#এক_প্রহরের_খেলা
৮||
-” তুমি যে সাসপেকশন থেকে সেদিন কথাটা জানতে চেয়েছিলে সেটা যদি সত্যি হয় তাহলে ? ”
প্রশ্নটা শান্ত ভঙ্গিতে ছুঁড়ে দিয়েই পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম। সেটার দিকে তাকিয়ে রইলাম কয়েক সেকেন্ড। একটু আগে দু’বার রিং হয়েছে। কল ভাইব্রেশনে ছিল বলে টের পাইনি। বাইকের ঝাঁকি আর ভাইব্রেশন একসাথে কাজ করছিল। সে কারণেই হয়ত আলাদা করে বুঝতে পারিনি। ফোনটা হাতে নিতে দেখলাম কলটা রুমকির ছিল। কল ব্যাক করলাম। মোবাইল কানে চেপেই এক পলক তাকালাম নায়লার দিকে। ওর হতভম্ব মুখটা দেখতে বেশ হাস্যকর লাগছে কারণ প্রশ্ন করেছি ঠিকই উত্তর দেবার সুযোগ দেইনি। উল্টো ফোনে ব্যস্ত ভাব দেখাচ্ছি। রুমকিই ফোন তুলল,
-” হ্যাঁ, বল মনিরা। ” ভারী স্বরে বললাম।
-” মনিরা বলছেন কেন আমাকে ? ” ওপাশ থেকে থমথমে মুখে প্রশ্ন করল রুমকি। আমি নায়লার দিকে আরেক বার তাকিয়ে হালকা গলায় বললাম, ” আচ্ছা, নুরী। এখন কী বলবে বল !”
-” দেখুন, না আমি মনিরা না নুরী। আমি রুমকি। আর গতরাতেও আপনাকে বলে দিয়েছি যে আমাকে মনিরা বানানোর চেষ্টা করে কোন লাভ হবেনা। আমি ওগুলোর একটাও হতে চাই না।”
-” এটা বলার জন্য ফোন দিয়েছ ? ”
-” এটা বলার জন্য ফোন দেব কেন। এই প্রসঙ্গ তো আপনি তুললেন। আমি তো ফোন দিয়েছি অন্য কারণে। যাই হোক, একটু তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে পারবেন?”
-” কেন, বাসায় আবার কী হয়েছে ? ”
-” বাসায় কিছু হয়নি। আপান যে আজই চলে যাবেন জানেন তো ? ”
-” ওহ্, দ্যাটস রিমাইন্ড মি। কয়টার বাস ?”
-” সন্ধ্যা সাতটার। ইয়ে, আমিও যাচ্ছি। মানে যেতে হচ্ছে ।”
-” হোয়াট ? ” এবার পুরোপুরি ভিরমি খেলাম। রীতিমত চেঁচিয়ে উঠলাম। বললাম, আপানের সাথে যাচ্ছ মানে? তোমার তো চলে যাবার কথা না।”
-” কারণটা এলে বলব ,এখন রাখি।”
বলেই রুমকি ফোন রেখে দিল। আমি মনে মনে এক রকম ছটফট করেই উঠলাম। রুমকি আপানের সাথে যাচ্ছে। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব। গতরাতে আমাদের মধ্যে কিছু কমিটমেন্ট হয়েছে। সেটা সে এত তাড়াতাড়ি কিভাবে ভুলে যেতে পারে। বিরক্তি চাপতে ঘাড়ে হাত বুলিয়ে এদিক সেদিক তাকালাম। মেজাজটা খারাপ হওয়া ধরছে ধীরে ধীরে। খেয়াল করলাম নায়লা বিস্মিত চোখে আমাকে দেখছে।
যদিও আমি আপানকে কারণ দেখিয়েই চেঁচিয়েছি যেটা ওপাশে রুমকি ধরতে না পারলেও এপাশের চুমকি তথা নায়লা ঠিকই ধরতে পেরেছে। তার চেহারার মারমুখী ভাবেই তা স্পষ্ট।
আমি তাকানোর সাথে সাথেই নায়লার দাঁতে দাঁত চেপে বলল, ” এ্যাই, তুমি আমাকে তখন কী বললে ? আমার সাসপেকশন সত্যি হবে মানে ? আর এই মনিরাটা কে, নুরীই বা কে ? আপান চলে যাচ্ছে শুনে এত জোরে চিৎকার দিলে কেন ? আসলে কী হচ্ছে তোমার বাসায় জানতে পারি ? ঐ মেয়ে তোমাকে বাইরে এলেই ফোন দিয়ে নানান ছুতানাতায় বাড়ীতে ডেকে নিয়ে যায়। কেসটা কী ? আর এখন তো এমন ভাবে কথা বললে যেন কারো চলে যাবার খবরে তুমি আপসেট হয়ে পড়েছ ! সেটা নিশ্চয়ই তোমার ঐ আপান নয় ? উড ইউ টেল মি, হোয়াটস গোয়িং অন ? ” এক সাথে প্রশ্নগুলো করে থামল নায়লা ।
নিরবে নায়লার প্রশ্নগুলো শুনলাম। তবে অন্যান্য দিনের মত অস্থিরতা প্রকাশ করলাম না। কেন যেন আজ আর নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে ইচ্ছে হল না আমার। নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললাম, ” তুমি আমাকে প্রোবাবলি সাত থেকে আটটা কোশ্চেন করেছ। এখানে কী আমি বেছে বেছে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দেব নাকি সবগুলো ? কারণ পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের নিয়ম হচ্ছে শেষ প্রশ্নটা সহ যে কোন তিনটা বা চারটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়, এটাই নিয়ম। তোমার প্রশ্নব্যাঙ্কের কয়টা প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে এটা কিন্তু বলে দাওনি। এটা একটু ক্লিয়ার কর।”
-” বহুত রঙ্গে আছো মনে হচ্ছে ? নতুন বউ মনে হয় আজকাল খুব যত্ন করছে। চাপার ধারের সাথে সাথে গায়ের চিকনাইও বেশ বেড়েছে দেখছি ? ”
হাসতে গিয়েও সামলে নিলাম। আজ সকালে আপানও এরকমই একটা মন্তব্য করেছে। ভয়ে দ্বিতীয়বার আপানের সামনে যাইনি। তবে আমার মতে, ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের উচিত আপানকে হায়ার করে নিয়ে যাওয়া। এই বুড়ি কিভাবে যেন সব বুঝে ফেলে। নাস্তা খেতে খেতেই নির্বিকারে বলে বসেছে , ” আমার ভাইটা দেখি আজকা চকচক করতাছে ।’ বলেই কানের কাছে মুখ এনে বিড়বিড় করে জানতে চাইলেন একান্ত কিছু কথা। আমি লজ্জা না পাবার ভান করে এড়িয়ে গেছি কিন্তু বুড়ির ছানি পড়া চোখের চেয়ে মনের চোখ সাংঘাতিক তীব্র। গালে ঠোনা মেরে বললেস, ” আইজ আমি বাসনা পাইতাছি। ভালো ভালো খুব ভালো। আমি কেবল ‘কচু পাইসো’ বলেই সরে এসেছি। বাসনা পাবার কারণটা একেবারে অযৌক্তিক নয় বলেই সামনে বসে থাকার সাহস পাইনি।
-” কী হল, একা একা হাসছ যে? কী জিজ্ঞেস করেছি শোনোনি? ”
আমি তাকাতেই সে ফের বলল ,” আমার সবগুলা প্রশ্নের উত্তর দাও । প্রথমে বলো আমার সাসপেকশন সত্যি হওয়া বলতে কী বুৃঝিয়েছ তুমি ! “অনেকটা মারমুখি ভঙ্গিতে বলল নায়লা।
আমি কব্জি উল্টে ঘড়ি দেখলাম, সাড়ে পাঁচটার উপরে বাজে। আপান যাবে সাতটার বাসে। তারমানে সাড়ে ছয়টার আগেই চলে যাবে। তা যাক্, কিন্তু রুমকিকে কেন বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে সেটাই তো বোধগম্য হচ্ছে না। এই বুড়ি আসলেই আমাকে পাগল বানিয়ে ফেলবে। প্রথমে তো বলা নাই কওয়া নাই হুট করে বিয়ে করিয়ে একজনকে হাতে ধরিয়ে দিল আর এখন যখন আমার আঠারো বাই বাইশ ফুটের রুমটাতে ভাব-ভালোবাসার মিষ্টি মিষ্টি হাওয়া বইতে শুরু করেছে ঠিক তখনই ঐ বুড়ির যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। তবে আমাকে জানতে হবে যে রুমকি হঠাৎ ঝিনাইদহ কেন যাচ্ছে। কারণ রুমকির পরীক্ষার এখনও দুইমাস বাকী। এখন যাবার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। তাছাড়া রুমকির সাথে আমার ডিভোর্সও নাকি হয় নাই। ওটা নাকি ও আমাকে ভয় দেখাবার জন্য বলেছিল। প্রথমত ফিউচার টেন্সে নাকি কখনো তালাক কার্যকর হয় না। তারচে বড় কথা, আমি রুমকির হাত ধরে তওবা করেছি গতকাল। ওয়াদা করেছি আর কোনদিন এসব কথা মুখে আনব না। দুজনের বন্ধুত্ব হয়েছে নতুন করে। আমরা দুজন নতুন এক চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। তাহলে হঠাৎ চলে যাবার মত কী হল।
বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে বললাম, ” একসাথে তো সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দেয়া সম্ভব না। জরুরী কোনটা সেটা বল। উত্তর দিয়ে আমি ভাগব। কারণ আপান ইজ গোয়িং।”
-” আপান যাচ্ছে তো তোমার কী? এর আগেও উনি গেছেন তখন তো এত পাগলামি দেখিনি।”
-” নায়লা। আমার বাসার পরিস্থিতি কতটা জটিল তা যদি জানতে তাহলে এভাবে বলতে না। প্রীতিকে নিয়ে বাসায় এমনিতেই জট পাকিয়ে আছে সব। আমার সেখানে থাকা জরুরী।” এড়িয়ে যেতে চাইলাম আমি।
-” তোমাদের সবটাতেই বাড়াবাড়ি। এতে জট পাকানোর কী আছে। বিয়ে তো আর হয়ে যায় নাই। আর হলেও ডিভোর্স করায়া নেয়া যেত। এগুলো আজকাল কোন ব্যপার না। ”
আমি শান্ত চোখে তাকালাম। ধীরে ধীরে বললাম, ” কিছু মানুষের জন্য সব কিছুই ছেলেখেলা। নিজেকে দিয়েই বিচার করো, আজ আমি যদি তোমাকে ফেলে চলে যাই তুমি কী এরকম স্বাভাবিক রিএক্টই করবে ? বলবে যে আজকাল এমন ব্রেকাপ তো কতই হচ্ছে, এসব কোন ব্যপার না। বলবে এটা ?” উত্তরের আশায় তাকিয়ে রইলাম নায়লার মুখের দিকে। নায়লার উত্তরটা আমার আসলেই জানা দরকার।
নায়লা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। কী ভাবছে কে জানে। চাপা স্বরে হঠাৎ বলে উঠল, ” আচ্ছা, যাও। বাড়ী যাও এখন । তোমার আপানকে বিদায় দিয়ে আসো। পারলে ঐ গাইয়াটাকেও সাথে ঝুলিয়ে দিয়ে আসো। ”
চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাড়ীর পথ ধরলাম। নায়লার কাছ থেকে অন্যরকম উত্তর আশা করেছিলাম। সচেতন ভাবে না হলেও আমার অবচেতন মন আজ অন্যকিছুই শুনতে চাইছিল । নিজেও জানিনা কখন কোন এক অসতর্ক মুহূর্ত থেকে রুমকিকে চাইতে শুরু করেছে আমার দুর্বোধ্য মন। একটু আধটু না। প্রচন্ড ভাবে। এই অমোঘ আকর্ষণ এড়ানোর কোন পথ আমি খুঁজে পাচ্ছিনা। বরং আজ যদি নায়লা বলত, ব্রেকাপ হলে হোক। আমি এটা নিয়ে এতটা আপসেট নই। তাহলে আজ আমি হয়ত হালকা হয়ে যেতে পারতাম। কিন্তু নায়লা আমাকে বাস্তবিকই বিপদে ফেলে দিল। এখন আমি জানি না কী করব। এক প্রহরের খেলায় নিজের যুক্তি বুদ্ধি সব খুঁইয়ে বসে আছি।
বাইক যখন নিউমার্কেট ক্রশ করছে ঠিক তখনই কোমড়ের কাছটা বিজবিজ করে উঠল। অবচেতন মন বলল এ নিশ্চয়ই রুমকি। বলাকা’র একটু সামনে গিয়ে বাইক থামিয়ে কোমড়ের বেল্টে গোঁজা মোবাইলটা তুলে নম্বর দেখেই রাজ্যের বিরক্তি ভর করল। নিজেকে কষে একটা চড় লাগাতে ইচ্ছে করল এই মুহূর্তে। কেন ধরে নিলাম যে এটা রুমকিরই ফোন ! ধ্যাৎ, আরো দেরী হবে এখন। যদিও এটুকু নিশ্চিত যে রুমকি আমার সাথে দেখা না করে যাবে না।
-” বল্ শান্ত।”
-” দোস্ত তুই কই? ”
-” রাস্তায় আছি। বাইকে। কী বলবি তাড়াতাড়ি বল, জ্যামে আটকে যাব।”
-” একটু জেনারেলে চলে আয়না দোস্ত। আম্মাকে নিয়ে এসেছি এখানে। ব্লাড লাগবে। আমার দুজন ডোনার দরকার। একজনকে পেয়েছি আরেকজন তুই ছাড়া কারো কথা ভাবতে পারছিনা। তোর ব্লাড গ্রুপ তো আম্মার সাথে মেলে।”
অসহায়ের মত কথাগুলো শুনে গেলাম। মোবাইলটা পকেটে রাখতে যাবার আগে মাটিতে আছাড় মেরে ভেঙ্গে ফেলার ইচ্ছাটা গলাটিপে হত্যা করলাম। আমার ঠিক নেই। ফেলে দিতেও পারি। দুই বিপরীতমুখী টানাপোড়েনে মনের অবস্থা যে কী দাঁড়ায় তা ভুক্তভোগী ছাড়া বাকীদের পক্ষে বোঝা কঠিন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইক স্টার্ট দিলাম। মনটা পড়ন্ত বিকেলের মতই বিষন্ন হয়ে আছে।
ধীর লয়ে এগিয়ে গেলাম এলিফ্যান্ট রোডের দিকে । দুইটা বিষন্নতার সাথে যুক্ত হয়েছে তৃতীয় বিষন্নতা।
নায়লার আমাকে আঁকড়ে ধরতে চাওয়ার আকুলতা, বিনা নোটিশে রুমকির চলে যাবার সমন জারি আর এখন শান্তর মায়ের জন্য রক্ত দিতে যাবার জোর তাগিদ। এই তিনটির মাঝে যে কোন একটি ভোগাচ্ছে বেশী। মনের চোরাগলিতে খুঁজে পেতে বের করে জানতে পারলাম, রুমকির চলে যাওয়ার খবরটাই আমাকে চরম ভোগাচ্ছে।
গত রাতের বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থান আমাদের জীবনে একটি নতুন দিনের সূচনা করে দিয়ে গেছে। নতুন করে রুমকির প্রেমে পড়েছি আমি। কারণটা আর কিছু নয়। দুজনের একান্ত কিছু মুহূর্ত। শরীর কখনো এতটা কাছে আসতে পারেনা মানুষের মন যতটা আসতে পারে। আমরা এসেছিলাম। গল্পে কথায় গতরাতেও আমরা ভোর করেছি ঠিক সেই বিয়ের রাতের মতই। সেদিনের মত গতরাতেও কথক ছিল একা রুমকি আর আমি ছিলাম নিরব স্রোতা। পার্থক্য এতটুকুই ছিল, আজকের আমি বিয়ের রাতের আমি ছিলাম না। বিয়ের রাতে আমার সমস্ত চেতনা জুড়ে ছিল নায়লা। সেদিন আমি প্রতি মুহূর্তে অপেক্ষায় ছিলাম কখন বলব নায়লার কথা। কিন্তু গতরাতে আমার চেতনা জুড়ে ছিল রুমকি। প্রতিমুহূর্তে অপেক্ষায় ছিলাম কখন ওকে বলব, ভাললাগে, ভালবাসি। কিন্তু বলতে পারিনি। কারণ তাতে রুমকির কাছে আমাকে ছোট হয়ে যেতে হত। রুমকি কী ভাবত যখন ওকে বলতাম তোমাতে বাধা পড়ে গেছি। লম্পট ছাড়া আর কিছু ভাবত না। কারণ আগের দিনও যার মনে নায়লা, আজ কয়েক ঘন্টার মধ্যে নায়লা সরে গিয়ে রুমকি মনে ঠাঁই পায় কিভাবে। কিন্তু আমি জানি পেয়েছে। তবে কেমন করে পেয়েছে সেটা জানি না। কেবল এতটুকু জানি, রুমকিকে আমার লাগবে। ওকে হারাতে চাইনা।
আমাকে পেয়ে যেন হাতে চাঁদ পেল শান্ত। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে দ্রুত চেম্বারে নিয়ে গেল আমাকে। টেষ্ট করিয়ে তার রিপোর্ট পেয়ে রক্ত দিতে দিতে রাত সাড়ে নয়টা বেজে গেল। বাইক সোজা ছোটালাম বাড়ীর দিকে। বুকের ভেতর অচেনা ধুকপুকানী। আমি জানি, আপানের কানমলা খাব। কারণ আমার জন্যই আজ তার দেরী হবে।
বাড়ী পৌঁছে গ্যারেজে কোনমতে আছড়ে ফেললাম এক্স এলটা। তারপরেই ছুট লাগালাম দোতলায়। জানি রুমকির বিচক্ষণ চাহনী আর প্রশ্রয়ের হাসি দেখে আমি আরেকবার হারিয়ে যাব। গতরাতেও গিয়েছিলাম। গল্পে কথায় ভুলে গিয়েছিলাম দুজনের মাঝে কুশনের পাহাড় দিতে। যার ফলে কখন পাশ বদলে রুমকির কাছে চলে গিয়েছিলাম বলতে পারব না। যখন টের পেয়েছি তখন অনেক দেরী হয়ে গেছে। সম্ভবত এ কারণেই মুরুব্বীরা বলেন আগুন আর ঘি একসাথে রাখতে নেই। নিঃশ্বাসের সুরে বিশ্বাসের অনেক কথা বলা হয়ে গিয়েছিল। বিশ্বাস বাস্তবতায় রূপ নিতেই যাচ্ছিল কিন্তু ফজরের আযান হয়ে যাওয়ায় রুমকিকে আবিস্কার করা সম্ভব হয়নি। তখনই ওকে বলেছিলাম, ” আমাকে একটু সময় দাও, আমি তোমার কাছে পুরোপুরি ফিরতে চাই। ” রুমকির উত্তর ছিল আরো স্মার্ট। সে বলেছিল, ” ফিরলে রুমকির কাছেই ফিরবে। কোন নুরী বা মনিরার কাছে না।”
বাথরুম বারান্দা তন্নতন্ন করে অবশেষে আম্মুকে ডাকতে ডাকতে নিচে নামলাম। রুমকি ওপরে কোথাও নেই তারমানে সে নিচে আম্মুদের ঘরে আছে। আমাকে দেখে আম্মু বেরিয়ে এল।
-” তুই কী রে ঋভূ। মেয়েটা তোকে পই পই করে বলল, সে ঝিনেদা যাচ্ছে। তুই কিনা আড্ডা শেষ করে এই রাত করে এলি? ”
-” রুমকি কই ? ” আম্মুর কথার জবাব দেবার ধৈর্য নেই আমার। অসহিষ্ণু স্বরে বললাম আমি।
-” কই আবার। সন্ধ্যা সাতটায় বাস। ওরা তো সোয়া ছয়টার সময়ই বের হয়ে গেছে। রুমকি তোর জন্য আধাঘন্টা দেরী করে শেষ পর্যন্ত চলেই গেল। ওর আর দোষ কী। আমি, তোর বাবা আমরা সবাই বললাম যে তুমি যাও। ঋভূকে আমরা বুঝিয়ে বলব।”
অসাঢ় হয়ে গেলাম অনেকটা। রুমকি চলে গেছে ! শেষ পর্যন্ত আমাকে না বলেই চলে গেল রুমকি। কিন্তু কেন। আজ তো ওর যাবার কথা ছিল না। রাগে অভিমানে কোন কথা না বলে নিরব বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম আম্মুর দিকে।
আম্মু বললেন, ” ওর মা’টা হঠাৎ করেই অসুস্থ হয়ে গেছে। তোর শ্বশুড় ফোন করে জানানোর পরই রুমকি মন খারাপ করে কান্নাকাটি করছে দেখে তোর বাবাই বললেন, যাও মা’কে দেখে আসো। দুদিন থাকো, ঋভূ গিয়ে নিয়ে আসবে। এসব শুনে বাধ্য হয়েই রওনা দিয়েছে মেয়েটা। আর তোর আপানকে তো জানিস। আজ যাবে বলেছে আজই যাবে। রুমকি চেয়েছিল তোর সাথে দেখা করে কাল যেতে। কিন্তু তোর আপানের জন্য ওকে নগদে রওনা দিতে হয়েছে। আচ্ছা, তুই এখন হাত মুখ ধুয়ে টেবিলে বস, আমি খাবার দিচ্ছি।”
-” আমি খাব না, আমার খিদে নেই।” বলে মুখ ভার করে সোজা আমার রুমে চলে এলাম। রুমে ঢুকতেই খারাপ লাগা তীব্রতা ধারণ করল। মোবাইল হাতে নিয়েও রেখে দিলাম অদম্য অভিমানে। অন্যরকম অশান্তিতে ছেয়ে আছে মনটা। কাপড় না ছেড়েই বিছানায় গড়িয়ে পড়েছি। বালিশে মুখ গুঁজে পড়ে থাকতে গিয়ে কখন চোখটা লেগে এসেছে বলতে পারব না। ঘুম ভাঙ্গল মোবাইলের শব্দে। ঘুম ঘুম চোখেই কোনমতে মোবাইল হাতে নিলাম। নাম দেখার প্রয়োজন বোধ করলাম না। এত রাতে সাধারণত নায়লাই ফোন করে। আজ আমি কারো সাথে কথা বলব না। আজ আমার রুমকির সাথে অনেক কথা ছিল। সেটা বলতে না পারার যাতনায় কথা না বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তাই একরকম বিরক্তি নিয়েই ফোনটা কেটে দিয়ে ঘুমে ডুবে গেলাম। তখনও জানি না, জীবন আমাকে নিয়ে কত বড় খেলা খেলতে যাচ্ছে। এখনও আমি বুঁদ হয়ে আছি একটি নির্মম প্রহরের নেশায়।
চলবে….