এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ – ৫
ফারজানা আহমেদ
___________
খলিল চৌধুরী মারা যাওয়ার প্রায় দেড় মাস হয়ে গেছে। তার ইচ্ছা অনুযায়ী তাকে গ্রামের বাড়িতে কবর দেয়া হয়েছে। আজ পয়তাল্লিশ দিন পর গ্রামের বাড়ি থেকে ভাড়া বাসায় ফিরলেন নিলুয়া মেয়েকে নিয়ে। রোহিতা উঠানে বসে আছে। নিহিন আর নিলুয়াকে আসতে দেখে দৌড়ে গেল। সালাম দিলো নিলুয়া বেগমকে। উত্তরে উনি হাসলেন কেবল। কী বিষন্ন সেই হাসি! ইশ, নিলুয়া লাঠি ভর দিয়ে হাঁটছেন। এই কদিনেই যেন অনেকখানি বয়স বেড়ে গেছে উনার। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছেন। উনাকে দেখে রোহিতার মনে পড়ে গেল সেই বিভৎস দৃশ্য! আহা! কেউ নিজের মাকে এভাবে মারতে পারে!
– কেমন আছিস রোহিতা?
নিহিনের কথায় ধ্যান ভাঙে রোহিতার। তাকিয়ে দেখলো নিলুয়া বেগম ঘরে চলে গেছেন। নিহিন দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। রোহিতা কোনো কথা বলল না। চুপচাপ একবার নিহিনকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। নিহিন আবার বলল, কথা বলবি না?
– ভালো আছি।
কথাটা বলেই নিজের ঘরে যাওয়ার জন্য উদ্ধত হয় রোহিতা। নিহিন পিছু ডাকল, আমাকে খুব খারাপ ভাবছিস তাইনা রে?
রোহিতা পিছু ফিরে তাকাল। মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটিয়ে বলল, খারাপ মানুষকে খারাপ ভাবলে তারা ভালো হয়ে যায় না।
– পেছনের গল্প না শুনে কাউকে খারাপ বলতে নেই।
– পেছনের বা সামনের, যেকোনো কিছুরই গল্প হোক না কেন। সবারই এটা মনে রাখা উচিত যে – মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।
নিহিন আস্তে আস্তে বলল, যে সাক্ষাৎ জাহান্নাম, তার পায়ের নিচে আবার আমার কিসের বেহেশত?
রোহিতা থমকাল। কৌতূহল নিয়ে চাইল নিহিনের দিকে। নিহিন শুকনো হেসে বলল, অন্তত পেছনের কাহিনী জানার দরকার ছিল। পরে নাহয় আমাকে খারাপ বলতি।
রোহিতা ঠাণ্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, কেন এতো বেপরোয়া তুই? কেন?
জবাবে আরেকবার শুকনো হাসল নিহিন। রোহিতার দিকে তাকিয়ে বলল, বলব। অবশ্যই বলব। যেহেতু আমার বেপরোয়া রূপটা দেখে ফেলেছিস সেহেতু এর পেছনের কাহিনীটাও তোকে বলব। একটু সময় দে।
– উনি তোর মা, নিহিন। আমি জানিনা কী এমন করেছেন। কিন্তু ঘুরেফিরে, উনি তোর মা। মায়ের গায়ে হাত তোলা পাপ।
কথাটা বলেই আবার চলে যেতে লাগল রোহিতা। নিহিন বলল, যার সবত্রই পাপে মোড়ানো, তার গায়ে হাত তোলা কী করে পাপ হয়!
নিহিনের কথায় আবারও থমকায় রোহিতা। কেমন গোলকধাঁধার মতো কথা বলছে নিহিন। তাকিয়ে দেখল নিহিনের চোখে জল। মায়া লাগল রোহিতার। আসলেই তো, পেছনের কাহিনী না জেনে এভাবে বলা কি ঠিক? রোহিতার মনে হলো নিহিনের সহানুভূতি প্রয়োজন। দেখা যাক না, কীজন্য মেয়েটা এমন। সে বলল, এসেছিস, ফ্রেশ হো। পরে কথা হবে।
নিহিন কিছুটা সহজ হলো। সে চোখ মুছে হেসে জিজ্ঞেস করল, তোর মা বাবা কেমন আছেন?
– ভালো। বাবা কিছু কাজে সিলেটের বাইরে গেছেন। মাসখানেক পর ফিরবেন।
– আর সোহেল ভাই? পড়াতে আসেন?
রোহিতা কিঞ্চিৎ হাসল। বলল, আসেন৷ পড়াতে আসেন।
নিহিন হেসে রসিকতার স্বরে ভ্রু নাচিয়ে বলল, সবকিছু কদ্দুর?
রোহিতা কপাল কুঁচকে বলল, কিসের সবকিছু? শুরু করে দিয়েছিস তোর লুচ্চামি?
– উইম্মা! উনি করলে দোষ নাই আর আমি বললেই দোষ!
– শোন আমি কিছু করি নি। ওসব আমার দ্বারা সম্ভব না।
– আচ্ছা ঘরে যাই। পরে আসব। এসে দেখব কী কী সম্ভব।
নিহিন আর রোহিতা যার যার ঘরে চলে গেল। রিনা বেগম শুয়ে ছিলেন। অসময়ে শুয়ে থাকতে দেখে রোহিতা চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে মা? শরীর খারাপ তোমার?
রিনা লেপের নিছ থেকে মাথার বের করে বললেন, না, কাজ নেই শুয়ে আছি। যা ভাত খেয়ে নে।
– তুমি খেয়েছো?
– পরে খাব। বাইরে কে ছিলো?
– নিহিন আর ওর আম্মু।
রিনা বেগম উঠতে উঠতে বললেন, ওহ, চলে এসেছেন উনারা? যাই দেখে আসি কী অবস্থা।
রিনা বেগম উঠে গেলেন। রোহিতা লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে খেতে গেল। সেদিন রোহিতা যখন তার বাবাকে ফোন করে খলিল চৌধুরীর মৃত্যুর খবর জানালো, তখন নিলুয়া বেগম রক্তাক্ত অবস্থায় ওর হাতেপায়ে ধরে আকুতি করেছিলেন যেন সে কাউকে এটা না বলে যে – নিহিন তাকে মেরেছে। সেদিন রোহিতা অবাক হয়েছিলো খুব। একেই বলে মায়ের ভালোবাসা। যুগ যুগ ধরে মায়েরা সন্তানের সব দোষ এভাবেই ঢেকে আসছেন। রোহিতা নিষ্কলুষ চোখে তাকিয়ে দেখছিলো, কী অবলিলায় সব যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করে উঠে গিয়ে শরীর থেকে রক্ত পরিষ্কার করলেন নিলুয়া। কীভাবে কাটা স্থানে ঔষধ লাগালেন। কীভাবে নিজেকে স্বাভাবিক করলেন। দশ মাস দশ দিন পর যে সন্তান নাড়ী ছিঁড়ে দুনিয়ায় এলো, সেই সন্তান যখন শারীরিক অত্যাচার করে তখন নিশ্চয়ই মরে যেতে ইচ্ছে করে? আহা! কী নির্মম! কী কষ্টকর!
___________
সন্ধ্যা সাতটায় বইখাতা নিয়ে বসে আছে রোহিতা। সোহেল বলে দিয়েছে, প্রতিদিন সে এসে যেন তাকে এভাবেই টেবিলে বইখাতা নিয়ে রেডি দেখে। নাহলে কঞ্চির বেত দিয়ে হাতের তালুতে মারে। রোহিতার অনেক রাগ হয়, মায়ের কাছেও বিচার দেয়। কিন্তু মায়ের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। লেখাপড়ার জন্য মার খেলেও নাকি ক্ষতি নেই। কিন্তু মা তো জানে না, রোহিতা লেখাপড়ার জন্য মার খায় না। মার তো খায় সোহেলের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকার অপরাধে। ঐ খাইস্টাভূত টাকে যে কীভাবে রোহিতা নিজের মনের কথা বুঝাবে!
– কীরে তুই কী করিস একা একা? পড়তেছিস?
নিহিন এসে বসলো রোহিতার পাশে। রোহিতা টেবিলে হাত রেখে তার ওপর মাথা রাখল। অস্পষ্ট ভাবে বলল, সোহেল ভাই আসবেন পড়াতে।
নিহিন বুঝতে পারল না। আবার জিজ্ঞেস করল, কী বললি? গড়াতে? কী গড়াতে?
রোহিতা মাথা তুলে ধমক দিল, আরে ধুর। পড়াতে। পড়াতে বলেছি। সোহেল ভাই আসবেন পড়াতে।
– ও আচ্ছা। তা তোর জিহবা তো বাট্টি না। ঠিক করে কথা বল।
– তুইও তোর মায়ের মতো কালা হয়ে যাচ্ছিস।
কথাটা বলেই নিজে নিজে থমকে গেল রোহিতা। নিহিনের দিকে তাকিয়ে দেখল নিহিনও অপ্রস্তুত বোধ করছে। প্রসঙ্গ পাল্টাতে নিহিন বলল, এইতো সুযোগ! তোর আম্মা আমাদের ঘরে৷ ঘর একা। এবার একটু সেক্সি স্টাইলে সোহেল ভাইকে মনের কথা বলে দে।
রোহিতা প্রচণ্ড বিরক্ত হলো। চোখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুলে সে বলল, সবসময় খারাপ কথা বলতেই হবে?
– ভালো কথা বললাম।
– শোন নিহিন, যে সম্পর্ক শারীরিক আকর্ষণ দিয়ে শুরু হয়, সেই সম্পর্ক শরীর পর্যন্তই। সেটা মন পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে না। শরীর ছুঁয়ে কাছে টানা টা ক্ষনস্থায়ী। আর মন ছুঁয়ে কাছে টানা টা চিরদিন থাকে। আমি ক্ষনস্থায়ী সম্পর্ক চাই না। আজন্মকালের ভালোবাসা চাই।
রোহিতার বলা কথাগুলো যেন মুহূর্তেই নিহিনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিল। সে বিস্ময় নিয়ে বলল, বাহ! কী সুন্দর কথা বললি রোহিতা। কোত্থেকে শিখলি?
এবার রোহিতা খানিকটা চুপ মেরে গেল। হাওয়ায় উড়ে আসলো খানিকটা লজ্জা, রক্তাভ আভায় মুড়িয়ে দিয়ে গেল তার ফর্সা গাল। নিহিন এবার রোহিতাকে ধাক্কা মেরে রসিকতার স্বরে বলল, ওহোওওও! প্রেমে পড়ে তো কাব্যিক হয়ে গেলি রে!
– কে কার প্রেমে পড়েছে?
গমগমে পুরুষালি গলাটা যেন পরিবেশটা কাঁপিয়ে তুলল। নিহিন আর রোহিতা একসাথে দরজার দিকে তাকাল। সাথেসাথেই দু’জনের বুকের ভেতর ভয় জেঁকে বসে। সোহেল এসেছে। সে কি শুনে ফেলল সব? রোহিতার বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম করছে। সোহেল এগিয়ে এসে চেয়ারে বসল। আবার জিজ্ঞেস করল, কী ব্যাপার? কথা বলছ না কেন তোমরা?
নিহিন গলা খাঁকারি দিল। সিদ্ধান্ত নিল সে বলে দেবে এখনই সব। এসব লুকোচুরি তার ভালো লাগছে না। সে বলল, আসলে রোহিতা…
রোহিতা চিমটি কেটে আটকে দিল নিহিনকে। তারপর হড়বড় করে বলল, আমাদের কলেজের একটা ফ্রেন্ড। তুমি এতো জেরা করছ কেন? সবকিছু তোমাকে বলা লাগে?
সোহেল কপাল কুঁচকে তাকাল। নিহিন একবার সোহেলের দিকে তাকিয়ে আবার রোহিতার দিকে তাকাল। তারপর বলল, আচ্ছা আমি যাই রোহিতা। কাল দেখা হবে।
বলেই নিহিন বেরিয়ে গেল। রোহিতা সোহেলের দিকে তাকিয়ে দেখল সোহেল এখনও তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে আছে। রোহিতা ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বলল, এ-এভাবে কেন তাকাচ্ছো?
– সমস্যা কী?
– কীসের সমস্যা?
– আমিও তো তাই জিজ্ঞেস করছি।
রোহিতা বই খুলতে খুলতে বলল, কোনো সমস্যা নেই।
– খালা কোথায়?
– নিহিনদের ঘরে।
– আমার দিকে তাকা। একটা কথা বলব।
রোহিতা সোহেলের দিকে তাকাল। সোহেল শান্ত কণ্ঠে বলল, নিহিনের সাথে চলাফেরা বন্ধ কর।
খুবই স্বাভাবিকভাবে কথাটা বলল সোহেল। কিন্তু এই একটা কথায় কেঁপে উঠল রোহিতা। হঠাৎ কেন এই কথা বলছে সোহেল? সে কী সব শুনে ফেলল? রোহিতার অস্বস্তি লাগছে। ঠোঁট শুকিয়ে আসছে। সে জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, কেন? কী করেছে সে?
___________
(চলবে)