এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ পর্ব-১

0
6449

আজ দু’দিন হলো রোহিতা’রা নতুন বাসায় উঠেছে। দুইদিনে সবকিছু গোছগাছ করে মাত্র আরাম করে বসেছে সে উঠোনে। সাধারণত ‘বাসা’ বলতে যা বোঝায়, রোহিতা দের নতুন বাসাটা সেরকম নয়। এটাকে একটা টিন সেটের বাড়ি বলা চলে। বাড়ির পেছনদিকে একটা পুকুরও আছে। বাড়িটায় দুটো ঘর আছে, সামনাসামনি। ফ্ল্যাট বলতে যা বুঝায়। রোহিতা উঠোনে বসার পর থেকেই লক্ষ্য করছে, সামনের ঘর থেকে একটা মেয়ে বারবার উঁকি দিচ্ছে দরজার বাইরে। রোহিতা কপাল কুঁচকায়। ২/৩ বার মেয়েটা উঁকি দেয়ার পর রোহিতা বিরক্ত হলো। সে উঠে ঘরে চলে গেল। ঘরে গিয়ে দেখলো দুজন অপরিচিত মহিলা আর পুরুষ বসে আছেন ড্রয়িং রুমে। তার বাবার সাথে গল্প করছেন দুজন। আশ্চর্য! এরা কখন এলো? উঠোনেই তো বসে ছিলো সে। এতো বেদিশা হয়ে বসে ছিলো ও? রোহিতা সালাম দিলো দুজনকে। রোহিতার বাবা মঞ্জুর মিয়া বললেন, আয় এদিকে আয়। দেখে যা। ইনারা হচ্ছেন তোর দাদু আর দাদী।

– দাদু আর দাদী?

ভারি অবাক হলো রোহিতা। জীবনে এদের দেখে নাই। এরা দাদু আর দাদী কীভাবে হলো? বয়স্ক মহিলাটা রোহিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, এই তোমার মেয়ে, চাচা?

– হ্যাঁ চাচি। এই আমার মেয়ে। এইবার কলেজে উঠলো।

মহিলার স্বামী বললেন, কোন কলেজে? এইযে সামনের টায়?

– এখনও ভর্তি করি নি। ভাবছি এটায়ই করব। বাসা থেকে দেখা যাবে। সেইফ ও আছে।

– হ্যাঁ। আমার মেয়েও এইবার কলেজে উঠলো। ভালোই হবে। দুজনে একসাথে যাবে।

রোহিতা আর সেখানে দাঁড়ালো না৷ ভেতরে চলে গেল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো তার মা চা বানাচ্ছেন। সে বলল, উনারা আমার দাদু দাদী কীভাবে হলেন মা?

রিনা বেগম হাসলেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে। তারপর বললেন, কথায় কথায় বেরিয়ে পড়লো তোদের গ্রামের পাশের গ্রামেই উনাদের বাড়ি। দুঃসম্পর্কের চাচা লাগেন উনি তোর আব্বার।

– ও। তার মানে ঐ মেয়েটা উনাদের মেয়ে!

– কোন মেয়েটা?

– আরে উঠানে বসেছিলাম। ঐ ঘর থেকে একটা মেয়ে বারবার উঁকি মারতেছিল।

– হ্যাঁ। উনাদের এক মেয়ে আর এক ছেলে। ছেলেটা লন্ডনে। আর মেয়েটা তোরই বয়সের।

– আচ্ছা। তানজিম কই?

– দোকানে পাঠাইছি।

– এখন দোকানে কিজন্য?

– বিস্কুট আনাচ্ছি। শেষ হয়ে যাচ্ছে।

রোহিতা কিছু বললো না। নিজের ঘরে চলে গেল। কিছুক্ষণ নিজের জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করে আবার গেল ড্রয়িংরুমে একটু টিভি দেখার জন্য। গিয়ে দেখলো দাদা আর দাদী এখনও বসে আছেন। আর একটু আগের সেই মেয়েটা বসে আছে তাদের পাশে। রোহিতা গিয়ে তার মায়ের একপাশে বসলো। তারপর ভালোভাবে জরিপ করতে লাগল মেয়েটাকে। গায়ের রঙ গৌরবর্ণ। চুলগুলো ম্যাগি নুডলস এর মতো পেঁচানো। চোখদুটো কেমন চায়নিজ চায়নিজ। মেয়েটা সুন্দরী। তবে একটু মোটা।

– রোহিতা, যাও ওকে ভেতরে নিয়ে যাও। গল্প করো।

বাবার কথায় ধ্যান ভাঙে রোহিতার। সে মেয়েটাকে ভেতরে নিয়ে নিজের রুমে বসালো। মেয়েটাকে চারিদিকে তাকিয়ে আবার রোহিতার দিকে চেয়ে ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম কী?

রোহিতা মেয়েটাকে আপাদমস্তক দেখে বলল, আমার নাম রোহিতা।

– আমার নাম নিহিন। এইবার কলেজে উঠলাম। তুমি?

– আমিও।

– আরেব্বা! আমি ভেবেছিলাম এতো গম্ভীর মেয়েটা আমার বড় হবে। এখন দেখি তুমি আমার বান্ধবী। হিহি!

কথাটা বলতে বলতে নিহিন রোহিতার ডান বাহুতে একটা থাপ্পড় বসালো। রোহিতার চোখ কপালে উঠে গেল। প্রথমবারের কথাবার্তায় কেউ এমন করতে পারে! নিহিন আবার বলল, নূরবানু স্কুল এন্ড কলেজে ভর্তি হবো আমি। তুমিও নিশ্চয়ই সেখানেই?

রোহিতা হাসার চেষ্টা করে বলল, হ্যাঁ। কারণ এটা বাসা থেকে দেখা যায়।

– গ্রেট। দুজনে একসাথে যাব। কালই ভর্তি হবো। এই তোমার মোবাইল আছে? ফেইসবুক আইডি আছে?

– আ-আছে তো।

– নাম বলো। ঘরে গিয়ে রিকোয়েস্ট পাঠাব। ওহ হো, এভাবে তো হবেনা। খুঁজে পাব না। আচ্ছা বিকেলে আমি আসব মোবাইল নিয়ে।

– আচ্ছা।

রোহিতার ভারি মজা লাগল। মেয়েটা মিশুক বটে। যাক, একা একা আর থাকতে হবেনা। কপালগুণে একটা মিশুক বান্ধবী জুটেছে। কিছুক্ষণ দুজনেই বসে বসে এটা সেটা নিয়ে অনেকক্ষণ গল্প করল। তারপর নিহিন চলে গেল। রোহিতার অনেক ফুরফুরে লাগতে লাগল। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, জানো মা, মেয়েটা অনেক মিশুক।

– হ্যাঁ। শুনেছি ওরা মানুষও অনেক ভালো।

– একটু ঘুমাই। তানজিমকে বলবা আমাকে এসে না জ্বালাতে।

– গোসল করবি না?

– মাগো এতো ঠান্ডা!

রোহিতা আর দাঁড়ালো না। শুয়ে পড়লো নিজের ঘরে গিয়ে।
_____________

বিকেল চারটা। রোহিতার ঘুম ভাঙে দরজায় করাঘাতের আওয়াজে। বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে সে। আবারও দরজায় করাঘাত করে কেউ। এবার মেজাজ বিগড়ে যায় তার। নিশ্চয়ই নিহিন। মা বলে নি সে ঘুমিয়ে আছে? অবশ্যই বলেছে। বলার পরেও এই অভদ্রতা! রোহিতা চেঁচিয়ে বলল, কে?

– দরজা খোল।

পুরুষালি ভরাট কণ্ঠ শুনে থমকে গেল রোহিতা। ঘুমের ঘোরে এই কণ্ঠ শুনছে? নাকি সত্যিই এসেছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ক-কে? কে এসেছো?

– দরজা খুলে খোমা দেখ। চিনে যাবি।

সত্যিই! সত্যিই আসছে। রোহিতা কী করবে এবার, কী করবে! তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখেমুখে পানি ছেটালো। বেরিয়ে এসে শীতের কাপড় খুঁজতে লাগল। এরমধ্যে আরো কয়েকবার আগন্তুক দরজায় দুরুম দুরুম হাত লাগালো। শীতের কাপড় খুঁজে না পেয়ে আলনা থেকে একটা শাল নিয়ে কোনোমতে শরীরে পেঁচিয়ে দরজা খুললো। খুলেই চোখ বন্ধ করে হড়বড় করে বলতে লাগলো, মেরো না প্লিজ, মেরো না। আমি ঘুমোচ্ছিলাম। প্লিজ মেরো না।

– এমন করছিস কেন? তর হাবভাবে মনে হচ্ছে আমি তোকে দিনে রাতে নিয়ম করে পেটাই!

কথাটা শুনে চোখ খুললো রোহিতা। চোখের সামনে ঐ মনোমুগ্ধকর মুখটা দেখে আপনাআপনি ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো তার। সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলো আগন্তুকের দিকে। গদগদ করে বললো, সোহেল ভাই, আমার সাথে একটু মিষ্টি করে কথা বললেও তো পারো।

সোহেল চোখমুখ কুঁচকে বলল, একটা থাপ্পড় দিয়ে গাল ফাটিয়ে দেব। বারান্দায় যে লাইট লাগানোর কথা ঐটা কোথায়? খালা বললেন তুই রাখছিস। দে তো, ওটা লাগাব।

– তুমি সবসময় এভাবে কথা বলো আমার সাথে!

গাল ফুলিয়ে কথাটা বলে ধপাস ধপাস শব্দ করে হাঁটলো রোহিতা। তারপর লাইটটা দিলো সোহেলের হাতে। সোহেল সেটা নিয়ে বেরিয়ে গেল। রোহিতা মুখ ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সোহেল আবার ফিরে এসে বলল, এই শোন, এভাবে ধপাস ধপাস করে হাঁটিসনা। এটা পরের বাসা। কিছু হলে সবকিছু তো ক্ষতিপূরণ খালুকে দিতে হবে। একটু রয়েসয়ে চল।

বলেই সোহেল চলে গেল। রোহিতা হ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইল। মানুষ এতো বজ্জাত হয় কীভাবে?

বারান্দায় একটা চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়ে লাইট লাগাচ্ছে সোহেল। মঞ্জুর মিয়া আর রিনা বেগম দাঁড়িয়ে আছেন সেখানে। রোহিতা গিয়েই প্রশ্ন করল, তানজিম কোথায়? আসে নাই?

রিনা বেগম সোহেলের লাইট লাগানো দেখছিলেন গভীর মনযোগ দিয়ে। ওদিকে তাকিয়েই উত্তর দিলেন, এসেছিলো, বিস্কুট দিয়েই আবার বেরিয়ে গেল মাঠে খেলতে।

– আসার সাথেসাথেই টো টো শুরু করে দিয়েছে? বাবা তুমি কি ওকে একটুও বকবে না? ও কি শান্ত হবে না আর?

রোহিতার কথাটা শেষ হওয়ার সাথেসাথে হো হো করে হেসে উঠলো সোহেল। সাথে মঞ্জু মিয়া এবং রিনাও হাসলেন। রোহিতা খানিক চটে গিয়ে বলল, এতো হাসার কী আছে? আমি কি কৌতুক বলেছি?

মঞ্জুর মিয়া হাসি থামিয়ে বললেন, সায়েন্স, আর্টস না কমার্স?

– আর্টস। আমিতো আগেই বলেছি বাবা…

– কমার্স ছিলি, কমার্সই থাক। এই পাগলপনা করছিস কেন?

রোহিতাকে ধমকে উঠলো সোহেল। রোহিতা বলল, তুমি বললে তো হবে না। আমার কঠিন লাগে।

মঞ্জুর মিয়া ঘরে যেতে যেতে বললেন, তুমিই দেখো বাবা। আমি আর বুঝাতে পারছিনা।

সোহেল লাইট লাগিয়ে চেয়ার থেকে নেমে রোহিতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, কঠিন লাগলে কোচিং করবি।

– কোচিং থেকে যে হোমওয়ার্ক দিবে ওগুলো কে করে দিবে?

– নিজে করবি।

– যদি না পারি?

– আমি আছি। রোজ এক ঘণ্টা পড়াব।

– হ্যাঁ?

রোহিতার মনে হলো সে ভুল শুনছে। সোহেল প্রতিদিন এক ঘণ্টা এসে তাকে পড়াবে? রোহিতা কিছু বলতে যাবে তখনই দেখলো উঠোন পেরিয়ে নিহিন দৌড়ে আসছে। এমনভাবে দৌড়াচ্ছে যে তার হালকা মোটা শরীরের কিছু অংশের নড়াচড়া স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে সোহেল কপাল কুঁচকে বলে উঠলো, এই জোকারটা আবার কে?
________

(চলবে)
এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ – ১
ফারজানা আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here