এ শহরে বৃষ্টি নামুক❤️পর্ব-৪

0
1285

#এ_শহরে_বৃষ্টি_নামুক❤️
#লেখিকা_মালিহা_খান❤️
#পর্ব-৪

নীলরঙা গাঢ় বিকেল।বাহ্যজগৎ অলৌকিক নিরুপম।আকাশে শুভ্রনীলের বিশাল আধিপত্য।কয়েকটুকরা বিশুদ্ধ মেঘে বাউন্ডুলে যুবকের মতো কখন থেকে ঘুরে বেড়াচ্ছে।প্রকৃতি ঘিরে আর্দ্রতার ছোঁয়া।
মেইনরোডের এখানে ওখানে পানি জমে আছে।সেই পানিতে রাস্তার ধারে বেড়ে উঠা বৃক্ষরাজির সুনিপুণ প্রতিচ্ছবি নতুন আয়নার মতো দৃশ্যমান।সময়টা চোখে আটকে থাকার ন্যায় সুন্দর।
ফুটপাতে ছোট ছোট পা ফেলে হাঁটছে রাত্রি।তার পাশাপাশিই হাঁটছে নিভ্রান তবে তার পা রাস্তায়।রাত্রির মতে নিভ্রান তার তুলনায় খুব বেশি লম্বা।তাই পাশাপাশি হাঁটলে তাকে খুবই ছোট দেখায়।পথচারীরা নাকি কটুচোখে তাকায়।সেজন্যই সমান সমান বজায় রাখতে সে হাঁটছে ফুটপাতের উপর আর নিভ্রান রাস্তায়।
রাত্রির পরণে হাল্কা গোলাপি রংয়ের সাদামাটা ফুলহাতা কামিজ।মাথায় ওড়না টানা।একপাশে ঝুলছে পিঠের মধ্যখান পর্যন্ত দৈর্ঘ্যর মোটা বেনি।বামহাতে হ্যান্ডব্যাগ।ডানহাতটা খালি।সেই খালি হাতটাই নিজের শুদ্ধ স্পর্শে পূর্ণ করে দিলো নিভ্রান।আলতো করে টেনে নিলো নিজের হাতের মুঠোয়।সাথেসাথেই চমকে উঠলো রাত্রি।চোখেমুখে শিহরণ।ঠোঁটের মাঝে কিন্চিৎ ফাঁক।নিভ্রান স্বাভাবিক কন্ঠে বললো,
—“এত কিনার ঘেঁষে হাঁটছেন।কখন যেন পিছলে পড়ে যান।পড়লে তো সেই ধরতেই হতো তাই পড়ার আগেই ধরলাম।”

প্রতিবাদ করে কিছু বলতে যেয়েও হেসে ফেললো রাত্রি।নিভ্রানের এতবর্ষের সংযমী চোখজোড়াও বেহায়ার মতো চেয়ে চেয়ে অনুভব করলো সেই অসহনীয় হাসিটা।আলো হ্রাস পাচ্ছে।সন্ধ্যার আগমনী বার্তা মেয়েলি সুরে জানান দিচ্ছে,”আমি প্রায় এসেই পরেছি।”হঠাৎই এক দৈবাৎ হাওয়ার আগমন।কানের পিছে গোছানো চুলগুলো উড়ে চোখমুখ ঢেকে ফেললো নিমিষেই।মাথার ওড়নাটা পরে গেলো।চোখ বুজে চুল সরাতে গিয়ে তাল হারিয়ে ফেললো রাত্রি।পড়ার আগেই নিভ্রান তাকে সাবধানে রাস্তায় নামিয়ে নিলো।
কানের পিছে চুল গুঁজে দ্রুত চোখ মেললো রাত্রি।নিভ্রান তখন খুব ঘনিষ্ঠে।গায়ের পারফিউমের হাল্কা গন্ধটা পর্যন্ত তীব্রভাবে নাসিকারন্ধ্রে আঘাত হানছে।অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দু’কদম দুরত্ব সৃষ্টি করে নিলো রাত্রি।নিভ্রান ফোড়ন কাটলো,
—“বলেছিলাম না আপনি পড়ে যাবেন।”

—“আমি পড়িনি।আপনিই আগে আগে নামিয়ে দিলেন।নতুবা আমি ঠিকই সামলে নিতাম।”একহাতে মাথার ওড়নাটা তুলে নিতে নিতে আপত্তি করে উঠলো রাত্রি।সচরাচর সে এত কথা বলেনা।তার তো কথা বলার মানুষই নেই।একা একা থাকে।পড়াশোনা আর টি উশনি নিয়েই সারাদিন কেটে যায়।রাতে পাঁচ দশমিনিট মায়ের সাথে কথা বলে।তারপর একঘুমে রাত পাড়।ব্যস,এতটুকুই তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা।
এত সহজে সে কখনো কারো সাথে মিশেনা।কথা বলা তো অনেক দুর।কিন্তু এই লোকটার সাথে কেনো যেনো খুব সহজ হয়ে গেছে মাত্র দুদিনেই।লোকটার অমায়িক ব্যবহার,টানটান ব্যক্তিত্ব অনায়াসেই তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।

রাস্তার ধারে অযত্নে বেড়ে উঠা কদমগাছ।সবুজ পাতাগুলো চকচক করছে।বৃষ্টি বোধহয় প্রকৃতির ধোয়ামোছা করার বিশ্বস্ত কর্মী।যখনই তা নোংরা-ধুলোময় হয়ে উঠে তখনই সে দুহাত মেলে যত্নকরে তাকে স্নান করিয়ে দিয়ে যায়।শহরজুড়ে নরম আঁধার নেমে এসেছে।রাত্রি যেখানে ভাড়া থাকে সে বাড়িটা তিনতলা।মোড় ঘুরলে প্রথম বাড়িটাই তার গন্তব্যস্হল।সেই মোড়েই আছে কদমগাছটা।কেউ হয়তো খুব সযত্নে লাগিয়েছিলো কিন্তু সময়ের পালাবদলের আর খেয়াল রাখা হয়নি।এই বর্ষার মাঝামাঝিতে অজস্র কদম শোভা বাড়িয়ে দিয়েছে গাছটার।রাত্রি রোজই দেখে কিন্তু উচ্চতাটা একটু বেশিই উপরনিচ হওয়ার কুবাদে ফুল পাড়ার বাসনাটা সেখানেই চুরমার হয়ে যায়।নিভ্রান হাটছিলো নিশব্দে।সময়টা পার হয়ে যাচ্ছে ভেবে মনটা একটু বিষাদগ্রস্থ।ঘোর কাটলো রাত্রির হঠাৎ দাড়িয়ে পড়ায়।ঘাড় বাকিয়ে তাকাতেই রাত্রি চন্চল কন্ঠে বলে উঠলো,
—“আচ্ছা,আপনিতো অনেক লম্বা।আপনি আমাকে একটা ফুল নামিয়ে দিতে পারবেন?”

প্রথমে কথাটা বোধগম্য না হলেও কদমগাছটার দিকে নজর যেতেই অর্থটা স্পষ্ট হয়ে উঠলো।উওর না দিয়ে অবিলম্বে রাত্রির দিকে একটু ঝুঁকে উপরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো নিভ্রান।খুব সহজেই দুটো কদম ছিঁড়ে নিলো।রাত্রির মাথাটা তার বুকের কাছে।উত্তপ্ত নিশ্বাসগুলো প্রেমঝড়ের মতো আছরে পরছে।রাত্রির অস্বস্তির মাত্রাটা বাড়ার আগেই সোজা হয়ে দাড়ালো নিভ্রান।ফুলগুলো রাত্রির দিকে বাড়িয়ে বললো,”ধরুন,আরো দিচ্ছি।”
সযত্নে ফুলগুলো হাতে নিলো রাত্রি।গালদুটো লাল রংয়ের আভায় সজ্জিত।হাসলো নিভ্রান।আবারো হাত বাড়াতে উদ্যত হতেই সে মিনমিনে গলায় বললো,
—“আর লাগবেনা।”
থেমে গেলো নিভ্রান।রাত্রি তখন ফুলগুলো দিকে আচ্ছন্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঠোঁটের কোঁণ প্রসারিত করে রেখেছে।
নিভ্রানের বুঝতে সময় লাগলোনা,এই আঁটসাঁট,গম্ভীর মেয়েটার মাঝে একটা চন্চল ছটফটে মনও লুকিয়ে আছে।শুধু পৃথিবীর ভারি দায়ভারে তা বেরিয়ে আসতে অক্ষম।”
___________
চাবি ঘুরিয়ে দরজার লক খুললো রাত্রি।নিভ্রান তার পিছে দাড়ানো।এতদূর লোকটা এসেছে এখন ছাতা দিয়ে বাসায় বাইরে থেকেই বিদায় করে দেয়াটা প্রচন্ড বেয়াদবের মতো একটা কাজ হয়ে যাবে।পারিবারিক শিক্ষাটা বেশ শক্তপোক্ত রাত্রির।দরজা খুলে আগে নিভ্রানকে প্রবেশ করতে বললো সে।নিভ্রান মুচকি হেসে বললো,
—“আরে না না,ভেতর যাবনা রাত।আপনি ছাতাটা এনে দিন শুধু।”

রাত্রি ভ্রু কুঁচকালো।লোকটার পোশাক-আশাক,হাতের দামি ঘড়ি,বুকপকেটে ঢুকানো রোদচশমা দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে সম্রান্ত পরিবারের ছেলে।মূহুর্তেই চোখের ভাষা কঠিন হয়ে গেলো রাত্রির।অনেকটা শক্ত গলায়ই সে বলে উঠলো,
—“দেখুন,আমি বুঝতে পারছি আপনি বড়লোক মানুষ।তাই বলে আমার বাসায় ডুকতে পারবেন না এমনতো কোন কথা নেই।আপনি কিন্তু ইনডাইরেক্টলি আমাকে অপমান করছেন।”

চোখ ছোট ছোট করে তাকালো নিভ্রান।মেয়েটা কতদুর পর্যন্ত ভেবে ফেলেছে।সে তো যেতে চাচ্ছেনা কারণ বেশ দেরি হয়ে গেছে।গাড়ি নিয়ে রাত্রির স্টুডেন্টের বাসার সামনে গিয়েছিলো তখন।দুপুর থেকেই দাড়িয়ে ছিলো শেষমেষ বিকেলে রাত্রির দেখা মিলে।ওখান থেকে রওনা দেয়ার সময় একবার গাড়িতেই ফিরতে চেয়েছিলো কিন্তু রাত্রির সাথে হেঁটে আসার লোভটা সামলাতে পারেনি বিধায় গাড়িটা ওখানেই ফেলে এসেছে।
এখন আবার ওখানে যেয়ে গাড়ি নিয়ে তারপর বাসায় যেতে হবে।অনেকটা সময়ের ব্যাপার।
কিন্তু মেয়েটা যেভাবে কঠাক্ষ নজরে চেয়ে আছে এখন ভেতরে না গেলে সত্যিই খুব খারাপ দেখাবে।
পায়ের জুতা খুলতে শুরু করলো সে।গম্ভীর স্বরে বললো,
—“আপনি বড্ড বেশি ভেবে ফেলেন রাত।এরপর থেকে আর কখনো আমার সামনে এসব বড়লোক-ছোটলোকের তফাত দেখাতে আসবেন না।আই জাস্ট হেইট ইট।”বলেই একবার রাত্রির চোখের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো নিভ্রান।

রাত্রি চুপ হয়ে গেলো।সে হয়তো ভুল মানুষকে ভুল কথা বলে ফেলেছে।লোকটার চেহারায় অসীম গাম্ভীর্যতার চিহ্ন।
একরুমের একটা ছোট্ট বাসায় থাকে রাত্রি।রান্নাঘর আছে।ছোট একটা বসার জায়গায় মতোও আছে কিন্তু সেখানে কোন সোফা বা টেবিল নেই।
রাত্রিকে মোটেও বিচলিত বা লজ্জিত দেখালো না।সে আস্তে করে রুমের দরজাটা খুলে নিভ্রানকে বললো,
—“আপনি বিছানায় বসেন।”আরো একবার মুগ্ধ হলো নিভ্রান।সাধারনত দেখা যায় মানুষজন খুবই কুন্ঠিত বোধ করে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে।লজ্জিত হয়।কিন্তু রাত্রির এই বিন্দুমাত্র লজ্জিত না হওয়াটাও মন কাড়লো নিভ্রানের।মেয়েটা খুবই স্বাভাবিক নিজের সাদামাটা জীবনযাত্রা নিয়ে।
স্টীলের গ্লাসে করে পানি নিয়ে আসলো রাত্রি।কদমদুটোর ডাঁটা পানির মধ্য ভিজিয়ে পড়ার টেবিলের এককোণে চাপিয়ে রাখলো।পকেট থেকে ফোন বের করলো নিভ্রান।রাত্রি বললো,
—“চা খাবেন?”

—“না মিস,আপনি বসতে বলেছেন আমি বসেছি।তাছাড়া আমি চা খাইনা।”

রাত্রি মুখ লটকিয়ে ছোট্ট আলমারিটা খুললো।ছাতাটা বের করে বলল,
—“ওহ,আপনি কফি খান তাইতো?কফিও আছে।খাবেন?।”

রাত্রির কথা বলার ঢং দেখে হেসে ফেললো নিভ্রান।বললো,”কিছুই খাবোনা,ছাতাটা দিন আমি চলে যাবো।দেখুন দেরি হয়ে গেছে।”দীর্ঘ:শ্বাস ফেললো রাত্রি।ছাতাটা নিভ্রানের হাতে দিয়ে বললো,
—“আপনি জানলেন কিকরে আমি আজ বিকেলে পড়াতে গেছি?”
এক আঙ্গুলে কপাল ঘষলো নিভ্রান।ঠোঁট চেপে কিছু একটা ভেবে নিয়ে জোরালো কন্ঠে বললো,
—“ইটস্ আ কোইন্সিডেনস।”

মিনিটদশেক আগেই বেরিয়ে পরেছে নিভ্রান।কাপড়চোপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো রাত্রি।উদ্দেশ্য রাতের খাবার রান্না করা।রান্নাঘরে ঢুকেই স্বস্তির একটা শ্বাস ফেললো সে।বাড়িতে আসলে চা,কফি কিছুই নেই।ওসব নিতান্তই সৌজন্যতার খাতিরে বলেছিলো।নিভ্রান যদি কোনোভাবে ‘হ্যাঁ’ বলে দিত তবে বেশ ঝামেলা পড়তে সে।ভাগ্য ভালো নিভ্রান মানা করে দিয়েছে।মনে মনে হাসলো রাত্রি।এসব বিষয়ে তার ভাগ্যে আবার খুব সাথে থাকে।

~চলবে~

[রিচেক হয়নি।বানান ভুল থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here