#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-১৬
হাল্কা শব্দে কাঁচটা সরিয়ে দিতেই দমকা বাতাসে ভেসে বেড়ানো বৃষ্টির শীতল পানি ছুঁয়ে গেলো রাত্রির শুকনো চোখমুখ।প্রতিটি ধুলোকণায় প্রেমের বার্তা নিয়ে ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো মিষ্টি হিমেল হাওয়া।শিরশির করে উঠলো শরীরের লোপকূপগুলো।ঘরে এসি চলছে তার উপর এমন ঠান্ডা পরিবেশ।দাঁত কেঁপে উঠলো রাত্রির।এত ঠান্ডায় থাকা যায় নাকি?
দৈবাৎ উড়তে থাকা পর্দাগুলো একপাশে চাপিয়ে দিয়ে পিছনে ফিরতেই বিষম খেলো সে।নিভ্রান শোয়া থেকে উঠে সটান বসে আছে।বশীভূত দৃষ্টি ঘুরছে তারই সর্বাঙ্গে।রাত্রি বিব্রতবোধ করলো।লজ্জিত ভঙ্গিতে গায়ের ওড়না টেনে টুনে ঠি ক করতে করতে বললো,”উঠলেন যে?”
উওর আসলোনা।জড়োসড়ো হয়ে কাছাকাছি এসে দাড়ালো রাত্রি।নিভ্রান একবার পলক ফেললো।রাত্রির হাত টেনে তাকে মুখ বরাবর বসিয়ে দিলো।মাথা নুইয়ে ফেললো রাত্রি।লোকটা বোধহয় হুঁশে নেই।সামনে বসায় মদের গন্ধটা বেশ ভালো করেই পাওয়া যাচ্ছে।
নিভ্রান আলতো করে হাত রাখলো তার গালে।মুখ ক্রমশ এগিয়ে খুব নিকটে এসে বললো,
—“ওড়না ঠি ক করছেন কেনো?লজ্জা লাগছে?।রাত্রি অস্পষ্ট আওয়াজ করলো।নিভ্রান তার উওরের অপেক্ষা করলোনা।ধীরগলায় বললো,
—“মেয়েরা কখন লজ্জা পায় জানেন?সব চাহনী কিন্তু তাদের লজ্জা দিতে পারেনা।যখন মেয়েটা বুঝে যে
অপরপাশের মানুষটা তার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে,ওই চোখে অন্য ভাষা আছে।তখনই তাদের দৃষ্টি নেমে যায়,মাথা ঝুকে চায়,ঠোঁট কেঁপে উঠে।ঠি ক আপনার মতোন।তারমানে আপনি বুঝতে পারছেন যে আমি আপনার দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাচ্ছি।তাইনা?”
রাত্রির সারা শরীরে কেও যেনো দাউদাউ করে আগুন ধরিয়ে দিলো।কিসব অলুক্ষুণে কথাবার্তা!কি অদ্ভুত শিহরণ।হৃদপিন্ডের কম্পন কমছেনা কিছুতেই।নিভ্রান দুরত্ব বিনাশ করলো।সর্বোত্তম নিকটে এসে রাত্রির ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুল বুলালো।ক্ষণিকেই চমকে উঠলো রাত্রি।লোকটা কি এখনই ভয়ানক কিছু করে ফেলবে?চোখ তুলে তাকালো সে।লোকটার দৃষ্টি তার পাতলা ঠোঁটজুড়ে।
নিভ্রানের ঠোঁটের এককোঁণ প্রসারিত হলো খানিকটা।রাত্রি হাত মুঠো করে ফেললো।ভীত কন্ঠে বলে উঠলো,”নাহ্”।কিছুক্ষণ কেটে গেলো সেভাবেই।মুখের উপর আছরে পড়া নিশ্বাসের তীব্রতা কমে আসতেই ধীরগতিতে বুজে ফেলা চোখ মেললো সে।নিভ্রান তখন স্বাভাবিক দুরত্বে আছে।তবে হাতটা লেপ্টে আছে গালের উপরই।রাত্রি ফাঁকা ঢোক গিললো।নিভ্রান তার কপালের উপর অবিন্যস্তভাবে উড়তে থাকা চুল কানের পিছে গুঁজে দিতে দিতে ভারি গলায় বললো,
—“আমি মাতাল নই রাত।ভয় পাবেননা।”
রাত্রি একটু সহজ হলো।নিভ্রানের চোখের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বললো,
—“ভয় পাচ্ছিনা।…কিন্তু আপনি এসব খেয়েছেন কেনো?আপনাকে তো কখনো সিগারেটটাও ছুঁতে দেখিনি।”
নিভ্রান স্নান হাসলো।গাল থেকে হাত সরিয়ে বললো,
—“আপনি তো কতো কিছুই দেখেননি।এইযে আমি মৃতপ্রায় হয়ে কাতরাচ্ছিলাম শুধু একটাবার আপনার দেখা পাওয়ার জন্য।আর আপনি পরশুদিন কি করলেন?গমগমে গলায় বললেন,”চলে যান।”জানেন আমার কেমন লেগেছিলো?আচ্ছা বলেনতো,এই নরম পাথরটাকে আমি কেন ভালোবাসতে গেলাম?”
রাত্রি দৃষ্টি লুকানোর চেষ্টা করে বললো,
—“আপনি ঘুমাবেননা?”
—“আপনি সত্যি চলে যাবেননাতো?”নিভ্রানের সন্দেহজনক প্রশ্ন।
রাত্রি দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো।এতক্ষণ ধরে সে ঘরে ঢুকেছে।বাইরের সবাই না জানি কি ভাবছে?।এ বিষয়ে কিছু বলতেও পারছেনা।নিভ্রান রেগে যেতে পারে।অতএব,কিছু না বলাই শ্রেয়।নিভ্রান ঘুমালে অন্তত বের তো হওয়া যাবে ঘর থেকে।
নিভ্রানকে জোরপূর্বক শুইয়ে দিলো সে।মাথার কাছে বসে চুলে আস্তে আস্তে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো,
—“কোথাও যাবোনা।আপনি চোখ বন্ধ করুন।”
নিভ্রান চোখ বন্ধ করলো।সময় কেটে গেলো অনেকক্ষণ।
ভোর তখন চারটা।নিভ্রান ঘুমিয়েছে একটু আগে।রাত্রির একহাত তার আঙ্গুলের ভাঁজে ভাঁজে নিবদ্ধ।অন্যহাত তখনো অবিশ্রাম বিলি কেটে যাচ্ছে চুলের মাঝে।
নিভ্রানের ঘুম আরো একটু গভীর হতেই খুব সাবধানে হাতটা ছাড়িয়ে নেয় রাত্রি।মাথা থেকে হাত সরিয়ে নিশব্দে উঠে দাড়ায়।ব্যালকনির দরজা লাগিয়ে পর্দা টেনে দেয়।ঘর অন্ধকারে ছেঁয়ে যায়।ফাস্ট এইড বক্সটা এখনো বিছানায় ই আছে।রক্তমাখা তুলো গুলো পড়ে আছে টেবিলে।কোনরকমে পা ফেলে ড্রয়ার খুলে বক্সটা জায়গামত ঢুকিয়ে রাখে সে।তুলোগুলো হাতরিয়ে হাতরিয়ে একপাশে জড়ো করে রাখে।একটা দীর্ঘ হতাশ শ্বাস বেরিয়ে আসে।কম চেষ্টাতো করলোনা লোকটার পাগলামি কমানোর জন্য।আর কি ই বা করার আছে তার?
ড্রইংরুমে তখন নিশাদ আর নাহিদা।নওশাদ সাহেব ঘরে চলে গেছেন।নাহিদার চোখে ঘুম নেই।নিশাদ একটু আধটু ঢুলছে।রাত্রি বেরিয়ে এলো।সাথে সাথেই দু’জোড়া চোখ উজ্জল দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো তার দিকে।
অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো রাত্রি।গলা নামিয়ে কোনরকমে বললো,
—“উনি ঘুমিয়েছেন।”
নিশাদের চোখেমুখে স্বস্তি খেলে গেলো।নিজে নিজেই বিরবির করলো সে,
—“যাক অবশেষে!বাঘিনীর থাবায় বাঘ শান্ত হয়েছে।”
রাত্রি বুঝতে পারলোনা সে কি করবে।এখানে বসবে নাকি চলে যাবে?নাহিদার সাথে এখানে বসতেও ইচ্ছা করছেনা।আবার নিভ্রানকে বলেছে সে কোথাও যাবেনা।তার ভাবনার মাঝেই নাহিদা গলা ঝাড়লেন।নিচু গলায় বললেন,
—“তুমি এখানেই থাকো।ঘুম ভেঙে তোমাকে না দেখলে আবার রেগে যাবে।”
নাহিদার কাছ থেকে এমন কথা মোটেও আশা করেনি রাত্রি।এই উদ্ভট মহিলার এহেন মিষ্টভাষা তার হজম হচ্ছেনা।বসবে নাকি না দোটানার মাঝেই নিশাদ লম্বা হাই তুলে সোফায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বললো,
—“আমি এখন আপনাকে দিয়ে আসতে পারবোনা আপু।ঘুম পাচ্ছে।আপনি বসুনতো।”
অগত্যা বসতেই হলো তাকে।নাহিদা যেখানে বসেছে সেই সোফার এককোণেই চেপে বসলো সে।কিছুক্ষণ কেটে গেলো নিরবতায়।
খানিকবাদে নাহিদা মিনমিন করে বললো,
—“ও সারাদিন কিছু খায়নি।কোথথেকে যেনো ওই ছাইপাঁশ খেয়ে এসেছে।রাতে ফিরেও খায়নি।সকালে উঠলে যদি না খেতে চায় তবে তুমি একটু খাইয়ে দিয়ে যেও।তোমার কথা ফেলবে না।”
রাত্রি থতমত খেয়ে মাথা নাড়লো শুধু।নাহিদার সাথে কথা বলার রুচি হচ্ছেনা আবার মহিলার অসহায়,মলিন চেহারা দেখে মায়াও হচ্ছে।মাথার ব্যান্ডেজ রহস্যটা জানতে ইচ্ছা করছে খুব।এটাও কি নিভ্রানের দ্বারা হয়েছে?হয়তোবা হ্যাঁ।।লোকটা আর কি কি অঘটন ঘটিয়েছে কে জানে।নিশাদ মিটিমিটি হাসছে।রাত্রির দৃষ্টি এড়ালোনা।নিভ্রান যতো শান্ত এই ছেলে ততোই চন্চল।
_____________
সকাল সকালই ঘুম ভাঙলো নিভ্রানের।চোখের পাতায় কেউ যেন দশ টনের পাথর রেখে দিয়েছে।মাথায় ঝিমঝিম অনুভূতি।দু’হাতে কপাল চেপে টলতে টলতে উঠে বসলো সে।আশেপাশে রাত নেই।মেয়েটা ঠি কই চলে গিয়েছে।হাহ্!রাত শুনবে তার আবদার।চরম অবাধ্য মেয়ে!
পায়ে হাল্কা ব্যাথা হচ্ছে।তবু বিছানা থেকে নেমে সটান দাড়িয়ে গেলো নিভ্রান।টেনে দেয়া পর্দা দেখে একটু গলে গেলেও পাহাড়সমান অভিমানের ভিড়ে সেই খুশিটা নিমিষেই যেনো পিষ্ট হয়ে গেলো।
এলোমেলোভাবে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকলো সে।মুখের উটকো গন্ধটা এখন নিজেরই সহ্য হচ্ছেনা।এই দুর্গন্ধ নিয়ে সে রাতের এতো কাছে ছিলো ভাবতেই লজ্জা লাগছে।মেয়েটা না জানি কিসব ভেবে বসে আছে নে!সবসময়ই তো একধাপ বেশি বুঝে!
ফ্রেশ হয়ে চোখ মুখ না মুছেই পায়ে স্যান্ডেল দিয়ে ঘরের দরজা খুললো নিভ্রান।মেয়েটা কে কি ঠি ক ঠাক পৌছে দিয়েছে নাকি খোঁজ নিতে হবেতো।ফ্লোরে কাঁচের টুকরাদের পসরা বসেছে যেনো।সব ছড়িয়ে আছে।
শান্ত দৃষ্টিতে ড্রইংরুমে চোখ বুলাতেই সবিস্ময়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার।এ কি দেখছে!রাত্রি তার মায়ের কোলের উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।হতবিহ্বল গোছেই সামনে এগোলো সে।
নাহিদা ঘুমাচ্ছে সোফায় পিছের দিকে মাথা দিয়ে।আর রাত্রি তার কোলের উপর মাথা রেখে সোফায় পা ভাঁজ করে কাত হয়ে শুয়ে আছে।নাহিদার একহাত রাখা রাত্রির কপালের উপর।অজান্তেই ঠোঁটে একটা গাঢ় হাসি চলে এলো নিভ্রানের।
আরো কিছুক্ষণ একাধারে রাত্রি আর নাহিদাকে পর্যবেক্ষণ করলো সে।বিস্মিত ভাবটা একটু কেটে যেতেই
ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো পাশের সোফায় উল্টো হয়ে গভীর ঘুম দিয়েছে নিশাদ।
নিভ্রান নিশব্দে নিশাদের সামনে যেয়ে দাড়ালো।মাথায় আলতো করে চাঁটি মারতেই হুরমুর করে উঠে গেলো নিশাদ।নিভ্রানকে সটান দাড়িয়ে থাকতে দেখে মূহুর্তেই একটু ভড়কে গেলো।বেগতিক কন্ঠে বললো,
—“কি সমস্যা?আমার মাথাও ফাটিয়ে দিবি নাকি?”
নিভ্রান ধ্যান দিলোনা তার বেসামাল কথাবার্তায়।তার ভাই এমনই।একটু থেমে রাত্রির দিকে ইশারা করলো সে।বললো,
—“এসব কি?ও এখানে ঘুমিয়েছে কেনো?”
নিশাদ ঘাড় উচিয়ে দেখলো।দৃশ্যটা দেখে নিতেই দুই ভ্রু উঁচু করে বিস্ময় প্রকাশ করলো।তারপর আবারো ঘুমের ভাব করে বললো,
—“আমি জানিনা কিছু।এসব আমার ঘুমানোর পরে হয়েছে হয়তো।তোর তো খুশি হওয়া উচিত।এখন যা পাগলামি না করে বিয়ে করে ফেল।তারপর শান্তিতে থাকতে দে।”বলে একটু থামলো সে।তারপর দ্বিগুন ভাব ধরে বললো,
“তুই তো সাতদিনেও পারলি না আর আমি একরাতেই কিভাবে নিয়ে আসলাম দেখলি?”
নিভ্রান মনে মনে হাসলো।রাত্রির ঘুমন্ত চেহারার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে স্বগোতোক্তি করলো,
—“সবার সাথেই নরম।শুধু আমার বেলাতেই রাজ্যের যত সমস্যা এসে জুড়ে যায়।”
~চলবে~