এ শহরে বৃষ্টি নামুক❤️পর্ব২৭

0
1234

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৭

বৃষ্টি নেমে গেছে সময়মতো। প্রকৃতি ভিজছে। ভিজতে ভিজতে কাঁপুনি ধরে যাচ্ছে গাছের ডালে ডালে।অনিলের আক্রমনে তিরতির করে কাঁপছে চকচকে সবুজ পাতা। মেঘবালিকার অবশ্য কোনোদিকে খেয়াল নেই। সে তখন ঘুমে বিভোর। চলন্ত গাড়ির বেগে মাথাটা বারবার কাত হয়ে জানালায় ঠেকে যাচ্ছে। নিভ্রান একহাতে ড্রাইভ করছে। তার আরেকহাত ব্যস্ত স্ত্রীর পড়ে যাওয়া মাথা সোজা করে দিতে। জানালা খোলা। মেয়েটার মাথাটা সোজা থাকছেইনা। বারবার ঠুকে যাচ্ছে জানালায়। অবশ্য এতে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছেনা বলেই স্বস্তি। ঘুম ভাঙার কথাও না। নিভ্রান নিজহাতে রাতের খাবারের পর কয়েকটা ওষুধের ফাঁকে একটা আস্ত ঘুমের ট্যাবলেটও খাইয়ে দিয়েছিলো। এই ঘুম ভাঙতে ভাঙতে সকাল।

জানালার কাঁচ নামানো। তালমাতাল হাওয়া। পিছের সিটে বসে আছে নিশাদ। মুখের উপর জ্বলছে ফোনের আলো। রুবিনা, নাহিদা, নওশাদ সাহেব অন্য গাড়িতে আসছেন। এক গাড়িতে তো এত মানুষের জায়গা হবেনা। নিভ্রান অবশ্য রুবিনাকে এ গাড়িতেই আনতে চেয়েছিলো কিন্তু নওশাদ সাহেবের নাকি নিভ্রানের উপর একরত্তি বিশ্বাস নেই। সে নাকি রাত্রির খেয়াল রাখতে পারবেনা। মেয়েটার শরীর অসুস্থ। সে রাগের বশে কখন কি করে ঠি ক নেই। তাই নিশাদকে পাঠিয়েছে সাথে। উল্টোপাল্টা কিছু হলেও যেনো নিশাদ সামলাতে পারে। আর রুবিনার খেয়াল রাখার জন্য ওখানে নাহিদা আছে।
রাত্রির মাথাটা এবার বেশ জোরেসোরেই বারি খেলো। নিভ্রান টার্ন নিচ্ছিলো বিধায় খেয়াল করতে পারেনি।
নিশাদ গর্জে উঠলো,”বাবা তো ঠি ক ই বলেছে। ভাবির মাথা তো আজ ঠুকতে ঠুকতেই ফেটে যাবে। তুই তো বিয়ে করেই বউয়ের মাথা ফাটিয়ে রীতিমত হসপিটালে ভর্তি করবি। বুক নাই তোর? হ্যাঁ? বুক নাই? বুক ছাড়া মানুষ তুই?”

নিভ্রান ভ্রু কুঁচকালো। ঘাড় ফিরিয়ে নিশাদকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিলো। নিশাদ তখনো কটমটে চোখে চেয়ে রয়েছে। রাত্রির দিকে তাকাতেই দেখলো মেয়েটা নেতিয়ে আছে। গাড়ির স্পিড স্লো করলো সে। হাত বাড়িয়ে আলতো করে মাথাটা টেনে নিলো বুকে। গায়ের ওড়না গুছিয়ে দিলো। ঘুমে অচেতন রাত্রিও কিভাবে যেনো টের পেলো প্রিয় মানুষটার উষ্ণতা। তন্দ্রাঘোরেও সে কেমন করে যেনো গুটিয়ে গেলো বুকের মাঝে।
নিশাদ চোখ নামালো। মিটিমিটি হেসে বললো,
—“তুই তো বেশ নির্লজ্জ হয়ে গেছিস ভাই। এবার আমাকেও নির্লজ্জ হওয়ার সুযোগ করে দে।”

নিভ্রান হাসলো। বাবার সাথে মাত্রাতিরিক্ত রেশারেশি হলেও ভাইয়ের সাথে তার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। একেবারে অচেনা, ছেলেমানুষী রুপটা কেবল নিশাদের সামনেই প্রকাশ পায়।
রাত্রির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে সে ঠাট্টার সুরে বললো,
—“দিবো এক থাপ্পড়। সারাদিন তো বাবার আদেশে উঠানামা করতে করতেই তোর কোমড় বেঁকে যায়। বিয়ে করে বউকে কোলে নেয়ার আগে দেখবি বাবা তোকে কোলে নিয়ে বসে আছে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলছে,”ওরে, আমার একমাত্র সোনার টুকরো ছেলেটা। বাবার কোল ছেড়ে কোথাও যেওনা।”

নিশাদ হাসলো। তবে এই হাসিতে কেমন যেনো একটা মন খারাপের আভাস, তিক্ততার ছোঁয়া। নিভ্রান না বললেও সে বুঝে যে নিভ্রানের একটা চাপা অভিমান আছে বাবার উপর। সে ভাবে বাবা হয়তো তাকে বেশি অগ্রাধিকার দেয়। সেবার ঝগড়াঝাটির রেশ ধরে বাবা যখন ব্যবসার সব দায়িত্ব নিশাদকে দিয়ে দিলো তখন থেকেই কেমন যেনো নিজেকে গুটিয়ে একা করে ফেললো সে। আলাদা ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করলো। তারপর থেকে শুধু দুরত্ব আর দুরত্ব।

—“আমি বাবার একমাত্র ছেলে না ভাই। তুই কেনো বুঝিস না বাবা তোকেও সমান ভালোবাসে।”

—“তুই নিজেও জানিস তুই মিথ্যা বলছিস নিশাদ।”

নিভ্রানের কন্ঠটা এতোটাই গম্ভীর,ব্যাথাময় ছিলো যে বয়ে যাওয়া বাতাস গুলাও বুঝি থমকে গেলো। পরিবেশটাও কেমন আড়ষ্ট হয়ে উঠলো। নিভ্রান সহজেই ধরে ফেললো ব্যাপারটা। চন্চল নিশাদও তখন একদম চুপচাপ।
ড্রাইভ করতে করতেই নিভ্রান বুঝলো যতবার ভেজা দমকা হাওয়া শরীর ছুচ্ছে ঠি ক ততবারই রাত্রি থরথর করে কেঁপে উঠছে। তার সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। নিভ্রান নিজের পাশের কাঁচটা সুইচ টিপে উঠিয়ে দিলো। নরম গলায় ডাকলো,

—“নিশাদ।”

—“হুম?”

—“ওপাশের কাঁচটা একটু তুলে দে তো ভাই। ওর শীত করছে বোধহয়। কিভাবে কাঁপছে দেখ।”

নিশাদ হেসে ফেললো আবারো। সামনে ঝুঁকে জানালা লাগিয়ে দিলো,
—“তুই কাউকে এতটা ভালোবাসতে পারবি,আমি কখনো ভাবিনি ভাই।”

নিভ্রান একনজর রাত্রির ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে আবিষ্ট কন্ঠে উওর দিলো,”আমিও ভাবিনি।”
________________

ভোরের আলো যখন প্রায় ফুরিয়ে গেছে। আকাশ থেকে ঝিঁমানো মেঘ ছুটি নিয়ে তেজি সূর্যের আবির্ভাব ঘটছে। তখনই অবিরাম চলতে থাকা গাড়ির ঘূর্ণায়মান চাকাটা রেহাই পেলো। গাড়ি থামলো নিভ্রানের বাসার গেটে। সিটবেল্ট খুলতে খুলতেই নওশাদ সাহেবদের গাড়ি পেছনে এসে দাড়ালো। এতো তড়িঘড়ি করে ঢাকায় ফেরার কারণ হলো রুবিনাকে হসপিটাল থেকে রিলিজ দিয়ে দিয়েছিলো সন্ধ্যার পরই। শুধু মাথার ক্ষতটায় ড্রেসিং করতে হবে রোজ আর কিছু ওষুধপত্র। ওখানে নিভ্রানের চেনা পরিচিত কেউ থাকেনা। আর রাত্রির মামার বাসায় থাকার তো প্রশ্নই উঠেনা। তাই হোটেল টোটেলের ঝামেলা না করে আজই ফিরে আসলো। নিভ্রান বলে দিয়েছে রুবিনা তার ফ্ল্যাটেই থাকবে রাত্রির সাথে। রাত্রি অবশ্য আপত্তি করেছিলো কিন্তু নিভ্রান তাকে এক ধমকে থামিয়ে দিয়েছে তখন। বলেছে,”তার সাথেও এখন রুবিনার একটা সম্পর্ক আছে। রাত্রি যেনো নাক না গলায়।”

নিশাদ গাড়ি থেকে বেরোতেই নওশাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,” মেয়েটা ঠি ক আছেতো?” নিশাদ উওর দেবার আগেই নিভ্রান দরজা খুললো। নওশাদ সাহেব এগিয়ে গেলেন। রাত্রিকে নিভ্রানের বুকের মাঝে দেখে কিছুটা অপ্রস্তুত হলেন। চাপা লজ্জা পেলো নিভ্রানও। তবে রাত্রিকে ছাড়লোনা। একপলক চোখাচোখি হলো। নিভ্রান দৃষ্টি নামিয়ে গাঢ় কন্ঠে বললো,”নামতে তো দিবেন?”

নওশাদ সাহেব সরলেন না। বরং রাত্রির কপালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে আৎকে উঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন,
—“গা টা গরম হয়ে আছে দেখছি। খালি তো পারো পাগলামি করতে। কে অসুস্থ কে সুস্থ সেটা দেখার তো সময় নেই। বলেছিলাম ঘুমের ওষুধ পুরোটা দিও না। ভেঙে দাও। একটা আস্ত পাওয়ারফুল ট্যাবলেট এইটুকুন মেয়েটার সহ্য হবে?”

নিভ্রান চোখ বুজলো। রাগ সংবরণ করলো। এই মানুষটা আর পারেই বা কি? ওর ভুল ধরতে পারা ছাড়া?
সে নিজের ইচ্ছায় রাতকে ওষুধ দিয়েছে? ডাক্তার ই তো বলেছে পুরোটা খাওয়াতে। রাত্রি যত স্ট্রেস ছাড়া আরামে ঘুমাবে ততই ভালো। তবে মুখে এসব কিছুই বলা হলোনা। শুধু বললো,
—“সরুন। নামতে দিন।”

নওশাদ সাহেব চেঁতে উঠলেন,পারো কি শুধু একরোখাপনা ছাড়া? সারাটাদিন পুরো ওলোট পালট করে বিয়ে করলে। মেয়েটার উপর দিয়ে এতো ধকল গেলো সেটার কোনো তোয়াক্কাই নেই। তোমার বাবা আমি। আর যেখানে যাই করো না কেনো। অন্যর মেয়েকে নিয়ে এমন উড়োস্বভাব আমি সহ্য করবোনা বলে দিলাম।

—“আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন ও এখন আমার স্ত্রী। আমার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। অন্যর মেয়ে অন্যর মেয়ে বলাটা কি আদৌ সমীচিন?

—“বিয়ে করেছো বলে কি যা ইচ্ছে তাই করবে? মেয়েটা আমার মেয়ের মতো। ওর সাথে তো তোমাকে এভাবে অত্যাচার করতে দিবোনা আমি।”

নিভ্রান চিল্লিয়ে উঠলো এবার,
—“আপনার কোনদিন দিয়ে মনে হচ্ছে আমি ওর সাথে অত্যাচার করছি?”

নিশাদ এগিয়ে এলো। বাবার হাত টেনে সরিয়ে বললো,”বাবা, এখানে চিৎকার চেঁচামেচি করোনা। উপরে যাও। আমরা আসছি।”নওশাদ সাহেব গেলেননা। নাহিদা রুবিনাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেছে ততক্ষনে।

রাত্রিকে বুক থেকে সরিয়ে বেরিয়ে এলো নিভ্রান। ওপরপাশে যেয়ে দরজা খুলে বাবার সামনেই পাঁজাকোলা করে কোলে তুলে নিলো তাকে। গেট পেরিয়ে ঢুকতে ঢুকতে গলা বাড়িয়ে বললো,” গাড়ি টা পার্ক করে দিস নিশাদ।”

___________
নিজের ঘরেই রাত্রিকে শুইয়ে দিয়েছে নিভ্রান। ঘরে এসি চলছে। মেয়েটা রীতিমত ব্ল্যাঙ্কেটের ভিতর মাথা ঢুকিয়ে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই রুবিনাকে জিজ্ঞেস করে জেনেছে,”রাত্রি নাকি ছোট থেকেই ঠান্ডা একদম সহ্য করতে পারেনা। অল্পতেই দাঁত কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। মেয়েটা খুব উষ্ণপ্রিয়।”
নিভ্রান আনমনেই হাসলো। সে ছোট থেকে এসিতে অভ্যস্ত। বাসা থেকে বের হওয়ার পর সামান্য লিফ্ট দিয়ে নিচে নেমে গাড়ি পর্যন্ত পৌঁছাতেই ঘেমে একাকার হয়ে যায় শরীর। তারপর গাড়িতে এসি। অফিসেও সারাদিন এসির মধ্যে। আর মেয়েটা কিনা ঠান্ডা সহ্য করতে পারেনা? হাহ্!
বাইরে প্রায় সকাল হয়ে গেছে। রুবিনার শোয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে এসেছে সে। বাকি সবাইও হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে এতক্ষণে। কম খাটুনি তো হয়নি। একদিনে যেয়ে আবার একদিনে ফিরে আসা। যে সে ব্যাপার নয়।
ঘরের বাতি নিভিয়ে রাত্রির পাশেই শুয়ে পড়লো নিভ্রান। কনকনে ঠান্ডায় জমে আসা বিছানায় একটুখানি তপ্ত সংস্পর্শ পেয়ে সুড়সুড় করে নিভ্রানের অনেকটা কাছে চলে গেলো রাত্রি। নিভ্রান হঠাৎই হাসলো। এসির রিমোটের বাটন চেপে তাপমাত্রা কমিয়ে দিলো আরো কয়েক ডিগ্রি।

~চলবে~

[বানান ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রিচেক হয়নি।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here