এ শহরে বৃষ্টি নামুক❤️পর্ব২৮

0
1185

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-২৮

পর্দার ফাঁক দিয়ে দিনের আলো চিকচিক করছে সাদা মেঝেতে। ঘর আলোকিত। রাত্রি চোখ মেললো। মনে হচ্ছে চোখদুটো কেউ চোখা পেন্সিল দিয়ে গুঁতিয়ে ভোঁতা বানিয়ে দিয়েছে। কি অসহ্য ভার মাথা! শরীরে একফোঁটা শক্তি পাচ্ছে না। দূর্বল লাগছে। দু’হাতে মোটা ব্ল্যাঙ্কেট সরিয়ে ভেতর থেকে মাথা বের করলো সে। এটা নিভ্রানের রুম! রুমে অবশ্য নিভ্রান নেই। রাত্রি মাথা চেপে ধরলো। কালরাতে হাসপাতালের ক্যান্টিনে খাওয়াদাওয়ার পর মায়ের কাছে গেলো তারপর একসময় খুব ঘুম ঘুম পেলো… সে কি ঘুমিয়ে গেছিলো? অবশ্য রাতে তাদের রওনা দেয়ার কথাই ছিলো কিন্তু সেখান থেকে এখান অবধি চলে এলো.. টের পেলোনা? অদ্ভুত! এত গাঢ় ঘুম তো তার কোনোকালেই হয়না।
একটু একটু করে উঠে বসলো সে। অগোছালো চুল খোঁপা করতে করতেই হাল্কা করে দরজা ফাঁক করার শব্দ হলো। চকিতে মুখ তুলে তাকাতেই নিশাদ কে দেখা গেলো। একপলক চোখাচোখি হতেই মুখে খুশির ঝলক
খেলে গেলো নিশাদের। উচ্ছাসে ফেটে পড়লো সে,
—“ও আল্লাহ,অবশেষে ঘুম ভেঙেছে আপনার। ওদিকে তো বাবা ভাইয়ার মধ্য বিস্তর কথাযুদ্ধ লেগে যাচ্ছিলো।”
রাত্রি থতমত খেয়ে চেয়ে রইলো। অস্ফুট স্বরে বললো,
—“জি?”

তার বোকা বোকা হতভম্ব চাহনীতে নিশাদ হেসে ফেললো। নিভ্রান নাস্তার টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছে। নিশাদ সরে দাড়ালো। নিভ্রান দরজা হা করে খুলে ভেতরে ঢুকলো। উদ্দেশ্য খাবার টেবিলে বসা নওশাদ সাহেবকে দেখানো যে রাত্রির কিছুই হয়নি। একটা ঘুমের ওষুধ খেলে মানুষ মরে যায়না!
নওশাদ সাহেব ঘাড় ঘুরিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে একবার বিছানায় বসা রাত্রিকে দেখে নিলেন। অত:পর চোখ ফিরিয়ে বেশ জোরে সরেই ঠান্ডা গলায় বললেন,”নাহিদা, তুমি যাও তো মেয়েটার কাছে। তোমার ছেলে দেখবে এখনই ধমকাধমকি শুরু করে দিবে। মাথা তো রাতদিন গরমই থাকে।”
নিভ্রান কথাটা শুনেও কোনোরকমে হজম করে নিলো। ফোন বাজছে। বাটন চেপে আওয়াজ বন্ধ করলো সে। রাত্রির গালে কপালে হাতের উল্টোপিঠ ছোঁয়াতে ছোঁয়াতে বললো,
—“ঠি ক আছো?”

রাত্রি নিচু গলায় উওর দিলো,”জি।”
নাহিদা হাতে নিজের শাড়ি নিয়ে এসেছেন। রাত্রির জামাকাপড় আনা হয়নি এখনো। নিভ্রান একটুপর যেয়ে তার বাসা থেকে সব জিনিসপত্র নিয়ে আসবে। নাহিদা শাড়িটা বিছানার উপর রাখলেন,
—” তোমার তো জামাকাপড় আনা হয়নি। আপাতত গোসল করে এই শাড়িটা পরে নাও, যাও।”

রাত্রি মাথা নাড়ালো। নিশাদ যেয়ে আবার খাওয়ার মন দিয়েছে। নওশাদ সাহেবও চুপচাপ খাচ্ছেন। মা কে দেখা যাচ্ছেনা ওখানে। নাহিদা চলে যেতেই রাত্রি আমতাআমতা করলো,
—“মা কোথায়?”

নিভ্রান ফোন কানে নিয়ে কথায় ব্যস্ত ছিলো। রুবিনার ড্রেসিং করার জন্য একটুপর ডাক্তার আসার কথা। সে জন্যই একটু কথা বলে নিলো। ঠি ক সময়ে যেনো চলে আসে। রাত্রি প্রশ্ন করতেই ফোন নামিয়ে মুচকি হাসলো সে।
—“আন্টি উনার ঘরে আছে। তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। তারপর নিয়ে যাচ্ছি।”

রাত্রি গোসল করলো খুব কম সময়ে। বেলা গড়িয়ে গেছে। আজ আর ভার্সিটিতে যাওয়া হবেনা। গতকালও যেতে পারেনি। ইম্পর্টেন্ট ক্লাসগুলো মিস হয়ে গেলো।
কনুইয়ে সাদা তোয়ালে ঝুলিয়ে সে যখন হাল্কা সবুজ রংয়ের সুতি শাড়ি পরে বেরোলো…নিভ্রান যেনো বিষম খেলো কয়েকবার। ভেজা চুলগুলো দেখে গলা মরুভূমির মতো শুকিয়ে গেলো যেন। আগা থেকে পানি গড়িয়ে পিঠের ব্লাউজ ভিজিয়ে দিয়েছে। নাহিদার ব্লাউজ রাত্রির এমনেই খুব ঢিলে হয়। কাঁধে থাকছেনা। এর আগের বারও এমনই হয়েছিলো।
বউ হয়ে মেয়েটার ধংসাত্বক রুপ যেনো চোখে বেঁধে যাচ্ছে। রাত্রি চুল মুছছিলো। নিভ্রান হেঁটে তাকে পাশ কাটিয়ে ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ের খুললো। সেফটিপিন বের করলো। পিছে দাড়িয়ে বললো,”দেখি চুল সরাও, ব্লাউজটা একটু টেনে আটকে দেই। নেমে যাবেনা আর।”

রাত্রি উওর দিলোনা। ইততস্ত ভঙ্গিতে আয়নার তাকালো। কাপড়টা কাঁধের থেকে সত্যিই নেমে যাচ্ছে বারবার। নিভ্রান তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। বিধায় চোখে চোখ পরে গেলো। রাত্রি তোয়ালে সরালো। চুল একপাশে আনলো।
নিভ্রান কয়েকসেকেন্ড স্হির চেয়ে থেকে ব্যস্ত ভঙ্গিতে দু’পাশ থেকে বাড়তি কাপড় টেনে একসাথে করে সেফটিপিন আটকে দিলো। আঁটসাঁট হয়ে লেগে গেলো ব্লাউজটা। নিভ্রান সরে দাড়ালো,”হয়েছে?”

—“হু।”

—“চুল মুছে চলো। ব্রেকফাস্ট করতে হবে।”

ডাক্তার এসেছে। ব্যান্ডেজ বদলে দিচ্ছে রুবিনার। রাত্রি বসে আছে পাশেই। হাতে খাবারের প্লেট। বাড়ির সবার খাওয়া শেষ শুধু সে-ই খায়নি। নিশাদ আর নিভ্রানও সেখানেই দাড়িয়ে আছে।
রুবিনার কপালে ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে নিভ্রান ডাক্তারকে নিয়ে বেরিয়ে যায়। নিচ পর্যন্ত দিয়ে আসবে হয়তো।
সে চলে যেতেই রাত্রি মুখ খুললো। এতক্ষণ নিভ্রানের ভয়ে কিছু বলোনি। যদি রাগারাগি করে।
নিশাদের দিকে চেয়ে খাবার চিবাতে চিবাতে বললো,
—“সকালে কি হয়েছিলো? আপনি তখন কি বলছিলেন?”

নিশাদ মুচকি হেসে উওর দিলো,
—“আপনার জামাই আর শ্বশুরের মধ্য সেইরকম লেগেছিলো ভাবি। ভাইয়া আপনাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিলো কাল। তারপর তো আপনি সেই যে রাত দশটার দিকে ঘুমোলেন। সারা রাস্তা, সকাল গড়িয়ে গেলো তবুও আপনার ঘুম ভাঙলোনা। বাবা ভেবেছে ঘুমের ওষুধের জন্য আপনার শরীর খারাপ করেছে। আর ভাইয়া তো জানেনই একটু মেজাজ করে কথা বলে। সে নিয়েই আরকি..”

রাত্রি মনোযোগ দিয়ে শুনলো। এই ঘুমের ওষুধই তবে তার গভীর ঘুমের রহস্য। হায়! মানুষটা তার এতো যত্ন করে কেনো? ডাক্তার একটু বলেছে শরীর খারাপ তাতেই মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
তবে মনে এখনো শতশত প্রশ্ন কিলবিল করছে। নিশাদের দিকে মাথা নাড়িয়ে রুবিনাকে বললো সে,
—“আমি অজ্ঞান হবার পর মামা-মামী কই গেলো? তাদেরকে তো দেখলামই না আর।”

রুবিনা হাঁফ ছেড়ে বললেন,
—“ছেলেটা যেভাবে শাসিয়েছে..তোর মামা-মামী আর এজন্মে কিছু বলার সাহস পাবেনা। পুলিশেই দিয়ে দিতো। মামলা করবে। তোকে অন্য কেবিনে নিয়ে গেলো কোলে করে। তোর মামা আবার একটু বাজে কথা বলেছে। ব্যস, সে কি রাগ! আমিতো ভয় ই পেয়ে গিয়েছিলাম। অনেক বলে কয়ে তোর দোহাই দিয়ে শেষমেষ শান্ত করলাম। নয়তো তোর মামা-মামী এতক্ষণে জেলে থাকতো।”

রাত্রি থমথমে গলায় বললো,
—“শান্ত করলে কেনো? উনাদের জেলেই দেয়া উচিত ছিলো। নির্যাতন, হত্যাচেষ্টা মামলা দিলে সুড়সুড় করে ধরে নিয়ে যেতো।”

—“ধুর! ওরা আর কিছু করবেনা। মামলা টামলায় কত ঝামেলা হয়। যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।”

রাত্রি উওর দিলোনা। মন ভাবছে লোকটার হঠাৎ বিয়ে করার ঝোঁক উঠলো কেনো কাল? নিশ্চিত মামা তাদেরকে জড়িয়েই কিছু বলেছিলো। তাই হয়তো এতো হুড়মুড় করে সব বৈধ করে নেয়া।
নিশাদ ফোনে কিছু করছিলো। রাত্রি জিজ্ঞেস করলো,
—“আচ্ছা, আপনারা ওখানে গেলেন কখন?”

নিশাদ ফোন থেকে মাথা তুলে বললো,
—“আমরা গেলাম বিকেলের দিকে। ভাইয়া সকালে ফোন করে বললো, যাই হোক, সেভাবেই হোক আমি যেনো সব কাগজপত্র রেডি করে বাবা- মা আর কাজি নিয়ে ঠি ক ঠি ক সন্ধ্যার আগে সেখানে পৌছে যাই। সে বিয়ে করবে। আর ভাইয়া যেটা একবার বলে সেটাই করে। তাই আমিও কোনরকম আপত্তি না করে মা- বাবাকে বগলদাবা করে তড়িঘড়ি করে ছুটলাম চট্রগ্রামে। বুঝলেন?”

—“হু..” রাত্রি থেমে গেলো। নিভ্রান চলে এসেছে। আর কিছু না বলাই শ্রেয়।

______________

বিকেলের বিদেয় ঘন্টা বেজে গেছে। আকাশে গোলাপি আর নীলের সমারোহ। পশ্চিম দিকটা পুরো গোলাপি। যেনো একথোকা গোলাপ ফুল ভেসে রয়েছে নীলসাগরে। রাত্রি চুপচাপ দাড়িয়ে ছিলো ব্যালকনিতে। নিভ্রান, নিশাদ কেউ নেই বাড়িতে। দুপুরের পর দুজনে কোথায় যেনো বেরোলো তারপর আর ফিরেনি। নাহিদা আর নওশাদ সাহেব ঘুমাচ্ছেন। মাও নিজের ঘরে শুয়ে পড়েছে। নাহিদা তাকেও রেস্ট নিতে বলে গিয়েছিলো। কিন্তু ঘুম আসছেনা কিছুতেই। দূরে একটা নদী দেখা যায় এখান থেকে। সচ্ছ পানি। রুপালি রোদ সোনার মতো ঝিলমিল করছে। নৌকা গুলো চলছে বোঝা যায়। কিন্তু স্পষ্ট নয়।
রাত্রি মনভরে শ্বাস নিলো। তার জীবনে কখনো এত ভালোবাসা আসবে এ যেনো কল্পনার মতো। বাবা মারা যাওয়ার পর সে পুরোদস্তর ভেবেই নিয়েছিলো জীবন থেকে সব রং ফিকে হয়ে গেছে। আর কখনো তার জীবন রঙিন হবেনা। অথচ সাদা কালো এই শহরে তার জন্য যে কেউ একমুঠো লাল আবির নিয়ে অপেক্ষা করছে…কখনো ভাবেনি। কক্ষণো না।

দরজা খোলার শব্দ। রাত্রি পিছে ফিরলো। কয়েককদম সামনে এগিয়ে রুমে উঁকি দিলো। নিভ্রান দাড়িয়ে আছে। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই দেখলো বিছানা ভরা শপিং ব্যাগ দিয়ে। রাত্রি হকচকালো,
—“এগুলো কি?”
বাকিটা বলতে বলতেই নিশাদ ঢুকলো রুমে। দু’হাতে ব্যাগ। বেশ ভারি বোঝা যাচ্ছে। নিশাদ রাত্রির দিকে একঝলক তাকিয়ে শ্বাস আটকে বললো,

—“আপনি এতো পড়াশোনা করেন? বাপরে বাপ! আপনার পড়াশোনার ভারে আমিই নুইয়ে যাচ্ছি। ও আল্লাহ! আরে সর না। খাম্বার মতো দাড়িয়ে আছিস কেনো?”

নিভ্রান সরে দাড়ালো। নিশাদ ব্যাগদুটো উঠিয়ে বিছানার উপর রাখলো। উপর থেকে বোঝা যাচ্ছে ভেতরে বই-খাতা।
নিশাদ দু’হাত ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,”এইযে এখানে, ভাইয়া মার্কেটের সব শাড়ি উঠিয়ে এনেছে। আপনার আগামী দশ-বারো বছরের মতো চলে যাবে।”
রাত্রি শব্দ করে হেসে ফেললো। মানুষটা সবসময় ঠাট্টা করে।
নিভ্রান আলতো করে চাঁটি মারলো নিশাদের মাথায়। নিশাদ হাসতে হাসতেই বেরিয়ে গেলো। নিভ্রান দরজা আটকে দিলো ভেতর থেকে।
রাত্রি ব্যাগগুলো একটু আধটু ফাঁক করে দেখলো। শাড়ি বোঝাই।

—“পাগল নাকি আপনি? এতো শাড়ি দিয়ে কি করবো আমি?”

নিভ্রান শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বললো,
—“ওই যে দশ বারো বছর পড়বে।”

রাত্রি হতাশ স্বরে বললো,
—“আমি শুধু শুধু টাকা নষ্ট করলেন। আমার তো জামা ছিলোই। সেগুলোও তো এনেছেন দেখছি। আর কি দরকার ছিলো?”

নিভ্রান শার্ট খুলে গেন্জি পরলো। একহাতে রাত্রিকে কাছে টেনে চুলের খোঁপা খুলে পিঠে ছড়িয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বললো,
—“দরকার ছিলো বলেই এনেছি। সালোয়ার, কামিজ…ওসব বাইরে গেলে পরবে। আমার সামনে শুধু শাড়ি পরবে। বুঝলে?”

রাত্রি দমে গেলো, হেরে গেলো। আলতো করে নিভ্রানের পিঠ জড়িয়ে বুকে মাথা রাখলো। বিষন্ন কন্ঠে বললো,
—“একটা কথা বলি?”

নিভ্রান ভ্রু কুঁচকালো। মাথার পিছে হাত রেখে বললো,”বলো।”

রাত্রি ছোট্ট করে শ্বাস ফেললো। হাতের বন্ধন দৃঢ় করে বললো,
—“আপনি আমাকে বিয়ে করেছেন এরমানে তো এটা নয় যে আমাকে সবসময়ই আপনার টাকায় চলতে হবে। আমি..আমি নিজের খরচ নিজে চালাতে একটা অন্যরকম শান্তি পাই। মাসশেষে যখন নিজের কষ্টের টাকা দিয়ে কিছু করি সত্যি বলছি আমার খুব খুব আনন্দ হয়। হ্যাঁ, আপনি হয়তো বলবেন আপনার সব তো আমারও। মানছি, তবু আমি যদি টি উশনি করি তারপর ভার্সিটি শেষ হলে জব করি আপনার কি কোনো বারণ আছে?”

নিভ্রান হাসলো। চুলে হাত বুলিয়ে কোমলকন্ঠে বললো,
—“ধুর পাগল মেয়ে, আমার বারণ থাকবে কেনো? তোমাকে বিয়ে করেছি…বন্দি করে ফেলিনি। তোমার আনন্দ তে আমি কেনো বাঁধা হবো? এসব নিয়ে চিন্তা করে কেউ? আমি তোমাকে কখনো জোর করবোনা রাত।”

~চলবে~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here