এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ পর্ব-৬

0
3506

এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ – ৬ (ওয়ার্নিং: কিছু আপত্তিকর দৃশ্য, কথাবার্তা রয়েছে।)
ফারজানা আহমেদ
__________

– সে কী করেছে সেটা পরের বিষয়। আগে বল তো তুই এতো নার্ভাস কেন?

সোহেল ভ্রুকুটি করল। রোহিতার দিকে তাকিয়ে থাকল উত্তরের আশায়। রোহিতার জান যায় যায় অবস্থা। সে দম বন্ধ করে বলল, মানে কী! আমি নার্ভাস কেন হবো?

– তোকে দেখে তো তা-ই মনে হচ্ছে।

– এই পড়াও তো। শুধুশুধু কথা বলে সময় নষ্ট।

– ও বাবা! এ যে ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট আমার।

রোহিতা কপাল কুঁচকে তাকাল। তার রাগ হচ্ছে ভীষণ। এই খাইস্টাভূত সবসময় ওর সাথে এমন করে। রোহিতা বইয়ে মন দিলো। সোহেল এবার কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে বলল, চলাফেরা কমা। আমি চাই না তুই ওর মতো পাঁক্না হোস।

– পাঁক্না?

– পাঁক্না চিনোস না?

– কী করেছে সে?

– তোকে ভেঙে বলতে চাই না।

– আমিও চলাফেরা কমাবো না।

– শুনলে লজ্জা পাবি।

রোহিতা খানিকটা নড়েচড়ে বসল। খুব সন্তর্পণে বলল, লজ্জা পাব না। বলো।

সোহেল ‘উফ’ বলে উঠলো। তারপর রোহিতার হিসাববিজ্ঞান বইটা হাতে নিতে নিতে বলল, তোকে বলে লাভ নেই। খালাকেই বলব। তুই পড়।

– এমন করো কেন তুমি? বললে কী হয়?

করুণ মুখ বানালো রোহিতা। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল সোহেল। রোহিতা আশ্চর্যজনক ভাবে আবিষ্কার করল যে, সোহেলের হাসিটা এতো মায়াবী! একদম হৃদয়ে ধুকপুক তোলার মতো। বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে হাসছে সোহেল। সেই হাসিতে বারংবার কেঁপে উঠছে রোহিতার হৃদয়। রোহিতা এক অদ্ভুত সম্মোহনী দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলল, সোহেল ভাই, তুমি হাসার সময় চোখ কেমন ছোট ছোট বানিয়ে দাও। এভাবে আমার সামনে করো না। আমার বুকের ভেতর কিছু একটা হয়। তোমাকে বেশি সুন্দর দেখায়।

সোহেলের হাত থমকে গেল। সে চোখ তুলে তাকাল। দেখল রোহিতা এক ধ্যানে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এক সেকেন্ড… দুই সেকেন্ড… তিন সেকেন্ড… রোহিতা চোখ ফেরাচ্ছে না। সোহেল আস্তে করে ডাকল, রোহিতা!

রোহিতা জবাব দিল না। সে যেন এই পৃথিবীতে নেই৷ অন্য কোনো জগতে। ডানে বামে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজল সোহেল। বিছানার নিচে দেখতে পেল কাঙ্ক্ষিত জিনিসটা। কঞ্চির বেত, যেটা দিয়ে সে রোহিতাকে সোজা করে। সেটা এনে ফ্যাৎ করে মারল রোহিতার ডান বাহুতে। চিৎকার করে আহত জায়গায় হাত বুলাতে লাগল রোহিতা। সোহেল খানিক রাগত্ব স্বরে বলল, তোর বয়স সতেরো। আমার বয়স ছাব্বিশ।

– তো কী হয়েছে?

– কী হয়েছে মানে?

রোহিতা কিছু বলল না। গাল ফুলিয়ে বসে থাকল। সোহেল রোহিতার দিকে বই এগিয়ে দিয়ে পড়া বুঝিয়ে দিতে লাগল।
___________

রাত সাড়ে বারোটা। নিহিনের মোবাইলের ম্যাসেজ টোন বেজে উঠল। অন্তু ম্যাসেজ করেছে। জানালার পেছনে এসে পড়েছে সে। নিহিনের রাগ হলো। বার বার না করেছে, আজ না। আজ তার ভালো লাগছে না। কিন্তু অন্তু নাছোড়বান্দা, কিছুতেই শুনছে না। দেড় মাস পর আজ সুযোগ পেয়েছে, সে হাতছাড়া করবে না। নিহিনের বারবার মনে পড়ছে রোহিতার বলা কথাটা। শরীরের সম্পর্ক ক্ষনস্থায়ী। আসলেই কি অন্তুর সাথে তার সম্পর্ক শুধুই শরীরের? মন ছুঁতে পারে নি? কই, নিহিনের মন তো ছুঁয়ে ফেলেছে অন্তু। তাহলে? অন্তুও তো বলে সে নিহিনকে ভালোবাসে। আচ্ছা, মন ছুঁতে না পারলে কি ভালোবাসা হয়? জানালায় ঠুকঠুক আওয়াজে ভাবনার জগতে ছেঁদ পড়ে নিহিনের। সে দীর্ঘশ্বাস চেপে পা টিপে বেরিয়ে যায়। অন্তুর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই অন্তু তাকে জড়িয়ে ধরে অনেক জোরে। নিহিন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে তাকায় অন্তুর দিকে। আধো আলোয় সে অন্তুর চোখে তাকাল। বুঝতে চেষ্টা করল, ঐ চোখে কি তার জন্য ভালোবাসা? নাকি শুধুই শরীরের প্রতি লোলুপ টান। কিন্তু এই অল্প আলোয় চোখের ভাষাটা ভালোভাবে পড়তে পারছেনা নিহিন। হঠাৎ শরীরের স্পর্শকাতর জায়গাগুলোতে অন্তুর হাতের স্পর্শ পেতে লাগল সে। বুকের ভেতরটা কেমন হুহু করে উঠল হঠাৎ। কান্নারা দলা পাকাতে লাগল গলায়৷ নিহিন নিজেকে আবার ছাড়িয়ে নিল অন্তুর থেকে। অন্তু বিরক্ত গলায় বলল, সরে যাচ্ছো কেন বারবার নিহিন? এতোদিনের অভুক্ত আমি। প্লিজ শান্তি করো।

– তুমি আমাকে ভালোবাসো তো?

নিহিন বলল, অনেকটা ফিসফিস করে। নিশুতি রাত, সাথে ঝিঝি পোকার ডাক, সবকিছু মিলিয়ে কী করুণ, কী বিষাদে ভরা একটা লাইন! কতোটা কষ্ট বুকে নিয়ে কেউ এরকম একটা প্রশ্ন করতে পারে! কিন্তু এই লাইনটা একদম নাড়া দিল না অন্তুর হৃদয়কে। সে মুখ দিয়ে বিরক্তিকর শব্দ উচ্চারণ করে বলল, সময় নষ্ট করছ নিহিন। আমার ভেতর জ্বলে যাচ্ছে।

কথাটা বলে তার শক্ত দু’হাতে আবার কাছে টেনে নিলো নিহিনকে। আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে লাগল। অদ্ভুতভাবে আবিষ্কার করল নিহিন – যে ছোঁয়াকে সে এতোদিন ভালোবাসা হিসেবে জেনে এসেছে, সেই ছোঁয়াকে আজ হুট করে খুব নোংরা লাগছে। গা গোলাচ্ছে। নিহিন নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও পারছে না। তার বুকের ভেতর ঝড় বইছে। সে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে উঠল, অন্তু চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি।

থেমে গেল অন্তু। নিহিনকে ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে তাকাল। অবাক লাগছে তার। নিহিন আবার বলল, বলো না অন্তু, বিয়ে করবে আমাকে? চলো বিয়ে করে ফেলি।

– পাগল হয়েছ?

– না। আমরা তো একজন আরেকজনকে ভালোবাসি। বিয়ে করতে দোষ কোথায়? তোমারও তো বিয়ে করতে কোনো বাধা নেই।

– উফ নিহিন। পাগলের প্রলাপ করো না তো। আমার শরীর জ্বলছে। তুমি সাড়া দিচ্ছো না কেন?

– শরীর ছুঁয়ে কাছে টানা ক্ষনস্থায়ী। মন ছুঁয়ে কাছে টানা চিরদিন থাকে। তুমি আমার মন ছুঁয়েছ অন্তু। চলো বিয়ে করে ফেলি।

– তোমার মন ছুঁয়েছি বলেই আমার তোমাকে বিয়ে করতে হবে?

অন্তুর এই কথাটা যেন নিহিনের অন্তরাত্মা নাড়িয়ে দিল। সে আস্তে করে বলল, আমি তোমার মন ছুঁতে পারি নি অন্তু?

– চেষ্টা করলে কই? কতোদিন বললাম, চলো আমার ফ্ল্যাটে যাই। সবই তো করে ফেলেছি। আর সতিত্ব দিয়ে কী করবে?

– ওসব করলে মন পাব তোমার?

– শুধু ওসব করলেই তো হবে না। আমি যদি দেখি যে তুমি ওসব করে আমাকে পুরোপুরি সেটিস্ফাই করতে পেরেছ তাহলে বিয়ের কথা ভেবে দেখতে পারি।

নিহিন নিষ্পলক তাকিয়ে আছে অন্তুর দিকে। দু’বছর! এই মানুষটার সাথে দু’বছরের সম্পর্ক তার। দুই বছরেও মানুষটার মন ছুঁতে পারল না? কি-কিন্তু… এটা কীভাবে হয়। অন্তু তো পাগল ছিল ওর জন্য। নিহিন ঢোক গিলে আমতাআমতা করে বলতে লাগল, ত-তুমি সম্পর্ক শুরুর আগে প্রমিস করেছিলে আমাকে বিয়ে করবে।

অন্তু ফিচলে হেসে বলল, আরে ধুর, ওসব প্রমিস হরহামেশাই করা হয়। কে কোনটা রাখে? আসো তো, কাছে আসো।

নিহিনকে আবার কাছে টেনে নিয়ে নিজের হিংস্রতায় জেগে উঠল অন্তু। নিহিন মুর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। সে হিসেব কষছে। তারপর… হুট করে দুই বছরের সব হিসেব নিকেশ এক নিমিষেই সে মিলিয়ে ফেলল। হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠল তার ঠোঁটে। সে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল আনার। অন্তু এবার খ্যাপে গেল। দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, সমস্যা কী?

– বিয়ে করো অন্তু। বিয়ের আগে আর আমি এভাবে আসব না।

– পাগলামি করছ কেন আজ?

– আমার শরীরের প্রতিটি ইঞ্চি তুমি ছুঁয়েছ।

– হ্যাঁ। কারণ আমি ভালোবাসি।

– তাহলে বিয়ে করো। বিয়ে করতে তো বাধা নেই।

অন্তুর মেজাজ চড়ে গেল। সে এবার জোরজবরদস্তি শুরু করে দিল। নিহিন ধস্তাধস্তি করে নিজেকে দূরে সরিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল, বিয়ে করো আমাকে।

অন্তু এবার হিসহিসিয়ে বলতে লাগল, তোর মতো মা*রে বিয়ে করব আমি? হ্যাঁ? আমারে ছোটলোক মনে হয়? তোর মা একটা মা* আর তুই তার ঘর থেকে জন্মাইছস আরেক মা*।

নিহিন চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলো বারকয়েক। এজন্যই, নিজের জীবনের গোপন কথাগুলো কাউকে বিশ্বাস করে বলতে নেই। সুযোগ বুঝে সেই কথাগুলোকেই অস্ত্র বানিয়ে ফেলবে ওপর মানুষটা। চোখ খুলে আস্তে করে নিহিন বলল, যা বলার বলে ফেলেছিস। এক্ষুণি বেরিয়ে যা, আর জীবনে আমার সামনে আসবি না। জানিসই তো, আমার মান ইজ্জত নেই। তোর এতোদিনের কামাই করা ইজ্জত আমি দুই মিনিটে নষ্ট করে দিতে পারব।

অন্তু হেসে বলল, তোকে চাইলে আমি এখানে ফেলে রেপ করতে পারব। কেউ টেরই পাবে না। তোর মায় কানে শোনে না। তুই চেঁচালেও এখানকার বাইরে কেউ শুনবে না। কিন্তু তোর মতো নষ্টারে কিছু করে নিজের কলঙ্ক লাগাব না।

অন্তু চলে গেল। নিহিন সেখানেই বসে রইলো। অনেকক্ষণ। অনেক অনেক ক্ষণ। কাঁদলো ইচ্ছেমতো। অন্তুর বিষয়ে অনেকে অনেক খারাপ কথা বলেছিল। সে কানে নেয় নি। ‘যা রটে তা কিছুতো ঘটে’ – কথাটা কতোটা সত্যি আজ সে বুঝতে পারল। অনেকক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদল নিহিন। তারপর উঠে ঘরে গেল। নিলুয়া বেগমকে টেনে তুলে বিছানায় বসালো। তারপর সজোরে একটা থাপ্পড় লাগালো গালে। নিলুয়া বেগম টাল সামলাতে না পেরে অন্য পাশে গিয়ে পড়লেন।
______

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here