#এক_প্রহরের_খেলা
৫||
হুট করেই প্রীতির বিয়েটা ঠিক হয়ে গেল। আমি কস্মিনকালেও চিন্তা করিনি এত চট জলদি প্রীতির বিয়েটা ঠিক হয়ে যাবে। আমার ব্যপারে আপানের এক্সপেক্টেশনের কথা তো সর্বজনবিদিত কিন্তু প্রীতির ব্যপারে এমনটা ভাবা যায়নি। তবে মজনু মামা সোজা কথার মানুষ। তিনি ধানাই পানাই না করে সোজাসুজিই আকদের প্রস্তাব দিয়ে বসেছেন। আর তাতেই আমার পরম শ্রদ্ধেয় কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা উক্ত প্রস্তাব পেয়ে ‘না পাইয়া পাইলাম’ মর্মে গদগদ হয়ে সম্মতি দিয়ে বসেছেন। শুনে আমি ক্ষীণস্বরে প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছিলাম।
বাবার অনুপস্থিতিতে আম্মুকে আলাদা করে বললাম।
-” তোমাদের আচরণে মনে হচ্ছে আমরা দুই ভাই বোন তোমাদের বাড়ীর বোঝা। তোমাদের অন্নধ্বংস করে ভাঁড়ার খালি করে দিচ্ছি। তাই আমাদের বিয়ে দেবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ। প্রীতি এখনও বাচ্চা মেয়ে। ওর এখনই কিসের বিয়ে।”
-” অনার্স পড়ুয়া মেয়ে বাচ্চা মেয়ে হয় কিভাবে রে। ও তো রুমকির চেয়েও দু বছরের বড়। রুমকি এবার মাত্র এইচ এস সি দেবে। ”
-” রুমকির কথা ছাড়। বাপ-মা বিয়ে দিয়ে ঘাড়ের বোঝা নামিয়েছে। ওরা গ্রামের মেয়ে, ওদের কথা আলাদা। প্রীতিকে তুমি ওর সাথে মেলালে তো হবে না।” রুঢ় স্বরে কথাটা বলেই চকিতে চারপাশ দেখে নিলাম। নাহ্, রুমকি আশেপাশে নেই। কাজেই শোনারও চান্স নেই। কিন্তু রুমকি না থাকলে কী হবে। রুমকির শ্বাশুরি ঠিকই মাইন্ড করলেন। চাপা ধমকের সুরে বললেন,
-” ঋভূ। রুমকি সম্পর্কে তোর এভাবে কথা বলা বোধহয় উচিত হচ্ছে না। ওর বাপ-মা ঘাড় ওকে থেকে নামায়নি। আমাদের সামনে তোর আপান আব্দুল্লাহ ভাইয়ের হাত ধরে রুমকিকে তোমার জন্য চেয়ে নিয়েছে। নইলে আব্দুল্লাহ ভাই এখনই রুমকির বিয়ে দিতে রাজী ছিলেন না। তাছাড়া বিয়ে শাদী অল্প বয়সে হলেই ভাল। বরং আমরাই প্রীতির ব্যপারে দেরী করে ফেলেছি। সব কিছুর একটা পারফেক্ট টাইমিং আছে। বিয়ের বয়সে বিয়ে না করলে পরে বিয়েটা হয়ে যায় দায়িত্বের মত। যা কেবলি পালন করার জন্য করা । কিন্তু বিয়েটা তো কেবল দায়িত্ব না বাবা এটা মানুষের মৌলিক প্রয়োজনও। মানুষের মৌলিক প্রয়োজনকে সামাজিকতার ফেরে ফেলে একে ভিন্নমাত্রা দেয়া একেবারেই অনুচিত। ”
-” তবু, আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ের পক্ষপাতি না। ” ঘাড় গোঁজ করে বললাম।
-” কিন্তু প্রেম করার পক্ষপাতি, তাই না ? ” আমার কথাকে লুফে নিয়ে বললেন আম্মা। চোখ বড় বড় করে বললেন, ” তোকে যদি সময় মত বিয়ে দিতাম তাহলে আজ নিজের পেছনে ফেউ লাগিয়ে বসতে পারতি না। এখন তো দুই নৌকার সওয়ারী হয়েছিস।” এতটুকু বলেই আম্মা থেমে গেলেন।
আমি গোঁয়ারের মত বলে উঠলাম,
-” অামি দুই নৌকায় সওয়ার হইনি মা। তোমরা জোর করে আমার ঘাড়ে আরেক নৌকার বোঝা চাপিয়ে দিয়েছ। তাই আমাকে দুটো নৌকার গুন টানতে হচ্ছে। একটা স্বেচ্ছায় আরেকটা অনিচ্ছায়। প্রীতির বেলাতেও একই ভুল আমি মানব না। তোমরা কী প্রীতিকে জিজ্ঞেস করেছিলে যে সে কাউকে পছন্দ করে কিনা ? আমাকেও তো জিজ্ঞেস করো নি। কিন্তু আমি একদিন এই জাল ছিঁড়ে ঠিকই বেরিয়ে যাব। কিন্তু প্রীতি পারবে না। কারণ এ সমাজ ছেলেদের জন্য যতটা নমনীয়তা দেখায় মেয়েদের ততটা দেখায়না। সেকারণেই বলছি, রুমকির পাকনামি ভরা পরামর্শ শুনে লাফ দিয়ে আকদ করাতে দাঁড়িয়ে যেওনা। এনগেইজমেন্ট করে রাখো। দুজন দুজনকে বুঝুক তারপর আকদের সিদ্ধান্ত নিক।”
-” কী বলছিস তুই ? কাবিনের কথা মানা করে দেব ? ”
-” আলবৎ মানা করবে। রুমকি নিজে কী বোঝে যে তোমাদের এসব গুরু পরামর্শ দেয় ? আর তোমরাও মাত্র সাতদিনেই রুমকিকে বাড়ীর হর্তাকর্তা বানিয়ে বসেছ। ওর সম্পর্কে কতটুকু জানো তোমরা যে ওর পরামর্শ নিচ্ছো ? ”
আম্মু এবার চুপসে গেলেন। ক্লান্ত স্বরে বললেন, ” দেখি, তোর বাবার সাথে কথা বলে দেখি।”
মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে আকদায়োজন। এই কাঙালের কথা খাটেনি। তবে বাসী হলে ফলুক সেটাও চাইনা কারণ তাতে আমার বোনের সুখ নষ্ট হবে। তাই বাবা আর আপানের সাথে আমাকেও সম্মতি দিতে হল। কিন্তু রুমকিকে কথা শোনানোর সুযোগ পেয়ে পিছপা হলাম না।
ফাঁকা ঘরে একা পেয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বললাম ,” সবটার মধ্যে মাতব্বরী ফলানো শুরু করে দিয়েছ। তোমাকে এটা বলার পরও যে আমার জীবনে অন্য কারো প্রায়োরিটি বেশী তারপরেও এ বাড়ীর সর্বেসর্বা সাজার অপপ্রয়াস চালিয়েই যাচ্ছ। কী পেয়েছ তুমি? ”
-” জি না, আপনার ধারণা ভুল। আমি মোটেও এ বাড়ীর সর্বেসর্বা হতে চাইনি। বরং আমার এইচ এস সি পরীক্ষার বাহানায় শীঘ্রিই আমি এ বাড়ী ছেড়ে চলে যাবো বলে মনস্থ করেছি। অন্যভাবে গেলে তার চাপ আপনার উপর পড়বে বলেই এই অপেক্ষা । পরীক্ষার বাহানায় গিয়ে মাস দুয়েক পরে সবাইকে জানিয়ে দেব আপনাকে আমার পছন্দ না। তাহলে আপানার উপর আর চাপ আসবে না। কাজেই আমার ব্যপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। ” মৃদুস্বরে কথাগুলো বলে রুমকি চলে যেতে ধরলে ওকে থামালাম।
-” তাহলে তো তোমাকে সবাই সন্দেহ করবে।”
-” করবে না। আমার বাড়ীর লোক আমাকে জানে। তবে আপনার বাড়ীর লোক হয়ত আমাকে সন্দেহ করবে, তা করুক। আমি তো আর এখানে থাকতে যাচ্ছি না যে এখানকার সবার মনোভাব নিয়ে চিন্তা করব। তবে হ্যাঁ, আপান একটা ঝামেলা করতে পারে। সেটারও ব্যবস্থা করব ইনশাআল্লাহ।” বলে রুমকি চলে যেতে ধরলে আরেকবার ডাকলাম। স্বভাবসূলভ মেজাজ দিয়ে মেয়েটাকে ধ্বসিয়ে দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু তাকে স্বেচ্ছায় সরে দাঁড়াতে দেখে একটু করুণাই বোধহয় জন্মাল।
জানতে চাইলাম, ” এই স্বেচ্ছা নির্বাসনের কারণ ? ”
-” কারণটা আপনি ! ” বলে একটু থেমে করুণ চোখে তাকাল আমার দিকে। তারপর দৃষ্টি সরিয়ে বলল, ” বিয়ের রাতে আপনাকে বলেছিলাম , কোনদিন আমাকে বলবেন না যে আপনি আমাকে রাখবেন না বা আমার সাথে সংসার করবেন না। এতে এক তালাক হয়ে যায়। আমাদের ধর্মে এ ধরণের কথার উচ্চারণ কঠিন ভাবে নিষেধ করা হয়েছে। তারপরেও আপনি বলেছেন। সে হিসেবে এখন আমি আগামী তিনমাস আপনার স্ত্রী হিসেবে থাকব। এটা ইদ্দতকালীন সময়। তারপর আমি স্বাধীন। কিন্তু এই তিনমাস আমি আলাদা থাকব। প্রীতি যেহেতু চলে যাচ্ছে। ওর রুমে থাকতে আমার কোন সমস্যা হবে না। নিচের কেউ টেরও পাবেনা। সবকিছু আমি ভেবে রেখেছি। কাজেই আপনার চিন্তিত হবার কোন দরকার নেই।” বলে রুমকি আর দাঁড়াল না। দ্রুত বেরিয়ে গেল।
ওর কথা শুনে আমার স্বস্তিবোধ হবার কথা কিন্তু যতটা স্বস্তি পাওয়া উচিত ততটা পাচ্ছিনা। আজ আমারই মনের অগোচরে বলে ফেলা কথাটা আমার পায়ের বেড়ী খোলার চাবি হয়ে আমাকে মুক্ত করছে। অথচ আমি চিন্তিত বোধ করছি। কেন কে জানে । নাকি আপানের ভয় ? এটা তো সত্যি যে আপান একটা ঝামেলা পাকাবেই।চিন্তা বাড়ল এবার। পরক্ষণেই মনকে সান্ত্বনা দিলাম। দুউর, পাকালে পাকাক। আমার জীবন আমার। তারা চাইলেই এটাকে নিয়ে জুয়া খেলতে পারেনা। নিজেকে পিঠ চাপড়ে সান্ত্বনা দিলাম। তারপরেও মনের কোন এক কোণে কাঁটার মত খচখচ লেগেই রইল।
গত দুদিন ধরে বাসায় রীতিমত হুলুস্থুল অবস্থা। মজনু আঙ্কেল নিজেই আকদ করে রেখে যেতে চাচ্ছিলেন বলে আমার বাবা-মা’কে নতুন করে আকদের প্রস্তাব করতে হয়নি। তবে মজনু আঙ্কেলের সাথে একটা জায়গায় এসে মতের অমিল দেখা দিয়েছে। তিনি চাচ্ছিলেন, আপাতত আকদটা হয়ে থাক। তিনি বছর খানেক পরে দেশে এলে তখন ওয়ালিমা করে বউ ঘরে তুলবেন। আমার গ্রেট বাবাও সেটাই মেনে নিয়েছিলেন কিন্তু বাধ সাধলেন আপান। তাঁর এতে পোষাবে না।
প্রীতির বিয়ে উপলক্ষে গতকালই আপানকে ঢাকায় আনানো হয়েছে। উনি ঢাকায় এসে সব শুনে তখনই তাঁর ফোকলা দাঁতের তোতলা ভাষায় আম্মাকে বলতে লাগলেন, ” কাবিন কইরা মেয়ে বাজাইয়া থুইবা কুন কারণে। এইটা কী আমগো যুগ পাইছো যে মাইয়া ঘরে বইসা থাকব। সেয় তো পোরতিদিন যাইব সোয়ামীর লগে দেখা করতে। তারপরে এত্ত বড় পেট বানাইয়া বিয়ার ইস্টেজে উঠব। তহন কী বাচ্চা নষ্ট করবা না পেটুইলা মাইয়া বিয়া দিবা ? এইসব কাহিনী বহুত দেখসি। এসবের কুনু দরকার নাই। মাইয়ারে কাবিনের দিনই তুইলা দেও তাগো হাতে। এরপরে সোয়ামী নিয়া আসা যাওয়া করুক, চায় যা খুশি করুক। কুনু সমস্যা নাই। একটা ওলিমা করতে কী এমুন হাতিঘোড়া লাগে। অহন তো মোবাইলের যুগ। সবেরে ফুন কইরা আসতে বইলা দেও আর পুরা দায়িত্ব কুনু রেস্টুরেন্টে দিয়া দেও, কথা শ্যাষ। কাদিরা কো…? অরে খবর দেও। বাড়ি আসতে বলো তাড়াতাড়ি। আমার কথা বলো তারে, দুড় দিয়া আসবো ।” সবশুনে মজনু মামা আর বাবা দুজনই একমত হলেন যে মুরুব্বীর কথা ফেলা উচিত হবেনা। আর তারপরেই আয়োজনের ধুম পড়েছে। তবে রুমকি চলে যাবার কথা বললেও তার আচরণে স্বাভাবিক আছে দেখে স্বস্তি পেলাম আমি। নইলে আপান আর বাবা দুজনেই আমার কোর্ট মার্শাল করে ফেলবে এতে সন্দেহ নাই।
আজ বুধবার। শুক্রবার প্রীতির বিয়ে। সেই উপলক্ষে আকদের আগের দিন একেবারে ঘরোয়া পরিসরে গায়ে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। আম্মুর মুখেই শুনলাম, এই অনুষ্ঠানে নাকি ছেলেদের উপস্থিত রাখা হবে না। এটা শুধু মেয়েরা মিলে করবে। আর এই অভিনব প্ল্যানার যে আমার সদ্য আগত সহধর্মিনী রুমকি সুলতানা তা না শুনেও বুঝতে পারছিলাম। কিন্তু সব শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলাম না কারণ গায়ে হলুদের উৎসব নিয়ে আমার এমনিতেও তেমন কোন এক্সপেক্টেশন নেই। বরং ছেলেদের উপস্থিতির নিষেধাজ্ঞা জারি করায় তা আমার জন্য শাপেবর হয়েছে। এই পরিসরে আমি একটু বেরোতে পারব বাড়ী ছেড়ে। গত চার পাঁচদিন যাবৎ প্রীতির বিয়ে নিয়েই দৌড় ঝাঁপ করতে হয়েছে। নায়লার সাথে দেখা করা তো দুর, ফোনে কথা বলার ফুরসৎটুকু মেলেনি। আজই সুবর্ণ সুযোগ।
বাইরে বেরোবো বলে ভাবছি তখনই আপান আমাদের দুজনকে নিচে ডেকে পাঠালেন কারণ তিনি সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না। তাঁর হাঁটুর সমস্যা।
এই মুহূর্তে আমি আর রুমকি রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আপানের সামনে বসে আছি। তিনি আমার হাত ধরে আছেন কিন্তু কথা বলছেন রুমকির সাথে। তার মুখ হাসি হাসি হলেও কথার ধরণ বড়ই তীব্র যা আমি বরাবরই ভয় পাই। তবু নিরবে আপানের ডান হাত জড়িয়ে বসে রইলাম। কারণ এই মানুষটাকে আমি একই সাথে ভয় করি আবার প্রচন্ড ভালবাসি। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। আপান রুমকিকে বললেন,
” তর চেহারা সুরতের এই অবস্থা কেন রে রুমকি। আমার নাতি কী তরে খাওয়ায় না? ”
রুমকি মুচকি হেসে বলল, ” কেন খাওয়াবে না। আমি নিজেই পরীক্ষার টেনশনে আধামরা হয়ে আছি নানু। আর দুমাস পরেই তো পরীক্ষা।”
-” আমি তরে এই ভাতের কতা কইছি না গো নাতিন। অমন ছলাকলা আমার লগে করিস না। তর চেহারা কইতাসে ভিন্ন কথা। আমার লগে চালাকি করবি না! ” বলেই তিনি আমার দিকে তাকালেন, ” কী রে রূপইম্যা। বউয়ের এই দশা ক্যান ? ”
-” কী দশা ? ” বোকার মত রুমকি দিকে একবার তাকিয়েই চোখ সরিয়ে নিলাম।
-” কী দশা তুই বুজোস না ? রুমকিরে যেইরকম পাঠাইসি সেইরকমই আছে। শরমের কাঁটা দেহি ভাঙ্গে নাই। অর গায়েও তর বাসনা নাই। ক্যান রে বাই ? ”
আমি পাশে বসে নিরবে সব শুনে গেলাম। শরমের কাঁটা কিভাবে ভাঙ্গে শরমেই জিজ্ঞেস করার সাহস হলো না কারণ আপানের মুখে একদম লাগাম নাই। আর তার এ জাতীয় কথা বলা নতুন নয়। পুরোনো দিনের মানুষ বলেই কিনা কে জানে, সরাসরি কথা বলায় অভ্যস্ত তিনি। তবে আজ আমি একটু নার্ভাস হয়ে গেলাম। লজ্জাও পেলাম কিছুটা। ভাবছি, কথাটা তো আপান আমাকে একা বললেই পারতেন। রুমকির সামনে বলার কোন দরকার ছিলনা। কী জবাব দেব ভেবে পাচ্ছিনা।
আচমকা রুমকি প্রসঙ্গের মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বলল, ” আপান, বেয়াদবি না নিলে একটা কথা বলি ?” মনে মনে চমকে গেলাম ওর কথা শুনে। আমার নামে নালিশ করবে নাকি ?
-” কী কইবি…ক’ না ! ” বলে চিবানো পান জিহ্বার আগায় জড়ো করে হাতে নিয়ে ঘরের কোণে ছুঁড়ে মারলেন আপান। এদিকে আমার ঘাম ছোটার যোগাড় হয়েছে। কিন্তু রুমকি এসবের ধার দিয়ে গেল না।
মৃদু হেসে বলল, ” আপনি একটু আগে আমার শ্বশুরকে যে নামে ডাকলেন সেভাবে ডাকা কিন্তু গুনাহ।”
-” কী কস বইন ? ও আমার ছেলে। আমি তো অরে ছুটুকাল থেকাই ‘কাদিরা’ বইলা ডাকি। ” আপান অবাক আর আমি অস্বস্তিমুক্ত। মেয়েটা আসলেই বুদ্ধিমতী। কী চমৎকার করে প্রসঙ্গ বদলে ফেলল।
রুমকি মাথা নেড়ে বলল,
-” আমার শ্বশুরের নাম হলো মহিউদ্দিন কাদির। আর ‘ ক্বাদীর ‘ হলো আল্লাহর একটা গুণবাচক নাম। আপনি যেটা বললেন এটাতে নামটাকে বিকৃত করে ডাকা হলো। এমনটা গুনাহ নানু ।”
-” অ..! আমি তো অতশত বুজিনা বইন। না বুইজা ডাকি। আইচ্ছা, তুমি যখন বলছ, তাইলে আর ডাকুম না। অখন থেইকা অরে ‘মৈদ্দিন’ কইরা ডাকুম।” বুড়ি ফোঁকলা দাঁতে হাসলেন।
রুমকিও হেসে উঠে দাঁড়াতে গেলে আপান ওর হাত ধরে টান দিয়ে আবার বসিয়ে দিয়ে ফোঁকলা দাঁতে হেসে বললেন , ” চালাকি তো ভালোই জানো নাতিন। তবু আমার ভোন্দা নাতিটারে বশ করতে পারলানা ? সে যদি পুরুষ মানুষ হইয়া শরম পায় তাইলে তুমি অর শরম কাটাইয়া দেও বুবু। আমি তোমগো মিলমিশ চাই। এদিকে আসো। রূপইম্যার লগে বও। ” বলে রুমকির হাত ধরে টেনে আমার পাশে বসিয়ে আমার হাতে রুমকির হাত মিলিয়ে দিলেন। রুমকির কী হচ্ছিল জানিনা, কিন্তু আমার সমস্ত সত্ত্বায় এক অচেনা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ল। প্রবল অস্বস্তির সাথে এক টুকরো চোরা ভালোলাগা টুক করে আমার মনের গোপন আকাশটাকে ছুঁয়ে দিয়ে এল। পাশেই রুমকি মুখ নামিয়ে রেখেছে। আর পাথরের মত আমাকে ছুঁয়ে আছে। সে ছোঁয়াতে কোন উত্তাপ নেই।
আপান বলতে লাগলেন, ” আমি জানি, তোমাগো বিয়াটা আতকা হইসে। ভাব ভালবাসা হইতে একটু সময় লাগব। তাই বইলা তোমরা পরের মত থাকবা এইটা ঠিক না। শোনো, দুইজনরেই কই। সোয়ামী আর ইস্তিরি হইল গিয়া একে অন্যের পুশাক। আর পুশাকের কাম শইল ঢাকন। অয় তোমারে ঢাকব, তুমি অরে ঢাকবা….!”
আড়চোখে তাকাতে গিয়ে দেখলাম রুমকির নাক মুখ সব লাল হয়ে উঠছে। আমি নিজেও বুঝতে পারছি আপানের এসব আনসেন্সরড কথা বার্তা বন্ধ করতে বলা দরকার। কিন্তু আপান কিছু বুঝে ফেলবে এই ভয়ে নিরব রইলাম।
হঠাৎ লজ্জার মাথা খেয়ে বলে উঠলাম,
-” এসব তো জানি আপান। এবার থামো তুমি। আমার একটু বাইরে যেতে হবে। ” বলে উঠতে যাবার সময় পিঠে তার বুড়ো হাতের শক্ত থাবড়া খেয়ে থেমে গেলাম।
-” কই যাস্, বয় এইখানে। ” বলে হাত টান মেরে রুমকির পাশে বসিয়ে দিলে আমিও ফের ওর গা ঘেঁষে বসে পড়লাম। আমার অস্বস্তি দেখে আপান ফোকলা দাঁতে হেসে কুটিপাটি। আর বেচারী রুমকি সেই যে মুখ নামিয়েছে আর তোলার নাম নেই। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওকে ঐ লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়ে দিয়ে এক ছুটে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাই। কিন্তু এটাও করতে পারছি না। কারণ আপান অলরেডি নিজের বিয়ের সময়কার গল্প শুরু করে দিয়েছে। কিভাবে তার বাসর কেটেছে। উফ্, হরিবল। বেচারী রুমকি।
====
রুমকি আজ সকাল থেকেই দারুণ ব্যস্ত। সে দিক থেকে আমি আজ ঝাড়া হাত পা। কারণ বিয়ের যাবতীয় আয়োজন শাইন পুকুরে হচ্ছে। কাজের চাপ নেই বললেই চলে। তাই ভেবেছি, আজই একবার নায়লার সাথে দেখা করে এলে কেমন হয়। গতকাল আপানের চক্করে যেতে পারিনি। ওকে যদি কালকের আকদের অনুষ্ঠানে দাওয়াত করি তাহলেও একেবারে মন্দ হয়না। বাবা তো আমাকে বলেই দিয়েছেন, আমার যে ক’জন বন্ধু বান্ধব আছে তাদের সবাইকে দাওয়াত দিতে পারি। তাহলে নায়লা কেন নয়। যেমন ভাবা তেমন কাজ। বাইরে যাবার জন্য তৈরী হলাম। তার আগে ফোন করে আমাদের রঁদেভ্যুতে আসতে বলে দিলাম নায়লাকে। আমি যখন তৈরী হচ্ছি সেই সময় রুমকি এল।
-” এইযে, আপনি কী বেরোচ্ছেন ? ”
-” হ্যাঁ, কেন ? ” মুখোভাব গম্ভীর রেখেই জবাব দিলাম। আপানের গতকালকের কথাগুলোর পর ওর সামনে আমার অস্বস্তিটা যেন আরো বেড়ে গেছে। তাই এই চেষ্টাগাম্ভীর্য। কিন্তু মেয়েটা নির্বিকার। যেন কিছুই মনে নেই তার। এই মুহূর্তেও তাকে বেশ সপ্রতিভ দেখাচ্ছে। আজ মনে মনে আরেকবার স্বীকার করে নিলাম, মেয়েরা অস্কার উইনিং পারফরমেন্স জানে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি এই মেয়ে আমার প্রতি দুর্বল। কিন্তু ভাবখানা দেখ না। যেন আমার মত ঋভূ ওর আগে পিছে দশটা করে ঘোরে। হুঁহ্…! ভাবের রানী। দুমাস পরে চলে যাবে। তা যাও না, কে আটকেছে।
আমিও একা একাই ভাব নিলাম। শার্টের সামনের বোতাম গুলো ইচ্ছে করেই লাগালাম না। একটু ভাব দেখিয়ে বডি স্প্রে টা হাতে নিলাম। কেন এমন করছি আমি জানি না। কিন্তু করে চলেছি। মনের ভেতরের দুষ্ট মনটা বলছে , হুঁহ্..তুমি একাই বুঝি তোমার ভেজা চুুলের ভেলকি দেখাতে পারো। এবার আমার সিক্স প্যাকের ভেলকি দেখ। দেখি উদাসী ভাব কতক্ষণ টেকে।
বিরস ভঙ্গিতে উন্মুক্ত বক্ষে বডি স্প্রে’র ধুঁয়োয় ধুসরিত করে দিলাম। কেন যেন কাল থেকে ওর সামনে একটু ভাব ধরতে ইচ্ছে করছে। এসব নির্ঘাত আপানের কথায় সৃষ্ট ইলিউশান।
মুখোভাব গম্ভীর রেখেই বললাম, ” কী চাও বলে বিদায় হও। আমি তৈরী হচ্ছি দেখতে পাচ্ছ না?”
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি । আয়নায় রুমকির ছায়া পড়েছে। সে আজ গাঢ় বাসন্তী রঙা শাড়ী পড়েছে। গলায় হাতে জড়িয়েছে গাঁদা ফুলের মালা। একেবারেই অন্যরকম দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। ঠিক এ কারণেই আমার তাচ্ছিল্যপূর্ণ আচরণ একটু বেশীই দেখাতে হচ্ছে। মেয়েটা যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায় যে ওকে দেখে দু’বার ঢোক গিলেছি আমি। কারণ এই কদিনে আমি নিজেও খুব ভালভাবেই টের পেয়েছি যে, মেয়েটাও আচ্ছা পাজী। সে সবার সামনে পর্দা দেখায় আর আমার সামনে তার আলুথালু বেশ ধরতে ইচ্ছে করে। ঘর নড়ে তো বউ পড়ে অবস্থা। কখনও তার আঁচল সরে তো নয়ত জামা ভিজে। ভেবেছে আমি কিছু বুঝিনা। আমি সব চালাকিই বুঝি । বোকা না আমি।
রুমকি ইতস্তত করে বলল, ” ইয়ে আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে যে।”
-” কিহ্…? বাইরে যাবে মানে? ” ঘুরে দাঁড়িয়ে সরাসরি তাকাতে বাধ্য হলাম।
-” না, মানে, আমার একটা পার্সোনাল জিনিস আনতে হবে। কেনাকাটার সময় ভুলে গেছি। ওটা না হলে মহাবিপদে পড়ে যেতে হবে আমাকে। বাড়ীতে থাকতে আমার ছোটভাইটাই এনে দিত। এখানে আসার সময় আনতে ভুলে গেছি।”
-” কী সেই জিনিস ? ”
-” আপনাকে বলা যাবে না।” আরক্ত মুখে বলেই মুখ ফিরিয়ে নিল মেয়েটা।
ব্যস্ততার হাবভাব হয়ে গেল আবজাব । বিরক্ত হলেও জানতে ভীষণ ইচ্ছে হল কী তার সেই পার্সোনাল জিনিস যেটা সে আমাকে সাথে নিয়ে কিনবে! নিজেকে বেশ ইম্পর্টেন্টও মনে হচ্ছে আমার। তবুও পুরুষালি স্বভাব থেকেই বাঁদরামি করার ইচ্ছেটাকে দমন করতে পারলাম না। চিরাচরিত অভ্যাসে মুখ ফসকে বলেই বসলাম, ” আন্ডারগার্মেন্টস নাকী..?”
-” ছিহ্…!” দাঁতে দাঁত ঘষে শব্দটা উচ্চারণ করল রুমকি। যেন ছিহ তো না, ছ্যাঁছড়া উচ্চারণ করল।
আমিও ধমকের সুরে বললাম, ” বাহ্, নিজে আমাকে আড়েঠারে বললে ঠিক আছে আর আমি সরাসরি নাম উচ্চারণ করলে ছিহ্…?”
-” আমি কী এরকম কিছু উচ্চারণ করেছি ? আমি তো…!” বলেই সে দ্রুত একটা খাতা খুঁজে নিয়ে এসে তাতে খসখস করে কিছু লিখে সেই কাগজটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়েই উধাও। আমি বেকুবের মত কাগজটার দিকে তাকিয়ে দেখে হতাশ ভঙ্গিতে দু’হাত কোমড়ে রেখে উর্ধ্বমুখে তাকালাম। ফু করে সশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা ঝাঁকালাম। এটা তো একটা ঔষধের নাম। আশ্চর্য, এই সাধারণ জিনিসটা নিয়েও এত লুকোচুরি। আজব। এই মেয়ে কী পাগল নাকি…!!!
দরোজার বাইরে উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলাম। কাউকে না পেয়ে কাগজে ফের লিখলাম, ” এটা আমি একাই আনতে পারব। তোমাকে যেতে হবে না।” লিখে ড্রেসিং টেবিলের ওপর কাগজ চাপা দিয়ে বেরিয়ে গেলাম আমি।
====
-” কাল তাহলে তোমার বোনের বিয়ে ? ”
-” হম, কাল আকদ হবে। আকদের দিনই ওরা মেয়ে নিয়ে যাবে। বাবা আর মজনু মামার ইচ্ছা একবারে তুলে দেয়।”
-” বাহ্, তোমার প্যারেন্টস বেশ করিৎকর্মা দেখা যায়। ছেলে মেয়ে দুটোকেই শর্টকাটে পার করার ধান্ধা। আইডিয়াটা মন্দ না। অনেক খরচ বেঁচে যায় এভাবে।”
নায়লার কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। এই প্রথম নায়লার কথা বলার ভঙ্গি আমার কাছে ভাল লাগল না। এতোটা অশ্রদ্ধা করার মত তারা কিছু করেন নি যে নায়লাকে এভাবে বলতে হবে।
কিছুটা রূঢ় স্বরেই বললাম, ” দেখ, অপরাধ যা করার আমি করেছি। আমার প্যারেন্টস করেনি। কাজেই যা বলার সবসময় আমাকে বলবে। আমার ফ্যামিলিকে না।”
-” বিড়ালের মুখে হঠাৎ হালুম শুনে অবাক হচ্ছি।”
-” তারমানে তুমি বিড়াল মার্কা হাজবেন্ডই পছন্দ কর। যেন যখন তখন কিক মেরে পানিতে ফেলে দিতে পারো, তাই তো? ” হুট করে বলে ফেললাম কথাটা।
অনিচ্ছাকৃত ভাবেই রুমকির কথা বলার ভঙ্গিমার সাথে নায়লার ভঙ্গিমার একটা তুলনা চলে এল মনে।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, ” এ কারণেই ছেলেরা সমবয়সী মেয়ে বিয়ে করতে চায়না। মেয়েরা তাদের সমবয়সী সঙ্গীকে সবসময় ছেলেমানুষ নয়ত নাবালক মনে করে। যেমন, তোমার দৃষ্টিতে আমি।”
কথাটা কাজে দিল। নায়লা আমার মেজাজের আঁচ অনুমান করে স্বর নরম করে বলল, ” আচ্ছা, তুমি কী ফানও বোঝো না ! আমি তো এমনিই বলেছি। আর তুমি মাইন্ড করে বসলে। কখন যেতে হবে বলো তো ? ”
-” কাল রাত আটটায়। গুলশান শাইন পুকুর।”
-” তোমরা গায়ে হলুদ করছ না ? ”
-” হ্যাঁ, বাড়ীতে ওরা করছে তো। সব মেয়েরা মিলে…!”
-” ওয়াও। তাহলে বলছো না কেন ? আমিও হলুদ এটেন্ড করতে চাই।”
-” তুমি এটেন্ড করবে মানে ? তুমি গায়ে হলুদে গিয়ে কী করবে ? ”
-” কেন, বাকিরা যা করবে তাই। এই না বললে , সব মেয়েরা মিলে করবে ? আমিও তো মেয়েমানুষ।”
-” বাসায় জানতে চাইলে কী বলব? ”
-” বলবে আমি তোমার ক্লাস মেট ।”
-” না, না। সবাই সন্দেহ করবে। রুমকি তো পুরো বুঝে ফেলবে। ”
-” বুঝে ফেললে ফেলুক। সমস্যা কী। ওকে তো আমরা বোঝাতেই চাই। কেন, তুমি চাও না? ”
-” চাইব না কেন। আমি তো সরাসরি ওকে তোমার কথা বলেই দিয়েছি। সেও চলে যাবে বলেছে।”
-” তাহলে আর আপত্তি কিসের ? ”
-” না, ঠিক আপত্তি না ! ”
-” তাহলে কী ভয় পাও রুমকিকে ? ”
আমি থেমে গেলাম। নায়লার দিকে তাকাতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল রুমকির কথা। আস্তে করে উঠে দাঁড়ালাম। নায়লা তাকাল, ” কী হলো, কোথায় যাচ্ছ ? ”
-” একটা কাজ মনে পড়ে গেল হঠাৎ। যেতে হবে আমাকে।”
-” চলো, আমিও যাব তোমার সাথে।”
কথা না বাড়িয়ে নায়লাকে সাথে নিয়েই বেরিয়ে এলাম। মানা করলে নায়লা সন্দেহ করবে তাই ওকে নিয়েই ফার্মেসীতে ঢুকলাম। দোকানীকে ঔষধের নামটা বলতেই নায়লা খপ করে আমার শার্ট টেনে ধরল, ” এই অষুধ কার জন্য ? ”
-” কেন ? রুমকির জন্য ? ”
-” হোয়াট ? ”
-” হ্যাঁ, এত অবাক হবার কী আছে। সে নিজেই সাথে আসতে চাচ্ছিল কিন্তু আমি আনিনি। নিজেই কিনে নিয়ে যাব বলেছি।”
-” বাহ্, তারমানে রুমকি তোমাকে জিতে নিয়েছে ? ” নায়লার চেহারায় হতাশা না জেদ ঠিক বুঝতে পারলাম না।
চলবে….