এক_রক্তিম_শ্রাবণে❤️পর্ব-১৭
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
চামচে টুংটাং শব্দ তুলে লেবুর শরবত বানাচ্ছে তোহা।কাঁচের গ্লাসের সাথে স্টীলের চামচের ঘর্ষণের শব্দটা বেশ লাগছে তার।রান্নাঘর থেকে একটু পরপরই তেলের ঝাঁঝালো শব্দ কানে আসছে।আতিয়া আর আফিয়া মিলে কিসব যেনো বানাচ্ছে সেই বিকেল থেকে।নিশারা চলে গেছে আজ সকালে।যদিও আরো একদিন থাকার কথা ছিলো কিন্তু সৌহার্দ্যর জরুরি কাজ পরে যাওয়ার আজই যেতে হয়েছে।তারা যাওয়ার পর বিকালেই স্বর্ণারাও চলে গিয়েছে।
বাড়ি এখন আবার ফাঁকা ফাঁকা।তবে তাদের সাথে অনন্তও চলে যাওয়ায় বেশ স্বস্তি লাগছে তোহার।
॥
শরবতটা বানিয়ে মাত্র একচুমুক খেয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াতেই ঝড়ের গতিতে কলিংবেল বেজে উঠলো।
দরজার দিকে একবার বিরক্তিকর দৃষ্টি নি:ক্ষেপ করে দ্রুতপায়ে সেদিকে এগিয়ে গেলো তোহা।দরজা খুলতেই তিহান ক্লান্ত,পরিশ্রান্ত কন্ঠে দ্রুত বলে উঠলো,
—“মা কোথায় রে?ফ্ল্যাটের চাবিটা দিতে বলতো”
গাঢ় বেগুনী রংয়ের শার্ট তিহানের পরণে।হাতাগুলো কনুই পর্যন্ত গুটানো।হাতের পশমগুলো ঘেমে চামড়ায় সাথে লেপ্টে আছে।শার্টের উপরের তিনটে বোতাম খোলা বিধায় ফর্সা বুকের অনেকাংশই দৃশ্যমান।সেদিকে চোখ পরতেই মাথা নুইয়ে দরজা থেকে সরে দাড়ালো তোহা।নিচু গলায় বললো,
—“ভেতরে আসেন।খালামনি রান্নাঘরে।আমি এনে দিচ্ছি চাবি।”
তোহার নত চেহারার দিকে তীর্যক চাহনীতে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলো তিহান।অত:পর এর অর্থোদ্ধার হতেই একহাতে শার্টের বোতামগুলো লাগাতে লাগাতে সোফায় যেয়ে বসলো সে।দরজা আটকে ড্রইংরুমের ফ্যান ছেড়ে দিলো তোহা।
আফিয়ার থেকে চাবি আনার জন্য যেতে নিলেই তিহান জোড় গলায় বলে উঠলো,
—“এক গ্লাস পানি দে তো তিহু।”
কথাটা শোনার সাথেসাথেই নিজের হাতের ঠান্ডা শরবতের গ্লাসটা তিহানের দিকে এগিয়ে দিলো তোহা।বললো,
—“এটা খান।আমি অল্পএকটুই খেয়েছি,অতো এঁটো হয়নি।নয়তো নতুন করে বানিয়ে…”
এতটুকু বলতেই তার হাত থেকে গ্লাসটা নিয়ে নিলো তিহান।গটগট করে প্রায় অর্ধেকটা শেষ করে বললো,
—“চাবিটা নিয়ে আয় জলদি।”
পাল্টা কিছু বললোনা তোহা।আফিয়ার কাছ থেকে চাবি নিয়ে এসে দেখলো কানে ফোন ধরে শরবতে চুমুক দিতে দিতে কারো সাথে কথা বলছে তিহান।ঠোঁটের কোঁণে হাসি।তোহা কাছাকাছি যেয়ে দাড়াতেই সে না তাকিয়েই শরবতের গ্লাসটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে হাত বাড়িয়ে দিলো।তিহানের ফোনের মধ্য হেসে হেসে কথা বলা তোহার মোটেও পছন্দ না।একদম অসহ্য লাগে।ক্ষীপ্ত মেজাজে ধপ করে তার হাতের উপর চাবিটা রাখতেই চোখজোড়া সংকুচিত করে আড়চোখে তার দিকে তাকালো তিহান।তোহার চাপা রাগত চেহারা দেখে বিশেষ কোনো ভাবাবেগ দেখা দিলোনা তার মধ্য।নির্বিকার ভঙ্গিতে চাবিটা পকেটে ঢুকিয়ে গ্লাসের বাকি শরবতটুকু খেয়ে নিয়ে পায়ের উপর পা তুলে আয়েশি ভঙ্গিতে সোফায় হেলান দিয়ে বসলো সে।ফোনের ওপাশের মানুষটার কথার তালে তালে ঠোঁটের হাসিটা আরো গাঢ় হতেই স্হান ত্যাগ করলো তোহা।
ডাইনিং টেবিলে চিনির কৌটা,লেবু কাটার ছুড়ি সব এলোমেলো করে রেখেছে সে।সেসব গোছাতে গোছাতেই হঠাৎ পেছন থেকে তার হাতটা টেনে নিলো তিহান।তোহার ছোট্ট হাতের মুঠোটায় বড়সড় একটা চকলেটের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,
—“দরজা আটকে দিয়ে যা।”
তিহান চলে যেতেই দরজাটা আটকে দিয়ে হাতের চকলেটটার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো তোহা।আচ্ছা,এই হুটহাট মন ভালো হয়ে যাওয়া কি ভয়ংকর প্রণয়ের আভাস?
_____________
হাতে এক বাটি ডালের বড়া।আতিয়া গরম গরম ভেঁজে দিয়েছে তিহানের জন্য।তা নিয়েই বাধ্য মেয়ের মতোন পাশের ফ্ল্যাটে ছুটেছে তোহা।কলিংবেল চাপার আগে একবার দরজার লক ঘুরাতেই তা খুলে গেলো।ভ্রু কুঁচকালো তোহা।লোকটা কি একটু সাবধানে দরজাটাও লাগিয়ে রাখতে পারেনা?
নি:শব্দে ফ্ল্যাটে ঢুকে তিহানের রুমে উঁকি দিলো সে।তিহান রুমে নেই।হয়তো বারান্দায়।হয়তো না,সে বারান্দাতেই।হাসস্যজ্জ্বল কন্ঠের কথাবার্তা এখান অবধি শোনা যাচ্ছে।
হাতে বড়ার বাটিটা নিয়েই চুপচাপ তিহানের পিছে যেয়ে দাড়ালো সে।তার উপস্থিতি টের পেতেই ঘুরে তাকালো তিহান।কিছু বলার আগেই তোহা হাতের বাটিটা সামনে বাড়িয়ে অভিমানি রুদ্ধ কন্ঠে বললো,
—“আপনার জন্য,আম্মু পাঠিয়েছে।
ঠোঁট এলিয়ে হাসলো তিহান।ঠোঁটে হাসি রেখে দু’কদম এগিয়ে যেতেই দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলো তোহার।মূহুর্তেই হকচকিয়ে গেলো সে।চোখের অভিমানি ভাবটা সরে গিয়ে এখন লজ্জা আর অস্থিরতার সংমিশ্রণ
খেলা করছে।তিহান আরো একটু অগ্রসর হয়ে তার মাথার কাছের দেয়ালটায় একহাত রেখে বাহুডোরে আটকে দিতেই সে কম্পিত চাপা স্বরে বললো,
—“কি করছেন?কেউ এসে পরলে….”
তাকে আর কিছু বলার সুযোগ দিলোনা তিহান।নিজের কান থেকে ফোনটা সরিয়ে তোহার কানে চেপে ধরলো।আওয়াজ করতে যেয়েও থেমে গেলো তোহা।ওপাশ থেকে একটা লোকের কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।উচ্ছসিত স্বরে কারো নাম জিজ্ঞেস করছে লোকটা।কিছু বুঝতে না পেরে বোকার মতো তাকালো তোহা।অল্প শব্দ তুলে
হেসে ফেললো তিহান।তোহার কান থেকে ফোনটা সরিয়ে নিজের কানে নিয়ে বললো,
—“হ্যাঁ নিরব,আমি একটু পরে ফোন দিচ্ছি তোমাকে।ততক্ষনে একটু নাম ভেবে দেখি।ভালো কিছু পেলেই জানাচ্ছি।”
ওপাশের কথাটা তোহার কানে এলোনা তবে একসেকেন্ড পরেই তিহান”আচ্ছা”বলে ফোনটা রেখে দিলো।
ফোনটা পকেটে রেখে তোহার চোখে চোখ রাখলো তিহান।তোহা নিচে তাকাতে নিলেই তিহান একহাতের তর্জনী দিয়ে তার থুতনি উপরে তুলে শীতল গলায় বললো,
—“চোখ নামাবানা,তাকাও আমার দিকে।”
লজ্জায় দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো তোহা।তবে তিহানের কথার অমান্য করেনি সে।পলকহীন পাপড়িতে তিহানের অতি আকৃষ্ট ধূসর চোখজোড়ায় নিবদ্ধ হয়ে থেমে আছে তার দৃষ্টি।তার অনেকটা কাছে থাকা সত্তেও শোভনীয় দুরত্ব বজায় রেখেছে তিহান।নিজ থেকে বাড়াবাড়ি রকমের কাছাকাছি কখনোই আসেনা সে।
তিহান শান্ত সাবলিল কন্ঠে বললো,
—“আমার এক কলিগের আজকে বাচ্চা হয়েছে।ছেলেটা আমার থেকে বয়সে ছোট।বড় ভাই হিসেবে খুবই মান্য করে আমাকে।তাই তখন খুশির সংবাদটা সর্বপ্রথম আমাকেই জানিয়েছে।কারো প্রথম বাবা হওয়ার সংবাদটা শুনে হাসাটাই তো খুব স্বাভাবিক।তাই নয় কি?…আর এখন ফোন করেছে মেয়ের নাম কি রাখবে তা নিয়ে।ওর প্রথম মেয়ের নাম নাকি আমাকেই রাখতে হবে।শুনলেইতো কতটা অস্থির ধৈর্যহীন শোনাচ্ছিল ওর কন্ঠ।এটুকু বলে থামলো তিহান একটু সময় নিয়ে আবার বললো,তোমার অভিমান করার কারণটা যুক্তিযুক্ত নয়।এবার বুঝতে পেরেছো?”
—“হু”।মিহি স্বরে উওর দিলো তোহা।
মুখটা একটুখানি এগিয়ে আনলো তিহান।প্রচন্ড লজ্জায় তিহানের বাহু আঁকড়ে ধরে কাঁচুমাচু হয়ে দাড়ালো তোহা।শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে তিহানের।তোহার সাড়ামুখে চোখ বুলিয়ে গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে আচ্ছন্ন কন্ঠে সে বললো,
—“তুমি আমার প্রণয়রাজ্যের সেই বিধ্বংসী প্রণয়ীনী যে কিনা মূহুর্তেই তার মায়াভরা চাহনী দিয়ে আমার বুকে আটকে রাখা শান্তশীতল প্রণয়টুকুকে ধংস্বাত্বক করে তুলে।আমি তবুও নিজেকে প্রতিনিয়ত সংযত করে যাচ্ছি ‘প্রণয়ী’।শুধু তোমার জন্য।আর তুমি কিনা সেই সংযম টাকে ভেঙে গুড়িয়ে দেয়ার প্রণয়লীলায় নেমেছো?”
~চলবে~
[চোখের ব্যাথায় জ্বর অবধি এসে গেছে।সাথে তীব্র মাথাব্যাথাতো আছেই।ড্রপ নিচ্ছি,আশাকরি সপ্তাহখানেকের মধ্য ঠি ক হয়ে যাবে।আপনারা দুদিন যাবত অপেক্ষা করে আছেন তাই দিলাম।প্রচন্ড জ্বর নিয়ে এর থেকে বেশি লেখাটা সম্ভব হয়নি।দু:খিত।]