এক_রক্তিম_ভোর পর্ব_১৪
#প্রভা_আফরিন
রাত ক্রমশ গভীর হয়ে উঠেছে। আধ খাওয়া চাঁদটা পশ্চিম অন্তরীক্ষে বিরাজমান। মৃদুভাবে বয়ে চলা স্নিগ্ধ সমীরণে নাবিলার অশ্রু শুকিয়ে নোনা জলের ছাপ রেখে গেছে অনেকক্ষন। এই কান্না সুখের, পরম আনন্দের। হৃদয়ে প্রশান্তির ঢেউ একেরপর এক এসে আছড়ে পড়ছে। অশান্ত মন কাঙ্খিত ব্যক্তিটিকে প্রাপ্তির অমোঘ খুশিতে নিদ্রাহীন স্বপ্ন বুননে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। নেই সময় নিয়ে ভাবনা অথবা নির্মল নিদ্রার প্রস্তুতি।
নিশুতি আধার, সুনসান নীরবতা কিংবা হঠাৎ হঠাৎ দূর থেকে ভেসে আসা মা প্যাঁচার আকষ্মিক চিৎকারেও ভয়ের রেশ দেখা যাচ্ছে না মনের কোথাও। নাবিলা এক নির্ঘুম রজনী পার করছে আজ। সন্ধ্যার সেই খুশির রেশ অক্ষি যুগলের কোথাও নিদ্রা নামক বস্তুকে ঠাই দিচ্ছে না।
নাবিলা যখন দশম শ্রেণিতে মামা বাড়ি যায় তখনই ভালোলাগার প্রথম অনুভূতির আভাস পায়। ওর মামাতো বোনের প্রেমের বিয়ে ছিলো। নাবিলা বোনকে জিজ্ঞেস করেছিলো প্রেম কি? কিভাবে করে? ওর বোন হেসে উত্তর দেয়,
‘ যখন কাউকে ভালো লাগবে, তাকে মনে মনে মিস করবি, তার জন্য আলাদা এক অনুভূতির দেখা পাবি, তার কথা,আচার-আচরণ, ভঙ্গিমা সব মনে ধরবে তখন বুঝবি তার প্রতি তোর ভালোলাগা আছে। আর ভালোলাগাকে প্রাধান্য দিয়ে যখন সামনে এগোবি তখন প্রেমের দেখা পাবি।’
এর পর যতদিন মামা বাড়ি ছিলো নাবিলা শুধু ভালোলাগার ব্যক্তিটিকে খুজেছে। চোখ বন্ধ করে প্রয়াস ভাইয়ার মুখটাই পেয়েছে বারাবার। এই একজন মানুষই তো ওর চারপাশে থাকতো সবসময়। ওকে আগলে রাখা, শাসন করা, নতুন কিছু শেখানোতে মত্ত থাকা মানুষটাই তো ওই সেইজন। তারপরই ভয়ের আড়ালে উঁকি দেয় নতুন অনুভূতি। যে অনুভূতির নাম জানা ছিলো না নাবিলার। শুধু জানতো ভালোলাগে
গায়ে থেকে শাড়িটা খোলা হয়নি এখনো। খুলবেও না সহজে। তার প্রিয় ব্যাক্তিটির দেওয়া প্রিয় একটি উপহার এটা। চোখ বন্ধ করে বিছানায় গড়াগড়ি করতে করতে শাড়িটা দুমড়েমুচড়ে আলুথালু হয়ে গিয়েছে। তবুও গা থেকে খসাতে ইচ্ছে করছে না।
হুট করেই বারান্দ থেকে ধুপ করে একটা আওয়াজ এলো। মাঝ রাতে এমন একটা আওয়াজ আসাটা নিঃসন্দেহে ভয়ের। নাবিলার মনেও ভীতি সৃষ্টি হলো। বারান্দার দরজাটা খোলাই আছে। সেখানে অল্পবিস্তর চাঁদের আলোর আনাগোনায় একটা অবয়ব স্পষ্ট হলো। অবয়বটা নাবিলার বারান্দার দরজায় দাড়িয়ে আছে। নাবিলা ভয় পেলো কিন্তু ঘাপটি মেরে পড়ে রইলো বিছানায়। ভাবতে লাগলো কোনো ভুতের কবলে পড়লো, নাকি বাড়িতে চোর ঢুকেছে। গেইটে দারোয়ানকে টোপকে চোর কিভাবে আসবে মাথায় এলো না নাবিলার। তবুও ঘাপটি মেরে দেখতে থাকলো আসলে কি হয়। চোর হলে সুযোগ বুঝে আঘাত করবে।
আবছা অবয়বটা আধার ঠেলে নাবিলার খাটের পাশে এসে বসে পড়লো। নাবিলার হৃৎপিন্ড প্রবল গতিতে বাড়তে লাগলো। চোখ বুজে আয়াতুল কুরসি পড়তে লাগলো মনে মনে। তওবা করলো আর কখনো বারান্দার দরজা খোলা রাখবে না। বারান্দা দিয়ে আসা বাতাসে হঠাৎই একটে পরিচিত সুবাস নাকে এসে বাজলো নাবিলার। এই সুবাসটাই ঘুমের মাঝে অনুভব করেছে অনেকবার। প্রয়াস ভাইয়ার ডিওডোরেন্ট এর সুবাস এটা। নাবিলার ভয় কেটে গেলো। কাপুনি কমে গেলো। কিন্তু হৃৎপিন্ডের অস্বাভাবিক গতি যেন খালি রাস্তা পেয়ে সাই সাই করে বেড়েই চলেছে।
প্রয়াস ভাইয়ার ঘরে আলো জ্বলা, ঘুমের মাঝে পরিচিত গন্ধ পাওয়া কপালে উষ্ণ স্পর্শ! সব উত্তর মিলে গেলো সহজেই। এতোদিনের অসমাপ্ত সমীকরণের সমাধান হলো।
প্রয়াস এসেছে। আজই প্রথম নয়, আগেও অনেকবার মধ্যরাতে এই ঘরে আগমন ঘটেছে ওর। প্রয়াস ড্রিম লাইটটা জ্বালিয়ে দিলো। মূহুর্তেই একটা লাল ম্লান আলো সারাঘরের আধার দূরীকরণে লেগে গেলো। প্রয়াস ফিরে এসে নাবিলার কাছে বসলো।নাবিলার মাথার চুলে হাত গলিয়ে আস্তে আস্তে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। ও কিছুটা ঝুকে এলো নাবিলার দিকে। প্রয়াসের উষ্ণ নিশ্বাস ক্ষনে ক্ষনে আছড়ে পড়তে লাগলো নাবিলার মুখে। সাথে হৃদয়েও। নাম না জানা প্রশান্তি খেলে গেলো দুজনের বুকে। তারা একজন আরেকজনকে অনুভব করছে কিন্তু সেটা নাবিলা জানলেও অপরজন জানে না।
প্রয়াস লাল-খয়েরি আলো আধারের খেলায় প্রেয়সীর মুখে চোখ বুলালো। স্পষ্ট নয় বেশি। কিন্তু তবুও প্রশান্তির। নাবিলার চোখের কোনে শুকিয়ে যাওয়া জলধারায় নজর পড়তেই সেখানে আঙুল ছোয়ালো প্রয়াস৷ মেয়েটা বুঝি অভিমানে আবারও কেদেছে। নাহ! এবার বেশি বেশিই হয়ে গেছে। আর কাদাবেনা তার হৃদমোহিনীকে।
প্রয়াসকে কিছুটা ভরকে দিতেই নাবিলা নড়েচড়ে উঠলো। সাথে সাথেই প্রয়াস ওর চোখের পাশ থেকে আঙুল সড়িয়ে নিলো। নাবিলা উল্টো পাশ ফিরে শুয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো। শাড়ি পড়ে শোয়ার ফলে নাবিলার পিঠের দিকটায় এবং কোমরের কাছটা থেকে শাড়ি সরে উন্মুক্ত হয়ে গেলো। প্রয়াসের নজর সেদিকে পড়তেই তরাক করে বসা থেকে উঠে নাবিলার পায়ের কাছ থেকে কাথা টেনে গলা অবধি ঢেকে দিলো। বিড়বিড় করে বললো,
‘এই মেয়ে ঘুমের মধ্যেও আমায় পাগল করার ধান্ধায় থাকে। উফফ!’
নিস্তব্ধতায় প্রয়াসের আস্তে বলা কথাটা স্পষ্টভাবে নাবিলার কর্নকুহরে পৌঁছাতে সময় নিলো না। নাবিলা লজ্জা পেয়ে গেলো। হয়তো গালে সেই লজ্জার আভাস ফুটে উঠেছে। ভুলেও প্রয়াসকে বুঝতে দেবে না যে ও জেগে আছে। আবার কিছুটা নড়ে ওঠার ভান ধরে কাথাটা নাকে মুখে গুজে নিলো। প্রয়াস এবার আফসোস করলো কাথাটা দিয়ে ঢেকে দেওয়ার জন্য। প্রয়াস দাতে দাত চেপে স্বগোতক্তি করলো,
‘এতো মহা ঝামেলা। দেখালে কোমড়, পিঠ সহ দেখাবে আবার ঢাকলে মাথার চুল সহ ঢেকে ফেলবে। শান্তিতে দেখার সাধ আর পূরন হবে না এই মেয়ের জন্য।’
প্রয়াসের কথায় নাবিলা কাথা কামড়ে হাসি আটকালো। প্রয়াস আরো কিছুক্ষন বসে থেকে আফসোসে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। উঠে গিয়ে ড্রিম লাইটটা বন্ধ করে বারান্দার দরজা চাপিয়ে দিলো।তারপর বারান্দা টপকে আবার নিজের ঘরে চলে গেলো। দুটো বারান্দা পাশাপাশি এবং মাঝখানের দূরত্ব কম হওয়ায় টপকানো খুব কঠিন কাজ নয়। প্রয়াস যেতেই নাবিলা হাফ ছাড়লো। তারপর কিছুক্ষন শব্দ করে হাসলো। সবকিছু কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে। মনের গহীনে লুকায়িত ভালোবাসারা সব উপচে বেরিয়ে আসতে চাইছে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে আমিও আমার ভালোবাসার মানুষটা পেয়েছি। সে আমার। শুধুই আমার।
__________
বারান্দায় সোনালী আলো ঝলমল করে সকালের অভিবাদন জানাচ্ছে। আকাশের নীল রঙটা কিছুটা ঘোলাটে ধুসর বর্ন ধারন করে আছে। তবে পূর্বাকাশে সূর্য প্রতিয়মান হয়ে আছে সদর্পে। নাবিলা ঘুমিয়েছিলো ভোরের দিকে তাই ঘুম ভাঙলো কিছুটা দেরি করে। আড়মোড়া ভেঙে বারান্দায় এসে প্রয়াসের ঘরের দিকে তাকালো। জানালার পর্দা সরানো। সেদিকে তাকিয়ে দেখলো। কেউ নেই।কালকের কথাগুলো মনে হতেই নাবিলার অস্থিমজ্জায় লজ্জারা হানা দিলো। প্রয়াস ভাইয়ার সামনে দাঁড়াবে কি করে বুঝতে পারছে না নাবিলা। প্রয়াস ভাইয়াও ওর মনের খবর জেনে বসে আছে। ইশশ! মানুষটাকে কল্পনা করেই ওর অনুভূতিগুলো এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। বুকে কাপন ধরছে। অজানা এক খুশি বয়ে যাচ্ছে শরীর জুরে। সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবে তো?
খাবার খাওয়ার জন্য নামতেই প্রয়াসের সামনে পড়লো নাবিলা। সাথে জেসিও আছে। ওরা দাদির সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। নাবিলা কিছুটা অবাক হলো দৃশ্যটা দেখে। ওর দাদি যথেষ্ট রক্ষনশীল মনোভাবের মানুষ। মেয়েদের আধুনিক পোশাকে তার ঘোর আপত্তি। সেখানে জেসি টিশার্ট আর জিন্স পড়ে দাদির সাথে বসে গল্প করছে! কয়েক মুহূর্তের জন্য অনুভূতির লজ্জা ভুলে দাদিকে নিয়ে ভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলো নাবিলা। মায়ের ডাকে ধ্যান ভঙ্গ হলো।
‘এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? খেতে আয়।পড়াশোনা তো ছেড়েই দিয়েছিস প্রায়। খেয়েদেয়ে ভার্সিটি যা।’
নাবিলা নিজেকে সামলে মায়ের সামনে গেলো। সায়মা বেগমকে চোখের ইশারায় জেসি এবং দাদির দিকে দেখালো। সায়মা বেগম মেয়ের ইশারা বুঝলো। তিনি স্মিত হেসে বললো,
‘জেসির নাকি ওনাকে দেখে তোর মতো দাদির ভালোবাসা পেতে ইচ্ছে করে জানালো। মেয়েটা মায়াবী ভীষণ। মানুষের সাথে মিশতে পারে ভালো। তাই মাও গলে গিয়েছে।’
নাবিলা আরেকবার পিছন ফিরে তাকালো। প্রয়াসের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো ক্ষনেই। লজ্জারা আবার দিক বিদিক ছুটে এসে আছড়ে পড়লো নাবিলার গায়ে। চোখ সরিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়লো ও। মাত্র খাবার মুখে তুলেছে এমন সময় সায়মা বেগম প্রয়াসকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
‘নাবিলার পর তোর বিয়ের তোড়জোড় করবো ভেবেছিলাম। তা তো হলোই না। সেসব বাদ। এবার তোর বিয়ে নিয়ে আগে ভাবতে হবে। শাহেদ ভাই তো কাজের মধ্যে ধ্যান জ্ঞান দিয়ে বসে আছে। কখন আসে কখন যায় ঠিক নেই। ভাবি মারা যাওয়ার পর কাজকেই আকড়ে ধরে আছেন তিনি। মাঝে একদিন বলেছিলো তোর বিয়ে নিয়ে আলোচনা করতে। তোর পছন্দ থাকলে বলে ফেল বাবা। পাত্রী তুই নিজেই পছন্দ করবি। আমরা শুধু শুভ কাজ সেড়ে ফেলবো।’
নাবিলার কাশি উঠে গেলো মায়ের কথায়। প্রয়াস ছুটে এসে গ্লাসে পানি ঢেলে ওর সামনে ধরলো। কাশতে কাশতে চোখে পানি এসে গেছে। গ্লাসের পানিটুকু খেয়ে কিছুটা শান্ত হলো নাবিলা। প্রয়াস ডাইনিং টেবিলের সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে সকলের অগোচরে নাবিলার চোখের কোনের সামান্য লেগে থাকা জলটুকু তর্জনী দিয়ে স্পর্শ করে সামান্য ঝুকলো।মৃদু স্বরে বললো,
‘এইটুকুতে কাশি উঠলে চলে।’
নাবিলার হৃদ স্পন্দন হাওয়ার গতিতে বাড়তে লাগলো প্রয়াস এতো কাছে আসায়। আজ ওর সব অনুভূতিই যেন আলাদা। অন্যরকম।
প্রয়াস সায়মা বেগমের দিকে ফিরে বললো,
‘বিয়েতো করবোই মনি। নিজের পছন্দের মেয়েকেই করবো। চিন্তা করার দরকার নেই। মেয়ে তোমাদের চোখের মনি হয়ে আছে এবং থাকবে।’
চলবে…