এক_প্রহরের_খেলা মোর্শেদা হোসেন রুবি ২৫

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

২৫||
মেয়েকে বুকের সাথে অনেকক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলেন রুমকির মা। রুমকিও ছোট্ট কিশোরীর মতো লেপ্টে রইলো মায়ের বুকের মাঝে। যেন কত বছর পর মা’কে ফিরে পেয়েছে সে। মা মেয়ের মিলনদৃশ্যে চোখের জল ধরে রাখতে পারেন নি বাবা আব্দুল্লাহ। তিনি খাটের অপর পাশে বসে ঘনঘন চোখ মুছে যাচ্ছেন। তিনজনের এই নিরবতার মাঝেই নিজেদের অনেক কথা বলা হয়ে গেছে তাদের। একসময় লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মুখ খুললেন আব্দুল্লাহ হুজুর ।
-” আমি তো অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম রে মা। থানা থেইকে যখন বললো, আমাগের কোনো আত্মীয় গেছে তোরে আনতি। সেই তখনই চিন্তায় পইড়ে গেসিলাম। আমি বলি, এ আবার কুন ফেউ। পরে নুরুদ্দিন ভাই সাহস দিলে সেখানে গেলাম। গিয়ে তো আল্লাহর রহমতে তোরে পেয়ে গেলাম।”
-” হ্যাঁ, আব্বা। আপনারা আসার আগের দিন রাতেই একজন গিয়েছিলো আমাকে নিতে ! সে ওখানে সবাইকে পরিচয় দিচ্ছিলো আমার আত্মীয় বলে।” বলতে বলতে রুমকি মা’কে ছেড়ে সোজা হয়ে বসলো। ওর নাকের পাতা সামান্য ফুলে উঠতে দেখা গেলো এবার। কঠিন স্বরে বললো, ” পরে বুঝলাম, এটা তোমার বোন পো’র লোক। আজাদ ভাই একটা লোক পাঠিয়েছিলো আমাকে নিতে। ”
-” কস কী ? আজাদের লোক ছিলো ঐটে ?”
-“হ্যাঁ , আব্বা। লোকটা তো সেটাই বললো। আমি প্রথমে তার সামনে যাইনি। কোহিনুরকে দিয়েই খবর পাঠিয়েছি যে কোনো গায়ের মাহরামের সাথে দেখা করবো না। পরে কোহিনুরের বাঁকা বাঁকা কথা শুনে বুঝলাম ওকে হয়ত কিছু টাকা পয়সা দেয়া হয়েছে। কারণ মহিলা আমাকে বোঝাতে বদ্ধপরিকর ছিলো। সে নানা ভাবে আমাকে ভয় দেখাচ্ছিলো যে আমি যদি ঐ লোকের সাথে না যাই তাহলে পুলিশ আমাকে জেলে ভরে রাখবে অথবা মহিলা শোধনাগারে দিয়ে দেবে তখন সেটা নাকি আরো মানবেতর জীবন হবে আমার। তারপরেও আমি সাফ জানিয়ে দেই যে, আমি অপরিচিত কারো সাথে যাবো না। আর সে আজাদের লোক হলে তো আরো যাবো না। পরে মহিলা রাগ করে সরে যায়।”
-” খুব ভালো করেছিস ওর সাথে না গিয়ে। আমি শুধু আজাদের শয়তানিটা চিন্তা করি। ওরে সামনে পাইলে এইবার আমি লাঠিপেটা করব। হারামজাদা ছোটকাল থাইকেই জ্বালিয়ে আসতিসে। এ তো আল্লাহর রহমত যে আমরা সময়মতো পৌঁছে গিইসি। নাইলে পরে গেলে কী যে হতো।”
-” না আব্বা। আপনারা না আসলেও আমি ঐ লোকের সাথে যেতাম না। ঐ মহিলার টোনেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে সে সহজ মানুষ না। কারণ প্রথম দিনই টের পেয়েছি যে আমার হাতের দুটো আংটিই গায়েব। একটা ছিলো আমার বিয়ের আগের। ওটা খোলা সহজ ছিলো না। সবসময় পড়ে থাকতে থাকতে আঙ্গুলে চেপে বসে গিয়েছিলো। কসরত করে খুলতে হতো। ঐটাও সে খুলে নিয়েছে। আপনা হতে খুলে পড়ার আংটি ওটা না। তখনই যা বোঝার বুঝে নিয়েছি আব্বা। লোভী মানুষের ঈমান মুহূর্তেই বিক্রি হয়ে যায়। ঐ মহিলা উপকার করলে কী হবে আব্বা। তার লোভটা বড্ড বেশী। তাই লিটন সমাদ্দার নামের চামচাটা যেন তাকে দিয়ে অন্যভাবে চেষ্টা করতে না পারে সে কারণেই স্থির করেছিলাম মহিলাকে লোভ দেখাবো। আমার নিজের জমানো যে টাকাগুলো আছে তার সবটাই আমি ওকে দিয়ে দেবো বলে ভেবেছি। তবু যেন সে আমাকে লিটনের হাতে তুলে না দেয়। এসব পরিকল্পনা করার সময়েই তোমরা চলে এলে।” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো রুমকি।
কিছুক্ষণ নিরব থেকে মুখ নামিয়ে বললো,
-” একটা সত্যি কথা বলবেন আব্বা ? ”
-” কী কথা মা ? ”
-” রূপমের অবস্থা কী অনেক বেশী খারাপ?” রুমকির কণ্ঠে বিষন্নতা। ব্যথা বিধুর কাতরতা।
আব্দুল্লা হুজুর কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, ” হ। অনেক খারাপ ছিলো। তাই বইলেই তো তোর শ্বশুর তোরে ফালায়ে থুয়ে ছেলে নিয়ে দৌড় দিসে। ”
-” আমি রূপমের কাছে যাবো আব্বা।”
-” কী দরকার মা। তুই সাইধে কেন যাবি ? তোর শ্বশুর তোর জন্যে একটা ফোন দিসে না খোঁজ নিয়েছে ? ওরা নিজে থেইকে না আসলি পরে তো আমি তোরে যাইতে দেব না মা।”
-” এটা কেমন কথা বলেন আপনি? ” রুমকির মা তেতে উঠলেন। এতোক্ষণ নিরবই ছিলেন তিনি। এবার সরব হলেন।
– ” মেইয়ে বিয়ে দিসি আমরা সেখানে। তারে ঘরে আটকায়ে থুইবেন কী করতে। আজাদ আবার কেওয়াজ বাধালে তখন কী করবেন? ”
-” এইবার কেওয়াজ বাঁধালি পরে ওর খবর আছে। এবার আর ওরে ছাইড়ে দেবো না আমি। কিন্তু রুমিরে যাইতি দিবো না। তারা নিজে থাইকে আইসে মেয়ে নিয়ি যাবে। আমার মেইয়ে পানিতে পড়ে যায় নাই। তার ছেলের দাম আছে, আমার মেয়ের দাম নাই ? আগে জামাইরে সাইরে উঠতে দ্যাও। সে নিজেই খোঁজখবর করবে। তাছাড়া রূমকির এভাবে যাওয়াটা ভালো দেখায় না। মহিউদ্দিনের কাছে আমি এটা আশা করিনি। ও আমার সাথে যেটা কইরেছে এটা আমি ওর কাছ থাইকে মোটেই আশা করিনাই।” আব্দুল্লাহ হুজুরকে অস্থির দেখালো। ওরা মা মেয়ে দুজনেই থেমে গেলো। এরপর আর কথা আর বেশী এগুলো না। আব্দুল্লাহ উঠে চলে গেলেন।
রুমকি ব্যথিত চোখে বাবার চলে যাওয়া দেখলো। বোঝা যাচ্ছে ছেলেবেলার বন্ধুর আচরণ তাকে প্রচন্ড কষ্ট দিয়েছে। এজন্যই অভিমানাহত তিনি। কিন্তু তার অভিমান যে রুমকির জন্য জান নিয়ে টানাটানির অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুপম হাসপাতালে আছে শোনার পর থেকে পাখি হয়ে উড়ে ওর কাছে চলে যেতে মন চাইছে। কিন্তু বাবার জন্য আটকা পড়ে গেছে ও নয়তো আজ রাতেই বাবাকে নিয়ে রওনা দিয়ে দিতো। আচ্ছা, রূপম কেমন আছে এখন ? সন্তর্পনে দীর্ঘশ্বাস পড়লো রুমকির। রূপমের কথা মনে পড়ছে। ভীষণ রকম উদাস হয়ে যাচ্ছে মনটা ।

======

হালকা একটা ঝাঁকুনি লেগে তন্দ্রা টুটে গেলো আজাদের। কখন যে চোখটা লেগে গিয়েছে টেরই পায়নি সে। রাত তিনটার দিকে ফ্রেশ হয়ে দুজনেই শুয়ে পড়েছিলো। ভ্রমনের ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন ছিলো দুজনেই। ঘুমিয়ে পড়তে দেরী হয়নি।

চোখ মেলে কয়েক সেকেন্ড সিলিং ফ্যান দেখলো আজাদ। মনে পড়লো সে এখন অনেকটা নিরাপদ জায়গায় সরে এসেছে যা ওর শত্রুদের ধারণার বাইরে। এখন ওকে খুঁজতে হলে নতুন করে খোঁজ আরম্ভ করতে হবে। কিন্তু এবার আজাদ ওদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে এবার আর আম্মাকে ফোন দেবেনা সে। বলা যায়না ফোন ট্যাপ করেও রাখতে পারে। আর না করলেও আম্মাকে বিশ্বাস নেই। কোনো না কোনো ভাবে খবর ঠিকই লিক করে দেবেন উনি। আর শুধু একটা কলই করবে আজাদ। এস. আই আজিমকে। না পেলে মামুনকে। সেখান থেকে জানবে রুমকির বর্তমান অবস্থা। ব্যস্, তারপর কয়েকদিনের জন্য ডুব দেবে তার নবপরিণীতাকে নিয়ে। তখন শুরু হবে আসল হানিমুন। অদিতিকে জানাবে আজাদ আসলে কতোটা প্রেমিক পুরুষ। গত কয়েকদিন বেচারী যে আজাদকে পেয়েছে সে এক ছন্নছাড়া । আজ থেকে সে পাবে প্রেমিক আজাদকে। যে ভালোবাসতে জানে, ভালোবাসা শেখাতে জানে।

দু চোখ মুদে গভীর একটা শ্বাস ফেললো আজাদ। সারা শরীরে এক আরামদায়ক আলস্য। পা দুটো টানটান করে দিয়ে আড়মোড়া ভাঙ্গতেই সমস্ত শরীর মন একসাথে রোমাঞ্চিত হলো। মন আপনা হতেই গেয়ে উঠলো, ” এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।”
মুচকি হেসে পাশ ফিরে অদিতিকে নিজের কাছে টানার জন্য হাত বাড়িয়েও থমকে গেলো। অদিতির জায়গাটা খালি। কিছুটা চমকে গেলো তারপর হতাশ হয়ে পাশ বালিশটাকে আঁকড়ে ধরেই তাতেই মুখ ডুবিয়ে পড়ে রইলো খানিকক্ষণ। বেশ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে ওভাবে পড়ে থাকার পর হঠাৎ মুখ তুলে বাথরুমের দরজার দিকে তাকালো আজাদ। বিরক্তির চিহ্ন কপালে। কী আশ্চর্য, অদিতি কী করছে এতোক্ষণ ওখানে ? ফের মুখ গুঁজে চোখ মুদে আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা চললো। এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো। উঠে বসে ডাক দিলো, ” অদিতিইই….?”

সাড়া না পেয়ে নিজেই উঠে গিয়ে বাথরুমের দরজায় টোকা দিলো। আর তখনই টের পেলো দরজাটা আসলে খোলা। বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দরজাটা হালকা ধাক্কা দিতেই হাট করে খুলে গেলো সেটা। বাথরুম খালি। বোকার মতো কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে পুরো রুমের দিকে তাকালো সে। বারো ফুট বাই চৌদ্দ ফুটের মাঝারি রুমটাতে একটা খাট আর টেবিলটা ছাড়া আর কিছুই নেই । দেয়ালে একটা আলমারি বসানো আছে যেটা ওরা নিজেরাই খোলেনি। কারণ ওতে রাখবার মতো কিছু ওদের কাছে নেই। তাছাড়া ওরা কোনো লাগেজও আনেনি সাথে। কুয়াকাটায় কেনা হালকা কাপড়ের ব্যাগটায় ওর দুটো হাফ প্যান্ট ছাড়া আর কিছু নেই। ওটা বিছানার ওপরেই পড়ে আছে এখনও। তাহলে অদিতি কোথায় ? অদিতি নিশ্চয়ই ঐ আলমিরাতে লুকিয়ে নেই ? আনমনেই সেদিকে তাকালো আজাদ। হতবিহ্বল পায়ে কয়েক কদম এগিয়ে ঘরের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো । মাথা যেন কাজ করছে না ওর। অদিতি তবে গেলো কোথায় ? আর সে ওকে না বলে যাবেই বা কেন। এখানে তো কাউকেই চেনে না সে। তাছাড়া এই সাত সকালে ওর বাইরে যাবার এমন কী দরকার পড়লো । কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে রইলো আজাদ। চুলে হাত বোলালো। কিছুই বুঝে আসছে না ওর।

ওরা এখন আছে চট্টগ্রামের একটা অখ্যাত রেস্তোরায়। গতকাল মাঝরাতেই ওরা চট্টগ্রাম এসে পৌঁছেছে। আজাদের ইচ্ছে ছিলো কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে রাতেই রাঙামাটির বাস ধরবে। কিন্তু অদিতিই জানিয়েছিলো যে ওর কিছু পার্সোনাল সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাতেই রওনা দিলে ওর সমস্যা হবে। কাজেই রাতটা কোথাও কাটিয়ে সকালে যেন রওয়ানা দেয় আজাদ। অবশেষে ওর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েই চট্টগ্রামের এই হোটেলটা তে উঠেছে আজাদ। খুবই সস্তাদরের হোটেল। কিন্তু আজাদের জন্য ভালো। সামান্য ভয় ছিলো অদিতিকে নিয়ে কিন্তু মেয়েটা এবার আর নাট সিঁটকায়নি। চুপচাপ শান্ত ভঙ্গিতে ওর সাথে রুমে এসেছে। বোরকা নিকাব খুলে বাতাসে হ্যাঙ্গারে মেলে দিয়েছে তারপর চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। আজাদ ধরেই নিয়েছিলো যে জার্ণির কারণে হয়তো ক্লান্ত তাই বেশী ঘাঁটায়নি। এখন মনে পড়লো মেয়েটা গতকাল বাস থেকেই অস্বাভাবিক রকম শান্ত হয়ে ছিলো। বিশেষ করে শেষবারের কথোপকথনের পর। তার মানে কী অদিতি ঐ কথাটায় রাগ করেছে? কই, আজাদ তো টের পায়নি। বরং ওকে নিরব দেখে নানা ভাবে ওর মন বোঝার চেষ্টা করেছিলো সে। কিন্তু মেয়েটা কোনোভাবেই ওকে কিছু বুঝতে দেয়নি। বরং স্বাভাবিক ভাবেই ওর প্রতিটা কথার উত্তর দিয়েছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হয়তো অদিতি ওর কথায় কষ্ট পেয়েছে। কারণ আজাদ রুমকির ব্যপারে ঐ কথাটা ওভাবে সরাসরি বলে ফেলেছে। আজাদের ভাবা উচিত ছিলো অদিতি ওর স্ত্রী। প্রেমিকা নয়। আর স্ত্রী হিসেবে অদিতির রাগ হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু আজাদ তো এটা ইচ্ছে করেই করেছিলো। কারণ ওকে রাগাতে ভালো লাগছিলো ওর। মনে মনে ভেবে রেখেছিলো, একটা জায়গায় থিতু হবার পর আয়েশ করে ওর মান ভাঙাবে। কিন্তু অদিতি যে এতোটা রেগে যাবে বুঝতেই পারেনি আজাদ।
মনটা হঠাৎই হু হু করে উঠলো ওর। কী মনে হতেই ঝড়ের বেগে ছুটে গিয়ে দরোজা খুলে নিচে কাউন্টারে নামলো সে। সেখানে খোঁজ নিতেই জানতে পারলো, একজন বোরকা পরিহিতা মহিলা সকাল বেলায় বাইরে গিয়েছে। কোন রুমের বোর্ডার জানতে চাইলে মহিলা আজাদের রুমের নাম্বার বলেছে আর জানিয়েছে যে রুমে তার স্বামী ঘুমিয়ে আছে। সে একটা বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছে।

ম্যানেজারের মুখে সব শোনার পর আজাদ পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেলো এবার। এমনটা যে হবে তা সে কোনোদিনই ভাবেনি। অদিতি ওকে ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু কোথায় গেলো সে। কিছুই তো চেনেনা সে এখানকার। আর যাবেই বা কোথায় ? এখানে কে আছে ওর। পায়ে পায়ে নিজের রুমে ফিরে এলো আজাদ। হঠাৎ প্রচন্ড রাগ হলো ওর নিজের ওপর। একই সাথে কষ্টও। কী দরকার ছিলো মেয়েটাকে ঐভাবে কথাটা বলার। সবারই একটা নিজস্ব সেল্ফ রেসপেক্ট থাকে। অদিতির মতো মেয়ের সেল্ফ রেসপেক্ট তো আরো চোখা। কতটা আস্থাশীল ভাবলে মেয়েটা ওর মতো একটা বাউন্ডুলেকে সরাসরি বিয়ের জন্য প্ররোচিত করে। নাহ্, অদিতির ব্যপারে একটা বড় ভুল হয়ে গেছে। এটা রুমকি না যে ফিঁচফিঁচ করে কাঁদবে আর ফুলদানী ছুঁড়ে মারবে। রুমকীকে একদিন প্রচন্ড ক্ষেপিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন ও পেতলের ফুলদানী ছুঁড়ে মেরেছিলো ওর দিকে। ইস্, অদিতিও নাহয় তাই করতো। না বলে চলে গেলো কেন।
উত্তরটা নিজের মনেই খুঁজে নিলো আজাদ। আসলে অদিতি একটা আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন একটা মেয়ে। আর রুমকিও তাই। এটা আজাদের ব্যর্থতা যে সে দুজনের কাউকেই ধরে রাখতে পারলো না।
অজান্তেই নিজের বাম হাতের তালুতে ডান হাত মুঠো পাকিয়ে প্রচন্ড কিল বসালো। নিজের ওপরই রাগে ফুঁসতে লাগলো সে। অক্ষম এক আক্রোশে তড়পাতে লাগলো বেচারা।

ধপ করে বিছানায় বসে অসহায়ের মতো মোবাইলটা টেনে নিলো। কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা আজাদ। আহ্, একটা ফোনও যদি করতো অদিতি। তাহলে স্যরি বলতে পারতো আজাদ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে মোবাইলটা সরিয়ে রেখে ভাবতে বসলো । কোথায় যেতে পারে অদিতি। ও কী ওর ওপর রাগ করে ঢাকায় ফিরে গেলো ? নাকি অন্য কোথাও ? একা একটা মেয়ে অন্য কোথায়ই বা যাবে । দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠতে যাবার মুহূর্তেই ফোনটা বেজে উঠল। চমকে উঠে রীতিমত হামলে পড়লো ফোনের উপর। কে করেছে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না। অস্থিরচিত্তে বলে উঠলো, ” হ্যালো অদিতি…?”

-” কী রে শালা *** ? বহুত মৌজে আছিস দেখা যায় ? আর থাকবি নাই বা কেন ? তোর ডানে অদিতি, বামে অদিতি, উপরে অদিতি, নিচে….!”
-” বাপের পুত হলে সামনে এসে কথা বল। মায়ের আঁচলের নিচ থেকে ওরকম হালুম আমি নিজেই ছোটবেলায় বহুত করেছি। এখন আর পোলাপানের সাথে খেলিনা। তোর বাপেরে ফোন দে মামদার পো। আমি তার সাথেই কথা বলবো। ফিউজেজ বাল্বের সাথে আমি কথা বলিনা। শালা পাতি মাস্তান। বাপের নামে কুঁদিস। বাপ ছাড়া ফিউজ তোরা। আজাদ মুনতাসিরের সাথে কুঁদার বয়স হয়নি তোর। অদিতি কোথায় সেটা আগে বল ? ” আজাদের মুখ রাগে লাল হয়ে উঠেছে। কী বলছে ভেবে দেখলো না।
ওপাশে কয়েক সেকেন্ডের নিরবতা। তারপরই লিটন সমাদ্দারের কণ্ঠ শোনা গেলো, ” অদিতিরে নিজের পকেটে ঢুকায়ে এখন আমারে জিগাস অদিতি কই ? শালা বাটপার। পাঁচ লাখ টাকা নিইছিস তো নিইছিস, লগে আমার মামাতো বোনটারেও বগলদাবা কইরেছিস। এহন আবার নখরা দেখানো হচ্ছে ? ”

আজাদ থেমে গেলো। অদিতিকে তাহলে লিটন নিয়ে যায়নি। তাহলে মেয়েটা গেলো কোথায় ? কিছু বলার আগেই শুনলো লিটন সমাদ্দারের চ্যালেঞ্জ।
-” এই শোন। যেটা বলার জন্য তোরে ফোন দিয়েছি। ভয়ের চোটে তো ফোন বন্ধ করে রাখোস। তাই এস আই মামুনের ফোন থেকে তোরে ফোন দিসি। তোর এক আত্মীয় না একসিডেন করে মরিছে গতপরশু ? যার জন্য দিনে তিনবার থানায় ফোন করে গালমন্দ করিস ? ”
-” কে মারা গেছে ? ” আজাদ পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেলো।
-” নাম তো জানিনে সোনা। তবে তোমার যে আত্মীয়ের লাগি দিনে তিনবার ফোন দ্যাও। সে কিন্তুক আমার হাতের নাগালে আছে। ”
-” মানে ? কে হাতের নাগালে আছে ? তুই আমারে ব্লাফ দিচ্ছিস ? তুই ফোন মামুনের হাতে দে। আমি ওর সাথে কথা বলবো।”
-” ওতে কোনো লাভ হবেনা। তুই আমার কাছে শোন্। তোর মামাতো বোন যে স্বামী নে বাসে করি ঢাকা যাচ্ছিলো সেই বেচারী যে একসিডেন্ট কইরেছে তা তো তুই ভালোই জানিস। তবে তোর মামাতো বোন বাঁইচে থাকলেও তার সোয়ামী কিন্তু মইরেছে। বেচারী এখন বিধবা হয়ে গ্রামে পড়ে আছে। এখন তুই সিদ্ধান্ত নে। ফিরে আইসে মামাতো বোইন সামলাবি না নতুন বউ এর পিছন পড়ে থাকবি। তোর মামাতো বোনটারে দেইখিসি রে…! যা টসটসা…!”
-” ঠিক তোর বোনের মতো। তাই না ? ” রাগে বিশ্রী গালি দিতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো আজাদ।
ঠান্ডা স্বরে বললো, ” তোর কাছে রুমকিকে যেমন লেগেছে বা অদিতিকে যেমন লাগে এখন থেকে আমার কাছে তোর বোনেরে ঠিক তেমনই লাগবে। হাউজ দ্যাট ? অদিতির কাছেই আমি শুনেছি তোর বোনের কথা..!”
-” তুই শালা পাক্কা হারামী। তোরে যে আমি কেমনে মারুম শালা, খালি সামনে আয়। তোরে গর্তের থন বাইর করুম এবার। আর বাইর যদি না হইছিস তো তোর রুমকিরে আমি খাইসি। কসম করি কইলাম। তোরে আজকের দিনটা সময় দিলাম। বাংলাদেশের যে মাথাতেই আছোস, ভালোমানষির মতো সোজা ঝিনেদা চলি আসবি। তারপরে তোর সাথে সামনা সামনি কথা হবে।” বলেই কট করে ফোনটা কেটে দিলো লিটন। হতাশা এবার পুরোপুরি গ্রাস করলো আজাদকে। রাগ সামলাতে ফোনটা আছড়ে ভাঙ্গতে গিয়েও বিছানায় ছুঁড়ে মারলো আর প্রায় সাথে সাথেই বেজে উঠলো ফোনটা।
দ্রুত কিছুটা ঝুঁকে মোবাইলটা বিছানা থেকে তুলে চোখের সামনে আনলো আজাদ। তখনই দেখলো এটাও একটা আননোওন নাম্বার।

আস্তে করে রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই সমস্ত শরীরে হঠাৎ শীতল এক ঝলক বাতাস ছুঁয়ে গেলো আজাদকে। আহা, এ তো সেই জলতরঙ্গের সুর। আজাদ কাঁপা স্বরে বললো।
-” অদিতি তুমি ? না বলে কোথায় গিয়েছো তুমি? ” ছিটকে বেরোলো কথাগুলো।
– ” কী করছিলে ? ” শান্ত কণ্ঠে বললো অদিতি।
-” তার আগে বলো তুমি কোথায়? ”
-” আমি যেখানে থাকার সেখানেই আছি। তোমাকে বলতে যাবো কেন। তোমাকে তো মুক্ত করে দিয়েই এসেছি।”
-” মানে ? ” থমথমে সুরে বললো আজাদ।
-” মানে সহজ আজাদ। পরিস্থিতির ফেরে পড়ে আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছ তুমি। ভালোবেসে যে করোনি তা গত তিনদিনে জানা হয়ে গেছে আমার।”
-” অদিতি শোনো, এসব কথার কোনো ভিত্তি নেই। তোমাকে ভালো না লাগলে এমনিই বিয়ে করিনি। ”
-” আমি কোনো তর্কে যাবো না আজাদ। কেবল এতোটুকু বুঝেছি। তোমাকে আটকে রাখা অন্যায় হচ্ছে আমার। আমার কারণেই তুমি আজ বিপদে। আমি রাঙামাটি পৌঁছে বড়মামাকে ফোন দিয়ে জানিয়ে দেব আমার সিদ্ধান্ত। যেটা বলার জন্য তুমিই আমাকে বাসে ফোন সেধেছিলে। মনে পড়ে ? আমি সেটাই করতে যাচ্ছি। মামাকে ফোন করে জানাবো যে ঐ সম্পত্তি আমার চাই না । তাহলেই তোমার সাথে সমাদ্দারদের সব ঝামেলা শেষ হয়ে যাবে। তবে চেকটা পারলে লিটনকে দ্রুত ফিরিয়ে দিও। এরপর রুমকিকে নিয়ে সুখে থেকো, বাই।”
-” এক মিনিট অদিতি। তুমি এখন কোথায় বলবে ? ” আজাদকে কিছুটা অস্থির দেখালো।
-” একবারই তো বলেছি তোমাকে বলবো না। বলার জন্য তো আর না বলে চলে আসিনি আজাদ ? ”
-” আমি বাসের ভেঁপু শুনতে পাচ্ছি। তারমানে তুমি বাসস্ট্যান্ডে ?”
-” রাখি আজাদ। ভালো থেকো। ”
-” অদিতি প্লিইজ। রাঙামাটি কোথায় যাচ্ছ তুমি ? তুমি তো জানো না, তোমার ঐ আন্টি কোথায় থাকেন।”
-” কে বলেছে জানিনা ! আমি ভালোভাবেই জানি তিনি কোথায় থাকেন। ওটাতো তোমাকে নিজের কাছে ধরে রাখার জন্য মিথ্যে বলেছিলাম। কারণ জানি তুমি আমাকে নামিয়ে দিয়েই ছুট দেবে। তাই কাছে ধরে রাখতে চেয়েছি। তোমার সাথে ভ্রমনের মজা নিতে চেয়েছি। এখন সেই প্রয়োজনটা নেই। আজ থেকে তুমি বাস্তবিকই আজাদ। আজাদ মানে জানো তো, মুক্তি ।”
-” অদিতি প্লিজ। ডোন্ট গো। আ’ম স্যরি।”
-” আমি তোমাকে কোনোদিনও ভুলবোনা আজাদ। কারণ আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবেসেছিলাম। বাই।”

আজাদ কিছু বলার আগেই ফোনটা কেটে গেলো এবারও। আজাদ তৎক্ষণাৎ কল ব্যাক করলো অদিতির ফোন নম্বরে কিন্তু ধরলো একটা ছেলে। সে জানালো যে মেয়েটা ওর মোবাইল চেয়ে নিয়ে ফোন করেছিলো সে চলে গেছে। আজাদ ব্যগ্র কণ্ঠে জানতে চাইলো, ” ভাই এটা কোন জায়গা ? ”
ছেলেটা জায়গার নাম বলে সাথে সাথেই বললো, ” ঐ আপা তো বাসে উঠে গেছে। বাস এখন ছেড়ে দেবে।”
আজাদ স্থবির হয়ে ফোন কানে চেপে দাঁড়িয়ে রইলো। ছেলেটা ‘রাখি সার’ বলে কল কেটে দিলে হতাশ হয়ে দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়লো সে।
আফসোসের অনলে পুড়তে শুরু করে দিয়েছে পোড়া মনটা। অদিতিও শেষ পর্যন্ত ওকে ভুল বুঝে চলে গেলো। আজাদ ওকে কী করে জানাবে যে ও কতটা ভালোবাসে ফেলেছে ওকে। জীবনের গভীর এক মুহূর্তে নিছক এক প্রহরের খেলায় অদিতি নামের মেয়েটা আজাদকে কতটা স্বপ্নীল করে তুলেছিলো। এক পরিশুদ্ধ জীবনের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেছিলো আজাদকে। আজ নিজেরই ছোট্ট একটা ভুলে সেই সব অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেলো।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here