#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_৩৫
#আভা_ইসলাম_রাত্রি
আজ রঙ খেলা হবে। রঙ-বেরঙে সেজে উঠবে বিয়ের বাড়ির প্রতিটা সদস্য। হোটেলের রুফটপে বিশাল তোড়জোড় চলছে। ছাদের একপাশে সারি বেধে রাখা হয়েছে, লাল, নীল, হলুদ, গোলাপী রং! অন্যপাশে একটা ফুলে ফুলে সাজানো সাদা রঙের দোলনা! যেখানে মিনহাজ আর আরোহীর রঙ মেখে বসবে। ফটোশট হবে। ছাদের আনাচে কানাচে গোলাপ ফুলের পাঁপড়ি ছড়িয়ে রাখা। একপাশে, ডেকোরেশন করা সেলফি স্টেজ! সর্বপরি, মারাত্মক আয়োজন বলা চলে। কিন্তু, এসবের মধ্যে আভা কোথায়? উত্তর হলো, আভা ঘুমিয়ে আছে। নিজের জন্যে বরাদ্দকৃত রুম লক করে শুয়ে আছে। সবাই ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছে। মাঝেমধ্যে একে অপরের দিকে রঙ ছুঁড়াছুঁড়ি করছে। হঠাৎ, তারার বোধ হলো, আভা কই? তারা চারপাশে চোখ বুলালো। নাহ, আভা তো নেই! তারা সাথীকে জিজ্ঞেস করলো,
— ” সাথী, আভা কোথায়? ”
সাথী ফুলের মালা বানাচ্ছিল। সুতোতে একে একে ফুল পুড়তে পুড়তে সাথী উত্তর করলো,
— ” আবা? ও তো ঘুমাচ্ছে। ”
তারা বিরক্ত হলো, বটে। আজ এত মজা হচ্ছে আর এই আভার বাচ্চা আভা ঘুমাচ্ছে। মাইর দেওয়া উচিৎ একে। তারা কোলের উপর থেকে সব ফুল মাটিতে ফেলে উঠে দাঁড়ালো। সিনথিয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ” তোরা মালা বানা। আমি আসছি। ”
— ” কই যাস? ”
সিনথিয়া প্রশ্ন করলো,
— ” কুত্তারে ডাকতে। ওর মরার মত ঘুমানো বের করছি আমি। ওয়েট! ”
তারা চলে গেলো।
তারা আভার রুমে কয়েকবার বেল বাজালো। কিন্তু, ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। তারা ডাকও দিলো দুবার। কিন্তু, নিরুত্তর আভা। একসময় তারা হাল ছেড়ে দরজায় লাথি দিয়ে আবার ছাদে চলে এলো।
তারাকে একা ফিরে আসতে দেখে, বাকি সবাই একটু অবাক হলো। তাহমিদ জিজ্ঞেস করলো,
— ” আভা আসেনি? ”
তারা ধাম করে বসে পড়লো। হাতে একটা ফুল নিয়ে অযথাই তার সকল পাঁপড়ি ছিঁড়ে হাত দিয়ে উড়িয়ে দিলো। কন্ঠে তেজ নিয়ে বললো,
— ” না। দরজাই খুললো না। বিরক্তিকর! ”
আবারো সবাই কাজে মন দিলো। আজকে প্রায় দশটা মালা বানাতে হবে। দুটো কনে আর বরের জন্যে। বাকিগুলো আভারা একে একে গলায় দিয়ে ছবি তুলবে। শুধু, বাড়তি মজার উদ্দেশ্যে!
হঠাৎ, তারার চোখ গেলো ছাদের একপাশে আহনাফের দিকে। আহনাফ একজন স্টাফকে দোলনায় কি করবে, কি করবে না সেটা বুঝাচ্ছে। তারার মুখে এবার হাসি ফুটলো। তারা এক মুহুর্তে দাঁড়িয়ে গেলো। তারপর, এক দৌঁড়ে চলে গেলো আহনাফের কাছে।
–” জিজু, জিজু! ”
পাশ থেকে হাপাতে হাপাতে বললো তারা। আহনাফ তারার দিকে তাকালো। চোখের ইশারায় স্টাফকে বিদায় দিয়ে তারার মুখোমুখিও হলো। ডান ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ” কিছু বলবে, শালিকা? ”
তারা তাকালো আহনাফের দিকে। নিজের দু গাল ফুলিয়ে অভিযোগ করলো,
— ” আভা ঘুমাচ্ছে! ”
আহনাফ শুনলো। তবে, বুঝল না কিছু। ডান ভ্রু আগের ছেড়ে আরো একটু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— ” তো? ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক! ”
— ” আরে জিজু, আপনি বুঝছেন না। আরেকটু পরই রঙ খেলা শুরু হবে। আমাদের হাতে বেশি সময় নেই। আভা ঘুম থেকে উঠবে কখন, আর রঙ খেলবেই বা কখন? আমাদের রঙ খেলা তো মাঠে মারা পড়বে তখন। বুঝতে পারছেন, আমি কি বলছি! ”
তারার মুখখানা ছোট হয়ে এটুকু হয়ে গেলো। চোখে কি নিদারুণ অসহায়ত্ব! যেন, আজ আভাকে ঘুম থেকে তোলাই তার একমাত্র ধর্ম। যে ধর্ম পালন না করলে ঘোর অনর্থ হয়ে যাবে। আর সেটা তারা কিছুতেই হতে দিবে না। এটা যেনো তার সংকল্প! আহনাফ তারার এমন অবস্থা দেখে হাসলো। ঠোঁট টিপে বললো,
— ” জ্বী, বুঝতে পারছি তোমার অবস্থা। আচ্ছা, যাও। আমি দেখছি। নো টেনসন! ”
তারার মুখে এবার হাসি ফুটলো। আহনাফের দিকে তাকিয়ে প্রায় লাফিয়েই বলে উঠলো,
— ” থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ! ”
তারা চলে গেলো। আহনাফ ফুস করে এক নিঃশ্বাস ফেলে এবার পা বাড়ালো রিসিপশনের দিকে।
_____________________
আজ গরম পড়েছে খুব। রোদও উঠেছে! কিন্তু, সবচেয়ে বিরক্ত লাগে তখন, যখন রোদের হলদে আলো একদম মুখের চারপাশে লুটোপুটি খায়। তেমনি, আভা। ঘুমাচ্ছিল কি শান্তিমতে। কিন্তু, শান্তির মায়ের শুরু হলো অশান্তি! তাই, রোদ দিয়ে জ্বালিয়ে আভার ঘুম ভাঙিয়ে দিলো। আভা মিটিমিটিয়ে তাকালো। কিন্তু, ওর দম বন্ধ লাগছে কেন? শ্বাস নিতে পারছে না। তবে কি, আভা মারা যাচ্ছে? মৃত্যুর কথা মাথায় আসতেই আভা তুমুল ভয় পেলো। তৎক্ষণাৎ মস্তিষ্কে চাপ দিতে লাগলো। ঘুমের ছোঁয়া কাটতে লাগলো, শরীর থেকে। আভার মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে সক্রিয় হতে লাগলো। চোখ খুলেই দেখলো, আভার পেটের উপর কারো হাত। হাত’টাকে একটু ভালো করে লক্ষ্য করলো আভা। লোমশ, পুরুষালি এক হাত। আভা ভয় পেয়ে গেলো।
‘ আল্লাহ!! ‘ বলে এক চিৎকার করে বড়বড় চোখ দিয়ে পাশে তাকালো। পাশের মানুষটিকে দেখে আভার ভয় পাওয়া চোখ শীতল হলো। বরং, সেই চোখে ভর করলো রাজ্যের বিরক্তি! আহনাফ আভাকে দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজে আছে। উনি কখন এলেন? দরজা তো লক করা। তবে? আভা আহনাফের থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। তবে, পারলো না। বরং, আহনাফ আরো শক্ত করে আভাকে জড়িয়ে ধরলো। আভার মনে হচ্ছে, আর একটু হলেই সে আহনাফের বুকের ভিতরে ঢুকে যাবে। আহনাফের ভারে পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে ও। এসবের কোনো মানে হয়? কেউ দেখলে কি ভাববে? ছিঃ! আভা এবার আহনাফের কানের কাছে চিৎকার করলো,
— ” ছাড়ুন আমায়। শুনছেন, ছাড়ুন। ”
আহনাফ ভ্রু কুঁচকে ফেললো। এক সমুদ্র বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলে তাকালো। তার চোখের আকৃতি দেখেই মনে হচ্ছে, চোখ মেলে তাকাতে যেনো তার বিরাট আলসেমি! আভা ভ্রু কুঁচকে রাগ নিয়ে বললো,
— ” এটা কি ধরনের অসভ্যতা! আপনি আমার রুমে, আমার বিছানায় কিকরে এলেন? দরজা ত লক করা ছিলো! ”
আহনাফ আভাকে একহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরা অবস্থায় অন্য হাতে দিয়ে পকেট থেকে চাবি বের করলো। আভার চোখের সামনে চাবিটা ঝুঁলিয়ে বাঁকা হেসে বললো,.
— ” ডুপ্লিকেট চাবি! ইউ নো হোয়াট, বুদ্ধি থাকলে উপায়ের অভাব হয়না! কিন্তু আফসোস! তোমার মাথায় সেটা নেই। সো..! ”
আভা চোখ সরু করে আহনাফের দিকে তাকালো। ঝগড়া করার মতো মুড তার নেই। তাই ও ছটফট করে বললো,
— ” হ্যাঁ, আমি জানি আপনি অনেক বুদ্ধিমান। মিস্টার ইন্টেলিজেন্ট, এবার আমাকে ছাড়ুন। আপনি রুম থেকে বের হন। কেউ দেখে নিলে খারাপ ভাববে। সো, গো! ”
আহনাফ হাসলো। আভার দিকে খানিক ঝুঁকে এসে শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করলো,
— ” কেউ দেখলে কি ভাববে? ”
আহনাফের ওমন ফিসফিসানি আওয়াজ শুনে আভার শিরদাঁড়া কেঁপে উঠলো। ঘন ঘন চোখের পল্লব ফেললো ও। বললো,
— ” আ.আপনি একটু দ.দূরে স.সরুন। ”
আভার কণ্ঠ তিরতির করে কাঁপছে। একটা শব্দ আরেকটা শব্দের সাথে মিশে নতুন এক ছন্দ তৈরি করছে। আহনাফ আভার দিকে আরও একটু ঘন হয়ে পুনরায় ফিসফিসালো,
— ” বলো..! কেউ দেখলে কি ভাববে? ”
আভার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। আহনাফের ফিসফিস আওয়াজ তার বুকের ভিতরে ঝড় তুলছে। মনে হচ্ছে, আর কিছুক্ষণ আহনাফ এমন করলে আভা নির্ঘাত মারা যাবে আভা তাকালো আহনাফের দিকে। স্থির চোখে তাকিয়ে ঠোঁট নাড়ালো,
— ” ভাববে…ভাববে, আমরা…আমরা..”
আভা হঠাৎ আহনাফের বুকে ধাক্কা দিয়ে আহনাফকে নিজের উপর থেকে সরিয়ে পাশে ফেলে দিলো। আচমকা আভার এমন ধাক্কায় আহনাফের কিছুটা সময় লাগলো নিজেকে সামলাতে। ততক্ষণে, আভা বিছানা ছেড়েছে। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে পিছন ফিরে একবার বললো,
— ” মানুষের ভাবার দিন শেষ, নারীশক্তির বাংলাদেশ! ”
আভা হেসে ওয়াশরুমে চলে গেলো। আহনাফ হতভম্ভ চোখে ওয়াশরুমের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা এত ফাজিল কেনো? আহনাফ উঠে দাঁড়ালো। বিছানা, রুম গুছিয়ে আভার উদ্দেশ্যে একটা চিরকুট লিখলো। তারপর, ডুপ্লিকেট চাবি দিয়ে দরজা লক করে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।
#চলবে
আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/245672510810650/?app=fbl