এ জীবন নাটকেরই মঞ্চ (শেষ পর্ব)
ফারজানা আহমেদ
_______
– তখন ক্লাস টু তে ছিলাম। একদিন স্কুল থেকে বাসায় ফিরে দরজায় ধাক্কাধাক্কি করছিলাম, মাকে ডাকছিলাম। কিন্তু দরজা কেউ খুলছিলো না। প্রায় পনেরো মিনিট দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে ক্লান্ত আমি ফ্লোরে বসে পড়ি। তারপর মনে পড়ে, দরজার মাঝে একটা ছোট ফোটা আছে। আমি সেই ফোটায় ভেতরে তাকালাম। দেখতে পেলাম বাড়িওয়ালা আঙ্কেল উলঙ্গ অবস্থায় আমার মায়ের উপরে শুয়ে কিছু একটা করছিল। মায়ের শরীরেও কাপড় ছিল না। সেই দৃশ্যটা দেখে বুঝতে পারছিলাম না ওটা আসলে কী। কিন্তু এটুকু বুঝতে পেরেছিলাম, যা হচ্ছে সেটা ভালো না। আমি চেঁচিয়ে মাকে ডাকতে লাগলাম। আমরা যেখানে থাকতাম সেই বাড়িটা ছিলো অনেকটা নিরিবিলি জায়গায়৷ যদি আশেপাশে জনমানব থাকত তাহলে আমার চিৎকারে সব এক হয়ে যেত। কিন্তু আমার মা সেই সুখময় সময়টায় আমাকে একদম ভুলে গিয়েছিলো। অনেকক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দ হলো। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল বেরিয়ে এসে আমাকে দেখে খানিক থমকে গেল। ততক্ষণে মাও এসে দাঁড়িয়েছেন। আমাকে দেখে কাষ্ঠ হেসে বলেছিলেন, ওহ তুই এসেছিস। আমি মায়ের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে ছিলাম। মা আমার দিকে তাকাতে পারছিলো না। বাড়িওয়ালা আঙ্কেল মায়ের কাছে পানি চাইলো। মা আমাকে ভেতরে ডেকে পানি আনতে গেল। আমি ভেতরে পা বাড়াতেই পেছন থেকে বাড়িওয়ালা আঙ্কেল আমাকে জড়িয়ে ধরল। তারপর আমার তলপেটের নিচে আর বুকের ওপর দু’হাতে ব্যথা দিতে লাগল। আমি চিৎকার করলাম। আমার চিৎকার শুনে মা দৌড়ে আসে, ততক্ষণে বাড়িওয়ালা আঙ্কেল আমাকে রেখে চলে যায়। মাকে কেঁদে কেঁদে বলেছিলাম, মা, বাড়িওয়ালা আঙ্কেল আমাকে ব্যথা দিয়েছে। আমার বুকে ব্যথা দিয়েছে, প্রশ্রাবের রাস্তায় ব্যথা দিয়েছে। মা কোনো কথা বলে নি। আমাকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদেছে। আমি মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাড়িওয়ালা আঙ্কেল নেংটা হয়ে কেন তার ওপরে শুয়েছিল। কেন সে নিজে নেংটা ছিল। মা কোনো উত্তর দেয় নি। আমার মুখ চেপে ধরে বারণ করেছে যাতে এসব কথা কাউকে না বলি। আমিও ছোট ছিলাম, মায়ের কথা শুনেছি। তারপর আরো দু’একবার বাড়িওয়ালা আঙ্কেল এসেছিলো আমাদের বাসায়। মায়ের ঘরে দরজা বন্ধ করে কিরকম চিৎকার করত। ভাবতাম, হয়ত মাকে মারত৷ কিন্তু এই মারটা যে কেমন মার ছিল সেটা বুঝতে পারলাম যখন বড় হলাম। মা নামক ঐ মহিলাকে ঘেন্না লাগতে লাগল আমার। ঐ মহিলার ছায়াও আমার ঘেন্না লাগে। আমার বাবা কাজের জন্য বাসায় থাকতে পারত না। সেটার সুযোগ নিয়েছে ঐ মহিলা। চরিত্রহীনা মহিলা!
কথাগুলো বলে দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল নিহিন। হুহু করে কাঁদতে লাগল। সেই কান্নায় কেমন এক বিষণ্ণ পরিবেশ তৈরি করে দিল চারিদিকে। রোহিতারও চোখ ভিজে উঠল। সে দুহাতে চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করল। তারপর নিহিনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, হয়তো কোনো মজবুরি ছিল। হয়তো… হয়তো কিছুর জন্য ব্ল্যাকমেইলের শিকার হয়েছিলেন তিনি।
নিহিন মাথা তুলল। তার চোখ দুটি ফুলে আছে। মুখ টকটকে লাল। সেই ফোলা চোখেই হেসে দিল নিহিন। কী ভয়ঙ্কর লাগল সেই হাসি! রোহিতার ভেতরটা কেমন করে উঠল। নিহিন বলল, আমি আর আমার ভাইয়া আমার মায়ের আগের ঘরের সন্তান। আমাদের জন্মদাতা আমাদের জন্ম দিয়েই কোথায় যেন চলে যায়। কিজানি, বেঁচে আছে কি না। সবাই তো বলে মরে গেছে। তারপর কী করে যেন আমার বাবার মতো ভালো মানুষের সাথে ঐ মহিলার বিয়ে হয়ে গেল। বাবার ছিল মৃগী রোগ। তারপর আবার বাবার কোনোদিন নিজের সন্তান পাওয়ার ভাগ্য ছিলো না। মানে কোনোদিন বাবা হতে পারবেন না। আমাদের একেবারে নিজের সন্তানের মতো জান দিয়ে আদর করতেন। মনেই হতো না, উনি আমাদের সৎ বাবা ছিলেন। একজন মৃগী রোগীর রোগ হুট করে ওঠে। হয়তো অন্তরঙ্গতার সময় ওঠে যেত।
কথাটা বলে হাসল নিহিন। রোহিতার বুক ধুকপুক করতে লাগল। সে কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। নিষ্পলক তাকিয়ে আছে নিহিনের দিকে। নিহিন আবার বলল, মজার একটা ব্যাপার শুনবি, রোহিতা?
কথাটা বলে রোহিতার চোখের দিকে তাকালো নিহিন। কেন যেন রোহিতার শরীরটা কেঁপে উঠল। সে কোনো উত্তর দিল না। নিহিন নিজে থেকেই বলল, মা পরপুরুষের সাথে শুতো, এটা বাবাও জানত।
চমকে উঠলো রোহিতা। সে বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। কিছুর বলার জন্য খুঁজে পাচ্ছে না। এতো কষ্ট! একটা মানুষ বেঁচে থাকা অবস্থায় এতো কষ্ট সহ্য করে গেছে। কতোটা অসহায় হলে নিজের স্ত্রীর এসব জানার পরও একটা মানুষ চুপ থাকে। নিহিন রোহিতাকে একটা ঠেলা দিয়ে বলল, এবার হয়ত ভাবছিস বাবা জেনেও কেন কিছু বলল না। এটাও বলছি। বাবার ওপর অনেক পয়সার লোন ছিল। সেই টাকাগুলো ঐ মহিলার ভাই দিচ্ছে। একসাথে না, আস্তে আস্তে দিচ্ছে, অনেক বছর ধরে। যাতে টাকা পেয়েই বাবা সরে না যায়। কারণ আমাদের একটাই বাড়ি, সেই বাড়িতে বাবার মা বাবা আছে। লোন না দিতে পারলে বাড়ি দখল হয়ে যাবে। ওদের আর কোথাও যাওয়ার জায়গা থাকবে না। বাবা যে চাকরি করে, সেই চাকরিটাও ঐ মহিলার ভাইয়ের কথায় হয়েছে। বাবা কিছু বললে সে নিঃস্ব হয়ে যেত। হাজতে যেতে হতো। তার বুড়ো বাপ মা পথে বসে যেত।
কী বিষাদময় হাসি হেসে কথাগুলো বলছিল নিহিন! রোহিতার ভেতরটা কেমন দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল। বাইরে থেকে পরিবারটা দেখলে যে কেউ বলবে, কী সুন্দর পরিবার! কী সুখী সবাই। কিন্তু এই ভেতরের খবর তো কেউ জানবে না। প্রতিনিয়ত ভালো থাকার নাটক করে গেছে এই মানুষগুলো। আহা! পৃথিবীতে কতো কতো নাটক চলে! জীবনটা সত্যিই নাটকের মঞ্চ। রোহিতা উঠে যেতে চাইল। নিহিন হাত ধরে আটকে বলল, আরোও একটা কথা শুনে যা। আর তো কোনোদিন দেখা হবে না তোর সাথে। বলেছি যখন, সব বলে দেই। বাবা মারা যাওয়ার পর আমরা আমাদের বাড়িতে ছিলাম না। ছিলাম মায়ের বাবার বাড়ি। সেখানে সদ্য বিধবা হওয়া এই মহিলাটা তার চাচাতো ভাইয়ের সাথেও বিছানায় মজ মাস্তি করে এসেছে। মাঝেমাঝে মনে হয়, আমার মা পতিতা।
কথাটা বলেই হাত ছেড়ে দিলো নিহিন রোহিতার। রোহিতা আর কোনো কথা না বলে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে কাঁদতে লাগল। অনেক, অনেকক্ষণ কাঁদল। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে যাচ্ছে একেবারে। কতো রকমের মানুষ আছে দুনিয়ায়! কতোভাবে জীবনযাপন করছে তারা। রোহিতার কষ্ট ক্ষনে ক্ষনে বাড়তে থাকল। সে কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়ল।
রোহিতার যখন ঘুম ভাঙে, তখন সন্ধ্যা পেরিয়েছে। বাইরে অনেক হইচই শোনা যাচ্ছে। সোহেল ভাইয়ের গলা শোনা যাচ্ছে। রোহিতা দরজা খুলে বাইরে বেরোলো। বারান্দায় যেতে লাগলেই কোত্থেকে সোহেল ভাই এসে তার পথ আগলে দাঁড়ালেন। চারিদিকে অনেক মানুষের কথা শোনা যাচ্ছে। রোহিতা বলল, কী হয়েছে সোহেল ভাই?
সোহেল কিছু বলল না। রিনা বেগম এসে দাঁড়ালেন রোহিতার সামনে। কারো মুখে কোনো রা নেই। রোহিতা চারিদিকে তাকাতেই হঠাৎ চোখে পড়ল, দুজন মহিলা পুলিশ নিহিনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। রোহিতার চোখ বড় হয়ে গেল। সে রিনা বেগমকে জিজ্ঞেস করল, মা কী হয়েছে? নিহিনকে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে কেন?
রিনা বেগম আঁচলে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে ভেতরে চলে গেলেন। রোহিতা সোহেলের দিকে তাকালো ভয়ার্ত চোখে। সোহেল রোহিতাকে টেনে নিয়ে গেল ভেতরে। তারপর ঘরের দরজা বন্ধ করে দিল। রোহিতা বারবার জিজ্ঞেস করছিল কী হয়েছে। সোহেল জানালো, মাগরিবের আজানের সময় উঠোনে বেরিয়েছিলেন নিলুয়া বেগম। সোহেল তখন এসে ঢুকেছিল ঘরে। রিনা বেগমও বাইরে ছিলেন। সবার সামনে উদ্ভ্রান্তের মতো দা দিয়ে কুপিয়েছে নিহিন তার মাকে। নিলুয়া বেগম মারা গেছেন। কাহিনী শুনে রোহিতা স্তব্ধ হয়ে গেল। শরীর হিম হয়ে আসলো। মেরুদণ্ড হয়ে পড়ল টানটান। মেরে ফেলেছে! খুন করে ফেলেছে! নিজের মাকে খুন করেছে নিহিন! নিজের জন্মদাত্রী মাকে! মা তো মা-ই হয়। মাকে কেউ কীভাবে মারতে পারে! রোহিতা কিছু ভাবতে পারছে না। তার বুক ফেটে কান্না বের হচ্ছে। সে দৌড়ে গিয়ে নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল। রিনা বেগমও কাঁদতে লাগলেন। মা হচ্ছে আল্লাহর তরফ থেকে দেয়া শ্রেষ্ঠ উপহার যার পায়ের নিচে প্রতিটি সন্তানের বেহেশত। বেহেশতকে কেউ কীভাবে মারতে পারে। রোহিতার কান্নারা বাঁধ মানছে না। দূরে দাঁড়িয়ে সোহেল দেখছিল আর তার চোখেও পানি আসছিল। কাঁদতে কাঁদতে হুট করে রোহিতার মনে পড়ল, এজন্যই কি নিহিন বলেছিল যে তার সাথে রোহিতার আর কোনোদিন দেখা হবে না?
রোহিতার কান্না কমে আসল। সে ভাবতে লাগল, দুনিয়ার মানুষ দেখছে একটা মেয়ে তার মাকে মেরে ফেলেছে। নিন্দা জানাচ্ছে সবাই। কিন্তু বাইরের নাটকটা কেউ ধরতে পারে না। সত্যিই! এই জীবন নাটকেরই মঞ্চ। তারপর হঠাৎ মাথায় এলো, আচ্ছা – নিলুয়া বেগম কি কিছুর জন্য মজবুর ছিলেন?
________
(সমাপ্ত)