এক_প্রহরের_খেলা মোর্শেদা হোসেন রুবি ১৭

#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

১৭||
আজাদকে এলোপাতাড়ী গাড়ী ড্রাইভ করতে দেখে একরকম ভয়ই পেল অদিতি। প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছে গাড়ীটা ছিটকে পড়বে রাস্তার একপাশে আর নয়তো যে কোনো সময় উল্টে যাবে। নিজেকে সিটের ওপর স্থির রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল ওকে। এমতাবস্থাতেই আজাদের চিৎকার শুনে সিট বেল্ট বেঁধেছে সে। প্রায় মিনিট বিশেক পর অদিতি নিজেই চেঁচিয়ে উঠে বলল, ” গাড়ীটা থামান প্লিজ..।”
আজাদ গাড়ী এতটুকু স্লো না করেই পাল্টা চেঁচালো, ” কেন? ”
-” উফ্, থামান বলছি। স্টিয়ারিংটা এবার আমার হাতে দিন ।”
বিস্ময়ের আতিশায্যে আজাদ কোনো কথা বলল না। ঘাড় ফিরিয়ে পরপর দুবার অদিতিকে দেখল। ওর চাহনীর প্রত্যুত্তরে অদিতি কেবল মাথাই ঝাঁকাল।
-” শিওর? ” আজাদ কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইল।
-” আরে বাবা, শিওর। গাড়ীটা রাস্তার একপাশে সাইড করুন আর আপনি এপাশে চলে আসুন। আপনার হাতে গুলি লেগেছে বলেন নি কেন? রক্ত পড়ছে তো।”
আজাদ চকিতে নিজের বাহুর দিকে তাকাল। তারপরই কমিয়ে আনল গাড়ির গতি।
পুরোপুরি বন্ধ করার আগে আরেকবার নিশ্চিত হয়ে নিতে ব্যাক সাইড মিরর দেখল। নাহ্ পেছনে অজগরাকৃতির রাস্তাটা লম্বাটে হয়ে অনেকদুর চলে গেছে। আজাদের গাড়ীটা খানিক উঁচুতে হওয়ায় ঢালুর দিকের পথ প্রায় পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। এবং সেখানে কোনো গাড়ীর নামনিশানা নেই।
গাড়ী একপাশে থামল। এতক্ষণে হাতের দিকে মনোযোগ দেবার সুযোগ হলো আজাদের। মুখ নামিয়ে বাহুর দিকে তাকাতেই রক্তের অস্তিত্ব টের পেল। টিশার্টের একপাশের হাতা অনেকখানিই ভিজে গেছে। বাহু চেপে ধরে দরজা খুলে নেমে পড়ল আজাদ। অনুসন্ধানী চোখে চারপাশ আরেকবার দেখে গাড়ীর অপর পাশে চলে এল। অদিতি ততক্ষণে সিট টপকেই ড্রাইভিং সিটে চলে এসেছে। আজাদ প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসতেই আঁতকে উঠল অদিতি। ওর শীৎকারে আজাদ হাসার চেষ্টা করতে গিয়ে ধমক খেল, ” পাগল নাকি আপনি ? হাসছেন কেন ? আপনার হাত থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে আর আপনি কিনা…!” থেমে গিয়ে রাস্তার চারপাশে তাকাল অদিতি। চারিদিকে কোন দোকানপাট নজরে এলোনা। অদূরে একটা চায়ের ছাপড়া আছে কেবল। মনে পড়ল আজাদ শহর থেকে বেরোনোর জন্য এলোপাতাড়ী গাড়ী চালিয়েছে। গত পঁচিশ মিনিটে ওরা বেশ কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করে এসেছে। আজাদের দিকে তাকাতেই ওর চেহারায় যন্ত্রণায় ছাপ দেখতে পেল অদিতি। মুখটা কুঁচকে রেখেছে বেচারা।
-” ইস্, আপনার তো ডাক্তার দরকার।” অদিতি খানিকটা অসহায়ের মতই বলে উঠল।
-” এখানে ডাক্তার কোথায় পাবেন ? ”
-” ডাক্তার না হলেও যে কোন ফার্মেসী….!” বলেই দ্রুত ইগনিশন সুইচ অন করল অদিতি । ওর অভ্যস্ত ভঙ্গি দেখে মনে মনে চমৎকৃত না হয়ে পারল না আজাদ। তবে কোন মন্তব্য করলো না সে। মৃদু ঝাঁকি দিয়ে স্টার্ট নিলো গাড়ীটা। এগিয়ে চলল মসৃণ গতিতে। আজাদ এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের হাত নিয়ে।
-” আমি এদিকের রাস্তাঘাট একদমই চিনিনা। ফার্মেসী কোথায় জানেন ? ”
-” সামনের ডান দিক ধরে যান। মিনিট দশেক গেলে একটা পাবেন তবে ভাগ্য ভালো থাকলেই কেবল সেটা খোলা পাওয়া সম্ভব। ওটা বেশীরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে।” বলতে গিয়ে অজান্তেই রিয়ার ভিঊ মিররে চোখ পড়লো ওর। রাস্তা আগের মতোই ফাঁকা। হালকা একটা স্বস্তি কাজ করলো মনে। যাক্, ফেউ ছাড়ানো গেছে তাহলে। যদিও চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। আর তা হলো মেয়েটাকে নিয়ে দ্রুত এই এরিয়া ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার। আজাদ একা হলেও এতটা ভাবত না কিন্তু অদিতি মেয়েটা সাথে থাকাতে সব কিছু অন্যরকম করে ভাবতে হচ্ছে। তাছাড়া লিটনের টাকাটা ফেরত দেয়া দরকার। বেকুবটা টাকার শোকে আধাপাগল হয়ে আছে। তার উপর অদিতি হাতছাড়া। লিটন নিশ্চয়ই ক্ষেপে আছে। এদিকে অদিতিকে রাঙামাটি দিয়ে এলেও একেবারে সুনিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কে জানে, গন্ধ শুঁকে শুঁকে যদি সেখানে গিয়েও হাজির হয় শুয়োরটা! মেয়েটার কী অবস্থা করবে কে জানে। বাহুতে টান পড়ায় শিউরে উঠে ভাবনা বিচ্ছিন্ন হলো আজাদের। ক্ষণিকের জন্য সন্দেহ হলো, বুলেট ভেতরে রয়ে গেছে কিনা। পরক্ষণেই নিজেকে সান্ত্বনা দিল। নাহ্, বুলেট ভেতরে নেই। তখনই কেটে বেরিয়ে গেছে। বুলেট থাকলে সে নিশ্চয়ই এত শান্ত থাকতে পারত না। যদিও ক্ষতস্থান অসম্ভব টাটাচ্ছে।
-” ঐ যে ফার্মেসী। ” অদিতির চাপা স্বরের চিৎকারে জানালা ভেদ করে বাইরে তাকাল আজাদ। কপালগুণে ফার্মেসী খোলা পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভাগ্য তাহলে আজ একটু বেশীই সুপ্রসন্ন। যতবার এই পথ দিয়ে গেছে কোনবারই এটা খোলা পায়নি আজাদ।
অদিতি আগেই নেমে পড়েছে। আজাদ তার পিছু নিলো। অল্পবয়সী এক কমপাউন্ডার এগিয়ে এসে কথা বললে আজাদ বাহুটা এগিয়ে দিয়ে ক্ষতস্থান দেখালো। মনে সামান্য দ্বিধা ছিল কম্পাউন্ডার ছেলেটাকে নিয়ে। হয়ত ছেলেটা ওর ক্ষতস্থান দেখে নানান প্রশ্ন জুড়ে দেবে। কিন্তু তেমনটি হলো না। সম্ভবত ছেলেটা এখনও পৃথিবীর জটিল দিকগুলো পুরোপুরি চিনে উঠতে পারেনি। সে কেবল “গুলি লাইগসেনি” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই আজাদের হাত মেরামত করতে নেমে পড়ল। যেন প্রশ্ন করাটাই তার কাজ, উত্তর শোনার ততটা ইচ্ছা নেই। আজাদ অদিতি দুজনেই নিরব রইল। ছেলেটাও আর কোন প্রশ্ন করলো না। মিনিট পনের বাদে আজাদ আরাম বোধ করতে লাগল। ছেলেটা আসলেই কাজের। চমৎকার ফার্ষ্ট এইড দিয়েছে।

আজাদ কথা না বাড়িয়ে দাম মিটিয়ে দিয়ে পেইনকিলার আর ক্ষতসারার ঔষধ নিয়ে সোজা গাড়ীতে উঠে পড়ল। অদিতিকে প্রফেশনাল ড্রাইভারদের মত সিট বেল্ট খুঁজতে দেখে বলল, ” আপনি সত্যিই বড় অদ্ভুত মেয়ে। একের পর এক চমক দিয়ে যাচ্ছেন। আমি কিন্তু আপনার গাড়ী চালাতে পারার কথাটা শুনে টাশকি খেয়েছি।”
-” আরো খাবেন। অপেক্ষা করতে থাকুন।”
-” তাই নাকি ? দ্বিতীয় টাশকিটা কখন পাবো জানতে পারি ? ” বলে গাড়ীতে রাখা পানির বোতল বের করে পেইনকিলারটা খেয়ে নিল সে। অদিতি গাড়ী স্টার্ট করে বাতাসের শব্দে বলল, ” রাতের আগেই ইনশাআল্লাহ ।”

======

আদরের মেয়েকে ফিরে পেয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদলেন ইমাম সাহেব। সাথে সাথেই দু’ রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করলেন তিনি। একটা মুরগী কিনে সদকা করে দিলেন। কাজের মেয়েটাকে দিয়ে বললেন, ” এটা তুই বাড়ী নিয়ে রেঁধে খাস।”। রুমকির মা’ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলেন। মেয়ের মুখে গতকালের বিভীষিকাময় রাতের সমস্ত কথা শুনে কতশত বার যে আকাশের দিকে হাত তুলে শোকর জানালেন তার ইয়ত্তা নেই। একপর্যায়ে প্রাথমিক আবেগ কেটে গিয়ে দুজনেই বাস্তবে ফিরে এলেন। মেয়ের জামাই এর হাত ধরে নিজেই এবার অনুনয়ের সুরে তুললেন আব্দুল্লাহ হুজুর ।
-” বাবা, আমার মেয়েটা কখনও মিথ্যে বলে না। আপনি মানে আপনারা ওর কথা বিশ্বাস কইরেছেন তো বাবা? আপনাদের পরিবার থেকে যদি কোন প্রশ্ন ওঠে…!”

-” অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠেনা বাবা।” শ্বশুরকে থামিয়ে দিয়ে বলল ঋভূ। যদিও বাবা ডাকতে খানিক সংকোচ হচ্ছিল ওর। তবু ঋভূ বললো, ” বাবা, আমার পরিবার থেকে কোন প্রশ্ন উঠবেনা ইনশাআল্লাহ। যদি ওঠে সেটার জবাব দেবার জন্য আমি আছি। আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না।”

-” ভাবতাম না বাবা। গুলবানু চাচীকে সেই শৈশব থেকে চিনি। আমার কোন বিপদে তাঁকে এমন নিরব আগে কোনোদিন দেখিনি।” এ পর্যন্ত বলেই থেমে গেলেন তিনি। ঋভূ উঠে দাঁড়িয়ে শ্বশুরের হাত ধরে বললো, ” যে কাজে রুমকির সায় ছিলো না তার জন্য রুমকিকে কেন দায়ী হবে। আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না। আর আমি স্থির করেছি আজই রুমকিকে নিয়ে ঢাকা ছাড়ব। যদি আপনি অনুমতি দেন তবেই ! ”
-” অনুমতি কী বলছো বাপ। মেয়েটাকে তার ঘরে ফিরে যেতে দেখলে আমি কতটা স্বস্তি পাবো তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। ভালো কথা, তোমার আপানের সাথে যদি ওকে নিয়ে একটু দেখা কইরে আসতে তাহলে….। ” আব্দুল্লাহর কথা শেষ হবার আগেই ঋভূ মাথা নেড়ে সরাসরি নাকচ করে দিল প্রস্তাবটা। আব্দুল্লাহ নির্বাক চেয়ে রইলেন।
ঋভূ গম্ভীর মুখে বলল, ” আমার স্ত্রী’কে যারা অসম্মানের চোখে দেখবে তাদের কাছে ধর্ণা দেবার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। আমি বিশ্বাস করি রুমকি নির্দোষ। কাজেই এ নিয়ে কোন কৈফিয়ত আমি কাউকে দেবো না। যার ইচ্ছে হয় বিশ্বাস করবে বা না করবে। আমার তাতে কিছু যায় আসে না।”
-” তবু বাবা। চাচী গুরুজন। তিনি….!”
-” এটা আমার উপর ছেড়ে দিন বাবা। আমি আপানকে অসম্মান করব না। আমি ঢাকা যাবার আগে অবশ্যই তাঁর সাথে দেখা করে আসব তবে একা। রুমকি ও বাড়ী যাবে না।” বলে ঋভূ বেরিয়ে গেলে আব্দুল্লাহ আর কিছু বলার অবকাশ পেলেন না।

আপান নিরুদ্বিগ্ন মুখে নিজের খাটেই দু’ পা মেলে চিরাচরিত ভঙ্গিতে এক পায়ের উপর অন্য পা ক্যাঁচ দিয়ে বসে পান সাজাচ্ছিলেন। নাতিকে দেখে পানের বাটা সরিয়ে রাখলেও কোন কথা বললেন না। ঋভূ বরাবরের মত আপানের পায়ের উপর আলতো হাত রেখে বললো, ” আমি বাড়ী যাচ্ছি আপান। আজ রাতের বাসেই।”
আপান চট করে কোন মন্তব্য করলেন না। শান্ত ভঙ্গিতে পানটা খিলি বানালেন।
ঋভূ উঠে দাঁড়াতেই বললেন, ” রুমকিরে নিয়েই ফিরে যাইতেছিস?”
-” তো কী রেখে যেতে বলছো ? ” উত্তেজিত না হবার পণটা রইলো না ঋভূর। চট করে যেন মাথায় আগুন ধরে গেলো ওর। আপান তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে হেসে বললেন, ” আমি তো বলি এমন মেইয়ে নিয়ে সংসার করা উচিত না। কে জানে গতরাইতে কমিনদে কী ঘটনা বানায়ে বইলেছে ! ”
-” আপান ! ” ঋভূ রাগ চেপে বলতে লাগল।” সংসার করব আমি। কাজেই আমাকে ভাবতে দাও। মনে করো আমার বউ পচে গেছে। তারপরেও সে আমার অধিকারভুক্ত। সবাইকে আমি তার ব্যপারে কথা বলার অধিকার দেইনি আর দেবোও না।”
-” ভাই কী রাগ কইরেসো আমার উপর? ”
-” নাহ্, আমার কারো উপর রাগ নেই। আমি এখন উঠব।”
-” ঢাকায় গেলি পরে তোমার বাবা, মা বাকি আত্মীয় স্বজনে নানান তানান কথা তুলবে রে ভাই। তাগের কী জবাব দিবা তুমি ? ”
-” তোমাকে যা দিয়েছি তাই দিবো। উত্তর কারো মনঃপূত হলে ভালো, না হলে নাই।”
-” তারমানে রুমকি তোমারে পটায়ে ফেইলিসে? ”
-” যা খুশি ভাবতে পারো। আমার কাছে কোন উত্তর পাবেনা এসবের। আমি মানুষটাই এমন। সবাই আমাকে পটিয়েই ফেলে। নইলে নিজের অসুখের বাহানা দিয়ে তুমিই বা সেদিন পটাতে কেমন করে!” এক নিঃশ্বাসে বলে থামল ঋভূ।

-” এহন আবার যদি ঐরকম কইরে হাত ধরি, তুমি আমার কথাডা রাখবা ভাই? ” আপানের কণ্ঠে অনুনয়ের সুর।
ঋভূ স্থির ঠান্ডা স্বরে বলল, ” রুমকির ব্যপার ছাড়া।”
-” তারমানে তুমি রুমকিকে ছাইড়ে দেবানা ? এই ভাগোড়া মেইয়ে নিয়েই সংসার করবা?”
-” হ্যাঁ, করবো। আর কিছু ? ” ঋভূ রেগে কাঁই হলেও নিজেকে প্রানপনে শান্ত রাখলো।
আপান মুচকি হেসে খাট থেকে নেমে ঋভূর হাত ধরে টানতে গিয়ে টের পেলেন, নাতি তার লোহার মত শক্ত হয়ে আছে। ঋভূ প্রচন্ড রেগে গেলেই কেবল এমন করে। আপান এবার নাতির পকেটে টাকার ছোটখাটো বান্ডিলটা ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ” তুমি পরীক্ষায় পাশ কইরেছো ভাই। আমি খুবই খুশি হইসি। মনটায় বড় অশান্তি ছিলো। আইজ দুর হইলো।”
-” মানে ? ” এবার ঋভূর পালা। সে যারপরনাই বিস্মিত আপানের পরিবর্তিত আচরণে। আপান সবজান্তার ভঙ্গিতে হাসলেন।
-” ভাই রে, বয়স তো আর বাতাসে হইতাসে না। কিছু বুদ্ধিশুদ্ধিতেও পাকে। তোমার এই জিনিসটাই আমারে চিন্তায় ফেইলেছিলো। তুমি আমার কারণেই এককথায় বিয়ে করতে রাজী হইলে। ঐদিকে শুনলাম মায়ের সাথেও নাকি রুমকিরে নিয়ে রাগারাগি কইরেছিলে। তুমি তোমার মায়রে হুমকি দিইসিলে যে বাড়ী ছাইড়ে চইলে যাবা। তোমার নাকি পছন্দের মেইয়ে আছে। সেদিন সব শুনেও কিছু বলিনি। ইবার সুযোগ পেইয়ে রুমকিরে বগলদাবা কইরে নিয়ে আসলাম। ইচ্ছা ছিলো তোমার মনের টানটা দেখবো। এর মইদ্যে ঘটলো আরেক ঘটনা। সুযোগ বুইঝে তোমারে টোকা দিয়ে দেখলাম তুমি কী কও। ভয়ও পাচ্ছিলাম ভাই, তুমি না আবার দুর্বল হইয়ে পড়ো আর বাবা মায়ের কথা শুইনে রুমকিরে কষ্ট দাও। তাই তোমারে ঐভাবে বইলে তোমার মন যাচিছি আমি। তুমি রাগ করাতে আমি খুশি হইসি ভাই। তুমি ঠিক না থাকলে ঐ মেয়ের জীবন কষ্ট করতি করতি যাবে। তুমি শক্ত আছো আর চিন্তা নাই। এবার তোমরা ঢাকায় যাতি পারো। আজাইদ্যারে বিশ্বাস নাই। সে আবার কোন মতলব আঁটে কে জানে।”
ঋভূ মন্ত্রমুগ্ধের মত আপানের কথা শুনছিলো। এবার আপানের হাত ধরে আস্থার সাথে বলল, ” আজাদ কেন, পৃথিবীর কেউই এখন আমার মনে রুমকির প্রতি বিষ ঢালতে পারবে না। ”
-” আলহামদুলিল্লাহ ভাই। আমি খুব খুশি হইসি। এইবার কী রুমকিটারে নিয়ে আসবি নাকি একবার দেখা কইরে যাইতে?”
ঋভূ মুচকি হেসে মাথা নাড়ল, ” এক্ষূনি নিয়ে আসছি। আচ্ছা ভালো কথা। পকেটে টাকা কিসের দিলে আপান ? ”
-” রাখ ঐ টা। আজ ঢাকা ফিইরে গিইয়ে সমুদ্দুরের টিকিট কাটবি। রুমকিরে নিয়া হানিমুন না কী কয়, ঐটা সাইরে আয়। বুঝলি ? ”
ঋভূ আনন্দে আপানের হাত চেপে ধরে তাতে চুমু খেয়ে বলল, ” তুমি আমাদের জন্য দোয়া করো আপান। ”
-” হ, তা তো করি। সমুদ্দুর গিয়ে আমার লাগি একটা পুতিন নে আয়।”
ঋভূ এবার বোকা বোকা হেসে ফেলল। আপানটার মুখে সত্যিই কিছু আটকায় না।
======

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আজাদ মোবাইলে কাউকে ট্রেস করার চেষ্টা করছে। কিন্তু নেট প্রবলেমে বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে ফোনটা ড্যাশবোর্ডের উপরে ছুঁড়ে মারল। অদিতি হঠাৎ করেই বলে উঠলো।
– ” আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা জানেন ? ”
-” কী বিশ্বাস হচ্ছে না ? ”
বাম হাত দিয়ে গুঁজে থাকা শার্টের কলার টেনে ঠিক করে তাকাল আজাদ। ডান হাতটা একরকম অকেজোই পড়ে আছে বলে বাম হাতেই সব করতে হচ্ছে ওকে। অদিতি একইভাবে বলল,
-” এই যে আমাকে ঘিরে এতসব কান্ড ঘটছে।”
আজাদ হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা ফের তুলে নিয়ে ডায়াল করে কানে চাপাল। সে অবস্থাতেই বলল , ” স্বাভাবিক। আজ আপনার শাহানের বাসরঘরে থাকার কথা ছিল আর আপনি কীনা আপনার আহত কিডন্যাপারকে পাশে বসিয়ে শহর থেকে পালাচ্ছেন। ব্যপারটা সত্যিই দুঃখজনক।”
-” আমি কিন্তু ঐ সেন্সে বলিনি। আমাকে রাগাবেন না প্লিজ। ”
-” সেক্ষেত্রে দুঃখিত। আমি ভেবেছিলাম আপনি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের সম্ভাব্য বিয়েটা মিস করছেন। তাছাড়া ভালোবাসার মানুষকে না পেলে যে কেমন লাগে সেটা….!”
-” শাহানকে আমি ভালোবাসিনা।” আজাদের কথাটা কেটে দিয়ে দ্রুত উচ্চারণ করলো অদিতি। আর একই সাথে অদিতির কথা শুনে ফোন কেটে দিয়ে ওর দিকে ভাল করে তাকালো আজাদ।
-” ভালোবাসেন না তো বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন কেন ? ”
অদিতি দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, ” এখন কোনদিকে যাবো ? ”
-” মেইনরোড ধরার আগে গাড়ীতে তেল নিতে হবে। আপনি বাম দিকের রাস্তা ধরে সোজা চলে যান। পেট্রল পাম্পে থামবেন।”
আজাদও স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো।
অদিতি কোন কথা না বলে গাড়ী বায়ে টার্ণ করলো।
শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল , ” আসলে আমাকে হিজাব নিকাবে দেখে অনেকেই ধরে নেয় যে, আমি খুব ধার্মিক একটা মেয়ে।”
-” কিন্তু আপনি তা নন। এটাই বলতে চাচ্ছেন ? ”
-” সব কথার ভুল ব্যখ্যা করেন কেন ?” স্পষ্টতই বিরক্ত হলো অদিতি। “এই পৃথিবীতে হাতে গোনা দু একটা জ্ঞানপাপী ছাড়া আর কেউই মানে না যে পৃথিবীটা আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে আমাদের মালিক ঐ একজনই। যিনি আকাশে আছেন। পার্থক্য শুধু এতোটুকুই, প্রাকটিসিং মুসলিমরা তাঁর বেঁধে দেয়া বিধানগুলোকে মানতে চেষ্টা করে আর বাকিরা মনগড়া ভাবে তাঁকে মানে বা স্বীকার করে। কেবল তাঁর বিধানগুলে মানার প্রয়োজন মনে করেনা।”
-” আপনি কোনটা ? ” আজাদ কৌতুহলের চোখে তাকাল তার পাশে বসা অদ্ভুত মেয়েটার দিকে। অদিতি মন দিয়ে ড্রাইভ করছে। আজাদের কথার উত্তর দিলনা। আজাদও আর কোন প্রশ্ন না করে সিটের ওপর নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। তখনই শুনলো।
” জানেন, আমি অনেকটা বাধ্য হয়েই হিজাবকে আপন করে নিয়েছি। ”

আজাদ হেলান দেয়া অবস্থাতেই তাকাল। দৃশ্যত নিরব রইলেও মনে মনে বলল, তোমার তো খোলা থাকা উচিতই না মেয়ে। লোকজন স্রেফ বিনা অস্ত্রে মারা পড়বে। আর নয়ত তারা তোমাকে মারবে।

অদিতি বলল, ” আমার বয়স যখন এগারো তখন আমার বাবা-মা একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। এরপর বড়মামা আমাকে তার কাছে নিয়ে আসেন। শাহান লিটন আর ওদের একমাত্র বোন মুনার সাথেই আমি বেড়ে উঠতে থাকি। কয়েক বছর পরই টের পেলাম আমার বয়স বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে লিটন আর শাহানের দৃষ্টিভঙ্গীও কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে। আবার বাড়ীতে আসা বিভিন্ন পুরুষ ভিজিটরসদের আলগা খাতিরও টের পেতে লাগলাম। তারা নানান ছুতোনাতায় আমাকে ডাকতেন। বুঝতে পারলাম, তাদের স্নেহ মমতা বন্ধুত্ব এসব ছিলো আমার কাছাকাছি আসার কিছু বৈধ নামমাত্র। এরইমধ্যে হঠাৎ একদিন লিটন আমার ঘুমের সুযোগে ঘরে ঢুকে অসভ্যতা করতে চেষ্টা করলো। টের পেয়ে সেদিনই অনেক ভেবেচিন্তে দুটো জিনিস বেছে নিলাম। হিজাব আর শাহান। প্রথমতঃ শাহানের সবকিছু লিটন আর মামার সাথে মিললেও সে নারী লোলুপ ছিলো না। দ্বিতীয় কারণ, শাহান আমার স্বামী হলে লিটন আমার উপর চড়াও হবার সাহস পাবেনা। কারণ মাথার উপর শাহান থাকবে। কাঁচা বয়সের কাঁচা বুদ্ধি বলতে পারেন। আর হিজাবটা নিলাম নিজেকে আড়াল করার জন্য। যদিও এটার জন্য প্রথম দিকে অনেক টিটকারী সহ্য করতে হয়েছিলো তবু ধীরে ধীরে এর সুফলটা পেতে শুরু করলাম। পর্দা করি এই কারণ দেখিয়ে এক বড়মামা ছাড়া আর কোন গায়ের মাহরামকে কাছে ঘেঁষতে দিতাম না। ঐদিকে শাহানকে বুঝতে দিলাম যে আমি ওকে পছন্দ করি। শাহান প্রথম থেকেই আমাতে মুগ্ধ ছিলো। ওর সেই মুগ্ধতার পালে হাওয়া দিয়ে সম্পর্কের নৌকাটাকে আরো বেগবান করে দিলাম। ব্যস্, শাহান নিজেই মামা-মামীকে জানিয়ে দিলো যে ও আমাকে বিয়ে করবে। মামা মামীও বিনা প্রতিবাদে রাজী হলেন আর সমাজ জানলো তারা এক এতিম মেয়েকে আশ্রয়ের সাথে সামাজিক মর্যাদা দিয়ে সম্মাণিত করতে যাচ্ছেন। কেবল আমিই জানলাম যে, এটা কতবড় ধোঁকা। ” এক টানে কথাগুলো বলে থামল অদিতি।

আজাদ বলবে না ভেবেও বলে ফেলল, ” কিছু মনে করবেন না। ধোঁকা তো আপনিও শাহানকে দিতে যাচ্ছিলেন, তাই না ? ভালো না বেসেও ভালোবাসার ভান করা। এটা কী ধোঁকা নয় ? ” কথাটা শুনে খানিক নিরব থেকে সামান্য মাথা ঝাঁকালো অদিতি।

-” হম, একেবারে ভুল বলেন নি। তবে আমি শাহানকে ঠকাতাম না। আমার যা দায়িত্ব তা ঠিকই পালন করতাম। ভালোবাসার আর কী ! ওটাতো হয়েই যায়।”

আজাদ এবার মুচকি হেসে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। অদিতি হাসল না। কিছুটা রূঢ় স্বরেই কেটে কেটে বলতে লাগলো, ” আচ্ছা, আপনি নিজেও তো রুমকিকে ভালোবাসতেন তাই না ? তাহলে আবার সম্পত্তি লোভ করেছিলেন বললেন যে ? মানে, দুটো একসাথে কিভাবে সম্ভব হয় বুঝিনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ” বলে আজাদের বন্ধ চোখের দিকে বারদুয়েক তাকাতে গিয়ে গাড়ীটা আচমকা ঝাঁকি খেয়ে উঠল। অদিতি দ্রুত ‘স্যরি’ বলে স্টিয়ারিং এ সক্রিয় হলো। ওর অমনোযোগীতার কারণেই গাড়ীটা গর্তে পড়ে ঝাঁকি খেয়েছিল।

আজাদ এবার চোখ খুলে অদিতির দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “রুমকির ব্যপারটা আমার মায়ের রচনা। তিনি চাইতেন রুমকি আমার বউ হয়ে আসুক আর তার অংশের সম্পত্তি আমার ভাগে চলে আসুক। সেভাবেই তিনি আমাকে বারবার রুমকির সাথে ভিড়িয়ে দিচ্ছিলেন। আমি কোন সাধুসন্ত নই অদিতি। তাছাড়া আমার বেড়ে ওঠায় কোন বিধিনিষেধের বেড়াজাল কোনোকালেই ছিলো না। ফলে অল্প বয়সেই এমন কিছু বন্ধুবান্ধব জুটে গিয়েছিলো যাদের সাথে থেকে আমি জীবনকে কেবল উপোভোগ করতে শিখেছিলাম। হোক তা ছিনিয়ে নিয়ে। আমার মা কখনই এ ব্যপারে বাধা দেন নি। উল্টো আমার হয়ে বাবা আর সমাজের সাথে ফাইট করেছেন। ফলে বেপরোয়া হয়ে বেড়ে উঠতে আমার দেরী হয়নি। রুমকির ব্যপারে আমি সবসময়ই ডেসপারেট ছিলাম।”
-” এখন নেই ? ”
-” সে বিবাহিত।”
-” তাতে কী। আপনি তো বেপরোয়া। নিয়ম না মানা মানুষ। ”
-” এখন মানতে শুরু করেছি।”
-” হঠাৎ…?”
-” কী করবো ! একজন যে আয়না দেখিয়ে দিয়েছে। আর তাতে নিজেকে দেখে বিষম চমকে উঠেছি। জীবনে এত অসহায় বোধ করিনি কোনদিন।” শান্ত স্থির কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেল আজাদ। অদিতিও চুপ মেরে গেল।

গাড়ী পেট্রল পাম্পে চলে এসেছে। দুজনই কথা বন্ধ করে গ্লাস তুলে চুপচাপ বসে রইল। একটা লোক এসে তেল ভরে দিয়ে টাকা নিয়ে সরে যেতেই আজাদ বলল, ” দিন, এবার আমি চালাই। আপনি তো অনেকক্ষণ টানলেন।”
-” পাগল নাকি। আপনার হাতে জখম। তাছাড়া অনেকদিন পর গাড়ী হাঁকাচ্ছি। মন্দ লাগছেনা।” অদিতি এবার সামান্য হাসলো।
আজাদ সেদিকে তাকিয়ে বলল, ” আমাকে টাশকিত করবেন কখন ? তর যে সইছে না।”
অদিতি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললো, ” আর কিছুক্ষণ। তারপরেই আপনার জারিজুরি খতম।”
চলবে….

[অনাকাঙ্খিত ভাবে পর্ব বেড়ে যাওয়ায় আন্তরিক ভাবে দুঃখিত]#এক_প্রহরের_খেলা
মোর্শেদা হোসেন রুবি

১৭||
আজাদকে এলোপাতাড়ী গাড়ী ড্রাইভ করতে দেখে একরকম ভয়ই পেল অদিতি। প্রতিমুহূর্তেই মনে হচ্ছে গাড়ীটা ছিটকে পড়বে রাস্তার একপাশে আর নয়তো যে কোনো সময় উল্টে যাবে। নিজেকে সিটের ওপর স্থির রাখতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল ওকে। এমতাবস্থাতেই আজাদের চিৎকার শুনে সিট বেল্ট বেঁধেছে সে। প্রায় মিনিট বিশেক পর অদিতি নিজেই চেঁচিয়ে উঠে বলল, ” গাড়ীটা থামান প্লিজ..।”
আজাদ গাড়ী এতটুকু স্লো না করেই পাল্টা চেঁচালো, ” কেন? ”
-” উফ্, থামান বলছি। স্টিয়ারিংটা এবার আমার হাতে দিন ।”
বিস্ময়ের আতিশায্যে আজাদ কোনো কথা বলল না। ঘাড় ফিরিয়ে পরপর দুবার অদিতিকে দেখল। ওর চাহনীর প্রত্যুত্তরে অদিতি কেবল মাথাই ঝাঁকাল।
-” শিওর? ” আজাদ কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইল।
-” আরে বাবা, শিওর। গাড়ীটা রাস্তার একপাশে সাইড করুন আর আপনি এপাশে চলে আসুন। আপনার হাতে গুলি লেগেছে বলেন নি কেন? রক্ত পড়ছে তো।”
আজাদ চকিতে নিজের বাহুর দিকে তাকাল। তারপরই কমিয়ে আনল গাড়ির গতি।
পুরোপুরি বন্ধ করার আগে আরেকবার নিশ্চিত হয়ে নিতে ব্যাক সাইড মিরর দেখল। নাহ্ পেছনে অজগরাকৃতির রাস্তাটা লম্বাটে হয়ে অনেকদুর চলে গেছে। আজাদের গাড়ীটা খানিক উঁচুতে হওয়ায় ঢালুর দিকের পথ প্রায় পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। এবং সেখানে কোনো গাড়ীর নামনিশানা নেই।
গাড়ী একপাশে থামল। এতক্ষণে হাতের দিকে মনোযোগ দেবার সুযোগ হলো আজাদের। মুখ নামিয়ে বাহুর দিকে তাকাতেই রক্তের অস্তিত্ব টের পেল। টিশার্টের একপাশের হাতা অনেকখানিই ভিজে গেছে। বাহু চেপে ধরে দরজা খুলে নেমে পড়ল আজাদ। অনুসন্ধানী চোখে চারপাশ আরেকবার দেখে গাড়ীর অপর পাশে চলে এল। অদিতি ততক্ষণে সিট টপকেই ড্রাইভিং সিটে চলে এসেছে। আজাদ প্যাসেঞ্জার সিটে উঠে বসতেই আঁতকে উঠল অদিতি। ওর শীৎকারে আজাদ হাসার চেষ্টা করতে গিয়ে ধমক খেল, ” পাগল নাকি আপনি ? হাসছেন কেন ? আপনার হাত থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে রক্ত পড়ছে আর আপনি কিনা…!” থেমে গিয়ে রাস্তার চারপাশে তাকাল অদিতি। চারিদিকে কোন দোকানপাট নজরে এলোনা। অদূরে একটা চায়ের ছাপড়া আছে কেবল। মনে পড়ল আজাদ শহর থেকে বেরোনোর জন্য এলোপাতাড়ী গাড়ী চালিয়েছে। গত পঁচিশ মিনিটে ওরা বেশ কয়েক মাইল পথ অতিক্রম করে এসেছে। আজাদের দিকে তাকাতেই ওর চেহারায় যন্ত্রণায় ছাপ দেখতে পেল অদিতি। মুখটা কুঁচকে রেখেছে বেচারা।
-” ইস্, আপনার তো ডাক্তার দরকার।” অদিতি খানিকটা অসহায়ের মতই বলে উঠল।
-” এখানে ডাক্তার কোথায় পাবেন ? ”
-” ডাক্তার না হলেও যে কোন ফার্মেসী….!” বলেই দ্রুত ইগনিশন সুইচ অন করল অদিতি । ওর অভ্যস্ত ভঙ্গি দেখে মনে মনে চমৎকৃত না হয়ে পারল না আজাদ। তবে কোন মন্তব্য করলো না সে। মৃদু ঝাঁকি দিয়ে স্টার্ট নিলো গাড়ীটা। এগিয়ে চলল মসৃণ গতিতে। আজাদ এবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল নিজের হাত নিয়ে।
-” আমি এদিকের রাস্তাঘাট একদমই চিনিনা। ফার্মেসী কোথায় জানেন ? ”
-” সামনের ডান দিক ধরে যান। মিনিট দশেক গেলে একটা পাবেন তবে ভাগ্য ভালো থাকলেই কেবল সেটা খোলা পাওয়া সম্ভব। ওটা বেশীরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে।” বলতে গিয়ে অজান্তেই রিয়ার ভিঊ মিররে চোখ পড়লো ওর। রাস্তা আগের মতোই ফাঁকা। হালকা একটা স্বস্তি কাজ করলো মনে। যাক্, ফেউ ছাড়ানো গেছে তাহলে। যদিও চিন্তা থেকেই যাচ্ছে। আর তা হলো মেয়েটাকে নিয়ে দ্রুত এই এরিয়া ছেড়ে চলে যাওয়া দরকার। আজাদ একা হলেও এতটা ভাবত না কিন্তু অদিতি মেয়েটা সাথে থাকাতে সব কিছু অন্যরকম করে ভাবতে হচ্ছে। তাছাড়া লিটনের টাকাটা ফেরত দেয়া দরকার। বেকুবটা টাকার শোকে আধাপাগল হয়ে আছে। তার উপর অদিতি হাতছাড়া। লিটন নিশ্চয়ই ক্ষেপে আছে। এদিকে অদিতিকে রাঙামাটি দিয়ে এলেও একেবারে সুনিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। কে জানে, গন্ধ শুঁকে শুঁকে যদি সেখানে গিয়েও হাজির হয় শুয়োরটা! মেয়েটার কী অবস্থা করবে কে জানে। বাহুতে টান পড়ায় শিউরে উঠে ভাবনা বিচ্ছিন্ন হলো আজাদের। ক্ষণিকের জন্য সন্দেহ হলো, বুলেট ভেতরে রয়ে গেছে কিনা। পরক্ষণেই নিজেকে সান্ত্বনা দিল। নাহ্, বুলেট ভেতরে নেই। তখনই কেটে বেরিয়ে গেছে। বুলেট থাকলে সে নিশ্চয়ই এত শান্ত থাকতে পারত না। যদিও ক্ষতস্থান অসম্ভব টাটাচ্ছে।
-” ঐ যে ফার্মেসী। ” অদিতির চাপা স্বরের চিৎকারে জানালা ভেদ করে বাইরে তাকাল আজাদ। কপালগুণে ফার্মেসী খোলা পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ভাগ্য তাহলে আজ একটু বেশীই সুপ্রসন্ন। যতবার এই পথ দিয়ে গেছে কোনবারই এটা খোলা পায়নি আজাদ।
অদিতি আগেই নেমে পড়েছে। আজাদ তার পিছু নিলো। অল্পবয়সী এক কমপাউন্ডার এগিয়ে এসে কথা বললে আজাদ বাহুটা এগিয়ে দিয়ে ক্ষতস্থান দেখালো। মনে সামান্য দ্বিধা ছিল কম্পাউন্ডার ছেলেটাকে নিয়ে। হয়ত ছেলেটা ওর ক্ষতস্থান দেখে নানান প্রশ্ন জুড়ে দেবে। কিন্তু তেমনটি হলো না। সম্ভবত ছেলেটা এখনও পৃথিবীর জটিল দিকগুলো পুরোপুরি চিনে উঠতে পারেনি। সে কেবল “গুলি লাইগসেনি” প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিয়েই আজাদের হাত মেরামত করতে নেমে পড়ল। যেন প্রশ্ন করাটাই তার কাজ, উত্তর শোনার ততটা ইচ্ছা নেই। আজাদ অদিতি দুজনেই নিরব রইল। ছেলেটাও আর কোন প্রশ্ন করলো না। মিনিট পনের বাদে আজাদ আরাম বোধ করতে লাগল। ছেলেটা আসলেই কাজের। চমৎকার ফার্ষ্ট এইড দিয়েছে।

আজাদ কথা না বাড়িয়ে দাম মিটিয়ে দিয়ে পেইনকিলার আর ক্ষতসারার ঔষধ নিয়ে সোজা গাড়ীতে উঠে পড়ল। অদিতিকে প্রফেশনাল ড্রাইভারদের মত সিট বেল্ট খুঁজতে দেখে বলল, ” আপনি সত্যিই বড় অদ্ভুত মেয়ে। একের পর এক চমক দিয়ে যাচ্ছেন। আমি কিন্তু আপনার গাড়ী চালাতে পারার কথাটা শুনে টাশকি খেয়েছি।”
-” আরো খাবেন। অপেক্ষা করতে থাকুন।”
-” তাই নাকি ? দ্বিতীয় টাশকিটা কখন পাবো জানতে পারি ? ” বলে গাড়ীতে রাখা পানির বোতল বের করে পেইনকিলারটা খেয়ে নিল সে। অদিতি গাড়ী স্টার্ট করে বাতাসের শব্দে বলল, ” রাতের আগেই ইনশাআল্লাহ ।”

======

আদরের মেয়েকে ফিরে পেয়ে ব্যাকুল হয়ে কাঁদলেন ইমাম সাহেব। সাথে সাথেই দু’ রাকাত শোকরানা নামাজ আদায় করলেন তিনি। একটা মুরগী কিনে সদকা করে দিলেন। কাজের মেয়েটাকে দিয়ে বললেন, ” এটা তুই বাড়ী নিয়ে রেঁধে খাস।”। রুমকির মা’ও মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করলেন। মেয়ের মুখে গতকালের বিভীষিকাময় রাতের সমস্ত কথা শুনে কতশত বার যে আকাশের দিকে হাত তুলে শোকর জানালেন তার ইয়ত্তা নেই। একপর্যায়ে প্রাথমিক আবেগ কেটে গিয়ে দুজনেই বাস্তবে ফিরে এলেন। মেয়ের জামাই এর হাত ধরে নিজেই এবার অনুনয়ের সুরে তুললেন আব্দুল্লাহ হুজুর ।
-” বাবা, আমার মেয়েটা কখনও মিথ্যে বলে না। আপনি মানে আপনারা ওর কথা বিশ্বাস কইরেছেন তো বাবা? আপনাদের পরিবার থেকে যদি কোন প্রশ্ন ওঠে…!”

-” অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠেনা বাবা।” শ্বশুরকে থামিয়ে দিয়ে বলল ঋভূ। যদিও বাবা ডাকতে খানিক সংকোচ হচ্ছিল ওর। তবু ঋভূ বললো, ” বাবা, আমার পরিবার থেকে কোন প্রশ্ন উঠবেনা ইনশাআল্লাহ। যদি ওঠে সেটার জবাব দেবার জন্য আমি আছি। আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না।”

-” ভাবতাম না বাবা। গুলবানু চাচীকে সেই শৈশব থেকে চিনি। আমার কোন বিপদে তাঁকে এমন নিরব আগে কোনোদিন দেখিনি।” এ পর্যন্ত বলেই থেমে গেলেন তিনি। ঋভূ উঠে দাঁড়িয়ে শ্বশুরের হাত ধরে বললো, ” যে কাজে রুমকির সায় ছিলো না তার জন্য রুমকিকে কেন দায়ী হবে। আপনি এসব নিয়ে ভাববেন না। আর আমি স্থির করেছি আজই রুমকিকে নিয়ে ঢাকা ছাড়ব। যদি আপনি অনুমতি দেন তবেই ! ”
-” অনুমতি কী বলছো বাপ। মেয়েটাকে তার ঘরে ফিরে যেতে দেখলে আমি কতটা স্বস্তি পাবো তা তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না। ভালো কথা, তোমার আপানের সাথে যদি ওকে নিয়ে একটু দেখা কইরে আসতে তাহলে….। ” আব্দুল্লাহর কথা শেষ হবার আগেই ঋভূ মাথা নেড়ে সরাসরি নাকচ করে দিল প্রস্তাবটা। আব্দুল্লাহ নির্বাক চেয়ে রইলেন।
ঋভূ গম্ভীর মুখে বলল, ” আমার স্ত্রী’কে যারা অসম্মানের চোখে দেখবে তাদের কাছে ধর্ণা দেবার কোন ইচ্ছেই আমার নেই। আমি বিশ্বাস করি রুমকি নির্দোষ। কাজেই এ নিয়ে কোন কৈফিয়ত আমি কাউকে দেবো না। যার ইচ্ছে হয় বিশ্বাস করবে বা না করবে। আমার তাতে কিছু যায় আসে না।”
-” তবু বাবা। চাচী গুরুজন। তিনি….!”
-” এটা আমার উপর ছেড়ে দিন বাবা। আমি আপানকে অসম্মান করব না। আমি ঢাকা যাবার আগে অবশ্যই তাঁর সাথে দেখা করে আসব তবে একা। রুমকি ও বাড়ী যাবে না।” বলে ঋভূ বেরিয়ে গেলে আব্দুল্লাহ আর কিছু বলার অবকাশ পেলেন না।

আপান নিরুদ্বিগ্ন মুখে নিজের খাটেই দু’ পা মেলে চিরাচরিত ভঙ্গিতে এক পায়ের উপর অন্য পা ক্যাঁচ দিয়ে বসে পান সাজাচ্ছিলেন। নাতিকে দেখে পানের বাটা সরিয়ে রাখলেও কোন কথা বললেন না। ঋভূ বরাবরের মত আপানের পায়ের উপর আলতো হাত রেখে বললো, ” আমি বাড়ী যাচ্ছি আপান। আজ রাতের বাসেই।”
আপান চট করে কোন মন্তব্য করলেন না। শান্ত ভঙ্গিতে পানটা খিলি বানালেন।
ঋভূ উঠে দাঁড়াতেই বললেন, ” রুমকিরে নিয়েই ফিরে যাইতেছিস?”
-” তো কী রেখে যেতে বলছো ? ” উত্তেজিত না হবার পণটা রইলো না ঋভূর। চট করে যেন মাথায় আগুন ধরে গেলো ওর। আপান তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে হেসে বললেন, ” আমি তো বলি এমন মেইয়ে নিয়ে সংসার করা উচিত না। কে জানে গতরাইতে কমিনদে কী ঘটনা বানায়ে বইলেছে ! ”
-” আপান ! ” ঋভূ রাগ চেপে বলতে লাগল।” সংসার করব আমি। কাজেই আমাকে ভাবতে দাও। মনে করো আমার বউ পচে গেছে। তারপরেও সে আমার অধিকারভুক্ত। সবাইকে আমি তার ব্যপারে কথা বলার অধিকার দেইনি আর দেবোও না।”
-” ভাই কী রাগ কইরেসো আমার উপর? ”
-” নাহ্, আমার কারো উপর রাগ নেই। আমি এখন উঠব।”
-” ঢাকায় গেলি পরে তোমার বাবা, মা বাকি আত্মীয় স্বজনে নানান তানান কথা তুলবে রে ভাই। তাগের কী জবাব দিবা তুমি ? ”
-” তোমাকে যা দিয়েছি তাই দিবো। উত্তর কারো মনঃপূত হলে ভালো, না হলে নাই।”
-” তারমানে রুমকি তোমারে পটায়ে ফেইলিসে? ”
-” যা খুশি ভাবতে পারো। আমার কাছে কোন উত্তর পাবেনা এসবের। আমি মানুষটাই এমন। সবাই আমাকে পটিয়েই ফেলে। নইলে নিজের অসুখের বাহানা দিয়ে তুমিই বা সেদিন পটাতে কেমন করে!” এক নিঃশ্বাসে বলে থামল ঋভূ।

-” এহন আবার যদি ঐরকম কইরে হাত ধরি, তুমি আমার কথাডা রাখবা ভাই? ” আপানের কণ্ঠে অনুনয়ের সুর।
ঋভূ স্থির ঠান্ডা স্বরে বলল, ” রুমকির ব্যপার ছাড়া।”
-” তারমানে তুমি রুমকিকে ছাইড়ে দেবানা ? এই ভাগোড়া মেইয়ে নিয়েই সংসার করবা?”
-” হ্যাঁ, করবো। আর কিছু ? ” ঋভূ রেগে কাঁই হলেও নিজেকে প্রানপনে শান্ত রাখলো।
আপান মুচকি হেসে খাট থেকে নেমে ঋভূর হাত ধরে টানতে গিয়ে টের পেলেন, নাতি তার লোহার মত শক্ত হয়ে আছে। ঋভূ প্রচন্ড রেগে গেলেই কেবল এমন করে। আপান এবার নাতির পকেটে টাকার ছোটখাটো বান্ডিলটা ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, ” তুমি পরীক্ষায় পাশ কইরেছো ভাই। আমি খুবই খুশি হইসি। মনটায় বড় অশান্তি ছিলো। আইজ দুর হইলো।”
-” মানে ? ” এবার ঋভূর পালা। সে যারপরনাই বিস্মিত আপানের পরিবর্তিত আচরণে। আপান সবজান্তার ভঙ্গিতে হাসলেন।
-” ভাই রে, বয়স তো আর বাতাসে হইতাসে না। কিছু বুদ্ধিশুদ্ধিতেও পাকে। তোমার এই জিনিসটাই আমারে চিন্তায় ফেইলেছিলো। তুমি আমার কারণেই এককথায় বিয়ে করতে রাজী হইলে। ঐদিকে শুনলাম মায়ের সাথেও নাকি রুমকিরে নিয়ে রাগারাগি কইরেছিলে। তুমি তোমার মায়রে হুমকি দিইসিলে যে বাড়ী ছাইড়ে চইলে যাবা। তোমার নাকি পছন্দের মেইয়ে আছে। সেদিন সব শুনেও কিছু বলিনি। ইবার সুযোগ পেইয়ে রুমকিরে বগলদাবা কইরে নিয়ে আসলাম। ইচ্ছা ছিলো তোমার মনের টানটা দেখবো। এর মইদ্যে ঘটলো আরেক ঘটনা। সুযোগ বুইঝে তোমারে টোকা দিয়ে দেখলাম তুমি কী কও। ভয়ও পাচ্ছিলাম ভাই, তুমি না আবার দুর্বল হইয়ে পড়ো আর বাবা মায়ের কথা শুইনে রুমকিরে কষ্ট দাও। তাই তোমারে ঐভাবে বইলে তোমার মন যাচিছি আমি। তুমি রাগ করাতে আমি খুশি হইসি ভাই। তুমি ঠিক না থাকলে ঐ মেয়ের জীবন কষ্ট করতি করতি যাবে। তুমি শক্ত আছো আর চিন্তা নাই। এবার তোমরা ঢাকায় যাতি পারো। আজাইদ্যারে বিশ্বাস নাই। সে আবার কোন মতলব আঁটে কে জানে।”
ঋভূ মন্ত্রমুগ্ধের মত আপানের কথা শুনছিলো। এবার আপানের হাত ধরে আস্থার সাথে বলল, ” আজাদ কেন, পৃথিবীর কেউই এখন আমার মনে রুমকির প্রতি বিষ ঢালতে পারবে না। ”
-” আলহামদুলিল্লাহ ভাই। আমি খুব খুশি হইসি। এইবার কী রুমকিটারে নিয়ে আসবি নাকি একবার দেখা কইরে যাইতে?”
ঋভূ মুচকি হেসে মাথা নাড়ল, ” এক্ষূনি নিয়ে আসছি। আচ্ছা ভালো কথা। পকেটে টাকা কিসের দিলে আপান ? ”
-” রাখ ঐ টা। আজ ঢাকা ফিইরে গিইয়ে সমুদ্দুরের টিকিট কাটবি। রুমকিরে নিয়া হানিমুন না কী কয়, ঐটা সাইরে আয়। বুঝলি ? ”
ঋভূ আনন্দে আপানের হাত চেপে ধরে তাতে চুমু খেয়ে বলল, ” তুমি আমাদের জন্য দোয়া করো আপান। ”
-” হ, তা তো করি। সমুদ্দুর গিয়ে আমার লাগি একটা পুতিন নে আয়।”
ঋভূ এবার বোকা বোকা হেসে ফেলল। আপানটার মুখে সত্যিই কিছু আটকায় না।
======

বেশ কিছুক্ষণ ধরেই আজাদ মোবাইলে কাউকে ট্রেস করার চেষ্টা করছে। কিন্তু নেট প্রবলেমে বিরক্ত হয়ে এক পর্যায়ে ফোনটা ড্যাশবোর্ডের উপরে ছুঁড়ে মারল। অদিতি হঠাৎ করেই বলে উঠলো।
– ” আমার বিশ্বাস হচ্ছেনা জানেন ? ”
-” কী বিশ্বাস হচ্ছে না ? ”
বাম হাত দিয়ে গুঁজে থাকা শার্টের কলার টেনে ঠিক করে তাকাল আজাদ। ডান হাতটা একরকম অকেজোই পড়ে আছে বলে বাম হাতেই সব করতে হচ্ছে ওকে। অদিতি একইভাবে বলল,
-” এই যে আমাকে ঘিরে এতসব কান্ড ঘটছে।”
আজাদ হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা ফের তুলে নিয়ে ডায়াল করে কানে চাপাল। সে অবস্থাতেই বলল , ” স্বাভাবিক। আজ আপনার শাহানের বাসরঘরে থাকার কথা ছিল আর আপনি কীনা আপনার আহত কিডন্যাপারকে পাশে বসিয়ে শহর থেকে পালাচ্ছেন। ব্যপারটা সত্যিই দুঃখজনক।”
-” আমি কিন্তু ঐ সেন্সে বলিনি। আমাকে রাগাবেন না প্লিজ। ”
-” সেক্ষেত্রে দুঃখিত। আমি ভেবেছিলাম আপনি খুব স্বাভাবিকভাবেই নিজের সম্ভাব্য বিয়েটা মিস করছেন। তাছাড়া ভালোবাসার মানুষকে না পেলে যে কেমন লাগে সেটা….!”
-” শাহানকে আমি ভালোবাসিনা।” আজাদের কথাটা কেটে দিয়ে দ্রুত উচ্চারণ করলো অদিতি। আর একই সাথে অদিতির কথা শুনে ফোন কেটে দিয়ে ওর দিকে ভাল করে তাকালো আজাদ।
-” ভালোবাসেন না তো বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন কেন ? ”
অদিতি দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল, ” এখন কোনদিকে যাবো ? ”
-” মেইনরোড ধরার আগে গাড়ীতে তেল নিতে হবে। আপনি বাম দিকের রাস্তা ধরে সোজা চলে যান। পেট্রল পাম্পে থামবেন।”
আজাদও স্বাভাবিকভাবেই জবাব দিলো।
অদিতি কোন কথা না বলে গাড়ী বায়ে টার্ণ করলো।
শান্ত ভঙ্গিতে বলে উঠল , ” আসলে আমাকে হিজাব নিকাবে দেখে অনেকেই ধরে নেয় যে, আমি খুব ধার্মিক একটা মেয়ে।”
-” কিন্তু আপনি তা নন। এটাই বলতে চাচ্ছেন ? ”
-” সব কথার ভুল ব্যখ্যা করেন কেন ?” স্পষ্টতই বিরক্ত হলো অদিতি। “এই পৃথিবীতে হাতে গোনা দু একটা জ্ঞানপাপী ছাড়া আর কেউই মানে না যে পৃথিবীটা আপনা আপনি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে আমাদের মালিক ঐ একজনই। যিনি আকাশে আছেন। পার্থক্য শুধু এতোটুকুই, প্রাকটিসিং মুসলিমরা তাঁর বেঁধে দেয়া বিধানগুলোকে মানতে চেষ্টা করে আর বাকিরা মনগড়া ভাবে তাঁকে মানে বা স্বীকার করে। কেবল তাঁর বিধানগুলে মানার প্রয়োজন মনে করেনা।”
-” আপনি কোনটা ? ” আজাদ কৌতুহলের চোখে তাকাল তার পাশে বসা অদ্ভুত মেয়েটার দিকে। অদিতি মন দিয়ে ড্রাইভ করছে। আজাদের কথার উত্তর দিলনা। আজাদও আর কোন প্রশ্ন না করে সিটের ওপর নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। তখনই শুনলো।
” জানেন, আমি অনেকটা বাধ্য হয়েই হিজাবকে আপন করে নিয়েছি। ”

আজাদ হেলান দেয়া অবস্থাতেই তাকাল। দৃশ্যত নিরব রইলেও মনে মনে বলল, তোমার তো খোলা থাকা উচিতই না মেয়ে। লোকজন স্রেফ বিনা অস্ত্রে মারা পড়বে। আর নয়ত তারা তোমাকে মারবে।

অদিতি বলল, ” আমার বয়স যখন এগারো তখন আমার বাবা-মা একটা রোড এক্সিডেন্টে মারা যান। এরপর বড়মামা আমাকে তার কাছে নিয়ে আসেন। শাহান লিটন আর ওদের একমাত্র বোন মুনার সাথেই আমি বেড়ে উঠতে থাকি। কয়েক বছর পরই টের পেলাম আমার বয়স বাড়ার সাথে পাল্লা দিয়ে লিটন আর শাহানের দৃষ্টিভঙ্গীও কেমন যেন পাল্টে যাচ্ছে। আবার বাড়ীতে আসা বিভিন্ন পুরুষ ভিজিটরসদের আলগা খাতিরও টের পেতে লাগলাম। তারা নানান ছুতোনাতায় আমাকে ডাকতেন। বুঝতে পারলাম, তাদের স্নেহ মমতা বন্ধুত্ব এসব ছিলো আমার কাছাকাছি আসার কিছু বৈধ নামমাত্র। এরইমধ্যে হঠাৎ একদিন লিটন আমার ঘুমের সুযোগে ঘরে ঢুকে অসভ্যতা করতে চেষ্টা করলো। টের পেয়ে সেদিনই অনেক ভেবেচিন্তে দুটো জিনিস বেছে নিলাম। হিজাব আর শাহান। প্রথমতঃ শাহানের সবকিছু লিটন আর মামার সাথে মিললেও সে নারী লোলুপ ছিলো না। দ্বিতীয় কারণ, শাহান আমার স্বামী হলে লিটন আমার উপর চড়াও হবার সাহস পাবেনা। কারণ মাথার উপর শাহান থাকবে। কাঁচা বয়সের কাঁচা বুদ্ধি বলতে পারেন। আর হিজাবটা নিলাম নিজেকে আড়াল করার জন্য। যদিও এটার জন্য প্রথম দিকে অনেক টিটকারী সহ্য করতে হয়েছিলো তবু ধীরে ধীরে এর সুফলটা পেতে শুরু করলাম। পর্দা করি এই কারণ দেখিয়ে এক বড়মামা ছাড়া আর কোন গায়ের মাহরামকে কাছে ঘেঁষতে দিতাম না। ঐদিকে শাহানকে বুঝতে দিলাম যে আমি ওকে পছন্দ করি। শাহান প্রথম থেকেই আমাতে মুগ্ধ ছিলো। ওর সেই মুগ্ধতার পালে হাওয়া দিয়ে সম্পর্কের নৌকাটাকে আরো বেগবান করে দিলাম। ব্যস্, শাহান নিজেই মামা-মামীকে জানিয়ে দিলো যে ও আমাকে বিয়ে করবে। মামা মামীও বিনা প্রতিবাদে রাজী হলেন আর সমাজ জানলো তারা এক এতিম মেয়েকে আশ্রয়ের সাথে সামাজিক মর্যাদা দিয়ে সম্মাণিত করতে যাচ্ছেন। কেবল আমিই জানলাম যে, এটা কতবড় ধোঁকা। ” এক টানে কথাগুলো বলে থামল অদিতি।

আজাদ বলবে না ভেবেও বলে ফেলল, ” কিছু মনে করবেন না। ধোঁকা তো আপনিও শাহানকে দিতে যাচ্ছিলেন, তাই না ? ভালো না বেসেও ভালোবাসার ভান করা। এটা কী ধোঁকা নয় ? ” কথাটা শুনে খানিক নিরব থেকে সামান্য মাথা ঝাঁকালো অদিতি।

-” হম, একেবারে ভুল বলেন নি। তবে আমি শাহানকে ঠকাতাম না। আমার যা দায়িত্ব তা ঠিকই পালন করতাম। ভালোবাসার আর কী ! ওটাতো হয়েই যায়।”

আজাদ এবার মুচকি হেসে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। অদিতি হাসল না। কিছুটা রূঢ় স্বরেই কেটে কেটে বলতে লাগলো, ” আচ্ছা, আপনি নিজেও তো রুমকিকে ভালোবাসতেন তাই না ? তাহলে আবার সম্পত্তি লোভ করেছিলেন বললেন যে ? মানে, দুটো একসাথে কিভাবে সম্ভব হয় বুঝিনি। তাই জিজ্ঞেস করলাম। ” বলে আজাদের বন্ধ চোখের দিকে বারদুয়েক তাকাতে গিয়ে গাড়ীটা আচমকা ঝাঁকি খেয়ে উঠল। অদিতি দ্রুত ‘স্যরি’ বলে স্টিয়ারিং এ সক্রিয় হলো। ওর অমনোযোগীতার কারণেই গাড়ীটা গর্তে পড়ে ঝাঁকি খেয়েছিল।

আজাদ এবার চোখ খুলে অদিতির দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, “রুমকির ব্যপারটা আমার মায়ের রচনা। তিনি চাইতেন রুমকি আমার বউ হয়ে আসুক আর তার অংশের সম্পত্তি আমার ভাগে চলে আসুক। সেভাবেই তিনি আমাকে বারবার রুমকির সাথে ভিড়িয়ে দিচ্ছিলেন। আমি কোন সাধুসন্ত নই অদিতি। তাছাড়া আমার বেড়ে ওঠায় কোন বিধিনিষেধের বেড়াজাল কোনোকালেই ছিলো না। ফলে অল্প বয়সেই এমন কিছু বন্ধুবান্ধব জুটে গিয়েছিলো যাদের সাথে থেকে আমি জীবনকে কেবল উপোভোগ করতে শিখেছিলাম। হোক তা ছিনিয়ে নিয়ে। আমার মা কখনই এ ব্যপারে বাধা দেন নি। উল্টো আমার হয়ে বাবা আর সমাজের সাথে ফাইট করেছেন। ফলে বেপরোয়া হয়ে বেড়ে উঠতে আমার দেরী হয়নি। রুমকির ব্যপারে আমি সবসময়ই ডেসপারেট ছিলাম।”
-” এখন নেই ? ”
-” সে বিবাহিত।”
-” তাতে কী। আপনি তো বেপরোয়া। নিয়ম না মানা মানুষ। ”
-” এখন মানতে শুরু করেছি।”
-” হঠাৎ…?”
-” কী করবো ! একজন যে আয়না দেখিয়ে দিয়েছে। আর তাতে নিজেকে দেখে বিষম চমকে উঠেছি। জীবনে এত অসহায় বোধ করিনি কোনদিন।” শান্ত স্থির কণ্ঠে কথাগুলো বলে গেল আজাদ। অদিতিও চুপ মেরে গেল।

গাড়ী পেট্রল পাম্পে চলে এসেছে। দুজনই কথা বন্ধ করে গ্লাস তুলে চুপচাপ বসে রইল। একটা লোক এসে তেল ভরে দিয়ে টাকা নিয়ে সরে যেতেই আজাদ বলল, ” দিন, এবার আমি চালাই। আপনি তো অনেকক্ষণ টানলেন।”
-” পাগল নাকি। আপনার হাতে জখম। তাছাড়া অনেকদিন পর গাড়ী হাঁকাচ্ছি। মন্দ লাগছেনা।” অদিতি এবার সামান্য হাসলো।
আজাদ সেদিকে তাকিয়ে বলল, ” আমাকে টাশকিত করবেন কখন ? তর যে সইছে না।”
অদিতি হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বললো, ” আর কিছুক্ষণ। তারপরেই আপনার জারিজুরি খতম।”
চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here