চলন্ত বাসে দাঁড়িয়ে আছে নাবিলা। পিঠে অনবরত কারো নোংরা স্পর্শ পাচ্ছে সে। হালকা ঘাড় ঘোরাতেই পেছনে ভুড়িওয়ালা একজন মধ্য বয়স্ক লোককে দেখলো। বাস যতবার হালকা ঝাকি দিচ্ছে ততবার লোকটা ইচ্ছাকৃতভাবে নাবিলার পিঠে এসে পড়ছে। সামনে সড়ে যাওয়ার যায়গাও নেই, পেছনে আছে তবে ভুড়িওয়ালা লোকটা যেভাবে দাড়িয়েছে তাতে পেছনে যাওয়া অসম্ভব।
একরাশ অস্বস্তি, ঘৃনা, দম বন্ধকর অনুভূতি এসে হানা দিলো নাবিলার মাঝে। এমন সময় নাবিলার ফোন বেজে ওঠে। আর সাথে সাথেই নাবিলার রাগে দপদপ করতে থাকা মাথায় একটা বুদ্ধি খুলে যায়। ফোন নাম্বার চেক না করেই রিসিভ করে চড়া গলায় কথা বলে উঠলো, যেনো পুরো বাসের মানুষ তার কথা শুনতে পারে।
-‘ হ্যাঁ হ্যালো। শয়তানটাকে ধরেছিস তো।
হ্যা হ্যা.. আমি আসছি তোরা লাঠিসোঁটা নিয়ে রেডি থাক। শয়তানটার হাত ভেঙে গলায় ঝুলিয়ে দেবো যেনো কোনোদিন কোনো মেয়েকে স্পর্শ করতে না পারে। এরা পেয়েছেটা কি? মেয়েরা এদের সরকারি সম্পত্তি! যে ভীড়ের মাঝে, বাসে, যেখানে সেখানে আপত্তিকর স্পর্শ করবে আর মেয়েরা মুখ বুজে তা মেনে নেবে! তা ভাবলে ভুল করবে। এদেরতো বাথরুমের জুতো দিয়ে পিটানো উচিৎ।
হ্যা… আর কয়েকটা আছে বুইড়া। সন্তানের বয়সী মেয়েদের দিকে নোংরা হাত বাড়ায়। হাত কেটে পকেটে ঢুকিয়ে দেবো যদি আর একবার দেখি। রাখছি।’
কথাগুলো নাবিলা পেছনে ফিরে লোকটার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছে। লোকটা লজ্জা পেয়ে মুখ কাচুমাচু করে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়িয়েছে এখন। বাসের সবাই কথাগুলো শুনে নাবিলার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তবে কথাগুলো বলে নাবিলার মাঝে এখন একটা শান্তি এবং আত্মবিশ্বাস ভর করেছে।
সে বাস থেকে নেমে পড়লো। বাকি অল্প একটু পথ হেটেই যাওয়া যাবে। ভার্সিটি থেকে ফিরতে সিএনজি বা রিক্সা না পেলে প্রায়ই বাসে আসতে হয় তাকে। এমন ঘটনার সম্মুখীন মাঝে মাঝেই হতে হয়। তবে আজ ঘুড়িয়ে অপমান করতে পেরে বড্ড শান্তি অনুভূত হচ্ছে। মুখ বুজে থাকলে এমন অমানুষ গুলো একই ঘটনা বারবার ঘটাতে অসীম সাহস পেয়ে বসে।
বাড়ি ফিরতেই চক্ষু চড়কগাছ নাবিলার। এ কাকে দেখছে সে। দুই বছর এর বেশি হয়ে গেছে লোকটার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই নাবিলার। অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করলো,
-‘ প্রয়াস ভাইয়া!’
-‘ রাস্তায় কি ঘটেছে?’
এহেন প্রশ্নে আরেকবার ভরকে গেলো নাবিলা। প্রয়াস ভাইয়া হঠাৎ এমন কথা কেনো জানতে চাইলো?
-‘মানে?’
-‘ কাকে শুনিয়ে ধমকি দিচ্ছিলি ফোনে?’
নাবিলার ভ্রু কুচকে কথাটা বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর জলদি করে পার্স থেকে ফোন বের করে তখনকার নাম্বারটা চেক করলো। একটা অচেনা নাম্বার। বুঝতে আর বাকি নেই কলের মালিক প্রয়াস ভাইয়া।
নাবিলা বসার ঘরের আশে পাশে তাকালো। নাহ!কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রান্না ঘর থেকে টুংটাং আওয়াজ আসছে। মা নিশ্চয়ই রান্না ঘরে। বাসের ঘটনা ঘুনাক্ষরেও দাদির কানে গেলে আজই নাবিলার পড়াশোনা বন্ধ করে বিয়ের পিরিতে বসিয়ে দেবেন তিনি।
নাবিলার দাদি নয়নতারা বেগম খুবই রক্ষনশীল একজন মহিলা। রাস্তাঘাটে অকারনে কোনো যুবক ইভটিজিং করলে তিনি প্রতিবাদের বদলে উলটে মেয়েদের আড়াল করতে চান। ঘরে বসিয়ে রাখতে চান। নয়নতারা বেগমের মতে মেয়ে বড় হওয়া মানেই তাকে বিয়ে দিয়ে স্বামীর ঘরে পাঠানো। সেখানে নাবিলার বাবা মা একপ্রকার তার মতের বিরুদ্ধেই মেয়েকে পড়াচ্ছেন। নাবিলার চোরা চোখ দেখে প্রয়াস মুচকি হাসলো।
প্রয়াস আরো কিছুটা এগিয়ে নাবিলার বরাবর দাঁড়িয়ে বললো,
-‘ ভয়ের কিছু নেই। দাদি তার ঘরে আছেন এখন।’
কথাটা শুনে হাফ ছেড়ে বাচলো নাবিলা। প্রয়াস আবার বললো,
-‘সাহসী হয়ে গেছিস দেখছি। ভালো।অন্যায়ের প্রতিবাদ করা ভালো। তবে তা নিজেকে সেইফ রেখে। ‘
নাবিলা নিজেকে সামলে উত্তর দিলো,
-‘ তুমি কবে এলে প্রয়াস ভাইয়া?’
-‘ এইতো আজ সকালে। আমার আসায় বুঝি অখুশি তুই?’
নাবিলা মেকি হেসে বললো,
-‘ না না তেমন কিছু না। আমিতো খুশিই হয়েছি।’
-‘ কিরে ওখানে দুটিতে কি করছিস? প্রয়াস বাবা আয় বোস এখানে। এতোদিন পর আমাদের মনে পড়লো! এবার আর তোকে ছাড়ছিনা আমি। একেবারে বিয়ে দিয়ে বেধে রাখবো যেনো আর বিদেশে যাওয়ার ভুত মাথায় না চাপে।’
নাবিলার মা সায়মা বেগম চা নিয়ে এসে বললেন।
প্রয়াস নাবিলার দিকে তাকিয়েই বসতে বসতে উত্তর দিলো,
-‘ হ্যা মনি। এইবার বিয়েটা করেই ফেলবো। বিদেশের ভুত মাথা থেকে নামিয়ে বউয়ের ভুত চাপাবো।’
প্রয়াস হেসে একহাতে সায়মা বেগমকে জড়িয়ে ধরলো। সায়মা বেগম হেসে প্রয়াসের মাথায় হালকা চাপড় মেরে বললো,
-‘ পাগল ছেলে।’
নাবিলা প্রয়াসে চোখের সামনে আর দাড়াতে পারলো না। একপ্রকার ছুটেই রুমে চলে গেলো। প্রয়াস সেদিকে তাকিয়ে আবার মনির সাথে গল্পে মেতে উঠলো। নাবিলার মাকে প্রয়াস মনি বলে ডাকে। প্রয়াসে বাবা এবং নাবিলার বাবা খুব ভালো বন্ধু ছোটবেলা থেকেই। তাদের বাড়িও পাশাপাশি। প্রয়াসের মা যখন মারা যায় তখন প্রয়াস মাত্র অষ্টম শ্রেনিতে পরে। তারপর থেকেই সায়মা বেগম তাকে নিজের ছেলের মতো করে ভালোবাসা দিয়েছে।
রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লো নাবিলা। ছোটবেলা থেকেই নাবিলার জীবনে একমাত্র শনি হলো প্রয়াস। বাবা মা স্বাধীনতা দিলেও প্রয়াসের জন্য তার সদ্ব্যবহার করতে পারেনি নাবিলা। এখানে যাবিনা, ওইটা করবি না, এমন সাজবি না এইরকম হাজারো আদেশ চাপিয়ে দিতো নাবিলার ঘাড়ে। এতে নাবিলার পরিবারও যেনো খুশি হতো।
নাবিলাএ একমাত্র গৃ্হশিক্ষক ও ছিলো প্রয়াস। ছোট থেকে ইন্টার অবধি প্রয়াসই ওকে পড়িয়েছে। নাবিলা খুব করে চাইতো প্রয়াস ভাইয়ার চোখ ফাকি দিয়ে স্বাধীনভাবে ঘুরতে, মজা করতে। ওর ইচ্ছে পূরনও হয়েছিলো। দুই বছর আগে প্রয়াস হুট করেই সিদ্ধান্ত নেয় মাস্টার্স করতে বিদেশ যাওয়ার। নাবিলা তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে।
প্রয়াস চলে যাওয়ায় সে হয়ে গেছিলো মুক্ত বিহঙ্গ। তবে সেটাও বেশিদিন টেকেনি তার কিছুদিন পরই তাকে আবার বেধে ফেলা হয়। আর সেই কাজটি করেন তার দাদি নয়নতারা বেগম। দুই বছরে অনেক কিছু বদলেছে। নিশ্চয়ই প্রয়াস ভাইয়া আর আগের মতো শাসন করবে না।
নাবিলা ফোস করে নিশ্বাস ফেললো। এমন সময় ওর ফোন বেজে উঠলো। স্ক্রিনে তাকিয়ে একরাশ বিরক্তি ফুটে উঠলো নাবিলার মুখে। না চাইতেও রিসিভ করে সালাম দিলো।
-‘ তোমাদের বাড়িতে একজন ছেলে এসেছে। সে কে?’
নাবিলা অবাক হয়ে গেলো।
-‘আপনি জানলেন কি করে?’
-‘ কিভাবে জানলাম সেটা বড় কথা না। আমার মিটিং আছে। সময় কম তাই সরাসরি উত্তরটা আশা করছি।’
-‘ উনি প্রয়াস ভাইয়া। আমাদের পাশের বাড়িতে থাকে এবং আমার বাবার বন্ধুর ছেলে। আমাদের আত্মীয় বলতে পারেন।’
-‘ এতোদিন তো দেখলাম না!’
-‘ কারন উনি কানাডা ছিলেন দুইবছর।’
বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো নাবিলা। লোকটাকে সব প্রশ্নের পইপই উত্তর দিতে হয়। নাহলে দাদির কাছে আবার বিচার দেবে নাবিলার নামে। মানুষটাকে একদম সহ্য হয় না ওর। কোথায় যাচ্ছে, কি করছে সব তার জানা চাই।
-‘ আচ্ছা পরে কথা হবে। রাখছি।’
নাবিলা মনে মনে বললো -‘রেখে আমায় উদ্ধার করুন। যত্তসব। ‘
নাবিলার মতে, একটা মেয়ের জীবন যতটা কম্পলিকেটেড হওয়া দরকার ততটাই ওর কম্পলিকেটেড জীবন ওর।
বাহিরে থেকে সায়মা বেগম এবং প্রয়াস ভাইয়ার হাসির শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই আড্ডা জমে উঠেছে।
_______
নীল আকাশে বিরাজমান সূর্যের প্রখরতায় ভাটা পড়েছে। কিছুক্ষন পরই টুপ করে পশ্চিমে ডুব দিবে। মৃদুমন্দ সমীরণে দাঁড়িয়ে শুভ্র মেঘের উড়ে চলা দেখছে নাবিলা। খোপা করা কোকড়া চুলগুলো ছুটে পিঠের ওপর পড়েছে। দূরে কিছু পাখির কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে।
বিকেলের এই সময়টা নাবিলার খুব প্রিয়। পরিবেশটা কেমন ঝিমিয়ে আসতে থাকে। মানুষের ব্যস্ততা কমতে থাকে। সাথে পাখিদেরও। প্রতিদিন নিয়ম করে এই সময় ছাদে এসে আকাশ দেখে সে। হঠাৎ কারো কন্ঠস্বরে চমকে পেছনে তাকায় নাবিলা। পাশের ছাদে প্রয়াস ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। কারো সাথে বোধহয় ফোনে কথা বলছে। নাবিলার দিকে একবার তাকিয়ে আবার কথা বলায় মনোযোগ দিলো প্রয়াস। দুই বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় এক ছাদ থেকে আরেক ছাদের দুরত্ব ও কম। একটু সাহস করলে লাফিয়ে অন্য ছাদে যাওয়া যাবে।
নাবিলা প্রয়াসকে দেখে ছাদ ছেড়ে চলে যেতে নিলে প্রয়াস পেছন থেকে ডেকে ওঠে। অগত্যা থেমে যেতে হলো তাকে।
প্রয়াস কিছুটা এগিয়ে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘ কেমন আছিস তুই?’
এই সময় হঠাৎ এই প্রশ্নের মানে বুঝলোনা নাবিলা। প্রয়াস আবার বললো,
-‘ দুপুরে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তার আগেই তো চলে গেলি। তাই এখন করলাম। বলবিনা?’
প্রয়াসের গলায় জানার আকুতি। এই স্বরে প্রয়াস কোনোদিন কথা বলেনি নাবিলার সাথে। সবসময় প্রয়াস কথা শুরু করেছে ধমকে। দুইবছরে প্রয়াসের অনেক কিছুই বদলেছে। আগে সে ক্লিন শেইভ করতো আর এখন দাড়ি রেখেছে। এতে যেনো প্রয়াসের সৌন্দর্য আরো ফুটে উঠেছে। নাবিলা ছোট করে উত্তর দিলো,
-‘ ভালো আছি ভাইয়া।’
এর পরই নাবিলার এতোক্ষনের ধারনাতে পানি দিয়ে প্রয়াস বললো,
-‘ সন্ধ্যা হতে চলেছে। এই সময় তোর সাপের মতো প্যাচানো চুলগুলো খুলে রেখে কি পেত্নী সেজে সবাই কে হার্ট অ্যাটাক করাতে চাস? বুদ্ধু!’
প্রয়াসের গলায় সেই আকুতি মাখা আওয়াজ টা আর নেই। আবার সেই আগের গলায় ধমকে বলা শুরু। কিছু মুহূর্ত প্রয়াসকে ভালো ভাবার জন্য নাবিলার নিজের ওপরই রাগ হলো। বিদেশে গেলেই কি আর বিরস মুখে মধু আসে নাকি। নাবিলার মেজাজ চটে গেছে। দাতে দাত চেপে স্থান ত্যাগ করতে নিলে প্রয়াস বললো,
-‘ এই তোর চশমা কোথায়? আগে তো চশমা ছাড়া এক পা ও ফেলতে পারতি না। ওয়েট! ওয়েট! তোর চোখের মনির রঙ এমন বাদামী ঘোলাটে তো ছিলো না। দ্যাট মিন্স তুই লেন্স পড়িস?’
নাবিলা চোখ নামিয়ে বললো,
‘ হ্যাঁ পড়ি। পাওয়ার লেন্স। এখন এটাই স্মার্টনেস।’
-‘ এই স্মার্টনেস এর সজ্ঞা তোকে কে শেখালো শুনি? আজকাল স্মার্টনেস এর নামে নিজেদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভুলে যাচ্ছিস সবাই।’
নাবিলা খুবই অবাক হলো। আগে যখন নাবিলার নাকের ওপর সবসময় চশমা থাকতো তখন সারাদিন প্রয়াস তাকে চশমা বুড়ি বলে ডাকতো। চশমাতে নাকি নাবিলাকে বুড়ি বুড়ি লাগে। অথচ এখন চশমা না পড়ায় নাকি সে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ভুলে যাচ্ছে!
-‘ তুমিইতো বলতে চশমায় আমায় বুড়ি লাগে। ভালো লাগে না। এখন যখন পড়ছি না তখনও বলছো ভালো না।’
-‘ তোর ওই সাপের মতো চুল ও তো আমার অপছন্দ। তাই বলে কি চুলের ধরন বদলেছিস?’
-‘ না। চুল নিয়ে কারো অভিযোগ নেই এক তুমি ছাড়া। কিন্তু চশমা অনেকের অপছন্দ।’
প্রয়াস গলার স্বর কিছুটা শক্ত করে বলল,
‘ অন্যার জন্য কি নিজের স্বাচ্ছন্দ্য বদলে ফেলবি? তোর নিজের স্বকীয়তা ভুলে যাবি? নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছা অশালীন নাহলে, বাবা মায়েরও সমস্যা না থাকলে, অন্যকেউ অপছন্দ করলে তার কথা শুনবি কেনো?’
নাবিলা আর কোনো উত্তর দিতে পারলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রয়াস কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো,
‘ঘরে যা।’
#চলবে…
এক_রক্তিম_ভোর সূচনা_পর্ব
#প্রভা_আফরিন