম।
কোয়েল: সেই, সবার বিহেভিয়ার দেখে তুমি বুঝে যাও তোমার প্রতি কার কেমন ফিলিংস শুধু নিজের বরেরটা বোঝো না।
মৃদু হাসলাম কোয়েলের কথাটা শুনে। কোয়েল আবার প্রশ্ন করলো,
কোয়েল: সত্যি বল তো, তুই কি সত্যি বুঝিস না আদিত্যদা তোকে ভালোবাসে?
মৌমিতা: বুঝি তো।
কোয়েল: তাহলে?
মৌমিতা: ওনার আগের ব্যবহারগুলো মনে পড়লে মনে হয় উনি হয়তো বদলে যেতে পারেন আবার। কারণ ফুলশয্যার রাতে করা ব্যবহার আর ভার্সিটিতে আসার পরে ব্যবহারে আকাশপাতাল তফাৎ। এই ভালো ব্যবহারটা যে সাময়িক নয় কে বলতে পারে? আমি শুধু ওনার অনুভূতিটা কতটা সত্যি সেটাই যাচাই করছি। সত্যিকারের ভালোবাসলে কোনোদিন হার মানবেন না।
কোয়েল: এটা তো আদিত্যদার কথা। তুই ভালোবাসিস না?
মৌমিতা: (হালকা হেসে উঠে দাঁড়িয়ে) বিয়ের প্রথম দিন থেকেই ওনার জন্য আমার মনে জায়গাটা তৈরী হয়েছিল। ভার্সিটিতে এসে ওনাকে জিয়ার সাথে দেখার পর সেটা আরো বেশি মজবুত হয়েছে। যত মনকে বুঝিয়েছি ওনার থেকে দূরে থাকবো তত বেশি জড়িয়ে পড়েছি। প্রথমে ভেঙে পড়েছিলাম ওনাকে জিয়াকে “আই লাভ ইউ” বলতে শুনে। তখন ঠিক করেছিলাম কোনোভাবেই আর ওনাকে নিয়ে ভাববো না। তাই তো সব সময় নিজেকে বোঝাতাম আমি ওনাকে ভালোবাসি না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই জানতাম যে আমি ওনাকে ভালোবাসি তাই তো জিয়াকে মানতে পারিনা ওনার পাশে ঠিক যেমন উনি এখন কাওকে মানতে পারেন না আমার পাশে অন্য কাউকে। ভালোবাসি দেখেই ওনার সাথে কথা বলি, ভালো না বাসলে এড়িয়ে যেতাম।
কোয়েল হুট করে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,
কোয়েল: ইয়ে! কি মজা। দুজনেই বুঝে গেছে এবার শুধু প্রকাশ করার অপেক্ষা। হুরররে!
আমিও হেসে দিলাম কোয়েলের সাথে। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়ে যে যার মতো বই নিয়ে বসলাম।
[#ফিরে_আসবো_আগামী_পর্বে 🥀]
আইডি- কোয়েল ব্যানার্জী