#এক_পশলা_বৃষ্টি_আর_সে
লেখনিতে: চৈত্র রায়
পর্ব___০৪
,
,
০৭
,
,
বিকেলে একদিন ছাদে দাড়িয়ে রাস্থার মানুষ জন দেখছিলাম…… দূর থেকেই দুজন মহিলা কে দেখে খুব পরিচিত মনে হলো……… একটু কাছে আসতেই চিনতে পারলাম এযে শাম্মি আর আন্টি….. এক দৌড়ে রুমে এসে চুলটুল আঁচড়ে ফিটফাট…… চোখে কাজল টানতে টানতেই বুঝতে পারলাম সুফিয়া খালা দরজা খুলে দিয়েছেন…… ছুটির দিন হওয়ায় মা সেদিন বাসায় ই ছিলেন…….. বাবা বেড়িয়েছিলেন কি একটা কাজে যেনো…… বরাবরের মতোই শাম্মি রুমে এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলো…… এমন একটা ভাব ধরেছি যেনো তাকে দেখে খুব অবাক হয়েছি আমি…… আন্টি ডেকে আমাকে তার পাশে বসালেন……. ব্যাপার টা তে কেমন একটা বউ শ্বাশুড়ি গন্ধ পাচ্ছিলাম……. আমাকে অবাক করে আন্টি মাকে বলতে শুরু করলেন….
,
,
,
——— আপা শাম্মি আর তুলিকে আমি কোনদিন আলাদা ভাবে দেখি নাই
,
,
কথাটা শুনেই আমি চাতক পাখির মতন বসে আছি…..অবশেষে আমার ভাবনা আমার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে
,
,
——— তুলিকে আমার খুব পছন্দ আপা…… আমার বড় ভায়ের ছেলের জন্য তুলিকে নিয়ে যেতে যাই……ছেলে খুব ভালো আপা…. এক্সপার্ট ইমপোর্ট এর বিজনেস…. চার পাঁচটা দেশতো ঘুরেও এসেছে……
,
,
——— তুলির বাবা আসুক….. কথা বলি….. তাছাড়া আমাদের কোন তাড়াহুড়ো নেই আপা…. মেয়ে পড়ছে পড়তে থাকুক….. তা শাম্মির জন্য দেখবো নাকি পাত্র কি বলেন আপা!!!
,
,
——— সে আর বলতে আপা….. অবশ্যই দেখবেন….. তবে এবছর আর ধরবো না….. বিয়ে কতো ঝামেলা আগে একটা শেষ করি…… ও আপা যার জন্য আসা…… শিমুলের বিয়ে ঠিক হয়েছে সামনের মাসের দুই তারিখ….. হাতে গুনে বারো দিন সময় হাতে আছে…… গুনধর ছেলে আর মেয়ে দেখার ফুরসত দেয় নি……
,
,
——— কি বলেন আপা….. শিমুল তো কতো শান্ত স্বভাবের
,
,
——— সে তো আপনার আর আমার সামনে…… তবে ছেলের পছন্দ আছে….. মেয়ের যেমন রূপ তেমনি গুণ…… চিটাগং মেডিক্যাল এর ছাত্রী…… এবার ইন্টার্নি করছে….. মেয়ের মামার বাড়ি আবার পুরান ঢাকা….. আমার ছোট ননদের বাড়ির সাথে মেয়ের মামার বাড়ি….. সেখান থেকেই তাদের ছয় বছরের পরিচয়…….. এবার বিয়ের জন্য চাপাচাপি করতেই সব খুলে বললো….. ছেলের পছন্দেই পছন্দ…. সংসার যখন ওরা করবে আমরা অযথা বাধা দিতে যাবো কেনো….
,
,
,
আন্টি আর শাম্মি সেদিন আরও আধ গন্টার মতন ছিলেন…… আমি তাদের পাশে বসে শুধু নির্বাক শ্রুতা ছিলাম…… শিমুল ভায়ের বিয়ের ব্যাপারেই টুকিটাকি আলাপ করছিলেন তারা…… কতো আশা নিয়ে বসেছিলাম হয়তো আমার আর শিমুল ভাইয়ের বিয়ের কথা বলবেন কিন্তু না তারা তো তার বিয়ের দাওয়াত দিতে এসেছেন…… ছয় বছরের প্রেম তাদের….. কই একদিন ও তো দেখলাম না তার সাথে কোন মেয়েকে….. অবশ্য আমি দেখার অপেক্ষায় তো আর কোন কিছু থেমে থাকবে না…… মেয়েও নাকি অপ্সরী….. যেমন রূপ তার তেমনি গুণ….. নিজে ইঞ্জিনিয়ার বউ ডাক্তার আর কি লাগে…… সেই তখন থেকে অনবরত এই সব ভাবনা মাথায় খেলেই যাচ্ছে….. আর হুট হাট যখন তখন কান্না পাচ্ছে….. কতো স্বপ্ন ছিলো শিমুল ভাইকে নিয়ে…… না কিছুই হলো না……
,
,
,
আজকাল রাস্থাঘাটে প্রায়ই শিমুল ভাইকে দেখি…… কখনো হাত ভর্তি বাজার বা কখনো রাস্থার মোড়ে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে চা খেতে খেতে আড্ডায়…… অইদিনের পর একদিন সকাল বেলা শিমুল ভাই দুহাত ভর্তি বাজারের ব্যাগ নিয়ে হাজির…… গুছানো চুল গুলো সামিনে কিছুটা ঝুকে পড়েছে….. কমলা শেডের একটা শার্ট পড়েছে…… শার্টের বুকে পিঠে ঘামে একদম লেপ্টে আছে…… আমি মাত্র গোসল শেষ করে ভেজা জামা নিয়ে ছাদে যাচ্ছিলাম…… শিমুল ভাইকে দেখেই কেমন যেনো পেটের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো…… ওনাকে বরাবরই বাজারের ব্যাগ হাতে আমার কাছে জামাই জামাই লাগতো….. ওনি বাজার করে ঘেমে নেয়ে আসবেন আমি পানির গ্লাস ওনার হাতে দিয়ে ব্যাগের বাজার গুলো একে একে খুলে দেখবো…… নাহ এমন কিছুই হলো না……. ধ্যান ভাংলো বাবার ডাকে…… রাস্থায় শিমুল ভাই নাকি জোর করে বাবার হাত থেকে বাজার নিয়ে বাড়ি পর্যন্ত নিয়ে এসেছেন…… আমি আর সেখানে দারালাম না….. সুফিয়া খালাকে ডেকে দিয়ে দ্রুত ছাদে চলে এলাম…….
,
,
,
আজকাল বড্ড স্বপ্ন দোষ হচ্ছে…… প্রায়ই দেখি শিমুল ভাইকে…… কখনো মাথায় চটি মেরে বলছে কিরে তুলা আমার বউ দেখতে কেমন!!! আবার কখনো দেখছি শিমুল ভাই একটা সুন্দর মেয়েকে নিয়ে রিক্সায় ঘুড়ছেন….. আমি সেই রিক্সার পিছনে দৌড়াচ্ছি……আবার কখনো দেখছি বউ সেজে বসে আছি কিন্তু শিমুল ভাই অন্য একজন কে নিয়ে এসে বললেন তুলা তুই এই ছেলেকে বিয়ে কর খুব সুখী হবি…. আমি চাইতেও কিছু বলতে পারি না….. খুব জোর করি, চেষ্টা করি কথা বলার কিন্তু পারি না……. এক ধরনের আঠালো জাতীয় কিছু একটা দিয়ে মুখ ভর্তি থাকে….. শিমুল ভাই চলে যায়….. একবারো পেছন ফিরে তাকায় না…… এরকম স্বপ্ন দেখে বুকে চিনচিনে ব্যথা নিয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠি….. এরপর সারারাত বিছানার এপাশ ওপাশ…. বুক ভরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি কিন্তু ঘুম আর আসে না ….. আগে শিমুল ভাইকে নিয়ে কতো স্বপ্ন দেখতে চাইতাম কিন্তু স্বপ্নে তিনি আসতেন না…… কিন্তু যখন এলেন তখন সব উলটা পালটা করে দিয়ে গেলেন……. অস্থিরতা ক্রমশ বেড়েই চলেছে দিনকে দিন…….. সেদিন কলেজ থেকে ফেরার পথে শিমুল ভাইকে দেখলাম এক মেয়েকে সাথে করে রিক্সায় যাচ্ছে……. সবুজ রঙের একটা গেঞ্জি পড়া….. লোকটাকে যতই দেখি ততই ভালোলাগে আর সাথে সাথেই অস্থিরতা টা দশ গুন বেশি হয়ে যায়…….. পাশে বসা মেয়েটাকে ও দেখলাম…… সুন্দর বললেও ভুল হবে একে…… এক কথায় অনন্য…….. দুজনকে বেশ মানিয়েছে…… না চাইতেই চোখ ওদের দিকে চলে যাচ্ছে…….. এতো কান্না পাচ্ছে…… ইচ্ছে করছে ছুটে গিয়ে শিমুল ভাইয়ের কলার ধরে বলি আপনি এই মেয়েটাকে কেন পাশে বসিয়েছেন!!!!! কেনো এতো হেসে হেসে কথা বলছেন ওর সাথে…… এসব দেখে তো আমার কষ্ট হচ্ছে শিমুল ভাই….. আমি তো আপনাকে ভীষণ রকমের পছন্দ করি….. অথচ আপনি এই মেয়েটাকে ছয় বছর ধরে ভালোবাসেন……. মানলাম এই মেয়ে অনেক সুন্দর শিমুল ভাই আপনি তো সেদিন ও আমায় বলেছিলেন আমি সুন্দর হয়ে গেছি….. আমাকে তো আপনি সবার থেকে আলাদা ভাবে তুলা ডাকতেন……… আপনি তো আমার প্রথম ভালোলাগা শিমুল ভাই…….. এলোমেলো ভাবে ভেবেই যাচ্ছি এসব………. কিন্তু কোন কোল্ কিনারা পাচ্ছিলাম না ভাবনার…….. সামনে তাকাতেই দেখলাম জ্যাম ছাড়িয়ে তাদের রিক্সা অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে……. কেন যেনো মনে হচ্ছিলো এইভাবেই শিমুল ভাই আমার জীবন থেকে চলে গিয়েছেন…….. অপরিনত বয়সের প্রথম প্রেম আর বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে খুব আশায় ছিলাম যে আমার ভ্যাগ্যে যদি তিনি থাকেন তাহলে একভাবে না একভাবে আমি তাকে পাবোই……… কিন্তু তেমন কিছুই হলো না…….. বেশ জাকজমক ভাবেই তাদের বিয়ে সম্পন্ন হলো……..ততোদিনে আমিও বেশ বুঝতে পারলাম যে আমার একতরফা ভালোলাগা তাদের এতো বছরের ভালোবাসার কাছে খুবই সাদামাটা আর তুচ্ছ……
,
,
,
শিমুল ভাইয়ের বিয়ের কিছু দিন পরেই আমার দুজন বান্ধবীর বিয়ে হয়ে গেলো আর বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টা মা বাবার চিন্তায় জোগ হলো………. বেশ কিছু দিন ধরে সাদাফ ভাই আগের মতোন সময় দিয়ে পড়াতে পারছেন না……. ঘন ঘন ছুটি নিচ্ছেন…… পড়ায় যাতে পিছিয়ে না পড়ি সেজন্য বেচের সাথে পড়াতেন বিকেলে……… পড়ানো শেষে আবার সাদাফ ভাই আমাকে বাসায় পৌছে দিয়ে যেতেন………. দেখতে দেখতে ইন্টার প্রথম বর্ষের ফাইনাল এক্সাম শুরু হয়ে গেলো……… এর মধ্যেই সাদাফ ভায়ের মা এক গাদা মিষ্টি আর ফলমূল নিয়ে বাসায় উপস্থিত হলেন…… আইস্ক্রিমের প্যাকেট টা আমার হাতে দিয়ে বললেন টুকি নে এটা তোর জন্য……. মা তো একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন এতো সব কিসের জন্য……..মায়ের প্রশ্নের তোপে না টিকতে পেরে বলেই দিলেন যে সাদাফ ভায়ের কাস্টমস এ খুব ভালো চাকরি হয়েছে………. বাবা সেদিন বাসায় ই ছিলেন……. সবাই খুব খুশি সাথে আমিও এতো দিনে যম ঠাকুরের কাছ থেকে রক্ষা পাবো বলে…… মা তো হাসতে হাসতে বলেই দিলেন…..
,
,
,
——— আমিতো ভেবেছিলাম কি না কি…… সাদাফের বিয়ে ঠিক হলো নাকি আবার…..
,
,
——— তো দাও তোমার মেয়েকে সাদাফের বউ করে নিয়ে যাই……. ছেলে বিয়ে করানোর জন্য তো আমি এক পায়ে রাজি এখন……..
,
,
——— সাদাফ কে আমারও খুব পছন্দ…… (মা)
,
,
——— ভাই আপনি কি বলেন!!! ছেলে তো আমার থেকে বেশি আপনারাই জানেন…….. আপনার মেয়ে আমার কাছে আমার মেয়ে হয়েই থাকবে….. এই কথা আমি আপনাকে দিচ্ছি……
,
,
——— আপা আমি একটু ভেবে চিন্তে দেখি…..
,
,
——— তা তো অবশ্যই ভাই……. আপনি চাইলে খুজ খবর ও নেন আমাদের দেশের বাড়িতে……… আমি আপনাকে ঠিকানা ও দিয়ে দিবো…….
,
,
,
ওদের তিনজনের কথা শুনে আমার আর মনে করে ভয় পেতে হলো না…… আত্নার পানি তো কবেই শুকিয়ে গেছে……. কই ভাবছিলাম এতো দিনে যম ঠাকুরের কাছ থেকে মুক্তি পাবো তা না…… এরা সবাই যড়যন্ত্র শুরু করে দিলো…… সাদাফ ভায়ের সাথে বিয়ে!!!! এক দেড় ঘন্টা ই তো আমার কাটে না….. আত্না হাতে নিয়া পড়তে বসি….. সেখানে বিয়ে!!! তাদের কি আমার আত্নার ভয় নাই নাকি……
,
,
,
রাতে খাবার জন্য রুম থেকে বেড়িয়ে শুনতে পেলাম মা বাবাবা একপ্রকার ঝগড়াঝাটি করছে…… যা আমার এতোখানি বয়সে আমি কখনো দেখি নি……. বাবা মাকে খুবই ভালোবাসেন আর কোন কাজ করার আগে সে ব্যাপারে মায়ের পরামর্শ সবার আগে নেন…… তাহলে কি নিয়ে তিনি এতো ক্ষেপেছেন…….একটু মনোযোগ দিতেই শুনতে পেলাম……… বাবার ইচ্ছা আমার চাচাতো ভাই রিয়াদের সাথে বিয়ে দেবার…… বাড়ির মেয়ে বাড়িতেই থাকবে….. আর তাছাড়া রিয়াদ এবার ঢাকা মেডিকেল থেকে কার্ডিওলজি তে ইন্টার্নশিপ করছে…… ব্রাইট ফিউচার এমএস করতে দেশের বাইরে যাবে……কিন্তু মা এতে রাজি না…… পরিবারে আত্নীয়তা করলে সম্পর্কে ফাটল ধরে…… মা সেটা কোনমতেই চায় না…… আর তাছাড়া রিয়াদের সেটেল হতে আরও চারপাচ বছর……… সে তুলনায় সাদাফ ভাই এস্টাবলিশ……. ঢাকার নিজস্ব বাড়ি…… পরিবারে ও কোন ঝামেলা নাই…….. তার উপর কতো ভালো চাকরি…… মেয়েও তাদের কাছে থাকবে…… সব শেষে বাবা মায়ের যুক্তির কাছে হার মেনে ঠিক করলো সাদাফ ভায়ের দেশের বাড়িতে যাবেন তাদের সম্পর্কে খোঁজ নিতে আর এই ব্যাপারে যেনো তাদেরকে কিছুই না বলা হয়…… এক মাত্র মেয়ে তার….. পাঁচটা দশটা না…… দশটা জিনিস বিচার বিবেচনা করে ঠিক মনে হলে তবেই কথায় আগাবেন তিনি…..
,
,
,
চলবে…..