#এক্কা_দোক্কা – ২২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
কাঠের চেয়ারে বেঁধে রাখা হয়েছে ঐশীকে। একটু আগে অনবরত ছটফট করছিল যে মেয়ে, সে এখন চুপটি করে বসে আছে। নড়াচড়া অব্দি করছে না। তার ঝাপসা চোখের সামনে ভাসছে, তার করা সেই রাতের ভয়ংকর খুনের দৃশ্য! ঐশী ভেবে পাচ্ছে না, অনল কি করে এসব প্রমাণ জোগাড় করল। যেখানে ঐশীর চালে এ দেশের পুলিশ অব্দি নাস্তানাবুদ। ঐশীর মুখ ধীরেধীরে কঠিন হলো। সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করলো ঐশী,
-” কি চাই তোমার, অনল? ”
অনল মুচকি হাসল। ঐশীর ঠিক সামনে চেয়ার টেনে বসে গা ছাড়া ভাবে বললো,
-” আপাতত একটাই চাওয়া আমার। ”
অনল মুখ এগিয়ে আনলো ঐশীর দিকে। ঐশী তখন স্বাভাবিক চোখে চেয়ে। অনল ফিসফিসিয়ে বললো,
-” তোমার খুনের সাথী হতে চাই। সাহায্য করতে চাই তোমায়, ওদের মেরে ফেলতে। ”
-” এতে তোমার লাভ? ”
-” লাভ তো একটা আছে। তবে এখন বলবো না। সময় যাক, তারপর তুমি নিজেই জেনে যাবে। তো বলো, ডিলে রাজি? ”
ঐশী কিছুক্ষণ ভাবল। রাজি হবে সে। যদি কখনো অনল ওর সাথে বেইমানি করে তবে অনলকেও সে খুন করতে দুবার ভাববে না। ঐশী ভ্রু কুঁচকে বললো,
-” আমি রাজি। ”
-” বাহ, বাহ। এই তো সোজা পথে এলে। দাড়াও তোমায় ছেড়ে দিচ্ছি। বাসায় গিয়ে আরামে একটা ঘুম দাও। কাল দেখা হচ্ছে। ”
অনল ঐশীর দড়ি ছুরি দিয়ে কেটে ফেলল। ঐশী দুবার হাত ঝাড়া দিল। হাতটা বড্ড ব্যথা করছে। দাগ পড়ে গেছে হাতে।
অনল ঐশীকে বাসায় যাওয়ার জন্যে পথ দেখালে ঐশী আটকে যায়। অনলের দিকে চেয়ে রহস্যভরা হাসি হেসে বলে,
-” মানুষের রক্তের ঘ্রাণ শুকবে, অনল? দারুন ঘ্রাণ। স্বাদটা আরো দুর্দান্ত। যাবে নাকি, কারো খুন করতে? ”
ঐশী এমনভাবে কথা বলছে যেন খুন করা ঐশীর নিত্যকার কাজ। অনল প্রথমে কিছুটা অবাক হলো। পরক্ষনেই হেসে বললো,
-” আজ-ই? ”
-” জুভান স্যার বাসায় নেই। বাসায় ফিরতে তার রাত হবে। আর খবর পেয়েছি, সাজ্জাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হসপিটাকে ভর্তি হয়েছে। তাই এখনি মুক্ষোম চালটা চেলে নিতে হবে। যাবে তুমি? ”
অনল আর একমুহূর্ত ভাবলো না। বললো,
-” অবশ্যই! ”
ঐশী আর অনল একসাথে হেসে উঠল।
_____________________________
-” তুমি সিওর তো ঐশী? এই ফাঁকা সিরিঞ্জ দিয়েই কাজ হয়ে যাবে? ”
ঐশী হাতে গ্লাভস পড়তে পড়তে বললো,
-” ছেলে হয়েও তোমার এত চিন্তা কিসের? দাও, সিরিঞ্জটা দাও হাতে। ”
অনল সিরিঞ্জ হাতে দিল ঐশীর। ঐশীর গায়ে নার্সের পোশাক। মুখে সবুজ মাস্ক। ঐশী মেডিসিনের ট্রে নিয়ে আইসিইউ রুমের দিকে চললো।
আইসিইউ রুমে এই মুহূর্তে প্রচুর ভিড়। সবাই সাজ্জাদকে দেখতে চাইছে। কিন্তু সাজ্জাদের সিকিউরিটির জন্যে শুধুমাত্র ডাক্তার আর নার্স ব্যতীত কাউকেই কক্ষে প্রবেশ করানো হচ্ছে না।
ঐশী মুখের মাস্কটা আরো একটু শক্তপোক্ত করে নিল।
অতঃপর সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ঐশী আইসিইউ রুমে প্রবেশ করলো। সাজ্জাদ হোসেনের সজাগ আছেন। ঐশী তার মাথার কাছে সুন্দর একটা গোলাপ ফুলের তোড়া রাখলো। সাজ্জাদ হোসেনের কানেকানে বললো,
-” তোদের জম এসে গেছে রে সাজ্জাদ। হরিপুর গ্রামের সেই এগারো বছরের মেয়ে এসে গেছে রে। ”
সাজ্জাদ হোসেন চকিতে তাকালেন ঐশীর দিকে। ঐশী মুখের মাস্ক খুলে ফেললো। জুভানের স্ত্রী ঐশীকে চিনতে সাজ্জাদের একটুও বিলম্ব হলো না। সাজ্জাদ হোসেন আঙ্গুল উঁচু করে ঐশীর উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাইলেন। কিন্তু পারলেন না। মুখ দিয়ে গুঙিয়ে যাচ্ছেন। একটুখানি বাঁচার আশায় রুমের বাইরে থাকা নিজের লোকদেরকে ডাকতে চাইলেন। তবে মুখে অক্সিজেন মাস্ক থাকায় পারলেন না। ঐশী সাজ্জাদ হোসেনের এমন ছটফটানি দেখে সুখ পেল খুব। কানের কাছে মুখ এনে বিড়বিড় করে বললো,
-” হ্যাপি জার্নি, সাজ্জাদ হোসেন। ”
সাজ্জাদের ছটফটানি দ্বিগুণ হলো। অতঃপর ঐশী সাজ্জাদের সেলাইন লাগানো সেই ক্যানুলার খুলে নিল। ক্যানুলার জন্যে যে ছিদ্র করা হয়েছিল, সেই জায়গা দিয়ে ফাঁকা সিরিঞ্জের সবটুকু গ্যাস পুশ করে দিল। সাজ্জাদ হোসেন গুঙিয়ে যাচ্ছেন। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। বুঝতে পারছেন, তার সময় গনিয়ে এসেছে। তার চোখ আস্তে আস্তে নিভে আসছে। কাজ শেষ করে ঐশী পুনরায় মাস্ক পড়ে আইসিইউ থেকে চলে এল।
ঐশী বেরুনোর দশ মিনিট পর আইসিইউ রুমে একপ্রকার হইচই লেগে গেল।সাজ্জাদ হোসেন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, মুহূর্তেই খবরটা পুরো দেশে ছড়িয়ে গেল। আমজাদ হোসেনের কানে কথাটা যেতেই তিনি হসপিটালে এসে একপ্রকার যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিলেন। সাজ্জাদ হোসেন আমজাদ এর ডান হাত। ডক্টর সাজ্জাদের মৃত্যুকে ন্যাচারাল ডেথ বললেও, তিনি জানেন এটা মোটেও ন্যাচারাল কোনো মৃত্যু না। সে ফিরে এসেছে। ১১ বছর আগে করা সেই অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতে সে আবার ফিরে এসেছে!
অনল আর ঐশী এই মুহূর্তে হসপিটালের একটা ফাঁকা স্থানে দাড়িয়ে আছে। সাজ্জাদ হোসেন মরার বিষয়টা এখনো অনলের বোধগম্য হচ্ছে না। অনল মাথা চুলকে জিজ্ঞেস করলো ঐশীকে,
-” কেইসটা কি হলো, ঐশী? ”
-” কি আবার হবে? সাজ্জাদ মারা গেল! আমি মেরে ফেললাম তাকে। ”
-” কিন্তু কিভাবে? তুমি তো গেলে আর আসলে। ”
-” সিম্পল। আমার হাতের যে সিরিঞ্জটা ছিল সেটা ৫ মিমি। একটা ৫ মিমির ফাঁকা বাতাস ভর্তি সিরিঞ্জ আমি সাজ্জাদের রক্তবাহী শিরার মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করিয়েছি। সাধারণত শিরা শুধুমাত্র লিকুইড পরিবহন করে হার্ট অব্দি পৌঁছায়। কিন্তু এখানে এক সিরিঞ্জ বাতাস প্রবেশ করানোর ফলে শিরা রক্তের লিকুইড এর পরিবর্তে বাতাস হার্টের আর্টারিতে পরিবহন করেছে। রক্তের অভাবে হার্ট এর আর্টারি বাতাস কর্তৃক ব্লক হয়ে গেছে। তারপর সাজ্জাদ হোসেন খতম! হা হা হা। ”
অনল বিস্মিত! এই থিওরিটা সে বইয়ে পড়েছে। কিন্তু কখনো ভাবেনি এই থিওরি দিয়ে কাউকে খুন করা যায়। অনল জিজ্ঞেস করলো
-” কেউ যদি তোমায় সাজ্জাদের খুনের মামলায় ধরে ফেলে, তখন? ”
-” পারবে না। কারণ সাজ্জাদ আগে থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে হসপিটাল ভর্তি হয়েছে। তাই এখন সবাই এই খুনকে ন্যাচারাল ডেথ হিসেবেই নেবে। ”
অনল ঠোঁট উল্টে বললো,
-” তুমি খুব বুদ্ধিমান, ঐশী। ”
ঐশী হাসলো, তথাপি কিছু বললো না।
_______________________________
বাসায় এসে গোসল করে ঐশী এখন বেশ শান্তি অনুভব করছে। দুপুরের ঔষুধ এখনো খাওয়া হয়নি। ঐশী ড্রয়ার খুলে ঔষুধ বের করলো। ঐশীর খাওয়া সিরাপের পাশে আরো একটা সিরাপ ছিল। সিরাপের গায়ে সুন্দর করে লেখা, ব্যথানাশক সিরাপ। ঐশীর মাথাটা খুব ধরেছিল। তাই ঐশী কোনোরূপ বিচার না করে সিরাপটা দু চামচ খেয়ে নিল।
প্রতিবার খুন করে আসার পর ঐশী নামাজ আদায় করে। তাই এবারও নামাজ পড়তে বসল। মাগরিবের নামাজ শেষ করতেই ঐশীর মাথাটা কেমন যেন করে উঠল। ঐশী দুহাতে মাথাটা চেপে ধরে কিছুক্ষণ জায়নামাজে বসে রইল। মনের মধ্যে কিছু নিষিদ্ধ অনুভূতি কাজ করছে। ঐশী খুব বিচক্ষণ থাকায় চট করে বুঝে ফেললে,তার শরীর ঠিক লাগছে না। ভেতরের নিষিদ্ধ ইচ্ছাগুলো ক্রমশ বাড়ছে। ঐশীর মন এখন, একটা পুরুষকে খুঁজে চলছে। ঐশী বুঝতে পারছে, তার দ্বারা আজ একটা অঘটন তো ঘটবেই নিশ্চিত। তার আগেই ঐশীকে ঘুমিয়ে পড়া উচিৎ। ঐশী বিছানায় গা এলাতেই বোধ হল, সে আর নিজের মধ্যে নেই। এই মুহূর্তে একটা পুরুষ তার চাই। কি করবে, ভেবে পেল না ঐশী। কান্না এল চোখের কোল চাপিয়ে। নিজের মধ্যে অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলো।
-“ঐশী, চলো আজ একসাথে চা খেতে খেতে গল্প করি। ”
জুভান কথা বলতে বলতে ঐশীর রুমে এল। তার হাতে চায়ের দু কাপ। জুভান ঐশীকে মাথা চেপে বসে থাকতে দেখে চায়ের কাপ দুটো টেবিলে রেখে হন্তদন্ত হয়ে ঐশীর পাশে এসে বসলো। ঐশীর কাধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল,
-” কি হয়েছে, ঐশী? আর ইউ ওকে? এমন করছ কেন, তুমি? ”
ঐশীর দু চোখে কামনা। ঐশী ধাক্কা দিয়ে জুভানকে নিজের থেকে সরিয়ে ফেলল। জুভান মাটিতে পড়ে গেল। পায়ে হালকা ব্যথা পেল। তবে সেই ব্যথাটুকু এড়িয়ে গিয়ে সে বিস্ময় নিয়ে বললো,
-” হোয়াট দ্য হেল, ধাক্কা দিলে কেন?কি হয়েছে তোমার, ঐশী? ”
ঐশী চিৎকার করে বলল,
-” সরে যান আমার থেকে। আমি ঠিক নেই এখন। চলে যান, রুম থেকে। চলে যান বলছি। ”
ঐশী কান্না করছে দেখে জুভান আগের ন্যায় বসলো ঐশীর পাশে। এবারেও ঐশী জুভানকে ধাক্কা দিতে চাইলে, জুভান ঐশীর দু হাত পেছনে নিয়ে আটকে দিল। ছটফটে ঐশীর চোখে চোখ রেখে নরম কণ্ঠে বলল,
-“একদম নড়াচড়া করবে না। যা জিজ্ঞেস করছি, তার উত্তর দাও। তোমার কি হয়েছে, ঐশী? আমায় বলো। তুমি অসুস্থ বোধ করছ? ”
জুভানের নরম কণ্ঠে ঐশী হার মানলো। আচমকা জুভানের গলার দিকে ঝুঁকে এসে ঠোঁট বসালো জুভানের কণ্ঠনালির বাহিরের ত্বকে। জুভানের সম্পূর্ণ দেহ যেন মুহূর্তেই কাপুনি দিয়ে উঠল। হতবম্ব চোখে তাকালো সে ঐশীর দিকে। দুহাতে ঐশীকে দূরে সরাতে চাইল। সে চায়না, অসুস্থতার রেশ ধরে ঐশী কোনো ভুল করে বসুক। জুভানের জন্যে ঐশী কখনো পস্তাক, সেটা জুভান কখন চাইবে না।
ঐশীকে সরিয়ে দিতেই, জুভানের আরো কাছে ঘেঁষে এল ঐশী। জুভানের গলায় মুখ গুঁজে বললো,
-” আপনাকে আমার চাই এখন, এই মুহূর্তে। দেবেন না আমায়? দিয়ে দিন না এই ‘আপনি’ টাকে। প্লিজ? ”
ঐশীর কণ্ঠে কাতর। জুভান যা বোঝার বুঝে ফেলল। ঐশী যৌন উত্তেজক সিরাপ খেয়েছে। কিন্তু, সেই সিরাপ ঐশীর হাতে এল কিভাবে? জুভান মাথায় হাত দিল। এখন কি হবে? আজ রাতে ঐশীকে সামলানো জুভানের পক্ষে মুশকিল হয়ে যাবে। ঐশীর এবার জুভানের গলায় কামড় বসালো। আচমকা আক্রমনে জুভান ব্যথায় অস্ফুটসুরে গুঙিয়ে উঠলো। হুট করে সে তার সমস্ত নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেললো। মনের কাছে হেরে গেল কঠিন বিবেক। জুভান ঐশীর চেপে ধরলো নিজের সাথে। ঐশীর কাতর চোখে চোখ রেখে বললো,
-” ঘুমন্ত বাঘকে জাগিয়ে দিয়েছ। এখন জীবন্ত বাঘকে সামলাতে পারবে তো, ঐশী? ”
ঐশীর জুভানের কথা শোনার ইচ্ছে নেই। সে দুহাতে গলা জড়িয়ে ধরলো জুভানের। অবশেষে জুভান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐশীকে আলতো হাতে শুইয়ে দিল বিছানায়।
কাছে আসার এক পর্যায়ে জুভান ফিসফিসিয়ে বললো,
-” তোমায় আমি ভালোবাসি, ঐশী। আজ আমাদের এই কাছে আসা তোমার কাছে নিছক ভুল হলেও, আমার কাছে আজকের এই রাত সারাজীবন স্মরণীয় থাকবে। তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলেও আমি আজকের পর কখনো তোমায় নিজের থেকে আলাদা হতে দেবো না। আজকের পর তুমি আমার অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছ। আর জুভান কখনো তার ব্যক্তিগত মানুষকে নিজের হাত ছাড়া করে না! ”
সুখের রাজ্যের ঘুরে বেড়ানো ক্লান্ত ঐশীও তখন মিনমিনিয়ে মনের মধ্যে চেপে থাকা কথাটা বলেই ফেলল,
-” আমিও ভালোবাসি আপনাকে, রকস্টার সাহেব। ”
জুভান রাজ্যজয় করা হাসি হাসলো। অতঃপর পুনরায় মত্ত হয়ে গেল প্রিয়তমাতে। জুভান জানে ঐশী সব ভুলে যাবে! কিন্তু জুভান কি আদৌ আজকের রাতটা কখনো ভুলতে পারবে?
#চলবে
যদি বলি, গল্পটা শেষের পথে?
লেখিকার গ্রুপ,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri