এক_শ্রাবণ_হাওয়ায় পর্ব – ১৯
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
-‘আপনি এটা বললেন কেনো যে আপনি আমার সাথে হানিমুনে যেতে চান?’
রুমে এসেই আমি আনভীরকে প্রশ্ন ছুড়ে মারলাম বিক্ষোভে। উনি খাটের একপাশে হেলান দিয়ে মোবাইল স্ক্রলিং করছিলেন। আমার কথা শুনে মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে আড়চোখে তাকালেন । আমি রাগে রীতিমতো ফোস ফোস করছি। আনভীর খাট থেকে উঠে খানিকটা কাছে এসে দাঁড়ালেন আমার। বলে ওঠলেন,
-‘তো তুমি কি চাও যে আমি অন্য কারও সাথে হানিমুন করতে যাই?’
আমি ভড়কে গেলাম উনার এমন কথায়। আনভীর ঠোঁটজোড়া হালকা চাপিয়ে সরু চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। এতে আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। নিজেকে শান্ত রাখতে হবে আহি, মানুষটার ঠোঁট কাটা কথা শুনে এতটাও অস্থির হলে চলবে না। আমি মৃদুস্বরে বললাম,
-‘আমি কেন সেটা চাবো?’
-ওহ! তাহলে তো তুমি আমার সাথে হানিমুনে যেতে চাও রাইট?
বলেই ঠোঁটজোড়ায় এক বাকা হাসি ফুটালেন তিনি। চোখে মুখে রম্যতার ছাপ। মহা জ্বালায় পড়েছি তো! হ্যা বললেও দোষ আবার না বললেও দোষ। উফ! এই লোক ৃনে হয় জন্মই নিয়েছে আমায় বিভ্রান্ত করে তোলার জন্য। আমি আক্ষেপ সুরে বললাম,
-‘জ্বি না। আমি মোটেও এমন কিছু চাচ্ছি না। আপনি কি জানেন না যে আমি ঠিক কিসের ইঙ্গিত করছি?
-‘না তো!’
উনি না জানার ভান করে বলে ওঠলেন এবার। আমি তাই বলি,
-‘আপনি এখনই আজরান ভাইয়াকে গিয়ে বলুন যে আমার এডমিশন টেস্টের পর কোথাও যাচ্ছি না আমি আপনার সাথে। আমাদের এগ্রিমেন্ট এর কথা ভুলে গিয়েছেন?’
আনভীর রম্যতা থামিয়ে সিরিয়াস হলেন এখন৷ আমি একটা জিনিস গভীরভাবে খেয়াল করেছি যে ‘এগ্রিমেন্ট’ এর নাম শুনলেই উনি কিছুটা রেগে যান। উনার মুখমন্ডলে ঠিক একটা চাপা আভাস ফুটে ওঠে যেমনটা বিয়ের প্রথমরাতে ‘এগ্রিমেন্ট’ কথাটি শুনে আমার হয়েছিলো। তবে উনার এমন মুখ দেখে ভালো লাগে আমার। মাঝে মাঝে উনি রেগে যাওয়া সত্বেও শুধুমাত্র নিজের আত্মতৃপ্তির জন্য বহুবার এই শব্দটা উনার সামনে বলেছি। এখনও ঠিক তাই হয়েছে।আনভীর ট্রাউজারের পকেটে হাত গুজে গহীন চোখে তাকালেন আমার দিকে । বললেন,
-‘আমি তখন হ্যাঁ বলেছি এই কারনে যাতে আজরান ভাইয়া আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে কিছুই বুঝতে না পারে। নাহলে একজন মানুষ যদি এত অনুরোধের পরেও আমরা না করে দিলে কেমন দেখায় ব্যাপারটা? আমি যদি তখন সরাসরি বলে দিতাম যে আমরা যাবো না তবে প্রশ্ন করে মাথা খেয়ে ফেলতো আমার। এন্ড এক্সাটলি আমি সেটা মোটেও চাচ্ছিনা । পেয়েছো তোমার উত্তর?’
উনার কথাটি যুক্তিযুক্ত মনে হওয়াতে আমি কথার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু বললাম না তাই।আনভীর এবার বললেন ,
-‘ইদানীং আমার প্রতি কিউরিসিটিটা একটু বেশি না তোমার? তোমায় আমি শুরু থেকেই বলছি যে ভালোমতো পড়ালেখা করো আর কি করছো তুমি? যত্তসব আজগুবি ব্যাপার নিয়ে পড়ে আছো। ওসব হানিমুন-টানিমুনের ভাবনা বাদ দিয়ে ঘুমাতে যাও চুপচাপ। এতদিন যা পড়েছো এখন পড়ার হার আরও দ্বিগুন বাড়িয়ে দেবে যেহেতু আগামী পরশু তোমার পরীক্ষা। ঠিকাছে?’
উফফফফ! আবারও পড়া আর পরীক্ষা। দোষটা আসলে আমারই । এই লোকটার কাছ থেকে মিষ্টি খুনশুটিময় কথা আশা করা নিতান্তই বেকার। নিজে তো রাতদিন পড়েছে , এখন আমার জীবনটাও পড়া-প্যারা নামক জালে আটকে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যা বললাম প্রতিউত্তরে।আনভীর কিছু বললেন না এবার। শুধু আমার হাত টেনে বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন।
____________________________
কোচিংয়ে আজকেই আমার লাস্ট ক্লাস। দুদিন বাদে যেহেতু মেডিকেল পরীক্ষা তাই আজকে কোচিংয়ের স্যাররা পরীক্ষা সংক্রান্ত কিছু টিপস শেয়ার করছে আমাদের সাথে। সত্যি কথা বলতে এতদিনে শুধু আজকের ক্লাসটাই বেশ আনন্দময় মনে হলো আমার। কোচিংয়ে আজ এতদিন হলো আসছি শুরু থেকেই স্যাররা শুধু পড়া আর নোট দিয়েই আমাদের মগজভর্তি করে ফেলেছে। দু’মিনিট পড়াশোনার বাইরে একটা কথাও বলেননি যাতে স্টুডেন্টসরা একটু রিফ্রেসমেন্ট ফীল করে। আজকে কোনো পড়াশোনা হয়নি, কোনো নোট সংক্রান্ত প্যারা মাথায় চাপেনি, শুধু বসে বসে স্যারদের কথা শুনেছি। ক্লাস শেষে সবার সাথে আরও একদফা কুশল বিনিময় করলাম আমি। কয়েকজন সিনিয়র স্যার থেকেও দোয়াও চেয়ে নিলাম। এখন বাইরে রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষা করছি আনভীরের।
মূলত সেই দিনে উনার প্রতি আমার ব্যবহারের আকষ্মিক পরিবর্তন দেখে এখন কিছুতেই উনি আমায় একা ছাড়েননা । প্রতিদিন আমায় নিজ দায়িত্বে কোচিং নিয়ে আসেন তারপর ভার্সিটিতে উনার একটা লেকচার কমপ্লিট করিয়ে আবার নিজ দায়িত্বে আমায় বাসায় রেখে আসেন। উনি মাঝে মাঝে সময় না পেলে আজরান ভাইয়াকেও বলে দেন আমায় নিয়ে আসতে। তবুও কোনোক্রমেই উনি আমায় একা ইনসিকিউর রাখবেন না। উনার এসব কান্ড থেকে মাঝে মাঝে আমি যেন ভেবেই পাইনা আসলে বলবোটা কি।
এখন কোচিং শেষে আনভীরের জন্য অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি কিন্ত মানুষটার যেন কোনো হদিস নেই। হঠাৎমোবাইলে নোটিফিকেশনের শব্দে মোবাইল চেক করে দেখি উনি ছোট্ট একটা টেক্সট দিয়েছেন,
-‘পাঁচ মিনিট ওয়েট করো। আমি আসছি।’
আমি তপ্তশ্বাস ফেলে মোবাইল ব্যাগের পকেটে ঢুকিয়ে রাখলাম। আশেপাশে লোকমানব আগের তুলনায় প্রায় কমে গিয়েছে। হঠাৎ পেছন থেকে একজন পুরুষালি গলায় বললো,
-‘এখনও বাসায় যাওনি?’
পেছনে ফিরে দেখি ধ্রুব ভাইয়া। মেইবি এখানকার ডিউটি শেষ করে বাড়ির জন্য ফিরছে। আমি তাই বলি,
-‘আনভীরের জন্য অপেক্ষা করছি। উনি আসবেন কিছুক্ষণ পর।’
-‘বাসা তো কোচিং থেকে বেশি দূরে না, তাহলে একা চলে যাও ? এটা খালি রাস্তা, তারওপর একা মেয়ে এভাবে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকাটা কি মানায়? আনভীর কখন না কখন আসে!’
ধ্রুব ভাইয়ার কথায় একটু ভয় ঢুকলো মনে। হুট করে মনে পড়লো অপূর্ব ভাইয়ার কথা। গতকাল রাতে চাচী অপূর্ব ভাইয়া সম্পর্কে কি যেন বলতে চেয়েছিলো আমায়। কিন্ত আমি তা না শুনেই কল কেটে দিয়েছিলাম ভয়ে। ওই পাষাণ, হৃদয়হীন মানুষটার ছায়াও আমি পুনরায় মারাতে চাই না। আমার কৈশর জীবন তো সে এককথায় শেষ করে দিয়েছিলো। এখন যদি সেদিনকার মতো আবার এখানে আসে? ধ্রুব ভাইয়া হয়তো আমার ভয় পাওয়াটা দেখতে পেয়েছেন। তাই বললেন,
-‘আচ্ছা, আমি একটা রিক্সা নিয়ে দিয়ে আসি তোমাকে? এতে তোমার কোনো প্রবলেম হবে?’
ভাইয়ার এ কথাটা আশার আলোর মতো মনে হলো আমার কাছে। কিন্ত আমার ভয় হচ্ছিলো আনভীরের ব্যাপারে। তবুও হ্যাঁ বললাম আমি। আনভীর কি বলুক না বলুক এটা আমার দেখার বিষয় হওয়ার কথা না। এখন এখানে উনার অপেক্ষা করাটা আসলেই আমার জন্য কিছুটা বিপদজনক।
.
.
রিক্সা আনভীরদের কলোনির দিকে এগিয়ে চলছে। আমার পাশে খানিকটা দুরত্ব নিয়ে বসা ধ্রুব ভাইয়া। আমি কোনো কথা না বলে ঠোঁট কামড়ে এটাই ভাবছি যে আনভীর ঠিক কতটা রেগে যাবে। এর মধ্যে ধুব ভাইয়া আচমকা জিজ্ঞেস করলো,
-‘এগ্রিমেন্ট শেষ হলে কোথায় যাবে তুমি?’
আমি চমকে তাকালাম ভাইয়ার দিকে। উনি যে হঠাৎ এ প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে এটা আমার ধারনা ছিলো না। ভাইয়া আবার বললেন,
-‘আমি ক্যাজুয়েলি জিজ্ঞেস করলাম তোমায়। আফটার অল এগ্রিমেন্টের পর তুমি আর আনভীর তো আর একসাথে থাকবে না। আর আনভীরও এর আগে যা বললো, তোমার ফ্যামিলি বলতেও তেমন কেউ নেই। তো থাকবে কোথায়?’
-‘কে বলেছে আমার ফ্যামিলি নেই। এই পৃথিবীতে এখনও একজন আছে যে মায়ের পর সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে আমাকে। তার কাছেই যাবো, এগ্রিমেন্ট শেষে না, এই পরীক্ষাটি দেওয়ার পর।’
ধ্রুব বিস্মিত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন,
-‘কে উনি?’
-‘আমার মামু।’
শীতল কন্ঠে বললাম আমি। ধুব ভাইয়া নিশ্চুপ। আমি তাই বললাম,
-‘একটা লম্বা সময় মামুর সাথে যোগাযোগ ছিলো না আমার। কিন্ত আমার মামুই এমন একজন মানুষ যে এতটা বছর আমার জন্য চিন্তা করেছৃন। মায়ের মৃত্যুর পর মামু বহুবার বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন আমায় এডপ্ট করবেন বলে। কিন্ত চাচা-চাচি রাজি হননি। রাজি হবেনই বা কেন, আমি চলে গেলে তো উনাদের বিনে পয়সার দাসিও চলে যেতো।’
বলেই একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম। ধ্রুব ভাইয়া এবার বললেন,
-‘থাক! ওসব ভুলে যাও। অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যেও। যদি কখনও আমার প্রয়োজন পড়ে , অবশ্যই আমাকে ডাকবে কিন্ত।’
আমি মৌনতা বজায় রেখেছি এবার। শুধু আর কিছুদিন, এই এগ্রিমেন্ট শেষ হওয়ার পূর্বেই আনভীরের কথামতো উনাকে ছেড়ে চলে যাবো আমার মামুর কাছে।
.
.
.
________________
এখন আমি বসে আছি একটি হাসপাতালের বেডে। পায়ের মধ্যে কিছুক্ষণ আগে ডক্টর ড্রেসিং করিয়ে দিয়েছেন। আসলে তখন রিক্সা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে একটা ছোটখাটো এক্সিডেন্ট হয়েছে আমার আর ধুব ভাইয়ার। ধ্রুব ভাইয়ার তেমন একটা ক্ষতি না হলেও আমার পায়ের অংশটুকু ভালোভাবে ছিলে গিয়েছে। রক্তও গড়িয়ে মাখামাখি অবস্থা প্রায়। পরে ধ্রুব ভাইয়াই আমায় হাসপাতালে নিয়ে আসলো। পায়ে ব্যান্ডেজ করাতে চুলকাচ্ছে অনেক। কিন্ত ডাক্তার ওই অংশটুকু ধরতে সাফ মানা করে দিয়েছে। আমি ভাবলাম একবার আজরান ভাইয়া বা বাবাকে ফোন করে বলা দরকার। আনভীরকে তো মোটেও বলবোনা, পরে আবার কি তুলকালাম কান্ড করে বসে আল্লাহ মালুম।
তবে কথা আছে না, ‘যেখানে বাঘের ভয়, সেখানে সন্ধ্যা হয়!’, আমার সাথে সেরকমই এক ব্যাপার ঘটেছে। বাইরে আমি কারও উচ্চস্বরে কথা বলার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তখনই নার্সের বারন করা সত্বেও দরজা খুলে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে পড়লেন আনভীর। উনার চোখমুখ রীতিমতো লাল হয়ে গিয়েছে উত্তেজনায়, শার্টের অবস্থা অগোছালো। উনি কোনো কথা না বলে হুট করে আমায় কোলে তুলে নিতেই আমি যেন হতভম্ব হয়ে গেলাম। নার্স ডাক্তার এমনকি ধ্রুব ভাইয়াও চমকে গিয়েছে এমন করাতে। আনভীর ধ্রুব ভাইয়াকে বললেন,
-‘থ্যাংক ইউ ওকে হেল্প করার জন্য। এখন আহির জন্য আমিই যথেষ্ট আছি। নিজের মেডিসিনগুলোও ঠিকমতো নিও। আমি ওকে নিয়ে গেলাম।’
বলেই হনহন করে উনি করিডোরের দিকে ছুটলেন। জেলাসি কি তবে এটাকেই বলে যে একজন মানুষ আমায় হেল্প করলো তারপরও উনি এরকম ইমম্যাচিউর বিহেভ করলেন? এদিকে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করছে আমার। তুই শেষ আহি! এই লোক তোকে লজ্জায় মাটিতে পুতে ফেলবে!
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ
ভুলক্রুটি ক্ষমাসুলভ চোখে দেখবেন।