এক_রক্তিম_ভোর পর্ব_২৮

এক_রক্তিম_ভোর পর্ব_২৮
#প্রভা_আফরিন

হসপিটালের করিডোরে বিঃধস্ত এক পরিবার এক চিলতে আলোর আশায় বসে আছে। সায়মা বেগম অনবরত আহাজারিতে বেশ কয়েকবার জ্ঞান হারিয়েছেন। জ্ঞান ফিরে আবারো সেই বুক ফাটা আর্তনাদ। এখন ক্লান্ত, শক্তি বিহীন শরীর নিয়ে চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে বসে গোঙাচ্ছে একটু পর পর। নয়নতারা বেগমকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দিয়ে হসপিটালেই কেবিন বুক করে সেখানে রাখা হয়েছে। তার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। ডাক্তারদের আশঙ্কা তার পুনরায় হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা রয়েছে।

শাহেদ সাহেব এবং তারেক হোসেন স্তব্ধ, নির্জীব, নিষ্প্রান হয়ে বসে আছেন মেয়ের কেবিনের সামনে। কোথা থেকে কি হয়ে গেছে এখনো কারো বিশ্বাস হচ্ছে না। মাহি, দিশা, জেসি সবাই করিডোরে বসে আছে। জেসি রাতে মাহিকে নাবিলাদের বিয়ের ছবি পাঠানোর কথাটা বলতে কল দিয়েছিলো। শুনলো কিছু ভিন্ন কথা। ওর আর দেশ ছাড়ার কথা মাথায় এলো না।

নাবিলা, অলিভার এবং এমিলি তিনজনই আই সি ইউ তে ভর্তি। ড্রাইভারের আঘাত গভীর হলেও ডাক্তার তাকে বিপদমুক্ত ঘোষণা করেছে। তবে তার কপালে, ঘাড়ে বেশ সেলাই পড়েছে। দুহাত প্লাস্টার করা হয়েছে। সুস্থ হতে বেশ সময় লাগলেও তিনি জীবন ঝুকি মুক্ত।

প্রয়াস চাতক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আই সি ইউর দরজায়। একটা ভালো সংবাদ পাবার আশায়। তিনজনকে নিয়ে ডাক্তাররা এখনো আশঙ্কা মুক্ত নয়। রাত পার হয়ে ভোর হয়েছে কিছুক্ষন। কাল একটি সুখের রাত হবার কথা ছিলো। হয়েছে জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ রাত। যেখানে এক একটা নিশ্বাসও কষ্টকর।
ডাক্তার জানিয়েছে নাবিলার পিঠে, মাথার পেছনে, এবং পায়ে বাজে ভাবে জখম হয়েছে। মাথার আঘাতটা গুরুতর হওয়ায় জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত ডাক্তাররা নিশ্চিত হয়ে কিছুই বলতে পারবে না।

এমিলি সবার মধ্যে সবথেকে বেশি আহত ব্যাক্তি। ওকে দেখে যে কারো চোখে অনায়াসে জল চলে আসবে। এক্সিডেন্টের সময় অলিভার ওর কোলে ছিলো। ছেলেকে আড়াল করতে গিয়ে বেশি আঘাত প্রাপ্ত হয়েছে সে। ডান পা হাটু থেকে প্রায় আলগা হয়ে গেছে। রাতেই এক দফা অস্ত্রোপচার করে ওর পা টা আলাদা করা হয়েছে। এমিলির মাথা থেকে শুরু করে সব যায়গাতেই বেন্ডেজ করা। ঠোট টা পর্যন্ত দুর্ঘটনার ভয়াবহতা থেকে বাদ যায়নি। ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত লেগেছে। তিনজনের জন্য রক্তের যোগার করতে প্রয়াস এবং নাবিলার পরিবারের সবথেকে বেশি কষ্ট হয়েছে।

অলিভারও মায়ের মতো বেশ আঘাত প্রাপ্ত। ছোট্ট একটা শরীরে বেশ অনেকগুলো সেলাই পড়েছে । রক্ত ঝরেছে। বাচ্চাটা বেঁচে ফিরলে এই ট্রমা থেকে সহজে বের হতে পারবে কিনা সন্দেহ। বিধস্ত প্রয়াস নাবিলার থেকেও বেশি দোয়া করছিলো অলিভারের জন্য। বাচ্চাটা যেনো বেঁচে যায়। নিস্পাপ প্রানটা যেন আবার হেসে ওঠে। ওকে যেন ওর বাবার ভয়ঙ্কর খেলার নিষ্ঠুরতম বলি হতে না হয়।

ডাক্তারদের ধারনা ছিলো এমিলি কোমায় চলে যাবে। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে এমিলির জ্ঞান ফিরলো সকাল আটটা নাগাদ। যেখানে ওর থেকে কম আঘাত পেয়েও অলিভার বা নাবিলার জ্ঞান ফেরা নিয়ে নিশ্চয়তা ডাক্তাররা দিতে পারছে না। এমিলি জ্ঞান ফিরে প্রয়াসের সাথে কথা বলতে চাইলো। ডাক্তারদের নিষেধ সত্ত্বেও প্রয়াস ওর সাথে কথা বলতে গেলো।

এমিলি দুর্বল কন্ঠে জানতে চাইলো,
‘আমার অলিভার কি বেঁচে আছে?’

প্রয়াসের মনে হলো এর থেকে করুন, কঠিন কথা কেউ ওকে জিজ্ঞেস করেনি। একজন মা জানতে চাইছে তার ছেলে জীবিত কিনা। কি বলবে ও। বেঁচে আছে? নাকি মরার মতো বেঁচে আছে। অনেকক্ষন কথার সাথে যুদ্ধ করে প্রয়াস উত্তর দিলো,

‘আছে।’ মিথ্যা শান্তনা স্বরুপ যোগ করলো,
‘ডাক্তার বলেছে খুব জলদিই সুস্থ হয়ে উঠবে।’

এরপর কিছুক্ষনের নীরবতা। এমিলি খুব কষ্টে কাটা ঠোঁট নাড়িয়ে উচ্চারণ করলো,
‘আমাকে দেখে কি অলিভার ভয় পাবে প্রয়াস?’

‘পাবে না। ভালোবাসার মানুষকে কেউ ভয় পায়না।’

‘কিন্তু অলিভারতো তার সুস্থ এবং সুন্দর মাকে ভালোবাসে। এই মাকে কি ও চিনবে?’

‘তুমি বেশি কথা বলো না। জলদিই ঠিক হয়ে যাবে। অলিভারও তোমার কাছে আসবে।’

এমিলি বোধহয় হাসার চেষ্টা করলো প্রয়াসের উত্তর শুনে। কিন্তু আজ ওর হাসতেও মানা। প্রয়াসকে বললো,

‘আমার ছেলেটা এখন থেকে তোমার দায়িত্বে রইলো প্রয়াস। ওর সব দায়িত্ব তোমার। বাবা কিংবা দাদুর বাড়ির ত্রিসীমানায় আমার ছেলে যেন না যায়। আগলে রেখো ওকে।’

প্রয়াসের বুকটা ধ্বক করে উঠলো।
‘এসব কেনো বলছো এমিলি?তোমাকে সুস্থ হতে হবে। অলিভকে আবার মায়ের আদর দিয়ে বড় করবে তুমি। যতদিন তুমি অসুস্থ থাকবে, অলিভ আমার কাছে ভালো থাকবে। ওর সর্বোচ্চ খেয়াল রাখবো আমি।’

‘আমার অলিভ তিন বছরের একটা বাচ্চা। সবসময় ওর স্মৃতিগুলো সুন্দর রাখতে চেয়েছি আমি। ওর বাবাকে নিয়েও কখনো বাজে কথা বলিনি ওর সামনে। তুমি দেখো ও যেন এই এক্সিডেন্টের স্মৃতিটুকু জলদিই ভুলে যায়। এই এক্সিডেন্ট থেকে যেন রিকোভার করতে পারে।’

প্রয়াস কাপাকাপা কন্ঠে বললো,
‘এটা এক্সিডেন্ট ছিলো না এমিলি। এটা ঘটানো হয়েছে।’

বাকিটুকু প্রয়াসের আর বলতে হলো না। এমিলি নিজেই সব বুঝে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,

‘ওকি জানতো গাড়িতে ওর ছেলে আছে?’

‘হয়তো না।’

আরোকিছু কথা হলো প্রয়াস এবং এমিলির মধ্যে।
প্রয়াস কথা বলার পুরোটা সময় একবারও চোখ তুলে তাকাতে পারেনি এমিলির দিকে শুধু বেড়িয়ে আসার সময় দুইহাত হাত জোর করে মাথা নিচু করে ছিলো কিছুক্ষন। হয়তো চোখের জল আটকানোর বৃথা চেষ্টা। প্রয়াস বেরোতেই এমিলি আবার চোখ বুঝলো।

প্রয়াস বেড়িয়ে এসে অয়নের নাম্বারে ফোন লাগালো। ভেবেছিলো ফোনটা বন্ধ থাকবে। হলোও তাই। প্রয়াস দিশাকে অনুরোধ করলো ওর মায়ের মাধ্যমে অয়নের সাথে যোগাযোগ করতে। তাকে যেন নিজের এই মহান কর্মের বিস্তারিত জানানো হয়। যেন জানানো হয় তার আদরের ছেলে এবং ছেলের মাও নাবিলার সাথে আঘাতপ্রাপ্ত। অয়ন ওর মায়ের সাথে রেগুলার যোগাযোগ রেখেছে দিশা সেটা জানে। সে প্রয়াসকে আশ্বাস দিয়ে অলিভারকে আরেকবার দেখে এলোমেলো পায়ে বেরিয়ে গেলো।

একটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে সবাই প্রায় দুর্বল হয়ে গেছে। খাবার শেষ কখন খেয়েছিলো জানা নেই প্রয়াসের। হয়তো কাল দুপুরে। শাহেদ সাহেব তার বন্ধু তারেক হোসেন এবং সায়মা বেগমকে স্বান্তনা দিয়েই যাচ্ছে রাত থেকে। খাবার এনে সবাইকে খাওয়াতেও চেয়েছে। কিন্তু পানি ছাড়া আর কিছুই কারো গলা দিয়ে নামেনি।

নয়নতারা বেগমের ঘুমের ঔষধের প্রভাব কেটেছে বেলা করে। সবাইকে আশ্চর্য করে দিয়ে তিনি ছিলেন একদম শান্ত। না কাদলেন, আর না কারো সাথে কোনো কথা বললেন। এতে করে সবাই আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলো। নয়নতারা বেগমের সাথে একজনকে সব সময়ই রাখা হলো। দায়িত্বটা জেসি নিজের কাধে তুলে নিলো। দাদির সবদিকে খেয়াল সেই রাখবে বলে আশ্বাস দিলো। কিন্তু একটা পাথরের কি খেয়াল রাখবে জেসি?

অয়ন যখন হাসপাতালে এলো তখন প্রায় বেলা এগারোটা বাজে। সে হন্তদন্ত হয়ে পাগলের মতো ছুটে আই সি ইউ’র সামনে এসে দিশাকে বলতে লাগলো অলিভার কোথায়। অয়নকে এখানে দেখে উপস্থিত সবাই চমকেছে। দিশার সাথে ইতিমধ্যে তার বাকবিতন্ডা লেগে গেছে। যদিও প্রয়াস এখনো এমিলি, দিশাকে ছাড়া কাউকে এক্সিডেন্টের ব্যাপারে কিছু জানায়নি। জানানোর অবকাশ পায়নি। কিন্তু দিশা এবং অয়নের ছোট খাট একটা বাকবিতন্ডায় সবাই মোটামুটি আঁচ করে নিলো আসল ঘটনা।

তারেক হোসেন যখন রাগে কিড়মিড় করে এগিয়ে আসতে চাইলো, প্রয়াস বাধা দিয়ে নিজে এগিয়ে গেলো। অয়নকে এমিলির কেবিন দেখিয়ে দিয়ে বললো,

‘ওখানে কেউ তোর অপেক্ষায় আছে। ছেলে বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে পড়েও জানতে পারবি। আগে ওখানে যা।’

অয়ন একটা কথাও বাড়ালো না। ঘোরগ্রস্থের মতো এগিয়ে গেলো সারনির দুই নাম্বার রুমটায়। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতে নিলে নার্স বাধা দিলো। প্রয়াসের অনুরোধে ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পেলো অয়ন। তবে ভেতরে ঢুকে ওর মনে হলো না আসাই বোধহয় ভালো ছিলো।

এমিলির তখনো জ্ঞানে আছে। ডাক্তার ঘুমের ঔষধ দিতে চাইলেও সে গ্রহনে অস্বীকার জানায়। তাকে কিছুক্ষন সময় সজ্ঞানে থাকতে দেওয়ার অনুরোধ করে। ওর একজনের সাথে কথা বলা বাকি। হয়তো শেষ কথা বলা৷ অয়ন দেখলো সাদা কাপড়ে গলা অবধি ঢাকা এক বীভৎস নারীকে। ওর বাচ্চার মা।

‘দূরে কেনো অয়ন? ভয় পাচ্ছো আমায় দেখে?’

অয়ন কয়েকবার ঢোক গিলল। শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে কাপাকাপা গলায় বললো,

‘তুমি বাংলাদেশে আসবে বলোনি কেনো?’

এমিলি হাসলো। শ্লেষাত্মক হাসি। বললো,
‘তোমার সাথে কি আমার তেমন কোনো সম্পর্ক আছে যে জানাবো?’

‘আমার ছেলে কোথায় যাবে আমার জানার অধিকার আছে। কেনো জানালেনা আমায়।’

এমিলি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলো। করুন কন্ঠে বললো,
‘আমায় কি কখনো ভালোবেসেছিলে অয়ন?’

অয়ন সহসাই প্রশ্নটার উত্তর ভেবে পেলো না। কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,
‘ভালোবাসতাম বলেই অলিভার এসেছিলো আমাদের মাঝে।’

‘উহু। ভালোবাসোনি। আমি তোমার মোহ ছিলাম। এক ভীনদেশী সুন্দরী মেয়েকে নিজের গার্লফ্রেন্ড করে রাখার আগ্রহ থেকে আমার প্রতি তোমার নজর পরেছিলো। সেটাকে আমি ভেবেছিলাম ভালোবাসা। তুমি ভেবেছিলে ইচ্ছা পূরন। আমার ওপর মোহ ছিলো তোমার। এবং মোহকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিলো আমাদের সম্পর্ক। যেদিন মোহ ছুটে গেলো বাবা মায়ের এক্সকিউজ দিয়ে ছেড়ে দিলে আমায়। অলিভ তোমার ভালোবাসার চিহ্ন নয়। ও শুধু আমার ভালোবাসার চিহ্ন।’

‘তুমি বলতে চাইছো আমি অলিভকে ভালোবাসি না?’

‘হয়তো নিজের রক্ত বলে ওর প্রতি তোমার একটা মায়া হয়ে গেছে। পিতৃত্বের টান। তবে জানোতো! তুমি যেদিন বাবা মায়ের দোহাই দিয়ে আমাদের সম্পর্কের ইতি টানলে সেদিন থেকে আমার এক দীর্ঘশ্বাসের দিন শুরু হয়। সেই দীর্ঘশ্বাস কতটা যন্ত্রনার সেটা আমিই জানি।
আমার ভালোবাসা মিথ্যা ছিলো না। তুমি আসলে ভালোই বাসতে জানো না। না আমাকে বেসেছিলে, না অলিভকে, আর না নাবিলাকে। নাবিলাকে পুতুল করে রাখতে চেয়েছিলে। সেটা ভেস্তে গিয়ে অহং-এ লাগায় নাবিলা তোমার জেদে পরিনত হলো। আর ফলাফল দেখো। তোমার জেদ, রাগ, হিংসা, প্রতিশোধ পরায়নতা অর্থাৎ তোমার পাপ তোমারই ছেলেকে শেষ করে দিচ্ছে।’

অয়ন এতোক্ষনে দেখলো এমিলির একটা পা বোঝা যাচ্ছে না সাদা চাদরের নিচে। ওর বিষ্ময় দেখে এমিলি কান্না চেপে রাখা গলায় বললো,

‘নেই।’

অয়ন মুখ ঢেকে ফেললো।

এমিলির শেষ লাইনটা ছিলো,
‘আমার ছেলে যদি বেঁচে থাকে, ওর জীবনে তুমি আর কোনোদিন এসো না।’

অয়ন কেবিনে ঢোকার দশ মিনিটের মাথায় এমিলি শ্বাস ত্যাগ করলো সারাজীবনের মতো। ওর দীর্ঘশ্বাসের অবসান ঘটেছে। তবে দীর্ঘশ্বাসের শুরু হলো অপরজনের। উত্তপ্ত, অনুশোচনার দীর্ঘশ্বাস। হয়তো এই দীর্ঘশ্বাস বয়ে বেড়াতে হবে বাকি জীবন।

অয়ন যখন কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো ওর নির্লিপ্ততা দেখে প্রয়াস বুঝে গেছে মানুষটা পৃথিবী ত্যাগ করেছে। প্রয়াস এক কোনে চুপচাপ বসে রইলো৷ উঠতে ইচ্ছে করলো না। ক্ষেপে উঠে অয়নকে ধরতে ইচ্ছে করলো না। এমিলির নিথর দেহের কাছেও যেতে ইচ্ছে করলো না। ও জানতো এমনটাই হবে। তবুও মানতে কেনো কষ্ট হচ্ছে?

তারেক হোসেন অয়নকে হসপিটালে দেখা মাত্রই পুলিশকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। পুলিশ এসেও পড়েছে। অয়ন কেবিন থেকে বের হতেই ওকে ধরা হলো। অয়ন বাধা দিলো না। ওর মাথায় এমিলির বলা কথাটা ঘুরছে। অলিভারের প্রতি ওর ভালোবাসা নেই। শুধু আছে পিতৃত্বের টান। সত্যিই কি তাই? তাহলে এই টান এতো বেশি অসহ্য কেনো? এতো যন্ত্রনার কেনো? দিশার দিকে করুন চোখে তাকিয়ে বললো,

‘অলিভারকে দেখতে পারবো? শুধু একবার?’

দিশা অবাক হলো। ওর হুকুম জারি করা ভাই অনুরোধ করছে! দিশা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলো কেবিনটা। অয়ন শুধু একবার বাহিরে থেকে দরজার ছোট কাচের আস্তরন দিয়ে ছেলেকে দেখলো। ছোট্ট শরীরটা বিছানার সাথে মিশে আছে। মুখে অক্সিজেন। কপালে বেন্ডেজ। হাতে ক্যানোলা লাগানো। ছোট বুকটা ওঠানামা করছে ধীরে ধীরে।
অয়ন দেখলো। দেখেই গেলো যতক্ষন না পুলিশ কন্সটেবল ওকে টেনে টেনে না নিয়ে গেলো। আজ থেকে ওর জীবনে থাকবে আফসোস। ভালোবাসতে না পারার আফসোস। সাথে যন্ত্রনাময় দীর্ঘশ্বাস।

অলিভারের জ্ঞান ফিরলো পরেরদিন। ডাক্তার জানালো অলিভার এখন বিপদমুক্ত। তবে বাচ্চা বলে সাবধানে থাকতে হবে। কাটা স্থান যতদিন না আশি ভাগ ঠিক হচ্ছে ওকে হাসপাতালেই রাখতে হবে। জ্ঞান ফিরেই অলিভার ‘মাম্মা’ ‘মাম্মা’ বলে একাধারে কেদেই গেলো। দিশার হাজারটা আদুরে কথায়ও কান্না থামলো না। কান্নার ফলে গলা ভেঙে গেছে। একমাত্র প্রয়াসকে দেখে একটু শান্ত হয়েছে সে। প্রয়াস ওকে বুকে নিয়ে বলে,

‘অলিভ ডিয়ার,
হোয়াই ফিয়ার?
গুড বয় নেভার ক্রাই’স।’

অলিভ শান্ত হয়। কিছুক্ষন পর আবার তারস্বরে কেদে ডাকে,

‘মাম্মা! মাম্মা!’
মাম্মা আসে না। আসবেও না।

ওর কান্না দেখে কাদে দিশাও। কাদে সবাই। কাদতে পারেনা শুধু প্রয়াস। ওর মনে শুধু শক্ত থাকার প্র‍য়াস চলছে। একজন যে এখনো লুকোচুরি খেলায় ব্যস্ত।

নাবিলার জ্ঞান ফিরলো এক সপ্তাহ পর বৃহস্পতিবারে। প্রয়াস জোহরের নামাজ শেষে তখন অলিভারকে ভুলিয়ে ভালিয়ে খাওয়াচ্ছিলো। খবরটা পেয়ে ছুটে গেলো নাবিলার কেবিনে। এই সাতদিনে ও একবারের জন্যও নাবিলার কেবিনে আসেনি। দেখা তো দূর। ভালোবাসার মানুষটার নিস্তেজ দেহটা দেখার সাধ্য ওর ছিলো না। আজ দেখলো।

উপুর হয়ে শুয়ে আছে নাবিলা। পিঠে আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ায় এভাবেই থাকতে হচ্ছে তাকে। চোখ পিট পিট করে আশে পাশে কাউকে খুজছে। প্রয়াসকে দেখে সেই চোখ স্থির হলো। শান্ত হলো। তৃপ্ত হলো। প্রয়াস ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো ওর দিকে। মেঝেতে হাটু গেড়ে বসে ওর গালে হাত রাখলো। সাথে সাথেই ওর অক্ষিকোটরের ধরে রাখা উষ্ণ ঝরনা বাধ ভাঙলো। বয়ে যেতে লাগলো নিঃশব্দে। নাবিলা ক্যানোলা লাগানো হাতটা তুলে প্রয়াসের চোখ মুছিয়ে দিতে চাইলো। প্রয়াস সেই হাতটা অজস্র অধরের স্পর্শে ভরিয়ে দিয়ে গালের সাথে চেপে ধরলো। বললো,

‘তুই বড্ড নিষ্ঠুর।’

‘আমাদের নিয়তিই হয়তো বেশি নিষ্ঠুর। আজ কি আমাদের বিয়ের দিন?’

‘উহু। আজ থেকে এক সপ্তাহ আগে এই দিনে আমাদের গায়ে হলুদ ছিলো।’

নাবিলা বিস্মিত কন্ঠে বললো,
‘আমি এতোদিন অজ্ঞান ছিলাম?’

‘সাথে আমাদেরও শেষ করে দিয়েছিলি। সবাই জীবন্ত লাশ হয়ে গেছে।’

নাবিলা প্রয়াসের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি ফেললো,
লাল টকটকে চোখ, চোখের নিচে কালি, গালে অযত্নে দাড়িগুলো বেড়ে উঠেছে। নাবিলার কান্না পেয়ে গেলো। প্রয়াসকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করলো। কিন্তু ওর ওঠার শক্তিটুকু নেই।
প্রয়াস বোধহয় ওর মনের বাসনা বুঝলো। আরো ক্ষানিকটা এগিয়ে ওর ঘারে মুখ গুজে বললো,

‘ভালোবাসি নাবিলা। আমার এক জন্মের সবটুকু ভালোবাসায় শুধু তুই।’

নাবিলার এলো তার কিছুটা পর। নয়নতারা বেগম ছুটে এসেই নাবিলাকে জড়িয়ে ধরতে চাইলো। নার্স বাধা দিয়ে বললো,

‘পিঠের আঘাত এখনো সাড়েনি। তাই জড়িয়ে ধরা যাবে না।’

প্রয়াস নাবিলাকে ধরে বসিয়ে দিলো। নয়নতারা বেগম সাত দিন পর এই প্রথম কথা বললেন। কান্না মাখা আদুরে কন্ঠে বললেন,

‘খুব কষ্ট হচ্ছে সোনা?’

‘হচ্ছে। কিন্তু তোমাদের দেখে। কি অবস্থা করেছো নিজেদের?’

‘শরীর অসুস্থ হলেও মানুষ ভালো থাকতে পারে। কিন্তু মন অসুস্থ হলে যে ভালো থাকা যায়না। তুই যে আমাদের সবার মন।’

নাবিলা আলতো করে মাথা ঠেকালো নয়নতারা বেগমের বুকে। নয়নতারা বেগমের খরায় ফাটল ধরা শূন্য হৃদয়ে বৃষ্টি নামলো। ইচ্ছে করলো নাতনিকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে ফেলতে। লুকিয়ে ফেলতে। কিন্তু হাত উঠিয়ে জড়িয়ে ধরার ক্ষমতাটাও তার নেই। অতিরিক্ত খুশিতে শরীর অসার হয়ে গেছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here