#এক_কাপ_ঠান্ডা_কফি
পর্ব:- ১৫
আমার নাম মাহিন, বিয়ের আসর থেকে যে মেয়ে কিডন্যাপ করে হত্যা করা হয়েছে। সেই মাহিশা আর আমি আমরা দুজন দুজনকে ভালোবাসতাম অনেক। আপনি হয়তো আমাকে চিনবেন না, তবে আমি আপনার কথা শুনেছি।
রেস্টুরেন্টের এসির ঠান্ডা বাতাসের মধ্যেও যেন গরমে ঘামছে মাহিন। নিজের খানিকটা পরিচয় দিয়ে সে পরবর্তী কিছু বলার জন্য একটু চুপ করে রইল। সাজু ভাই বুঝতে পারছে মাহিন হয়তো তার কথাগুলো মনে মনে সাজিয়ে নিচ্ছে। সাজু বেশ আয়েশ করে বসলো, তার কোনো তাড়া নেই এমন একটা হাবভাব।
মাহিশার বাড়িতে গিয়েই মাহিনের কথা জানতে পেরেছিল সাজু। তার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছে ছিলেও সেই সময় হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া এদিকের ঝামেলা একটার পর একটা এমনভাবে পেঁচিয়ে গেছে সেই সুযোগ হয়নি। কিন্তু একটু আগে থানা থেকে বের হয়ে একটু সামনে আসতেই সাজুকে অবাক করে দেয় সে। তারপর নিজের নাম বলে কাছেই একটা রেস্টুরেন্টে যাবার অনুরোধ করে।
থানা থেকে বের হবার আগে সাজু ভাই সাব্বিরের সঙ্গে কথা বলেছিল। সাব্বির অসহায়ের মতো বারবার শুধু বলছে সে কিছু করেনি। মেয়েটাকে বস্তা খুলে বের করা আর একটু পানি খাওয়ানো ছাড়া আর কিছু করেনি সে।
সাজু বলেছিল,
– তোমার বাবা কাদের হয়ে কাজ করতেন তাদের সন্ধান দিতে পারবে? নাকি শপথ করা আছে।
– আমি তাদের চিনি না, এসব কাজ বাবা নিজে করতেন।
– কত বছর ধরে তোমরা এ কাজের সঙ্গে জড়িত?
– বেশ ক’বছর হয়ে গেছে।
– তোমার বর্ননা অনুযায়ী সেদিন রাতে তুমি বেশ কয়েকবার তোমার বাবার কাছে কল করেছ। আর তোমার বাবা নিজের মনিবের সঙ্গে যোগাযোগ করে আপডেট জানিয়েছে।
– জ্বি।
– তোমার বাবার সেই নাম্বারটা দাও আমি সেটা চেক করে দেখতে চাই সেদিন রাতে তোমার বাবা কাদের সঙ্গে কথা বলেছে।
– বাবার সেই নাম্বার আমার মুখস্থ নেই।
– সেও কি নতুন নতুন সিম ব্যবহার করতেন?
– না।
– তাহলে বাবার নাম্বার ছেলের মুখস্থ থাকবে না?
– আমার মোবাইলে সেভ করা আছে, মোবাইলটা পুলিশের কাছে জমা। আপনি যদি সেটা আমার হাতে এনে দিতে পারেন তাহলে আমি বের করে দিতে পারবো৷
– ঠিক আছে আমি কথা বলে দেখবো।
– মেয়েটাকে খুন করতে চাইনি। আমি বেলকনিতে দাঁড়িয়ে বাবার সঙ্গে কথা বলছিলাম একটু পরে রুমে ফিরে দেখি খুন হয়ে গেছে।
– তুমি কি সত্যিই সম্পুর্ণ ফ্ল্যাট চেক করেছিলে? সেখানে কাউকে পাওনি?
– ভালো করে দেখেছিলাম, কাউকে দেখিনি তবে শুধু একবার তার গম্ভীর কণ্ঠের আওয়াজ শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর আর কোনো কথা বলে নাই আর আমিও একটু পরে বের হয়ে যাই।
– ঠিক আছে তোমার সঙ্গে আবার কথা হবে।
|
– সাজু ভাই?
মাহিনের ডাকে তাকিয়ে রইল সাজু। রামিশা তার বামদিকে বসে আছে, তার একটা হাত সাজুর ঘাড়ের ওপর রাখা।
– জ্বি বলেন মাহিন সাহেব।
– মাহিশা আর আমি দুজনেই পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু ওর বাবার জন্য সেটা সম্ভব হয়নি। অবশেষে নিজের বাবার ভয়ে আর আমাকে বাঁচানোর জন্য সে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়।
– কিন্তু তার বাবা আমাকে বলেছিলেন যে তিনি সরাসরি কিছু জানতেন না। মাহিশা নাকি বিয়ে করতে রাজি ছিল, সে নাকি ভালো করে তোমাকে চিনেই না।
– ডাহা মিথ্যা কথা ভাই, ওই লোকটা কতটা খারাপ আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। সামনে মনে হয় চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে চায়, গ্রামের মানুষ তাকে ভালো বলেই জানে। অথচ সে কত ভয়ঙ্কর সেটা আমি পুরোপুরি না জানলেও অনেক কিছু জানি।
– যতটুকু জানেন সেটাই বলেন।
– দক্ষিণ বঙ্গের অনেক বড় একটা চক্র আছে সাজু ভাই। এরা প্রধানত চারটা কাজ করে টাকা ইনকাম করে, তবে সবগুলোই বেআইনি।
– কি কি?
– সুন্দরবন ও সাতক্ষীরার বর্ডার থেকে মাদকদ্রব্য পাচার করা, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরার বিভিন্ন ট্রলার বা জাহাজ থেকে লোক কিডন্যাপ করে মুক্তিপণ দাবি করা, জাল টাকা ছাপিয়ে সারাদেশে পৌঁছে দেওয়া, আর ঢাকা ও খুলনা শহরের বড় বড় ব্যাবসায়ীদের থেকে চাঁদা দাবি করা।
– সবকিছুর সঙ্গে মাহিশার বাবা জড়িত?
– জ্বি, তবে এসব কথা খুব কাছের কেউ ছাড়া জানে না।
– আপনি কীভাবে জানেন?
– একটা সময় আমি তাদের দলের সদস্য ছিলাম, নকল টাকার ব্যবসা আর মাদকদ্রব্য পাচার করার কাজে আমি বেশ দক্ষ ছিলাম।
– আপনি হঠাৎ শত্রু হলেন কীভাবে?
– আমি বহুবার ওই বাড়িতে আঙ্কেলের সঙ্গে গিয়ে কথা বলতাম। এভাবে যাতায়াত করতে করতে একদিন মাহিশার সঙ্গে পরিচয়। আমি জানতাম সে আঙ্কেলের মেয়ে, তবে মাহিশার চোখে এতটা মায়া ছিল যে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। প্রথম প্রথম কাজের জন্য ওই বাড়িতে গেলেও পরবর্তীতে বিভিন্ন বাহানা খুঁজতাম যেন তাদের বাড়িতে যেতে পারি। কাজ না থাকলেও আমি কাজ একটা খুঁজে বের করতাম।
– কে আগে প্রেমে পড়েছিল?
– হয়তো আমি, তবে আমি যখন ঘনঘন তাদের বাড়িতে আনাগোনা করতে লাগলাম তখন সে বুঝতে পারে।
– আচ্ছা।
– একবার আমি সাতক্ষীরা থেকে মাল নিয়ে ঢাকা এসেছি, প্রায় দুমাস ছিলাম। এরপর হঠাৎ করে একদিন একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে।
– কলটা নিশ্চয়ই মাহিশা দিয়েছিল?
– হ্যাঁ। অনেকদিন ধরে তাদের বাড়িতে কেন যাচ্ছি না সেটা জানার জন্য কল দিয়েছিল। আমি ঠিক তার পরদিনই মাহিশাদের বাড়িতে গেছিলাম।
– মাহিশার বাবার এসব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড মাহিশা জানতো?
– না, পরিবারের কেউ জানতো না। এখনো কেউ জানে না হয়তো, তবে আমি মাহিশাকে সবকিছু বলেছিলাম।
– প্রেমে অন্ধ হয়ে দলের সঙ্গে বেঈমানী?
– না, মাহিশা অনার্সে ভর্তি হয়েছিল খুলনাতে। তারপর থেকে আমাদের খুলনা শহরে দেখা হতো আর সবসময় ঘোরাঘুরি।
– তারমানে তখন থেকে বিভিন্ন বাহানা দিয়ে আর ওদের বাড়িতে যাবার দরকার হতো না।
– না। কিন্তু আমার এভাবে ভবঘুরে হয়ে সবসময় ঘুরে বেড়ানো, তারপর সবসময় এতো টাকা আর হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়া। এসব কিছু মাহিশা সন্দেহ করতে থাকে, বারবার জিজ্ঞেস করতে শুরু করে। তার বাবার সঙ্গে আমি ব্যবসার কাজ করি কিন্তু সেই কাজটা কি সেটা জানতে চায়।
– আপনি তাকে বলে দিলেন?
– না, আমাদের দলের আরেকজন জেনে যায় যে আমি মাহিশার সঙ্গে প্রেম করি। সেই খবর সঠিক স্থানে পৌঁছে যেতে মোটেই বিলম্ব হয়নি। আঙ্কেল একদিন আমাকে ডেকে ঠান্ডা মাথায় অনেক কিছু বলেন।
– মাহিশাকে ভুলে যেতে হবে?
– হুম। আর আমাকে পদ্মা নদীর ওপাড়ে যেতে নিষেধ করা হয়।
– আপনি কি করলেন?
– বাধ্য হয়ে আমাকে ঢাকায় এসে এখানকার দলে কাজ শুরু করতে হয়। তবে মাহিশার সঙ্গে নতুন সিম দিয়ে যোগাযোগ করতে থাকি। আমি সপ্তাহে একবার করে খুলনা যেতাম সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে। কিন্তু দুমাস পরে আবারও ধরা পরলাম।
– তারপর?
– এরপর মাস খানিক পরে যখন আমাদের দেখা হয় সেদিন মাহিশা তার হাতে হাত রেখে সবকিছু জানতে চায়। আমি সেদিনই আমার পেশা এবং আঙ্কেলের বিষয় সবকিছু তাকে বলে ফেলি।
– সে বিশ্বাস করেছিল?
– হ্যাঁ করেছিল।
– নিজের বাবাকে এতো সহজেই অবিশ্বাস করে ফেললো?
– আঙ্কেলের লোকদেখানো ব্যবসা ছিল চিংড়ি মাছ৷
– সবকিছু জানার পরে মাহিশা কি করলো?
– ওকে আমি বলেছিলাম যে আমরা দেশে থাকতে পারবো না কারণ তাহলে বিপদ নিশ্চিত। আমরা দুজন মিলে ভারতে পালিয়ে যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম। আর গোপনে গোপনে সবকিছু পরিকল্পনা করতে লাগলাম। কিন্তু আসল সমস্যা বাঁধলো যেদিন মাহিশার বাবা তার মাকে প্রচুর মারধর করলেন।
– কিরকম?
– মাহিশা সেদিন তার বাবাকে প্রচুর বকাবকি করে আর সেই বকাবকির মধ্যে সে তার বাবার এসব অপরাধমূলক কাজের কথা বলে ফেলে।
– আচ্ছা।
– আঙ্কেল কিছু না বলে চুপচাপ থাকেন। তবে মাহিশার ওই ভুলের জন্য চরম মূল্য দিতে হয়েছে আমাকে।
– মানে?
– আমি তো তখন জানতাম না এসব ঘটনা খুলনা শহরে ঘটছে। আঙ্কেল ঢাকায় কল দিয়ে আমাকে বন্দী করার হুকুম করে। এরা আমাকে আটকে ফেলে আর প্রচুর নির্যাতন শুরু করে তবে প্রাণে মারে না।
– কারণ কি?
মাহিন কিছু বলার আগেই সাজুর মোবাইল বেজে উঠলো, ওসি সাহেব কল করেছে। সাজু রিসিভ করার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বললেন,
” আপনি কি উত্তর বাড্ডার সেই বাসায় একটু আসতে পারবেন? একটা খুব রহস্যময় বিষয় পেয়েছি, আপনিও আসতে পারেন। ”
– ঠিক আছে এখনই আসছি।
– আচ্ছা, আমি এখানেই আছি।
সাজু ভাই মাহিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনার বাকি ঘটনা আমি কিছুক্ষণ পর শুনবো মাহিন। আমাকে এখনই যেতে হবে মাহিশা যেই বাড়িতে খুন হয়েছে সেখানে। আপনিও আমার সঙ্গে যেতে পারেন।
– না পারি না।
– কেন?
– আমাদের দলের প্রত্যেকের কাছে আমার ছবি পৌঁছে দিয়েছে মাহিশার বাবা। যেখানে যেই অবস্থায় পাওয়া যাবে সেখানেই হত্যা করার হুকুম রয়েছে। আমি সবসময় পালিয়ে থাকি।
সাজু অবাক হলেও সেটা প্রকাশ না করে বললো,
– ঠিক আছে তাহলে আপনার অপেক্ষা করুন।
– আমাকে আপনার খুঁজতে হবে না আমিই আপনাকে খুঁজে বের করবো।
সাজু ভাই ও রামিশা টেবিল থেকে উঠে গেল।
এমন সময় মাহিনের মোবাইলে একটা মেসেজ আসলো। মাহিন সেই মেসেজ বের করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল,
” সাজু এখন উত্তর বাড্ডা সেই বাড়িতে যাচ্ছে, যেভাবে বলেছিলাম সেভাবেই করো। ভিতু ওসিকে ভুলভাল বুঝিয়ে তাকে দিয়ে কল করানো হয়েছে। তুমি তো জানো সাজুকে না মারলে ও দারোগা বিপদে পরবে। তাই কাজটা করতেই হবে আর সেটা আজই। নাহলে কিন্তু বারবার তাকে মারার ব্যবস্থা করতে পারবো না। ”
[ আর মাত্র ২/৩ পর্বে সমাপ্ত করা হবে। ]
চলবে…
লেখাঃ- মোঃ সাইফুল ইসলাম।