এক_রক্তিম_ভোর পর্ব_১৩
#প্রভা_আফরিন
‘নাবিলার অর্ধ বার্ষিক পরীক্ষার পর এক সপ্তাহের জন্য খুলনা যায় মামা বাড়িতে। মামাতো বোনের বিয়ে ছিলো সম্ভবত। সেখান থেকে ফিরেই নাবিলার মাঝে কিছু পরিবর্তন আসতে থাকে। পড়তে বসলে হঠাৎ হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়তো। পড়তে বসার জন্য কোনো বাহানাও করতো না। মাঝে মাঝে পড়ার সময় আমি মোবাইলে স্ক্রল করতে ব্যস্ত থাকলে ও আমার দিকে একধ্যানে তাকিয়ে থাকতো। হুট করে পরিবর্তনগুলো চোখে বাজলে প্রথম প্রথম পাত্তা দেইনি।
নাবিলা কিশোরী বয়সে যেনো বিপথগামী না হয় সে জন্য যথেষ্ট খেয়াল রাখতাম। কিন্তু কে জানতো যেসব জিনিস আটকাতে ওকে বাহিরের ছেলেদের থেকে সেইফ করতাম ও ঘরের ভেতরই সেসব অনুভূতিতে আক্রান্ত হবে! এবং সাথে আমাকেও আক্রান্ত করবে!
পড়া না পারলে বকার জন্য যেই চোখে ভয়-ভীতি কাজ করতো সেই চোখে হঠাৎ ভয়ের বদলে অভিমান দেখে আমি নিজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলাম।যেই মেয়েটা আমার থেকে পালাতে চাইতো সেই মেয়েটাই যেনো আঠার মতো আটকে থাকলে খুশি হয়। ওর কিশোরী বয়সের আবেগকে কিভাবে সামলাবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
ওকে বোঝানোর জন্য মনস্থির করতে না করতেই আমার ভার্সিটির এক বন্ধু ওকে পছন্দ করে বসে। আমায় এসে রিকুয়েষ্ট করে যদি নাবিলার পরিবার রাজি থাকে তবে আংটি পড়িয়ে রাখতে চায়। কথাটা শুনেই আমার টনক নড়ে। একটা বাচ্চা মেয়েকে আংটি পড়াতে চায়? নাবিলা তো ছোট্ট একটা মেয়ে। অন্তত আমার কাছে নাবিলা মানে সবসময়ই ছিলো ছোট বেলার পিচ্ছি মেয়েটা। কিন্তু বন্ধুর এহেন কথা শুনে নাবিলার দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকাই।
সত্যিই মেয়েটা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। শরীরে নারীসুলভ সুন্দর, সুশ্রী সকল বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। মুখটাতে একটা সুন্দর আভা খেলা করে সবসময়। আমার সামনে আসলে কেমন লজ্জায় নুইয়ে পড়ে মেয়েটা। একদিনেই যেন বড় হয়ে উঠলো আমার কাছে।ওই রুপ, চুল, চশমা পড়া আঁখি যুগল, সব যেন নতুন ভাবে আবিষ্কার হলো।
কই! আগেতো চোখে পড়েনি এসব। আসলে আমি কোনোদিন সেভাবে দেখিইনি ওকে। তাই আমার কাছে সব ছিলো অনাবিষ্কৃত।
আমার মধ্যে একরকম জড়তা চলে আসে। একেতো নাবিলাকে নতুন ভাবে আবিষ্কার করার অস্থিরতা।তারওপর নাবিলার আমাকে আকৃষ্ট করা, আশে পাশে ঘুরঘুর করার পাগলামিতে মেতে থাকা। সবমিলিয়ে আমি দিশাহারা অবস্থায় পড়েছিলাম।’
প্রয়াস লম্বা শ্বাস নিলো। আকাশে একটা আধখাওয়া রুপালি চাঁদ ঝলমল করছে। যার আলো গলে পড়ছে প্রয়াস আর জেসির গায়ে। আধার কিছুটা মলিন হয়ে আছে সেই আলোয়। নিশুতির নাম না জানা পোকাগুলো একাধারে ডেকে চলেছে দূরের ঝোপ থেকে। হিমেল হাওয়া এসে লাগলো ওদের গায়ে। শিরশির করে উঠলো প্রয়াসের শরীর। সাথে মনও।
জেসি জিজ্ঞেস করলো,
‘ তোমার দিক থেকে শুরুটা কিভাবে হলো?’
প্রয়াস চোখ বন্ধ করে বাতাসে নিজের অনুভূতি ছড়িয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
‘পৌষ মাস চলছে তখন। সকাল সকাল ভালোই কুয়াশা পড়তো। শীতভাবটা তখনো প্রখর হয়নি। ভোরে নামাজের পর প্রায় আধ ঘন্টা দৌড়ানো ছিলো আমার নিত্য অভ্যাস। এমনই এক সকালে দৌড়ে বাড়ি ফিরতেই থমকে গিয়েছিলাম। থমকে গিয়েছিলো আমার সব অনুভূতি। শুধু থমকে যায়নি আমার বেহায়া চোখদুটো।
পূর্বাকাশে সূর্য তখন উকি দিয়েছে সবে। তার রক্তিম আভা ভোরটাকে মখমলি আদুরে করে তুলেছে। সেই আদুরে রক্তিম ভোরে, বারান্দায় বসে এক রমনি লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পড়ে পায়ে আলতা দিতে ব্যস্ত ছিলো। খোলা চুলগুলো বারবার মুখের ওপর এসে বিরক্ত করছিলো। সে চোখমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে, মুখ থেকে চুল সরিয়ে কানের পিঠে গুজে দিয়ে আবার আলতা লাগাতে ঝুকে পড়ে পায়ের দিকে।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে কতবার যে ঢোক গিলেছি জানা নেই। পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হওয়ার যোগার। মনে হচ্ছিলো এক ট্যাংক পানি লাগবে সেই পিপাসা মেটাতে। কিংবা নাও মিটতে পারে। অনভিজ্ঞ হায়ে এবড়োথেবড়ো করে আলতা লাগিয়ে মেয়েটি বিশ্ব জয়ের হাসি দিয়ে দাড়ালো। এবং সাথে সাথেই দুজনের দৃষ্টি এক সুতোয় মিলিত হলো।
নাবিলা হয়তো সে সময় আমাকে আশা করেনি। আকস্মিক লজ্জায় মিইয়ে গেলো একদম। ভোরের রক্তিম সূর্যের মতোই ওর গালদুটোতে লালিমা দেখা গেলো।
আমি তখনো দেখেই যাচ্ছি বেহায়ার মতো। শাড়িতে মেয়েটার বয়স আরেকটু বেড়ে গেলো মনে হলো। উচ্ছল কিশোরী থেকে একদম নারীতে পরিনত হয়ে গেলো মেয়েটা। এক চিলতে লাজুক হাসি দিয়ে যখন আমার বুকে ঝংকার তুলে ও ভেতরে দৌড়ে গেলো তখন ধ্যান ভঙ্গ হয়ে ভাবতে লাগলাম আসলে কি হয়ে গেলো আমার।
ঘরে এসে ঘাম জড়ানো শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলাম। বারবার সেই মানবীর রক্তিম গালগুলো দেখতে ইচ্ছে করছিলো। মনকে সামলানো বড্ড দায় হয়ে উঠেছিলো।
যেইনা নিজেকে একটু সামলে উঠলাম তখনই সে আবার এসে এলোমেলো করে দিলো আমায়। সেদিন আমার জন্মদিন ছিলো। নিজের হাতে পায়েস করে এনেছিলো খাওয়াবে বলে। তাইতো মহারানী সকাল সকাল সেজেগুজে তৈরি হয়ে ছিলো। কিন্তু আমাকে অশান্ত করে দিয়েছিলো একদম। ওর সামনে তুতলে উঠছিলাম বারবার। নিজেকে ঠিক রাখতে গিয়ে ধমক দিয়ে বলি
‘তোকে সাদা শাড়িতে একদম বুড়ি লাগছে। একেতো চশমা পড়ে তারওপর শাড়ি। তোকে দাদি বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে। খবরদার এসব পড়ে আমার সামনে আসবিনা।’
মেয়েটার মুখটা একদম কাদোকাদো হয়ে উঠেছিলো। কোনোমতে পায়েসের বাটিটা রেখে দৌড়ে চলে যায় আমার সামনে থেকে। অথচ আমার মন বলছিলো অন্যকথা। বলতে ইচ্ছে করছিলো আরো কিছুক্ষণ থাক আমার সামনে। পারিনি। সারাদিন ঘরে দরজা আটকে ছিলাম। বন্ধুরা জন্মদিন সেলিব্রেট করতে কতবার ফোন দিয়েছে। কিন্তু আমি আটকে ছিলাম ভোরের সেই দৃশ্যতে।
প্রেমানুভূতি এক ছোয়াচে রোগ। যা নাবিলার থেকে আমার শরীরে সহজেই প্রবেশ করে এবং নিমিষেই গ্রাস করে নেয় আমার শরীর, মন, অনুভূতি এবং চিন্তাশক্তিকে। সেই করাল গ্রাস থেকে আমি মুক্তি পাইনি। মুক্তি চাইওনি। শুধু অনুভব করেছি। প্রতিটা দিন, প্রতিটা ক্ষণ।
নাবিলার আবেগ যেন ট্রেনের গতিতে ছুটছিলো তখন। আমার বকা সহজেই হজম করে আবার আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতো। নিজেকে সংযত করে যথেষ্ট শক্তভাব দেখাতাম। কিন্তু ওকে আটকানোর সাধ্যি ছিলো না আমার।
পড়াশোনাতেও বেখেয়ালি হয়ে পড়েছিলো। তাই বাধ্য হয়ে মিথ্যার আশ্রয় নেই। বলি আমার গার্লফ্রেন্ড আছে। কথাটা হয়তো ও আশা করেনি। প্রথম কয়েকদিন ঘর থেকে বের হয়নি। পরে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। কিন্তু যেই চোখে ভয় মিশ্রিত লজ্জা বিরাজ করতো সেই চোখে লজ্জার স্থানে হানা দেয় একরাশ বিরক্তি। ভেবেছিলাম ওর এইচএসসি পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।ভার্সিটি এডমিশন হয়ে গেলেই নিজের মনের কথা জাহির করবো। তাই মিথ্যা বলে এইসকল দিক থেকে দূরে রেখে পড়াশোনা মন দেওয়াতে চেয়েছিলাম।
সব আমার ইচ্ছেমতোই চলছিলো। বিপত্তি বাজলো যখন জানতে পারলাম দাদু আগেই আমার পথ বন্ধ করে দিয়ে গেছে। কথাটা শুনে একদম ভেঙে পড়েছিলাম। দাদুর শেষ ইচ্ছা না হলে কোনো চিন্তা ছিলো না। তবে সেইসময় বিয়েটা ভাঙলে পরিবারটা খুব কষ্ট পেতো। আর ওদের কষ্ট আমি কখনোই মানতে পারতাম না। সেজন্য নিজের ইচ্ছেকে বলি দিয়ে পাড়ি জমাই কানাডায়। নাবিলার সাথে কোনো যোগাযোগ রাখিনি। লন্ডনে তোমার বোনের বাড়ি না গেলে হয়তো অয়নের সত্যিটা আমার সামনে আসতো না আর আমাকে দেবদাসের রোল প্লে করে কাটাতে হতো বাকি জীবন। সবটা জেনে নতুন করে আশার আলো দেখতে পেয়েছিলাম। তারপরতো সব জানোই।’
‘এইজন্য বুঝি আজ আমাকে নিয়ে সকালে শাড়ি কিনতে গেলে? আমার মাধ্যমে ওকেও শাড়ি পড়ালে তাইনা?’ জেসি জানতে চাইলো।
‘একদম। আজ আবার ওর সেই বিধ্বংসী রুপে আমি কুপোকাত। এই রুপের সাগরে আমি বারবার, হাজারবার, অবিরত ডুবতে চাই। ভাসতে চাই। এই প্রেমানুভূতিতে আমার মরনও শ্রেয়।’
‘তাহলে এখন কেনো দেরি করছো মনের কথা জানাতে? মেয়েটাকে ধোয়াশার মধ্যে রেখেছো। আমাকে নিয়ে খুব জেলাস ফিল করে নাবিলা। আজ সকালে আমাদের একসাথে বের হতে দেখে ওর মুখটা দেখার মতো ছিলো।’
প্রয়াস ঠোঁট চেপে হাসলো।
‘আমি জানি ও তোমাকে নিয়ে জেলাস। নাবিলা যে এতো জলদি আমার প্রেমে পড়বে তা বুঝতেই পারিনি। ভেবেছি কাঠ খড় পোড়াতে হবে। কিন্তু সব একদম সহজেই হয়ে গেলো। ওর জেলাসি মুখটা দেখার লোভ সামলাতে পারছিনা বলেই তো এখনো বলিনি। তবে আর দেরি করবো না। এবার একদম আপন করে নেবো ওকে। আর দুরত্ব নয়।’
নাবিলার হাত পা কাপছে। উত্তেজনায় চোখে পানি চলে এসেছে। কি শুনলো এসব! ওর প্রয়াস ভাইয়া ওকেই ভালোবাসে! কেবল ওকেই!
খুশিতে পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। এত সুখানুভব হয়তো কখনো হয়নি ওর।
ছাদের প্রথম সিড়িতে দাঁড়িয়ে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে নিজেকে সামাল দিলো নাবিলা। উত্তেজনায় কি করবে কোথায় যাবে কিছুই বুঝলো না। একটু ঘাঢ় ঘোরাতেই দেয়ালের সাথে চশমাসহ মাথা ঠুকে গেলো ওর। হাতের চুড়িগুলোও মৃদু আওয়াজ করে উঠলো। নাবিলা জ্বিব কেটে থমকে দাড়ালো।
নিস্তব্ধতা ভেঙে আওয়াজটা পৌঁছে গেলো জেসি এবং প্রয়াসের কানে।
‘কে? কে ওখানে?’ প্রয়াস চেচিয়ে উঠলো।
নাবিলা জোরে কয়েকবার শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। পালাতে গেলে বুঝে যাবে ওরা। তাই ধরা দেওয়াই শ্রেয়।
‘ আ..আমি।’
সিড়ি থেকে বের হয়ে ছাদে দাড়ালো নাবিলা। আঁধারের জন্য মুখটা তেমন স্পষ্ট না হওয়ায় নাবিলা কিছুটা স্বস্তি পেল।
‘রাতের বেলা এখানে কি করছিস তুই?’ প্রয়াস ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রশ্ন করলো।
‘আ আসলে ঘরে ভালো লাগছিলো না। তাই ভাবলাম একটু ছাদে এসে দাড়াই। ওঠার সময় ধাক্কা খেলাম আরকি। ‘
নাবিলা কিছুটা হাসার চেষ্টা করলো। অনেকটা সহজ লাগছে এখন। তারপর আবার বললো,
‘তোমরা রাতের বেলা ছাদে কি করছো?’
প্রয়াস যেন হাফ ছেড়ে বাচলো। যাক বাবা কিছু শোনেনি তাহলে।
‘আমরা যাই করি। রাতের বেলা একা একা ছাদে উঠবি না তুই। ভালো না লাগলে দাদিকে সময় দে গিয়ে। যা ঘরে যা।’
নাবিলা কপট রাগ দেখাবার চেষ্টা করে মুখ ভেঙচি দিয়ে ধপ ধপ শব্দে পা ফেলে, চুড়ির টুংটাং আওয়াজ করে নেমে গেলো।
চলবে…