#এক্কা_দোক্কা – ৯
আভা ইসলাম রাত্রি
হলরুমে ভালোই হট্টগোল চলছে। হট্টগোলের মূল বিষয়বস্তু হলো, জুভান ও ঐশীর বৌভাত। জুভান শুরু থেকে এই নিয়ে অনীহা দেখিয়ে আসছে। তার ভাষ্যমতে, ‘ বিয়েটা যেখানে সাজানো এক নাটক, সেখানে এই অনুষ্ঠানগুলো নিছকই গুরুত্বহীন। ‘ তবে জুভানের এই বারণ শোনার মত তার বাড়িতে কেউই নেই। জুভানের মামা, আমজাদ হোসেন বড় সোফাটা দখল করে বসেছেন। তার চোখেমুখে রাজ্যের আত্মবিশ্বাস। বোনের ছেলে কখনোই তার আদেশ ফেলবে না, তা ভেবেই তিনি মনেমনে আত্মিক সুখ পাচ্ছেন। জুভান নিজ কক্ষে বসে গান গাইছিল। আমজাদ হোসেনের নির্দেশে পুষ্পিতা জুভানকে ধরেবেধে হলরুমে নিয়ে এসেছে। জোরজবরদস্তিতে জুভানের মুখখানা তেতো হয়ে আছে। মনে হচ্ছে কেউ তার গলা টিপে ধরে তার মুখের রক্ত শুকিয়ে নিয়েছে। জুভান বেশ বিরক্ত হয়ে মামার পাশে বসল। শ্লেষপূর্ণ কণ্ঠে বলল,
-” এসবের কি দরকার, মামা? খামোকা এই অনুষ্ঠান করবো, আর মিডিয়া জানাজানি হবে। এই বিয়ে নিয়ে আমি কোনোপ্রকার মিডিয়া-চর্চা চাইছি না, মামা। ”
আমজাদ হোসেন হাসিহাসি ভাব বর্জন করে মুখে গম্ভীর ভাব টানলেন। বললেন,
-” তোর মিডিয়া নিয়ে আমি কোনো কথা শুনতে চাইছি না। আর আমারও তো একটা সম্মান আছে। ভাগনা বিয়ে করিয়েছি, অথচ কোনো জাকজমক কিছুই হয়নি। বিয়েটা তোর মত সাদামাটা করেছিস কিন্তু বৌভাতটা আমার মত সুন্দর হতে হবে। ”
-” কিন্তু…”
-” স্টপ আরগুয়িং, জুভান। ”
জুভান থেমে গেল। মামার মুখের উপর কখনো তর্ক করে না সে। এই ‘না’ শব্দটার মধ্যে কোনো ভয় নেই, বরং আছে অজস্র শ্রদ্ধা! জুভান কখনো কাউকে ভয় পায়না, তবে সে একজনের কথা কখনো ফেলতে পারে না। আর সেই একজন হলো জুভানের মামা আমজাদ হোসেন। তাই এবারেও জুভান কোনোরূপ বাক্য ক্ষয় না করেই মামার কথায় রাজি হয়ে গেল।
অতঃপর বহু বাক-বিতন্ডা, মত পরিবর্তনের পর সিদ্ধান্ত হলো আগামীকাল বৌভাত অনুষ্ঠিত হবে। এবার আমজাদ হোসেন সরাসরি বলেছেন, বৌভাতের দিন সকল মিডিয়া উপস্থিত থাকবে। জুভান সবার সাথে নিজের স্ত্রী ঐশী খন্দকারকে পরিচয় করিয়ে দেবে। মামার সিদ্ধান্ত শুনে জুভানের চোখ কপালে স্পর্শ করল। সে কঠোরভাবে মানা করল এ বিষয়ে। কিন্তু আমজাদ হোসেন তার কথা আদেশস্বরূপ জুভানের উপর চাপিয়ে দিয়ে হলরুম ছেড়ে চলে গেলেন। রাগে জুভান রীতিমত কাঁপছে। ফর্সা নাকের ডগা রাগের ভাবমূর্তি স্বরূপ রক্তিম হয়ে গেছে। মামা কি করে এমন ফুলিশ একটা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন? সে বিশ্বাস করতে পারছে না, মামা এরূপ একটা সিদ্ধান্ত তার সাথে পরামর্শ না করে হুট করে নিয়ে নিতে পারলেন। জুভান রাগে জ্বলে উঠলো। সোফায় পা কর্তৃক লাথি দিয়ে হনহনিয়ে নিজের কক্ষে চলে এলো। ভারী লেদারের সোফাটা জুভানের লাথির তালে স্থানচ্যুত হয়েছে। জুভানের বন্ধুরা সব ফ্যালফ্যাল চোখে স্থানচ্যুত সোফার দিকে চেয়ে আছে।
_________________________
নিচে এতক্ষণ কি কথা হচ্ছিল, তার সবই ঐশী শুনেছে। জুভানকে উপরে উঠতে দেখে ঐশী তাড়াহুড়ো করে নিজ কক্ষে চলে গেল। কক্ষে ঐশীকে বিছানা ঠিক করতে দেখে জুভানের রাগ হুরহুর করে বেড়ে গেল। সে পেছন থেকে খচখচ কণ্ঠে বলল,
-” মামা সম্পূর্ণ মিডিয়াকে জানিয়ে আমাদের বৌভাত করতে চাইছেন! ”
ঐশী বিছানা ঝাঁট দিয়ে মৃদু হেসে বললো
-” ভালো তো। ”
‘ভালো তো’ কথাটা শুনে জুভানের মাথা গরম হয়ে গেল। ঐশীকে প্রথম থেকেই সে বলে এসেছে, তাদের বিয়ের ব্যাপারে যেন মিডিয়া না জানে। অথচ আজ তার কথাশুনে মনে হচ্ছে, সে জুভানের কথা বেমালুম ভুলে বসে আছে। জুভান ঐশীর হাত টেনে ধরলো। ঐশীকে নিজের দিকে ফিরিয়ে দাত খিচিয়ে বলল,
-” আমার কথা কি ভুলে গেছ? আমি বলেছিলাম তোমায়, আমাদের বিয়ের ব্যাপারে যেন মিডিয়া না জানে। অথচ তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে, পারলে এখুনি নাচতে নাচতে মিডিয়ার সামনে গিয়ে সব বলে দিতে পারলে তোমার শান্তি হবে। ”
ঐশী হাসল। সেই হাসি দেখে জুভান জ্বলে পুড়ে গেল। ঐশী নিজের কোমল হাতখানা জুভানের থেকে ছাড়িয়ে নিল। জুভানের শক্ত হাতের স্পর্শে ঐশীর হাতে কালশিটে হয়ে গেছে। ঐশী সহাস্যে বলল,
-” ডোন্ট ডেয়ার টু টাচ মি। আপনার মামা, আপনার প্রবলেম। আমি কি তাকে বলেছি, আপনি আমাদের বিয়ের বিষয় মিডিয়াকে জানান? তিনি নিজে যেচে সবাইকে জানাতে চাইছেন, সেখানে আমি কি করতে পারি। আপনার পছন্দ না হলে আপনি গিয়ে তাকে বলুন। খামোকা আমার শরীরে দাগ বসাচ্ছেন কেন? ”
এতক্ষণে জুভানের হুশ এলো। রাগের মাথায় সে ঐশীর হাতে আঘাত করে বসেছে, ভাবতেই অপরাধবোধে ডুবে যেতে লাগল। ঐশী হাত ঝাড়ছে, হয়তো ব্যথা করছে তার। জুভান আর কথা বলল না। খামোকা এতক্ষণ ঐশীর সঙ্গে রাগারাগী করল। উফ, কেনো যে সে নিজের রাগ কন্ট্রোল করতে পারে না? একদিন নিশ্চয়ই সে এই রাগের কারণে অনেক বড় কিছু হারাবে। জুভান হেঁটে ড্রয়ার থেকে ফার্স্ট এইড বক্স এনে ঐশীর হাতে ধরিয়ে দিল। বললো,
-” মলম লাগিয়ে নিও। নাহলে ইনফেকশন হয়ে যাবে। ”
ঐশীর ভ্রু কুঁচকে এলো। এতক্ষণ তো রাগে তোতলাচ্ছিল। এখন আবার কি করে এত ভালো হয়ে গেল? জুভান হয়তো কিছু বলতে চাচ্ছে। কিসের যেন একটা সংকোচ তার মুখে বিদ্যমান। ঐশী ভ্রু বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” কিছু বলবেন? ”
জুভান স্থির চোখে ঐশীর আঘাতপ্রাপ্ত হাতের দিকে চেয়ে। হঠাৎ জুভান গম্ভীর সুরে বলল,
-” আ’ম সরি ফর এভরিথিং। আমার এভাবে রেগে যাওয়া উচিত হয়নি। ”
ঐশী হাসল। বললো,
-” একটা কথা কি জানেন, রাগ হলো এ সংসারের সবচেয়ে নিকৃষ্ট এক অনুভূতি। এ অনুভূতি নিমিষেই একটা ভালো থেকে ভালো সম্পর্ক জ্বালিয়ে খা খা করে দিতে পারে। সাবধানে থাকবেন। আপনার রাগ সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ” ঐশী কথাটা বলে আর একমুহুর্ত দাঁড়ালো না। ফার্স্ট এইড বক্স বিছানার উপর ফেলে দিয়ে বেরিয়ে গেল কক্ষ ছেড়ে। জুভান নিস্পলক চোখে চেয়ে রইলো মাটিতে। এমন করে জুভানের দোষ কেউ কখনো ধরিয়ে দেয়নি। সবাই সবসময় ভয় পেয়ে এসেছে জুভানকে। জুভানের রাগ থেকে সবাই পালিয়ে বেড়ায়। আজ অন্তত কেউ জুভানের রাগকে ভয় পাইনি। বরং তার শান্তকথার বাণী দ্বারা জুভানের রাগকে শীতল করে দিয়েছে।
#চলবে
যারা পড়বেন, রেসপন্স করবেন। আর হ্যাঁ গঠনমুলক কমেন্ট করবেন। এতে লেখার আগ্রহ শ’গুন বেড়ে যায়।
লেখিকার পাঠকমহল,
আভার পাঠকঘর📚-stories of Ava Islam Ratri